দালি এবং লোরকা-শিল্পিত এক বন্ধন

অনুবাদ-জয়া চৌধুরী
হিস্পানিক সাহিত্যে ’২৭ এর জেনারেশন বলা হয় যেসব কবিদের তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কটি নামের মধ্যেও ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকার নামটি সবচেয়ে উজ্জ্বল। এ প্রজন্মের আরো দুটি নাম সালভাদোর দালি এবং ফরাসী চলচ্চিত্রকার লুই বুনুয়েল। ১৯২৭ থেকে ১৯৩৬ সালে লোরকার হত্যা পর্যন্ত এই তিন মহারথীর যে অন্তরঙ্গ সম্বন্ধ ছিল তা বহু চর্চিত। বিশেষ করে লোরকা ও দালি অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন। এতটাই যে ১৯৩৬ সালে লোরকা হত্যার বহু বছর পরে ১৯৮৯ সালে দালি প্রয়াত হবার আগের শেষ দুই বছর যখন অসুস্থ, স্ত্রী বিয়োগে একাকী, কথা প্রায় বলেনই না, তখনও তাঁকে আক্ষেপ করতে শোনা যেত কেন তিনি সেই ’৩৬ সালের গ্রীষ্মে লোরকাকে জোর করে প্যারিসে নিয়ে যান নি সেকথা বলে। তাহলে তো এমন অকালে লোরকা খুন হতেন না। তাঁদের পত্রাবলী পৃথিবী চর্চিত। তার মধ্য থেকে দুটি পত্র এখানে স্প্যানিশ থেকে অনুবাদ করা হল।
ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকাকে লেখা সালভাদোর দালির একটি পত্র
প্রিয় ফেদেরিকো,
এক গভীর শান্তিতে ভরপুর হয়ে, তোমার পবিত্র শান্তিতে নিমগ্ন থেকে এ চিঠি তোমাকে লিখছি। দেখো এই মধুর সেপ্টেম্বরে কিছুদিন আগেও খারাপ সময় কেটেছে। বৃষ্টি পড়ছে, প্রচণ্ড ঝড়, বন্দরে জাহাজ নোঙর ফেলে বসেই আছে, ওসব কিছু আরো গভীরে অনুভব করায়। আর ভেতরকার শান্ত, নরমসরম কাজকর্মের মৃদু আওয়াজ… বোন পাশে বসে জানলার ধারে সাদা কাপড় সেলাই করছে, রান্নাঘরে কেক টেক বানানো চলছে, ওরা আঙুর শুকোতে হবে এসব কথাবার্তা বলছে; আমি সবকিছু এঁকেছি- বিকেল, সাতখানা শক্ত ঢেউ, ওরা যেন সমুদ্রে ভাজা হয়েছে…কাল আঁকব আরো সাতখানা ছবি। আমি শান্ত হয়ে আছি কারণ ওগুলো ভালই এঁকেছি। তাছাড়া যতবার সমুদ্র আঁকি প্রতিবার সেটা আরো বেশি বেশি করে সমুদ্র হয়ে ওঠে। অতএব ফলাফল হল এই যে কাদাকেস জায়গাটার পরিত্রাতা সন্ত সেবাস্তিয়ানও বটে। তোমার মনে আছে পেনি পাহাড়ে সান সেবাস্তিয়ানের সেই সন্ন্যাসীকে? আসলে লা লিদিয়া কাগজে বলেছিলাম আমি কাহিনীটা। সান সেবাস্তিয়ানের ইতিহাস বলেছি যেটা প্রমাণ করে কতখানি বাঁধা আছে মেরুদন্ডের সঙ্গে আর তার পিঠের সঙ্গে থেকে সেটা কেমন অক্ষত। সন্ত সেবাস্তিয়ানের পাছায় কোন ব্যাথা না দিয়ে সেকথা ভাবো নি তুমি? কিন্তু ওসব ছেড়ে দিয়েছি। তোমার যে কোন পরিস্থিতিতে লেখা চিঠিটার জবাব দিচ্ছি। যেন বুড়োর দল! এই আমরা যেমন বন্ধু। তুমি কোনকিছুর বিরোধিতা করো না। বাবাকে বোঝাও যাতে তোমাকে শান্তিতে বাঁচতে দেন। তোমার ভবিষ্যতের বীমা, কাজকম্মো, ব্যক্তিগত উদ্যম বা অন্যান্য কোন বিষয় নিয়ে যেন জোরাজুরি না করেন… তোমার বই প্রকাশ করুন তিনি। ওগুলো তোমাকে বিখ্যাত করে দিতে পারে… আমেরিকা ইত্যাদি। একটা জলজ্যান্ত নাম এবং এখনকার মত লেজেন্ডারি নয় ঈশ্বর তোমায় সবটুকে দেখাবেন ইত্যাদি ইত্যাদি…
… আমি স্বপ্ন দেখি ব্রাসেলসে গেছি মিউজিয়ামে ডাচদের আঁকা ছবি নকল করছি; আমার বাবা এই প্রোজেক্ট নিয়ে সন্তুষ্ট। … গ্রানাদায় আসা? তোমাকে ঠকাতে চাই না, পারব না যেতে। ক্রিসমাসে ভাবছি বার্সিলোনায় প্রদর্শনী করব, ওটা বেশ বড় মাপের হবে; খোকা, আমায় এখনকার মতই কাজ করতে হবে সেইসব মাসগুলো। প্রতিদিন শান্ত দিন, কিচ্ছু ভাবনা নেই স্রেফ আঁকা। তুমি ভাবতে পারবে না ছবিগুলোতে নিজেকে কতখানি নিংড়ে দিয়েছি। পাথর ঘেরা সমুদ্রের পাশে থাকা খোলা জানলার পাশে দাঁড়িয়ে কতখানি প্রেম ঢেলেছি কাজগুলোয়। আমার রুটির ঝুড়ি, আমার সেলাই করতে থাকা খুকীরা, মাছগুলো, আকাশ যেন স্থাপত্য!
