তিনভুবনের কড়চা

তিনভুবনের কড়চা

দীপান্বিতা ঘোষ মুখোপাধ্যায়

দুগগা ঠাকরুণ এবার মর্ত্য থেকে আসা এস্তক স্বর্গে হৈ হৈ রৈ রৈ, মারমার কাটকাট। দেবদেবী, অপ্সরাঅপ্সরী, গান্ধর্বগন্ধর্বী সব তটস্থ। মর্ত্য নাকি আর সে মর্ত্য নেই। সেখানে গিয়ে পুজোপাঠ বুঝে নিতে হলে স্বর্গের সংবিধান খানিক বদলাতে হবে। তাইতে ঠাকরুণ ফিরে এসে গায়ের ব্যথা মরতে না মরতে ফরমান জারি  করেছেন, ‘রূপে লক্ষ্মী গুণে সরস্বতী’, এ প্রবচন আর চলবে না। সরস্বতীর নাম আগে বসবে, সংগে রূপ গুণ যে যা খুশি বসাক। কারণ শুনে ত সব্বাই ভোম্বল। আগের বছর থেকে কি এক রোগের জেরে মর্ত্যে ছোটবড়, মেজসেজ সবাই জেরবার। ধরি মাছ না ছুঁই পানি করতে পার যদি ত বাঁচলে নাহলে মরলে।

– ও মা ঠাকরুণ, বুজিয়ে বল না একটুক। জয়া বিজয়া দুপাশে পানের খিলি হাতে বসে। গপ্পোর গন্ধ পেয়েছে কিনা। ওরাই ত স্বর্গের সাংবাদিক। অবশ্য চোরাগোপ্তা। সঙ্গে বাদবাকিরাও জড় হয়।

– কি এক রোগ এসেছে আগের বছর থেকে। ছোঁয়াছুঁয়ি ত দূরস্থান কাছাকাছি দাঁড়িয়ে যদি তেমন কেউ জোরে নিঃশ্বাস ফেলে ত তুমি মরতে পার। পুজোর ফুলবিল্লিপত্তর সব বারণ হয়ে গেছে। সক্কলে ফোনে কিংবা এক ঢঙের বাক্স আছে তার নাম কম্পিউটর , তাতে করে পুজো পাঠাচ্ছে। সবই লিখে লিখে।কি অশান্তি ! কে কত দিলে ঠাকরুণ কিচ্ছু না বুঝে ফেরৎ এসেছেন গত বার  এই আশায় সামনের বার নিশ্চয় এ আপদ বিদেয় হবে । আশায় ছাই দিয়ে এবারেও সে দিব্যি টিঁকে আছে। তা ফি’বার ত আর কড়াগণ্ডাটি না বুঝে ফেরত যাওয়া যায় না ।  ছোটবেলা থেকেই ঠাকরুণ জানেন মহেশ্বরের ঘর করবেন, ছেলেপুলে হবে ; তাদের আবার বিয়েথা দিয়ে  নাতিপুতি পাবেন ; খিলি খিলি পানদোক্তা খাবেন; রষিয়েকষিয়ে রান্না করবেন ; দুপুরবেলা একটু ভাতঘুম সেরে সন্ধের ঝোঁকে চুলটুল বেঁধে, গা ধুয়ে সিরিয়াল দেখতে বসবেন। দিব্যি জীবন কেটে যাবে। খামোখা কিসের জন্যে পড়াশোনার ঝক্কি নিতে যাবেন ? মাঝরাস্তায় এমন ভূঁইফোঁড় অনাসৃষ্টি  উদয় হবে তা কে জানত। সরোই যা বাঁচাল। সব গুণেগেঁথে বুঝে নিতে পারল বলেই না ঠকতে হল না। এই এক পূজোর দৌলতে সম্বচ্ছরের অনেক কিছু জোগাড় হয়। মহেশ্বর জাতে মাতাল তালে ঠিক। কি কি নিয়ে ঠাকরুণ ফেরেন ঠিক নন্দিভৃঙ্গি মারফত টের পেয়ে যান। তবে কিনা শুধুই পাওনাটি বুঝবেন, গন্ডাটি মেটাবেন না তা ত আর ঠাকরুণ করতে পারেন  না। বাপেরবাড়ির খাতিরযত্নের বিনিময় মূল্য একটা আছে বইকি। রূপ , অর্থ , যশ , প্রতিপত্তি যে যা চায় সুযোগ সুবিধে মতন ঠাকরুণ দেন। কিন্তু কল্যাণ আর মঙ্গলের দিকটাও ত বিবেচনা করতে হয়। মর্ত্যে বড়লোকদের কথা আলাদা। আমজনতার ঘরের ছেলেরা মোটের ওপর, পরিবারের সাধ্য মত আর নিজের ইচ্ছে মত তবু লেখাপড়া করবার সুযোগ পায়। মেয়েগুলো ত আর ততটা পায় না। কিন্তু এবার থেকে তেমন করে লেখাপড়া না শিখতে পারলে বিয়ে থা করে সংসারও চালাতে পারবে না। মর্ত্যে ক্রমে ক্রমে ঝ্যাঁটান্যাতা চালাতেও নম্বর টিপতে হবে। দিনকাল মর্ত্যে বদলালে স্বর্গ, নরক কখনও বাদ যায়? একই সূতোয় ত বাঁধা। একটা বিনে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড  আধখানা বই পুরো হবে না । এ কথাটা লক্ষ্মী কিছুতেই বুঝতে চাইছে না।

