বিনির্মাণে বসতে লক্ষ্মী

মনীষা মুখোপাধ্যায়
“ যাবই আমি যাবই ওগো, বাণিজ্যেতে যাবই।
লক্ষ্মীরে হারাবই যদি, অলক্ষ্মীরে পাবই।“
লক্ষ্মী” “অলক্ষ্মীর” এই বাইনারি বেশ চিরায়ত ও বাঙালির পছন্দের ,কারণ আমরা জানি বাঙালি তর্ক ও বাইনারি-প্রবন, বিশেষ করে লিবারাল এলিট আঁতেলেকচুয়াল বাঙালি।এই পরিসরের বাইরে যে অন্য ভারত বর্ষ আছে সেখানে অত তর্ক-ফর্ক নেই , আছে খাপ-পঞ্চায়েত,আছে ব্রাক্ষ্মণ্যবাদ,আছে পিতৃতন্ত্র।কাজেই “লক্ষ্মী মেয়ে” একটি আপাত নীরিহ নির্মাণ মাত্র নয়,আড়ালে গর্জন করছে এক বিস্ফোরক দ্বান্দিকতা!
এবার একটু “লক্ষ্মীমেয়ে” নির্মাণটির সময়-রেখা ঝটপট পরিক্রমা করা যাক।রাজা রামমোহন রায় ও লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের আগে লক্ষ্মী মেয়েরা একাধারে শিশু শ্রমিক ,যৌন দাস এবং সন্তান উৎপাদন যন্ত্র এবং শহীদ, যিনি স্বামীর মৃত্যুর পর স্বেচ্ছায় বা পিতৃতান্ত্রিক আফিং এর ঘোরে ন’শো ডিগ্রি সেলসিয়াস (চিতার আগুনের সম্ভাব্য তাপমাত্রা) তাপমাত্রায় জ্যান্ত প্রবেশ করতে ও পঞ্চভূতে বিলীন হতে সক্ষম। ভারতবর্ষের সবচেয়ে দৃঢ়চেতা ফেমিনিস্ট ঈশ্বর চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের ইন্টারভেনশনে ভাষ্যটি কিঞ্চিৎ বদলালো: সম্ভ্রান্ত পরিবারের লক্ষ্মী মেয়েরা লেখাপড়া করবে এবং সেটা একরকম ব্যারোমিটারের কাজ করবে পরিবারটি কতটা আলোকপ্রাপ্ত তার সামাজিক পরিমাপের। বঙ্গীয় রেনেসাঁস , ব্রাহ্মসমাজের উদ্ভব এবং স্বাধীনতা আন্দোলন- এই তিনটির কনফ্লুয়েন্স লক্ষ্মী মেয়ের সংজ্ঞায় কিছু আপাত পরিবর্তন আনল : সীমিত এজেন্সি মেয়েদের আকর্ষণ বাড়ায় পিতৃতন্ত্র দ্রুত ছকে নিল। প্রগতিশীল পরিবারের আলোকপ্রাপ্ত বধূ নৈশ সাহিত্য সভা চালাতেই পারে, কিন্তু আফিং খেয়ে আত্মহত্যা করলে বৃটিশ পুলিশ কে উৎকোচ দিয়ে প্রমাণ নিকেশ করতে হয়। মেয়েরা স্বেচ্ছায় নিজের সামাজিক পরিধির মধ্যে থেকে জীবনসঙ্গী বেছে নিলে তওবা তওবা! কিন্তু সে যদি শ্রেনী, ধর্ম বা জাতের বেড়া ভাঙে তাহলে প্রগতিশীলতার মুখোশ খসে পড়তে দেরি হবে না এবং এই ট্র্যাডিশন সমানে চলিতেছে।
একুশ শতকের “লক্ষ্মী মেয়ে” কি একটি বিবর্তিত নির্মাণ নাকি নারীবাদ,সাম্যবাদ এবং উত্তর-আধুনিকতা বিনির্মাণ ঘটিয়েছে সংজ্ঞাটির ? মোক্ষম প্রশ্ন! পিতৃ তন্ত্র কিছু কনসেশন তো অবশ্যই দিয়েছে, অর্থনীতি ,বিশেষত বাজার অর্থনীতি, মেয়েদের একই সঙ্গে বিপননযোগ্য পণ্য এবং কন্ট্রিবিউটর এবং কনজিউমার হিসেবে দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করছে কারণ সেটি লাভজনক!এর ফলে মেয়েরা একই সঙ্গে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা পেয়েছে এবং কনসিউমার হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছে।আর বিয়ের বিজ্ঞাপনে ফরসা, সুন্দরী,কনভেন্ট এডুকেটেড এর সঙ্গে জায়গা করে নিয়েছে চাকুরিরতা।
ফলে জীবনে বেড়েছে চাপ, দোসর সোশাল মিডিয়া এবং বিজ্ঞাপনের বম্বার্ডমেন্ট,যেখানে সবাই পারফেক্ট সবাই ভয়ঙ্কর রকমের সুখী,এপিয়ারেন্সই রিয়্যালিটি!সব সময় সব কিছু হতে হবে, যাকে বলে, “সর্টেড”।
রবীন্দ্রনাথ “দুই বোন” উপন্যাসে মেয়েদের দুই ক্যাটেগোরিতে ভাগ করেছিলেন, মায়ের জাত আর প্রিয়ার জাত ( যেন মায়েরা প্রিয়া হতে পারে না!), এই নির্বিচার সাধারণীকরণ একটি ভয়ঙ্কর প্রবনতা, এর মূলে আছে পিতৃতান্ত্রিক সমাজের ফ্রয়েডিয়ান ফোবিয়া এবং বিষয়ী ধুরন্ধরতা । মেয়েদের যৌনতা তাই আজও ট্যাবু,আর যৌন স্বাধীনতা? ওটা অ-লক্ষ্মীদের ডোমেইন।
আরেকবার রবীন্দ্রনাথের কাছে ফিরে যাব। “পুরুষের অবলোকন”(male gaze) নারীকে দু’ভাবে দেখতে স্বচ্ছন্দ : দেবী বা বেশ্যা। “ঘরে বাইরে” এবং “চার অধ্যায়” উপন্যাসে বিমলা ও এলাকে সন্দীপ ও ইন্দ্রনাথ সচেতনভাবে ডেমি-গডেস(demi goddess) হিসেবে প্রোজেক্ট করে, যদিও দুজনেই এই দুই মহিলার যৌন বাস্তবতা সম্পর্কে সম্যক অবহিত।এই কৌশলী পিতৃতন্ত্র নিশ্চিত করে সামাজিক বলয় থেকে এদের নির্বাসন – বৈধব্যে বা মৃত্যুতে। এখানেই পিতৃতন্ত্রের শয়তানি সূক্ষ্মতা, তার নির্মাণ গুলিকে ভাঙচুর করার সময়ও তাদের বাস্তবতা কে স্বীকার করতে হয়। তাই লক্ষ্মী অ-লক্ষ্মীর বাইনারি বড় বিপজ্জনক এবং তাই মূলধারার সমাজ বাইনারি ভক্ত- মসিয়ঁ দেরিদা যেমন ভক্ত বিনির্মাণের।
এবার একটু ব্যক্তিগত প্রসঙ্গে যাই। আমার দেখা আর্কিটাইপাল লক্ষ্মী মেয়ে আমার মা,হয়তো বা কিছু মিথিক! যে রকম লক্ষ্মী হওয়া আমার সাধ্যাতীত।আবার অলক্ষ্মীই বা হতে পারলাম কই,থিওরি আর আইডিয়াই কপচে গেলাম, প্র্যাকটিসে লবডঙ্কা!যাই হোক মা এর কথায় আসি। আমার মা বেথুন কলেজের সাম্মানিক স্নাতক এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী,তিনি তাঁর দু’হাতে অপরিসীম শ্রম,দক্ষতা ও ভালোবাসা নিয়ে আমাদের সংসার সামলেছেন (সচেতন ভাবেই শ্রম শব্দ টি কে প্রথমে রাখলাম ):দরকারে মাথায় ঘোমটা দিয়েছেন,দরকারে অপরূপ আলপনা দিয়েছেন, মেয়েদের পড়াশুনা এমন কি কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির দায়িত্ব ও তাঁর ওপরই ন্যস্ত ছিল,এবং তাঁর লেজেন্ডারি রন্ধন ক্ষমতা যার প্রমাণ তিনি দৈনন্দিন দিয়েছেন। আমি যখন একাদশ শ্রেণীতে বেথুন কলেজে ভর্তি হই তখন নজরে আসে অ্যাকাডেমিক অনার্স বোর্ড বস্তুটি: পুরোণো আর্টস বিল্ডিং এর সিঁড়ির পাশের দেওয়ালে খোদিত অনার্সে প্রথম স্থান পাওয়া ছাত্রীদের নাম। একদিন বাংলা ক্লাসে যাবার সময় চোখে পড়ল উনিশশো বাষট্টি সালে বাংলা অনার্সে প্রথম স্থান পাওয়া ছাত্রীটির নাম –“শ্রীমতী ইরা রায়চৌধুরী”- আমার মা! মুখোপাধ্যায়ের নিচে কবে হারিয়ে গেছে রায়চৌধুরী,অন্যান্য সম্ভাব্য বাস্তবতার মতই!
লক্ষ্মী মেয়ে হলে মূল্য দিতে হয় অ-লক্ষ্মী মেয়ে হলেও ( ‘লক্ষ্মী ছাড়া’ ছেলের দলের প্রতি কিন্তু আস্কারার অন্ত নেই); কাজেই বিনির্মাণ জিন্দাবাদ!
অ-সা-ধা-র-ণ
বিনির্মাণে বসতে লক্ষ্মী
এককথায় চমৎকার