বিদায়! তোমাকে বড্ড ভালবাসি। একদিন আমাদের আবার দেখা হবে। কী দারুণই না কাটাব তখন!
লিখো। বিদায়! বিদায়! আমার হৃদয়ের ছবিগুলোর কাছে চললাম।
সালভাদোর দালি
কাদাকেস, সেপ্টেম্বর, ১৯২৬
সালভাদোর দালিকে লেখা ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকার একটি পত্র
আমার প্রিয় সালভাদোর,
গাড়িটা যখন টেনে তোলা হল, হাঁসগুলো তখন কক্কক করে ডাকতে শুরু করেছিল, আর আমায় মিলানের দুওমো গির্জার কথা বলতে শুরু করেছিল। ইচ্ছে করছিল কাদাকেসে তোমার সঙ্গে (আমার তুমিটার সঙ্গে) থাকব বলে গাড়ি থেকে ঝাঁপ দিয়ে বেরিয়ে যাই। কিন্তু পেপের বাঙময় হাতঘড়ি আর ওর বেচারী মুখের ওপরে থাকা নাক, মারিয়া দে প্যারিস গির্জার কলঘরে যেটা বেয়ে স্বচ্ছ কঠিন রক্তের সরু ধারা নেমেছিল আমায় আটকে দিল। রাস্তার বাঁকে থাকা কুকুরকুচ দের কাছ থেকে বিদায় নেবার সময় এক ঝলক তোমাকে দেখলাম। তুমি তেল চকচকে লাল টুকটুকে হাত দিয়ে খাচ্ছ। হাতে ফর্ক ছিল প্লাস্টার কাস্টে বানানো, আর সেটাও তুমি টেনে বের করে এনেছ চোখের পাতা থেকে। সবটুকুই যেন সদ্য ডিম ফুটে বেরনো মুরগীর ছানার মত নরম টিউ টিউ কোমল হাত দিয়ে করছ।
এখন ঘামছি, অসহ্য এক ভ্যাপসা গরমে মরছি। কাদাকেস জায়গাটায় একটা আনন্দ আছে, নিরপেক্ষ সৌন্দর্যের এক চিরস্থায়ীত্ব যেন, যেখানে স্বয়ং ভেনাস জন্মেছিলেন। কিন্তু এখন তার সেকথা মনে পড়ে না। এখন সে বিশুদ্ধ সৌন্দর্যের দিকে চলেছে। আঙুরলতা ঝোপগুলো অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। ওখানে দিনের পর দিন শিল্পীদের উচ্চ প্রশংসা করা হয়েছিল যেন তারা ডানা, ঢেউয়েরাই যেন শিল্পী। কোন একদিন ভেজা মাছের মত নমনীয়তা নিয়ে চাঁদ গির্জার চূড়োয় আর বাড়িগুলোর উপর নরম রাবারের মত নাকী শক্ত বেচারী চুণ বা চিবনো রুটির মত দুলবে। এটা আমি আবিস্কার করছি আর ভেবে উত্তেজিত হচ্ছি তুমি কাদাকেসে গেলে কী করবে। গোধূলির আলোয় শক্ত খোলসের সামনে তখনও ঢুকতে না পারা নভিস আনকোরা সালভাদোর দালিকে কল্পনা করছি। মুখ উঁচনো ফ্যাকাশে গোলাপি কাঁকড়ার বর্ম ঢাকা। আজ এতক্ষণে তুমে ভেতরে ঢুকে গেছ। সেখান থেকে টের পাচ্ছি (আহ! বাছা, কী কষ্ট!) যন্ত্রপাতির জঙ্গলে সুন্দর রক্তের কোমল স্রোতধারার শব্দ। শুনছি দুই ছোট্ট পশুর চড়চড় করা শব্দ, আঙুলের চাপে বাদামের খোলা ভাঙলে যেমন আওয়াজ হয় ঠিক তেমন। শ্রেণীবদ্ধ করা নারী হল পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর কবিতা, রক্ত দিয়ে যাকে গড়ে তোলা যায়। সেখানে এতখানি রক্ত থাকে যা গোটা ইউরোপের যুদ্ধে যত রক্ত ঝরেছে তার চেয়েও বেশি। সে রক্ত ছিল উষ্ণ। তা দিয়ে পৃথিবী ধুয়ে ফেলা আর ইরোটিজমের প্রতীকী তৃষ্ণা ও বিশ্বাস শান্ত করা ছাড়া তার আর তো কোন প্রান্ত ছিল না। তোমার রক্ত যেন ছবি, আর সাধারণভাবে তোমার শারীরবৃত্তীয় নন্দনতত্ত্বের কৃত্রিম ধারণা সম্পর্কিত গোটা বিষয়টায় একরকম দৃঢ় বাতাস আছে। সেটা এত সমানুপাতিক, এতটাই যুক্তিযুক্ত, এবং সেটি বিশুদ্ধ কবিতার এতখানি সত্যতা নিয়ে গড়া যে সেটি একটি বৈশিষ্ট্য ধারণ করে। বেঁচে থাকবার জন্য অবশ্য তা জরুরী নয়।