আসলে লক্ষ্মীর ভারি ডাঁট । লেখপড়া করা ত ওকেই ভজনা করবার জন্যে। তাই মন দিয়ে ওর পূজো করলেই হল। ঘড়া ঘড়া মোহর, দিস্তে দিস্তে টাকা থাকলে আবার লেখাপড়া করার ঝঞ্ঝাট কিসের! মোটা মোটা বই পড়ে, পরীক্ষা দিয়ে আদ্দেক জীবন বরবাদ করবার কল করে রেখেছে সরো। কেউ কেউ ফাঁদে পড়ে বটে। তা বলে সবাই নয় ।  কিন্তু মা যে এবার পাশা উলটে দিতে চাইছে। মর্ত্যলোকের মানুষজন জানে লক্ষ্মী মেয়ে বলতে বোঝায় যে মেয়ে সাত চড়ে মুখে রা কাড়ে না। উঠতে বললে ওঠে, বসতে বললে বসে। বাপ বল বাপ, সোয়ামী বল সোয়ামী, পুত্তুর বল পুত্তুর, জীবনটা যে এদের বশ তা মেনে নিয়ে নিজের আর সেই সঙ্গে সক্কলকার সুবিধে করে দেয়। তাইতেই ত মর্ত্যে লক্ষ্মী মেয়ের, লক্ষ্মীমন্ত বৌয়ের খুব কদর। আসলে মা লক্ষী ঠিক তেমনটি নন। স্বভাবে চঞ্চলা। সারা বছর ফি হপ্তায় এক মাত্র লক্ষীরই পুজো হয় । বাকি সবাই এক পুজোতেই খুশি। বড়সড় পুজো আবার দু’বার। এক কোজাগরী আর এক অলক্ষী বিদায় করে দীপান্বিতা। সরো কেমন সকালবেলায় পুজো নিয়ে ভক্তদের সারাদিন টইটই করে প্রেম করে বেড়ানোর সুযোগ দেয়। লক্ষ্মী তাদের নিরম্বু উপোস রেখে সূর্য না ডোবা এস্তক পুজো নেবে না। প্রেম করবে কি দুটো খেয়ে ঘুমোতে যেতে পারলে বাঁচে তখন বেচারারা। সামান্য অযত্নে বিগড়ে গিয়ে মুখ ফেরালে রাজা ফকির হয়ে যায়। মা লক্ষ্মী ছেড়ে চলে গেলে ফেরানো কঠিন। সরস্বতীর বিবেচনাবুদ্ধি ঢের বেশি। মানুষের জীবন, ইচ্ছে, আরাধনা কোনোটাই এক রকম যায় না। তাই অধীত বিদ্যা সরস্বতী কেড়ে নেন না। নাইবা পারল সে সারা জীবন বিদ্যের সাধনা করতে। বিদ্যেবুদ্ধি থাকলে অনেক নাহোক খানিক টাকাকড়ির জোগাড় হয়েই যায়। এ বাবদে লক্ষীর না বলবার উপায় নেই। তবে লক্ষীঠাকুর জানেন তিনি যেমনই হন, মর্ত্যে এই ‘লক্ষী মেয়ে’ মূর্তিটি টিকিয়ে না রাখলে ভারি বিপদ ।- মা’ও যেমন । রোগবালাই  যেন চিরকাল থাকবে। সরো এক্টূ লেখাপড়া আর গানবাজনা জানে বলে সব সময় মায়ের একচোখোমি। ওর ওপর নাকি নির্ভর করা যায়। গাঁটে কড়ি থাকলে সব এসে পায়ে লুটোপুটি খায়, তার নির্ভরতা ! বিদ্যেধরী মেয়েরা আবার কেউ সংসারে মন দেয় নাকি ? ফি বেস্পতিবার সন্ধেবেলা অফিস থেকে বাড়িই ফিরতে পারে না, পুজো করবে কি ? পুজো মানেই খাওয়াদাওয়া আর ঘুরতে যাওয়া। বারোয়ারি পুরুতে পুজো, দেয় ত ঐ অচ্ছেদ্দার ছাই পান্তাভাতে ঘি । তাই নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হবে এবার থেকে তাহলে। কে বোঝায় সরোকে ? – নাকি পরিবর্তন মেনে নিতে হয়। লোক দেখানো পুজোর প্রয়োজন কি অন্তরে ভক্তি থাকলে ! আরে তোর নাহয় বইয়ের পাতায় পুজো হয়। আমার ত আর তা নয়। জয়ধ্বনি দিয়ে পুজো হবে, লোক বাহবা দেবে। আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব নেমত্তন্ন খেতে এসে চকমেলানো বাড়ি, নতুন নতুন  আসবাব দেখে মুগ্ধ হবে, হিংসে করবে তবে না! আর এ সবই ত ঐ লক্ষ্মীমন্ত বৌয়ের আঁচলে বাঁধা থাকবে। ব্যবস্থা তুলে দিলেই হল ?  মা লক্ষ্মী সহজে ঠাকরুণের প্রস্তাব মেনে নেবেন না এ ত জানা কথা। রাগারাগি, ঝগড়াঝাঁটির পালায় শেষ পর্য্যন্ত ইতি টানল মহেশ্বরের বিধান। মর্ত্যের সমস্যা মর্ত্য থেকেই সমাধান নিয়ে আসতে হবে। ছদ্মবেশে লক্ষ্মী সরস্বতী দুজনেই মর্ত্যে যাবে। ইচ্ছে হলে জয়া বিজয়া আর নন্দিভৃঙ্গিকেও নিতে পারে। ঘরে ঘরে গিয়ে দেখতে হবে লক্ষ্মী না সরস্বতী, কন্যে আর তাদের বাপমায়েরা আজকাল কাকে মেয়ের জন্যে ভজনা করে বেশি?  সরস্বতী গুচ্ছের লোক জড় করে যেতে নারাজ। লুকিয়ে গেলে সত্যিটা জানা সোজা। লক্ষ্মী ঢক্কানিনাদ চাই। সে এক গা গয়না পরে আসবে। লুকিয়েচুরিয়ে এলে লোকের টনক নড়বে কেমন করে ! মহেশ্বরের কড়া নির্দেশ আছে এ ব্যাপারে  দুজনে  এক মত না হওয়া পর্য্যন্ত মর্ত্যে যাওয়া  চলবে না। বাইরের কেউ কোনো শলাপরামর্শ দিতে পারবে না।

