ওঁদের যেমন দেখেছি-১

ওঁদের যেমন দেখেছি-১

 

অজন্তা সিনহা

 

প্রথম প্রতিশ্রুতি, সুবর্ণলতা, বকুল কথা―আর সব বাদ দিয়ে এই ট্রিলজি পড়লেই তাঁর অন্তরের বার্তাটি পরিষ্কার হয়ে ওঠে। অনুভব করা যায়, তিনি একজন স্বতন্ত্র লেখক, ব্যক্তিত্বময়ী নারী, সময়ের থেকে অনেকটা এগিয়ে থাকা স্বাধীন চিন্তার অধিকারী একজন পরিপূর্ণ মানুষ। কৈশোরকালের কথা। তখন ওঁর যে লেখাই পাচ্ছি, গোগ্রাসে গিলছি। খুব যে সব সময় বুঝতে পারছি তা নয়। কিন্তু পড়তে খুব ভালো লাগছে। এই ভালোলাগার কারণটা বুঝেছি অনেক পরে, তারুণ্য পার করে প্রবীণতার সিঁড়িতে পা রেখে।

 

ভালোলাগার কারণটা ওই, ওঁর লেখা যেন বাঙালি সমাজের আয়না। সেই আয়নায় নিজেদের ভাবনাগুলোকে অজান্তেই আর পাঁচজনের মতো দেখতে শুরু করি আমিও। তথাকথিত নীতি-আদর্শ, প্রচলিত ধ্যানধারণা থেকে শাসন-বারণ–এইসব ঘিরে ক্রমশ ক্ষোভ-জ্বালা যত জমেছে, তত ওঁর লেখা কাহিনীর আয়নায় স্পষ্ট হয়েছে নিজের মুখ। তাঁর রচনা তখন আর নিছক গল্পকথা নয়। আমাদের ব্যক্তিত্ব গঠনের বর্ণমালা হয়ে উঠেছে ক্রমে। শক্তি ও সাহস পেয়েছি। পথ খুঁজে পেয়েছি অন্ধকারে। ধ্রুবতারার মতো আশাবাদের বার্তা পাঠিয়েছেন তিনি। আশাপূর্ণা দেবী। একজন নিতান্তই বাঙালি কন্যা থেকে বাঙালি গৃহবধূ ! কিন্তু কী ব্যতিক্রমী ও ব্যক্তিত্বময়ী ! সাহসী এবং চূড়ান্ত প্রতিভার আধার।

 

একদিকে লেখালেখির ক্ষেত্রে তাঁর সহজাত প্রতিভা। অন্যদিকে সমাজকে একেবারে কাটাছেঁড়া করে দেখার চোখ। কী গভীর ও মর্মভেদী তৎকালীন সমাজ ও মানুষগুলির বর্ণনা। এত যুগ পার হওয়ার পর, সেই সমাজের বহিরঙ্গ বদলালেও অভ্যন্তর বদলায়নি। আজকের সময়ে দাঁড়িয়েও আশাপূর্ণা দেবীর প্রতিটি লেখা তাই সমান প্রাসঙ্গিক। জন্ম উত্তর কলকাতার এক অত্যন্ত রক্ষণশীল পরিবারে। শৈশব কেটেছিল চূড়ান্ত প্রতিকূল পরিবেশে। তাঁর পরিবারে মেয়েদের স্কুলে যাওয়ার অনুমতি ছিল না। এমনকী বাড়িতে ভাইদের জন্য গৃহশিক্ষক এলেও, সেখানে পড়তে যাওয়া বারণ ছিল আশাপূর্ণা ও তাঁর বোনেদের।

 

কিন্তু আলোর মুখ দেখবে বলে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ যে সূর্যমুখী, তাকে আটকাবে কে ? দূর থেকে শুনে শুনে অক্ষর ও শব্দের সঙ্গে পরিচয় করে নিলেন এই অসীম প্রতিভাময়ী। তবে, পরিবারের একজন সদস্য ছিলেন, তিনি আশাপূর্ণার মা, কন্যার চেতনা ও মননে আলো আসার পথটা তিনিই করে দিয়েছিলেন। মায়ের উৎসাহেই প্রথমে কবিতা, তারপর ছোট গল্প লেখা শুরু করেন কিশোরী আশাপূর্ণা। বাপের বাড়ি থেকে স্বামীর ঘর। শোনা যায়, আশাপূর্ণার স্বামী কালিদাস গুপ্ত ছিলেন একজন উদার মনের মানুষ। তিনি যথেষ্ট  প্রেরণা ও উৎসাহ যোগান আশাপূর্ণার সাহিত্যচর্চায়। পরবর্তীকালে স্বামীর পাশাপাশি পুত্র ও পুত্রবধূর সমর্থন,সান্নিধ্য ও সাহচর্য পেয়েছেন। অন্যদিকে তিনি ছিলেন আদ্যন্ত এক গৃহস্থ মানুষ। পরিপাটি করে সংসার সামলেছেন।

 

এখানে একটা কথা বলার, আশাপূর্ণা যখন সাহিত্যচর্চা করছেন, তখন প্রচার মাধ্যমের কোনও ভূমিকাই ছিল না। এছাড়া, কোনও সুপারিশ, কোনও প্রভাব-প্রতিপত্তি খাটতো না পাবলিশারদের ওপর। তাঁরা পুরোপুরি জোর দিতেন লেখার গুণগত মানের ওপর। উপরোন্তু পাবলিশারের দরবারে লেখাটা পৌঁছনোই তো এক কঠিন ব্যাপার, পরিবারের সমর্থন যেখানে সহজলভ্য নয়। এক একজন দিকপাল পুরুষ সাহিত্যিক বিচরণ করছেন তখন। তাই প্রতিযোগিতাও ছিল যথেষ্ট। সেক্ষেত্রে ঠাকুর পরিবার বা ওই জাতীয় আলোকপ্রাপ্ত পরিবারগুলির বাইরে একটি সাধারণ বাড়ির এক নারীর পক্ষে সাহিত্যের জগতে নিজের জায়গা করে নেওয়াটা ছিল প্রায় অসম্ভব।

 

তা সত্ত্বেও প্রায় নিঃশব্দে আশাপূর্ণার পাঠানো প্রথম লেখাটি একজন পাবলিশার ছাপেন ও তাঁকে আরও লেখা দিতে বলেন। সেই শুরু। তারপর তো ক্লান্তিহীন লিখে গেছেন তিনি। শারীরিকভাবে একেবারে অপারগ না হওয়া পর্যন্ত তাঁর লেখার গতি অব্যাহত ছিল। অসম্ভব জনপ্ৰিয় ছিলেন সর্বস্তরের পাঠকের কাছে। ছোটদের জন্য প্রথমে কলম ধরলেও, পরে সব বয়সী পাঠকই আশাপূর্ণার লেখার রসভোগী হয়ে ওঠে। নিতান্ত ঘরোয়া পটভূমি তাঁর স্বতন্ত্র ভাবনা ও লেখনীর অনায়াস গমনে এক অনির্বচনীয় ছবি তৈরি করতে সমর্থ হয়। চেনা মানুষের অচেনা মনস্তত্ব, প্রাচীন ও নবীনের ভাবনার পার্থক্য, চলমান জীবনের রূপ-রস-গন্ধ মূর্ত হয়ে ওঠে শব্দের নিখুঁত আল্পনায়। এ কেবল তাঁর অন্তহীন প্রতিভা, মানুষকে জানা ও বোঝার চোখ, ধৈর্য ও একাগ্রতার ফসল।

 

সময়ের থেকে অনেক এগিয়ে থাকা এই সাহিত্যিক আমাদের ভাবনার জগৎকে সমৃদ্ধ করেছেন, শক্তি জুগিয়েছেন তাঁর অজস্র রচনার মধ্য দিয়ে। আমাদের অনেকের না বলা কথা যেন মূর্ত হয়ে উঠেছিল ওঁর লেখনীতে। ওঁর মতো বলিষ্ঠ, মরমি, জীবনবোধসম্পন্ন সাহিত্যিক বাংলা সাহিত্যের গর্ব। তিনি নারীর কথা বলতে গিয়ে কখনও নিছক পুরুষকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাননি। সমাজের বেনিয়মগুলির বিরুদ্ধে কলম ধরেছেন। যথার্থই বিরল চিন্তনের অধিকারী একজন মানুষ। এহেন এক কিংবদন্তীর ঝুলি যে পুরস্কারে ভরে উঠবে, সেটাই তো স্বাভাবিক। এমনই এক পুরস্কার প্রাপ্তি উপলক্ষে আয়োজিত এক সান্ধ্য অনুষ্ঠান তাঁর দক্ষিণ কলকাতাস্থিত বাসভবনে। অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন আশাপূর্ণা দেবীর পুত্রবধূ।

 

লেখা শেষ করবো সেই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকময় অধ্যায়ের মধ্য দিয়ে। আমার অনন্ত সৌভাগ্য আমি সেই সন্ধ্যায় আশাপূর্ণা দেবীকে তাঁর পায়ের কাছে বসে গান শোনাবার সুযোগ পেয়েছিলাম।

আশাপূর্ণা দেবীর বাড়ির পাশেই ছিল আমার এক বন্ধুর বাড়ি। আমরা একসঙ্গে পূর্বা দামের কাছে গান শিখতাম। সেই বাবদ মাঝে মাঝেই ওর বাড়ি যাওয়া হতো। আশাপূর্ণা দেবীর পরিবারের গল্প শুনতাম বন্ধুর কাছে। সকলেই ভদ্র, সভ্য, শিক্ষিত এবং মিশুকে।

অনুষ্ঠানের উদ্বোধনী গানটি আমায় গাইতে নিয়ে যায় আমার বন্ধু। রবীন্দ্রনাথের ‘পান্থ তুমি পান্থজনের সখা হে…’ গেয়েছিলাম, আজও ভুলিনি। ঘরোয়া অনুষ্ঠান। পরিবার, বন্ধু, ভক্ত সমাগমে আন্তরিক ও শান্ত, স্নিগ্ধ পরিবেশ। তার মধ্যে আমি এই অধম। ঘরের ঠিক মাঝখানে একটি আরামকেদারায় উনি বসে আছেন। আমরা কয়েকজন কার্পেটের ওপর বসেছি। দু’একজন বয়োজ্যেষ্ঠ চেয়ারে বসে।

 

আমার গান গাওয়া হলো। ওঁর পুত্রবধূ বললেন, সুন্দর নির্বাচন। উনি স্মিত হাসলেন। সেই হাসিতে কত কি ! তারপর প্রনাম করার পর মাথায় হাত রাখলেন। আহা, সেই স্পর্শে কি যে মমতা ! আমি নির্বাক ! তারপর অনুষ্ঠান শুরু হলো। অনেকেই অনেক কথা বললেন ওঁর সম্পর্কে। মুখে একটুকরো লাজুক ও মধুর হাসি। খুব মৃদুস্বরে উনি নিজেও কিছু কথা বললেন। অনুষ্ঠান অল্প সময়ের। ওঁর শরীর খুব একটা ভালো থাকতো না তখন। অনুষ্ঠান শেষে বাড়ি ফেরার পালা। এতটাই অভিভূত যে বন্ধুকে কৃতজ্ঞতা জানাবার ভাষাও হারিয়ে ফেলেছি। তখনও সাংবাদিকতা পেশায় পা রাখিনি।  সংসার আর গান নিয়েই ছিলাম। সাংবাদিক-সুলভ স্বাচ্ছন্দ্য আয়ত্তে ছিল না স্বাভাবিক কারণেই। অমন প্রিয় এক মানুষকে সামনে পেয়েও কিছু প্রশ্ন করবো বা নিজের অনুভূতি প্রকাশ করবো, ততটা স্মার্টও ছিলাম না সেদিন। ওঁর পায়ের কাছে বসে একটা গান গাইতে পেরেছি, আর কি চাই, এটাই হৃদয় ও মস্তিষ্ক জুড়ে ছিল সেদিন। আজও সেই অনুভূতি নিয়েই কথাগুলি ভাগ করে নিলাম পাঠকের সঙ্গে।

 

 

অজন্তা সিনহা

 

পুকুরঘাট

পুকুরঘাট

একদিন আমরা মাত্র কয়েকজন সদস্য নিয়ে পুকুরঘাট নামের একটি মেয়েদের ভার্চুয়াল দল খুলে ছিলুম। অচিরেই সে কয়েকটি সদস্যের দল কয়েক হাজার সদস্যের মেয়েদের দল হয় ওঠে। পুকুরঘাট দলের মত এত গুণী মেয়েদের সমাহার বাংলাদেশে খুব কম ভার্চুয়াল দলে আছে। কাজেই সেই দল সেখানেই আটকে থাকবে না বলা বাহুল্য। তাই পুকুরঘাট দলের অন্যতম উদ্যোগ হিসেবে প্রকাশিত হলো পুকুরঘাট পত্রিকা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

29 thoughts on “ওঁদের যেমন দেখেছি-১

  1. খুব ভালো লাগলো পড়ে,জেনে…কতটা আগুন ওনার কলমে ঝরেছে শান্ত ‘মা মা মুখ’
    দেখলে বোঝা যায় না একদম।

  2. খুবই ভাল লেখা… শুভেচ্ছা রইল… আরো লেখো, দিদি… পড়তে চাই 🙏❤️💐

    1. তোমরাই প্রেরণা। নিশ্চয়ই লিখবো।

  3. এতো ভালো লাগলো.. এই শব্দ টি “সূর্যমুখী”… আজও অনেক মেয়ে অনেক প্রতিকূলতার মধ্যেও সূর্যমুখী হতে চায় একটু.. হয়তো কোন আশাপূর্ণা তাঁদের কথা লিখছেন.. সহজ সরল ভাষায় কি সুন্দর লিখতেন তিনি..আজও কেউ কেউ সংসার যাপনের মাঝে সুবর্ণলতার থেকে একটু শক্তি নিতে চাইছে…. কোথাও

  4. এমন এক দীপ্তিময়ীর পায়ের কাছে বসে গান শোনালে সব তোলপাড় হয়ে যাওয়ার ই কথা।‌‌অভিভূত হয়ে লেখাটি পড়ছিলাম।
    ভাবছিলাম পাথর চাপা দিয়ে দিলেও রক্তকরবীর স্পর্ধিত লিখাটি মাথা তোলে তার মধ্যে থেকেই।

  5. প্রিয় লেখিকা আমার ও.
    আপনার অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ লেখাটা পড়ে খুউব ভাল লাগলো. এমন মানুষের সান্নিধ্যে আসা র ভাগ্য সবার হয় না. আপনার সেই বিরল ভাগ্য আর সেই অভিজ্ঞতা আমাদের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার জন্যে ভালোবাসা. আপনার লেখনীর মধ্যে দিয়ে আমরাও তাকে একটু ছুঁতে পারলাম.
    ভালো থাকবেন.

  6. দারুণ লাগলো এই অভিজ্ঞতার কথা জেনে।উনি তো পথিকৃৎ🙏🙏

  7. খুব ভালো লাগল। অপেক্ষায় রইলাম পরের পর্বের।

  8. এহেন সম দিকপাল মানুষের সান্নিধ্যে আসা সত্যি ভাগ্যের ব্যাপার ।

  9. সূর্যমুখীর মতো থেকো।
    এ লেখা ঋদ্ধ করল।
    প্রণাম আমাদের প্রিয় লেখিকা আশাপূর্ণা দেবীকে।

  10. Ki apon lekha go ! Khub valo laglo didi . Satyi ei mohan manushder katha ebong jibon amader patheyo . Ajkal prokrito bondhu , atmiyer sankhyata komchhe . Aro bisesh manushder katha uthe asuk tomar lekhonite ja hobe amader cholar prerona . 🙏🏻❤️

  11. শান্ত মানুষটিকে দেখলে বোঝাই যেত না কত তেজ ওনার কলমে। আপনি ভাগ্যবতী একদিনের জন্য হলেও ওনার সান্নিধ্যে এসেছিলেন। ওনার স্পর্শ লাভ করেছিলেন।

  12. এমন লেখা পড়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছে বলে আমি কৃতজ্ঞ!! অপেক্ষায় রইলাম পরের পর্বের জন্য।