বলা যেতে পারে “আমি ক্লান্ত হয়ে চলছিলাম আর অনুভব করছিলাম সে রক্তের শীতলতা আর আশ্রয়”; কিংবা বলা যায় “পাহাড় নামিয়ে এনেছিলাম ও পুরো সমুদ্রতীর ধরে দৌড়ে গিয়েছিলাম যতক্ষণ না সে দুঃখী মাথাটার দেখা পাই যেখানে চড়চড় আওয়াজ করা স্বাদু পশু দুটো দল বেঁধে রয়েছে, যাতে ভাল হজম হয়”।
এখন জানি তোমার কাছ থেকে নিজেকে আলাদা করতে গিয়ে তোমাকেই হারিয়ে ফেলছি। বার্সিলোনার যে ধারণা আমার মনে পড়েছে তা হল পুরো পৃথিবীটা খেলছে এবং কখন ভুলে যাবে এই উৎকণ্ঠায় ঘামছে। সবকিছু গুলোনোর মত, আগুনের সৌকর্যের মত ছুটে চলেছে। সবাই সিদ্ধান্তহীন, সবাই অসন্তুষ্ট। কাদাকেসের মানুষজন কেবল মাটির সর্পিলতা আর পায়ের পাতায় গজিয়ে ওঠা গাছের ছিদ্রের কথাই ভাবে তা নয়; এখন দেখছি কাদাকেসে কীভাবে নিজের কাঁধটাকে আমি অনুভব করেছি। কাঁধের পিচ্ছিল বাঁকের ওপর প্রথমবার রক্তের চলাচল অনুভব করেছি, যেখানে চারখানি ফাঁপা নল আহত সাঁতারুর চলাচলের ফলে কাঁপছিল। সেসব মনে করা আমার কাছে খুব সুস্বাদু এক বিষয়।
আমি কাঁদতে চাই তবে লুইস সাইয়েরার সেই চেতনাহীন কান্না নিয়ে কাঁদব। কিংবা ঐ গানটা, যেটা তোমার বাবা সারদানা নাচ নাচতে নাচতে গুনগুন করতেন… “চোখের জল”।
তোমার সঙ্গে আমি এক অবাধ্য গাধার মত ব্যবহার করছি। আসলে আমার পক্ষে তুমি ঢের বেশি ভাল। পরিষ্কার নজরে তোমায় যখন দেখি, মুহূর্ত কেটে যায়… আমার সত্য অনুভূতি হয়। কিন্তু তা কেবল তোমার প্রতি আমার আদর বাড়িয়ে দেয়। তোমার চিন্তাভাবনা তোমার মানবিক গুণের প্রতি আমার সংসক্তি বাড়িয়ে দেয়। আজ সন্ধ্যায় বার্সিলোনার সব বন্ধুদের সঙ্গে ডিনার সারলাম। পানীয় নিয়ে তোমার জন্য আর কাদাকেসে আমার থাকাটাকে উদযাপন করলাম। সবকটা আসন ভরা ছিল।
বাবাকে আমার প্রণাম জানিও। বোন আনা মারিয়াকেও ভালবাসা, ওকে বড় ভালবাসি। আর রাইমুন্দাকেও। সমুদ্রতীরে যখন যাবে আমার কথা মনে কোরো। সবচেয়ে বড় কথা যখন চড়চড় শব্দ ও অনন্য ছাইভস্ম আঁকবে, … আহ, আমার ছাই! ছবিতে আমার নাম লিখে রেখো যাতে নামটা দুনিয়ায় কোন কাজে আসে। আমায় ভাল করে জড়িয়ে ধরো ওটা তোমার ফেদেরিকোর খুব দরকার।
বীভৎস গরম!
বেচারা!
আমার প্রদর্শনী নিয়ে প্রবন্ধ লিখো আর সেকথা আমায় লিখে জানিও, খোকা!
ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা
বার্সিলোনা, ৩১ শে জুলাই, ১৯২৭
কাফে দে লা রাম্বলা
জয়া কেন জানি না তোমার অনুবাদ পড়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠেছি। শিশুর মতো। ভালো থেকো।