টুপটাপ তারা খসা আঁধারে মা দুগগা একা জানলায়। দূর থেকে কে যেন ছেলেবেলার নাম ধরে ডাকছে। ‘উমা উমা’ শুনতে শুনতে বহুদূরে মর্ত্যের আলো দেখতে পাচ্ছেন। মনে হচ্ছে  কত শত উমা সেখানে অন্ধকারে। ভাবতে ভাবতে পূব দিগন্তে ভোরের নরম আলো ফোটে। আরও একটা দিন, আরও এক টুকরো আশা, অনেকটা আলো। ওই ত পাখনা মেলা নীলকণ্ঠ পাখিটি । মর্ত্য থেকে মহেশ্বরের কাছে তাঁর ফেরার খবর নিয়ে আসে। কেনই বা তাঁর এক টুকরো বার্তা মর্ত্যে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারবে না? যাওয়াআসার পথটুকু শুধু নিজের স্রোতে ভাসিয়ে নেওয়া।

লক্ষ্মী সরস্বতীর মতান্তর মেটে নি । এই ফাঁকে ঠাকরুণ নীলকণ্ঠ পাখিকে দিয়ে মর্ত্যে চুপিচুপি বলে পাঠিয়েছেন সবাইকে মন দিয়ে ভেবে দেখতে – লক্ষ্মী কিন্তু চঞ্চলা ;  সরস্বতী তা নয়। সে সহজে রুষ্ট হয় না। বাপমায়েরা যেমনতেমন পড়িয়ে সংসারে লক্ষ্মীর  ভজনা করতে মেয়েকে ঠেলে দেবে নাকি সরোদিদির আশীব্বাদের জন্যে মন দেবে?লক্ষ্মী আর সরস্বতীর ঝগড়া না মেটা পর্য্যন্ত মর্তের হাতে সময় আছে ভাববার – লক্ষ্মী মেয়ে বা বউ কি সত্যিই চাই ? চাইলে কেন চাই? কার জন্যে চাই ? যা চাই তা কি ভুল করে চাই ?

 

দীপান্বিতা ঘোষ মুখোপাধ্যায়

দীপান্বিতা ঘোষ মুখোপাধ্যায়

পুকুরঘাট

পুকুরঘাট

একদিন আমরা মাত্র কয়েকজন সদস্য নিয়ে পুকুরঘাট নামের একটি মেয়েদের ভার্চুয়াল দল খুলে ছিলুম। অচিরেই সে কয়েকটি সদস্যের দল কয়েক হাজার সদস্যের মেয়েদের দল হয় ওঠে। পুকুরঘাট দলের মত এত গুণী মেয়েদের সমাহার বাংলাদেশে খুব কম ভার্চুয়াল দলে আছে। কাজেই সেই দল সেখানেই আটকে থাকবে না বলা বাহুল্য। তাই পুকুরঘাট দলের অন্যতম উদ্যোগ হিসেবে প্রকাশিত হলো পুকুরঘাট পত্রিকা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *