উলটে পাতা যেতেও পারে

উলটে পাতা যেতেও পারে

দীপান্বিতা ঘোষ মুখোপাধ্যায়

 

ছোটখাট ফ্ল্যাটে একা থাকা ; হাঁটা পথ না হলেও কাছাকাছি কলেজ আর বন্ধুবর্গ নিয়ে দিব্যি ছিল ঊর্মিমালা।  আশপাশটা দেখে মনে হত  বিয়ে থা না করার সিদ্ধান্তটা বোধহয় আখেরে ভালই হয়েছে। উৎপাতটা নিয়ে এল হাড় জ্বালানো করোনা। মানুষের মনের বিষ যে নিঃশ্বাস হয়ে বেরোবে কে কবে ভেবেছিল! ঊর্মিমালা অফিসিয়াল কাজকম্ম বাঙলা মতে কাগজ পেনেই সারত। দরকার পড়লে ছোট ছোট টরটরে সব সহকর্মীরা ভালবেসেই ওদের ভাষায় সফট কপিতে করে দিত। এখন ত কেউ কারুর মুখদর্শন করবে না । ঠেকা দিতে বর বা ছেলেপুলে কেউ নেই। ল্যাপটপটা ঠাকুরের সিংহাসনের মত রয়েছে। জাগতিক কোনো কাজে আসে না। রামের যেমন হনুমান, ঊর্মিমালার তেমন গাবলু । গাবলু গাড়ি চালায় বটে কিন্তু আর পাঁচটা ড্রাইভারের মত নয়। পাড়ায় পাড়ায় ফুটবল খেলে স্যুটকেশ, কাপডিশের সেট পায় ; এক কানে দুল পরে। গাবলুর বউ ইউটিউব দেখে রান্না করে।  জানে না হেন জিনিস নেই, চেনে না হেন মানুষ নেই। নিয়ে এল এক বন্ধুকে। নাম যাই হোক বন্ধুরা তাকে ডাকে ডন বলে । অল্প বয়সে বাবামা হারিয়ে বেশি দূর লেখাপড়া করে উঠতে পারে নি। তবে যেটুকু করেছে কনভেন্টের অনাথ আশ্রমে। ভুল হোক ঠিক হোক সবেগে ইংরিজি বলতে পারে।ডবল মাস্ক আর অবিরত স্প্রেধারার ঢালের আড়াল থেকে মেঘনাদের মত মোটামুটি তিন দিনেই ছেলেটি যুদ্ধ জয় করল। হাসিখুশি স্মার্ট ছেলেটিকে ঊর্মির দিব্যি লাগল।  কৃতজ্ঞতাসরূপ টাকাপয়সা ছাড়াও প্রচুর খাওয়াল। অনেকদিন আগে কেনা একটা জ্যাকেটও দিয়ে দিল।  পরের দিন শুধু মাত্র নম্বর আপ্লোড করতে হবে বলে একটু বেলা করেই আসতে বলে বেশ কয়েকদিন বাদে একটু নিশ্চিন্তিতে ঘুমোতে গেল । রাত বারোটা নাগাদ টং টং করে উঠল মোবাইলটা। হোয়াটসাপ খুলে ঊর্মি কিছুক্ষণের জন্যে বাহ্যজ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ল।  ঊর্মিমালার পিঠের গড়ন দেখে ডন আপ্লুত। রাতে ঘুমোতে পারছে না। তাই অনুমতি দিলে একটু ফোনে কথা বলতে চায়।  পঞ্চাশোর্ধ্ব ঊর্মিমালা সব ছেলেকেই এখন প্রায় অপত্য স্নেহে দেখে। প্রেমভালবাসা বা কামনাবাসনা ব্যাপারটাই খুব বেশি হলে চল্লিশ ছুঁই ছুঁইইয়ের মধ্যেই শেষ হয়ে যায় বলে বিশ্বাস করে। কি নিয়ে কথা বলতে চায় ? আপলোডিং না পিঠ ! মাঝরাত থেকে ঊর্মি মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকে। শ্যামও যাবে কূলও যাবে কোনোদিন ভাবে নি। নিশ্চিন্ত নিরপরাধ জীবনে শান্তিও গেল ডনও গেল। ডিজিটাল পৃথিবী তবে কি এমনি করে তাদের জীবনের দখিন হাওয়াটুকু  তছনছ করে দিতে এল? ভাবতে ভাবতে ঘড়ির দিকে তাকায়। পাঁচটার ঘরে কাঁটা। পূব আকাশ এখনও অন্ধকার কেন কে জানে। গুরু গুরু মেঘের গর্জন জানান দেয় , সামনে কঠিন বৃষ্টিধারা অকূলে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে । বহু আগে শোনা পুরোনো গান মনে পড়ে – ইটস হার্ড রেইন, গোনা ফল।

বছর চৌত্রিশ প্রায় বয়স হতে গেল শুভব্রতর। মফঃস্বলের ছেলে হলেও পড়াশোনার মাথা বরাবরই ভাল ছিল। নামকরা আইটি ফার্মে উঁচুর দিকে ছোট বয়সেই তরতর করে উঠে গেছে। পাশে কাউকে পাবার ইচ্ছেটা ইদানিং নড়েচড়ে বসছে। সেজদির কাছে মাবাবা পাত্রীর খোঁজ করছে জানতে পেরে ফুরফুরে মেজাজে ফ্ল্যাটে ফিরে বিরিয়ানি অর্ডার দিয়ে বারান্দায় বসে শুভ । অফিসের দু’একজনকে যে ভাল লাগে নি তা নয়, তবে আদতে মফস্বলের ছেলে থাকতে গিয়ে টনটনে শহুরে মেয়ের সঙ্গে যদি বিবাদ বাধে তবে সামাল দিতে পারবে এমন ভরসা নিজের ওপর খুব নেই। দুচারদিনের মধ্যে খান তিনেক ছবি হাতে পেল শুভ। একজনের লম্বা চুল আর টানাটানা চোখ দেখে খানিকটা প্রেমে পড়বার অবস্থাই তৈরি হল বলা যায়। সামনেই বিদেশ যাবার কথা। চাকরি করা মেয়ের যন্ত্রণা থেকে খুব বাঁচা বেঁচেছে মনে মনে ভাবে। মার মত যত্ন করে রান্নাবান্না করবে, সন্ধ্যেবেলা ধূপধুনো দেবে, শীতকালে পিঠেপায়েস করে খাওয়াবে। জীবনটা হালকা রাখতে হাত বাড়াবে। শুভর উল্টোদিকের ফ্ল্যাটে বাড়িওলা গগনবাবু থাকেন। এক সময়ে বড়সড় সরকারি অফিসার ছিলেন। ছেলেমেয়ে স্বভাবতঃই কোলকাতার বাইরে। কত্তাগিন্নি এ বয়সেও সপ্তাহান্তে ডিনারে বা ভাল বাংলা ছবি এলে দেখতে যান। বিকেলে টিপট সাজিয়ে  সেজেগুজে মুখোমুখি বারান্দায় বসেন। বাড়ির কোথাও ধূলোবালি, দুঃখ-কলহ কিছু নেই। তবে ভাড়ার টাকাটা নগদে দিতে হয়।আগের প্রজন্মের লোক ডিজিটাল টাকাকড়ি শুধু সামলাতে পারেন না এমন নয়, ভয় আছে বেহাত হয়ে যাবার। এক লপ্তে পৃথিবীর তাবৎ হ্যাকার কেলেংকারীর হিসেব দিয়ে দেবেন।  তবে ভাড়া দিতে গিয়ে ভাল চা, ঘরে তৈরি নিমকি , নাড়ু পাওয়া যায়। শুভর ভালই লাগে। সব উলটে দিতেই বুঝি করোনা এল। আপাতত সবাই ঘরবন্দী । ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ছিল সেদিন। হট্টগোলের আওয়াজ পেয়ে আইহোলে চোখ রাখতেই কিছুটা হতচকিত হয়ে গেল শুভ। গগনবাবু দরজার কাছে দাঁড়িয়ে কাকুতিমিনতি করছেন দরজা খোলার জন্যে। বন্ধ দরজার ওপাশ থেকে বাঘিনী কণ্ঠ ভেসে আসছে    – কিছুতেই না। আগে সরো দরজার কাছ থেকে। গগন গিন্নির কণ্ঠস্বর মিষ্টি এবং খাদের দিকে। সেই স্বরের পারদ  চড়ে আপাতত পাড়ার মোড় পর্য্যন্ত পৌঁছেছে । 

  – আমাকেও যদি ভয় পাও তুমি থাকবে কেমন করে অমু।

খড়িমাটি খাওয়া গলা গগনবাবুর। – আজুড়ে কথা বলতে এস না। তুমি বাইরে দাঁড়িয়ে দশ মিনিট জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেল। নাকে করোনা থাকলে বেরিয়ে যাবে। তারপর এই নাও।

সাঁ করে একটা বড়সড় তোয়ালে ছুটে আসে, সঙ্গে সাবান। সময় মত গগনবাবু ক্যাচ লুপতে না পারলে সাবানের আঘাতে মৃত্যু না হোক আহত হতেন । প্রস্তরবত শুভ যা দেখল, শুনল আর বুঝল তা হল গগনবাবু ব্যাংকে গিয়েছিলেন পেন্সন তুলতে। দশ মিনিট ঝাড়া নিঃশ্বাস না নিয়ে শুধু প্রশ্বাস ফেলার যোগমুদ্রায় গগনবাবুর মুখের চেহারা আহত সৈনিকের মত দাঁড়াল। তারপর তোয়ালে সাবান সহযোগে যখন রাস্তার কল থেকে নেয়ে আসার নির্দেশ এল তখন কিছুটা ধাতস্থ হয়েছে শুভ। দরজা খুলে গগনবাবুকে ভেতরে নিয়ে এসে বাথরুমে পাঠাল। বেরিয়ে এক কাপ চা দিতে গগনবাবু এক চুমুকে অর্ধেকটা খেয়ে ফেলে একটু  হাসলেন, সঙ্গে এক টুকরো কান্নার মিশেল।  চা খেতে খেতে আপন মনে পেছু হাঁটতে থাকেন ; জীবনের ধারাপাত । শুনতে শুনতে শুভর ভেতরটা হাড় হিম করা শীতলতায় আচ্ছন্ন হয়ে যেতে থাকে । গগনবাবুও মফঃস্বলের মেধাবী ছাত্র ছিলেন। কোলকাতায় পড়তে আর উঁচুপদে চাকরি করতে এসে ঠিক শুভর মতনই শহুরে টনটনে মেয়ের ভয়ে বাবামার দেখা এক পিঠ চুল, হরিণীবৎ অমলাকে বিয়ে করে এনে ছিলেন। আশা ছিল মায়ের মতই গোছানো হাতে পিঠেপায়েস আর ধূপধুনোর সংসার সাজিয়ে ধরনীতে স্বর্গখেলনা গড়বেন দুজনে  । অযৌক্তিক এঁটোকাটা, বারতিথি বরাবরই ছিল। তবে আজীবন অফিস নিয়ে ব্যস্ত থাকায় গগনবাবু সেসব নিয়ে খুব মাথা ঘামান নি। বিপর্যয়টা  আনল করোনা ।গগনগিন্নির সাবধানতা করোনা আবহে প্রায় ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। তাঁর অমু হরিণী থেকে বাঘিনী হয়ে গগনবাবুর মুণ্ডু চিবোচ্ছে। সমীকরণের যে সহজ সমাধান  মস্ত একটা প্রশ্ন চিহ্ন হয়ে দুলতে থাকে শুভব্রতর সামনে। কে যেন বলেছিল, কুয়ো ভাদিস !

বাবলুরা বস্তির পাশেই ছোট্ট একটা বাড়িতে ভাড়া থাকে। বস্তির মুখেই বাবলুর বাবার দোকান আছে একটা । খাতা, পেন্সিল, তেঁতুলের আচার, মৌরি লজেন্স পাওয়া যায়। টিমটিম করে চলে। বাব্লুদের একটা গানের দল আছে। মোটের ওপর রোজগার খারাপ হয় না। পনেরই আগস্ট থেকে পরের বছর পয়লা বৈশাখ অবধি সিজন। বেশির ভাগই কাছাকাছি মফঃস্বলের দিকে। বাবলু আর শঙ্কর গান গায়, বাকিরা তিনজন বাজায় ।  ব্যারাকপুরে একটা প্রোগ্রামে পিংকির সংগে দেখা হয়েছিল। ওর দাদাদের ক্লাব থেকে বাব্লুদের ‘গীত গাতা হুঁ’ ভাড়া করে নিয়ে গিয়েছিল। প্রোগ্রামের পর ভাল লেগেছে বলতে এসেছিল পিংকি আর তার বন্ধুরা। ছিপছিপে চেহারা, টান করে বাঁধা চুল, কথাবার্তায় এতটুকু জড়তা নেই। যতক্ষণ ছিল বাবলু চোখ ফেরাতে পারে নি।  ফোন নম্বর বদলের পর, সিনেমা দেখা, ভিক্টোরিয়ায় বসা মায় মলে ঘোরার পালা সাত মাসের মধ্যে সেরে দুজনে বিয়ে থা করে থিতু হল যখন বাবলু কিছুটা মাটির ওপর দিয়েই হাঁটছে।  অল্প দিনের মধ্যেই নামতে হল যখন বুঝল তার ঝকঝকে বউ বস্তির কলে জলও ধরবে না, ঘরে রান্নাও করবে না । সোনিয়া ম্যাডামকে হাতে হাতে জুগিয়ে যথেষ্ট রোজগার করে পিংকি । সোনিয়া ম্যাডাম কনে সাজায়, চুল বাঁধে, মুখচোখ ঘসে সাফসুতরো করে। পিংকি অর্ডার মাফিক যায় আসে। ইচ্ছে হলে বাড়ির খাবার খায়, ইচ্ছে হলে চাউমিন কিনে এনে খায়। পিংকিকে কাছে পেতে ইচ্ছে করলেই ধরা দেয় না। বাড়িতে প্রবল অশান্তি। গোদের ওপর বিষফোঁড়া ; গীত গাতা হুঁ’র সিন্থেসাইসার বাজিয়ে রফিককে বেশি দাম দিয়ে কারা যেন নিয়ে গেল। কাজকম্ম এলেও করার উপায় নেই । পয়সাকড়িতে টান।  ধীরে ধীরে বাব্লু নেতানো মুড়ির মতন হয়ে যায়। অশান্তির জেরটা পয়সার জোরেই ঠেকিয়ে রাখত। এ হেন  সময়ে করোনা এল ওপরওলার আশীর্বাদের মতন। সবাই দরজার ভেতরে।  পিংকিদের কেউ কাজে ডাকে না। দূর থেকে ত আর এসব কাজ হয় না। আপাতত বাড়িতেই থাকতে হচ্ছে। সুযোগ পেয়ে বাব্লুর মা বোনেরাও শোধ তুলছে। বাবার দোকানে সব্জি এনে বিক্রির ব্যবস্থা করল বাবলু। কাছাকাছি বড় বড় ফ্ল্যাটবাড়ির খদ্দেরও জুটে গেল। ফোন করলে দিয়ে আসছে। মুরগি বা মাছের কথাও ভাবনাচিন্তা করছে এখন। আপাতত পিংকিই ভেজানো মুড়ি হয়ে রয়েছে । আল্লার দান ছাপ্পাড় ফুঁড়ে। রফিকই যোগাযোগ করেছে। বিয়ে বাড়ি। তবে যে যার বাড়ি বসে মোবাইলেই গাইবে বাজাবে।  বাকি যা করার ওই করে দেবে। একটা বোতাম দেখিয়ে দিয়ে গেছে সেটা টিপলেই সবাই এক সংগে হয়ে যাবে। আজ শেষ গানে সবাইকে মাতোয়ারা করে দিয়ে এসেছে বাবলু।                                                                   

– পাতা দেখে গান গেও না, উলটে পাতা যেতেও পারে। পাতা দেখে গান গেও না আ, আ, আ—- গাইতে গাইতে রামের হাফ বোতল শেষ করে ঘুমোতে যায়।

দেখা পাতা উলটে যাবে, জানা পথ অজানায় মিশবে, চেনা সুর অন্য লয়ে বইবে। না দেখা পাতা, না জানা পথ, না শোনা সুরেরই কি অন্য নাম জীবন !

দীপান্বিতা ঘোষ মুখোপাধ্যায়

Nila Banerjee

পুকুরঘাট

একদিন আমরা মাত্র কয়েকজন সদস্য নিয়ে পুকুরঘাট নামের একটি মেয়েদের ভার্চুয়াল দল খুলে ছিলুম। অচিরেই সে কয়েকটি সদস্যের দল কয়েক হাজার সদস্যের মেয়েদের দল হয় ওঠে। পুকুরঘাট দলের মত এত গুণী মেয়েদের সমাহার বাংলাদেশে খুব কম ভার্চুয়াল দলে আছে। কাজেই সেই দল সেখানেই আটকে থাকবে না বলা বাহুল্য। তাই পুকুরঘাট দলের অন্যতম উদ্যোগ হিসেবে প্রকাশিত হলো পুকুরঘাট পত্রিকা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *