বিলেতে দেহাতি- পর্ব ৭

বিলেতে দেহাতি- পর্ব ৭

 

সুজাতা রায়

প্যারিসের কাল হলো শেষ। রাত পোহালেই বাক্সপ্যাটরা নিয়ে সুইজারল্যান্ডের দিকে রওনা দেব। ‘ভোজন’ – এ রাতের ভোজন সেরে হোটেলে পৌঁছতেই টিম ম্যানেজার এর মুখে দুঃসংবাদ। খবর এসেছে ‘ফ্রেঞ্চ হেল্থ পাস’ যা কিনা কোলকাতার RTPCR টেস্ট নেগেটিভ হওয়ার পর আমাদের দেওয়া হয়েছিল তা নাকি সুইজারল্যান্ডে গ্রাহ্য হবে না। অতএব আগামীকাল সুইজারল্যান্ডে ঢোকার মুখে বর্ডারেই আমাদের আবার RAPID ANTIGEN TEST করাতে হবে। মাথাপিছু খরচ পঞ্চান্ন ইউরো। মানে চার হাজার নশো পঞ্চাশ টাকা, মানে দুজনের ন হাজার নশো টাকা। সবার গজগজানি শুরু হয়ে গেল এইতো পাঁচদিন আগেই আমরা কলকাতায় টেস্ট করেছি।’ইউরোপিয় ইউনিয়ন’ এর কি মানে যদি ইউনিয়নের এক দেশের হেল্থ পাশ আর এক দেশ নাই মানে? আমাদের অবস্হা তো করুণতর। একেই ভাঁড়ে মা ভবানি! সারাদিন আইফেল টাওয়ার, শ্যেন ঘোরার অনাবিল আনন্দের উপর যেন বিষাদের কালি লেপে দিল কেউ। প্যারিসের কোথাও মাস্ক নিয়ে, দূরত্ববিধি নিয়ে, কোভিড নিয়ে কোনও নিয়মকানুন না থাকায় ভুলেই গেছিলাম পৃথিবীতে করোনা বলে কিছু আছে।আজ শেষবেলায় এসে সব তেতো হয়ে গেল।

ব্রেকফাস্ট সেরে শেষ বারের মতো রুমে এলাম লাগেজ নিতে। আলমারি, ড্রয়ার, ফ্রিজ সব আতিপাতি করে দেখা হচ্ছে কিছু ফেলে যাচ্ছি নাতো! পূবের জানলায় ভোরের সূর্য আর পশ্চিমের জানলায় লাল টুকটুকে মেপল গাছের রঙমিলান্তি খেলা শুরু। জীবনের তিনটে দিন এই ঘরে কাটিয়ে গেলাম! বেরোনোর মুখে কি মনে হলো কপাল থেকে টিপটা খুলে ওয়ার্ডরোবের পাল্লার ভেতরে লাগিয়ে এলাম।আমার একটুখানি রেখে গেলাম এই ঘরে।যদি রুমকিপারদের চোখ এড়িয়ে ওটি থেকে যায় হয় তো কখনও কোনও ভারতীয় নারী এই ঘরে এসে এক ফোটা দেশ খুঁজে পাবে! ট্যুর ম্যানেজার পইপই করে বলে দিয়েছে পাসপোর্ট ভিসা হেল্থপাস সব ঠিকঠাক হাতের কাছে রাখতে যখন তখন দরকার হতে পারে।প্যারিস থেকে জুরিখের দূরত্ব ছশো একষট্টি কিলোমিটার। যার বেশিরভাগটাই ফ্রান্স। ইওরোপের বৃহত্তম দেশ ফ্রান্স। সময় লাগার কথা সাড়ে ছ’ঘন্টার মতো। রাস্তায় দু তিনটে ব্রেক নিয়ে পৌঁছতে পৌঁছতে প্রায় আট ঘন্টা লেগেই যাবে।


 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

বাস প্যারিস ছাড়িয়ে হাইওয়েতে উঠতেই হঠাৎ হাউমাউ কান্নার আওয়াজে বাস শুদ্ধু মানুষ ধড়ফড়িয়ে উঠেছি ‘কী হলো?কী হলো?’ রাখাল বাবুর স্ত্রীর আকুল চিৎকার -‘আমি পাসপোর্ট ফেলে এসেছি’। কাটোয়ার পশুচিকিৎসক রাখালচন্দ্র সাহা (নাম পরিবর্তিত) আমাদের গ্রুপের প্রবীণতম মানুষ।সাতাত্তর বছর বয়েসে সত্তরোর্ধ স্ত্রীকে নিয়ে বেড়াতে গিয়ে আমাদের বিনাপয়সায় প্রভূত বিনোদন জুগিয়েছেন।এটি তারমধ্যে একটি মখমলী পেলব জনমানবহীন হাইওয়ে দিয়ে আমাদের বাস ঘন্টায় কত কিলোমিটার বেগে ছুটছে জানিনা শুধু জানি প্যারিস থেকে আমরা অনেকদূর এসে গেছি।রীতেশ (tour manager)স্পীকার হাতে নিয়ে সাহা গিন্নিকে নিঃশব্দে কান্নার নির্দেশ দিয়ে ভালো করে ব্যাগ খুঁজতে বলে চুপচাপ বসে রইলো।আমরা বাঙালি মহিলারা সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়েছি,হাজারদূয়ারী ব্যাগের সব দরজা খুলে খোঁজ চলছে পাসপোর্ট-এর সঙ্গে উচ্চস্বরে কান্না আর অনুনয় -‘বাস ঘোরাও! বাস ঘোরাও’! প্রতি মুহূর্তে বাস বাতাসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছুটছে। এদিকে অবিচল ট্যুর ম্যানেজার আর ওদিকে ড্রাইভার মিস্টার খটোমটো কানে হেডফোন লাগিয়ে লাগাতার প্রেমালাপে (আন্দাজ করছি নইলে বৌ এর সঙ্গে কেউ একটার বেশি কথা বলে ফোনে!) মত্ত।এবার কান্নার সঙ্গে শুরু হলো কত্তা গিন্নীর ধুন্ধুমার ঝগড়া। রাখালবাবু হাজারবার চাওয়া সত্ত্বেও গিন্নি পাসপোর্ট তার বুকপকেটে ট্রান্সফার করেনি। এই নিয়ে অবাঙ্গালিরা হেসে কুল পাচ্ছে না। বাঙ্গালিরা রেগে গরগর। পাক্কা আধঘন্টা এই কান্ড চলার পর ঐ ব্যাগেরই এক গোপন চেম্বার থেকে উদ্ধার হলো পাসপোর্ট। আমরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। তারপর শুরু হলো নাটকের দ্বিতীয় অঙ্ক। রাখালবাবু স্ত্রীর কাছ থেকে পাসপোর্ট নিয়ে নিজের কাছে রাখবেন।  স্ত্রী দেবেন না। ট্যুর ম্যানেজার থেকে শুরু করে বাস শুদ্ধু লোক ওনার স্ত্রীকে বোঝাতে লাগলেন শার্টের বুকপকেটের মতো নিরাপদ জায়গা আর হয় না, কেননা এই শীতের দেশে শার্টের ওপর চার পাঁচটা শীতবস্ত্র থাকবে হারানোর কোনো প্রশ্ন নেই। ‘দিয়ে দিলে আপনিই তো ঝামেলা মুক্ত হবেন কোনো দায় থাকবে না,শান্তিতে ঘুরবেন’ এহেন কূটবুদ্ধিতেও ভবি ভুলবার নয়। উনি কর্তাকে পাসপোর্ট দেবেন না তো দেবেনই না এবং শেষ অবধি দিলেনও না।কর্তা মশাই তিতকুটে মুখে ক্যামেরা নিয়ে জানলার বাইরে প্রকৃতিতে মন দিলেন। গিন্নী অলিম্পিক জয়ের হাসি নিয়ে যেন ভিক্ট্রি স্ট্যান্ডে উঠে সবার দিকে চাইতে লাগলেন অতঃপর বাস শুদ্ধু অবাঙালিদের হাসি মস্করা শুরু হলো বাঙালি মহিলাদের প্রবল দাপটে পুরুষদের কী করুণ দশা এই নিয়ে। দুর্গা একলা মহিলা হয়ে কেমন অসুর বধ করেছে,কালী তো একেবারে শিবের বুকের ওপর পা চাপিয়ে খাড়া। বাঙালি দেবতাদের দেখলেই বোঝা যায় মহিলারা কোথা থেকে inspired ইত্যাদি। ভেতরে মেজাজ চড়লেও বাইরে হেসে উড়িয়ে দেবার ভাণ করে আমি ট্যুর ম্যানেজার রীতেশকে জিজ্ঞাসা করলাম ‘তুমি এতো শিওর ছিলে কি করে যে ব্যাগেই আছে? হোটেলেও তো ফেলে আসতে পারতো?’ রীতেশ হাসতে হাসতে প্রথমে জোরে জোরে বললো ‘আমারও বাড়িতে এক ভদ্রমহিলা আছেন এবং তিনি বাঙালি!’ তারপর ফিসফিসিয়ে বললো ‘হোটেলে ফেলে এলে এতক্ষনে ফোন চলে আসতো আমার কাছে!’

ট্যুর ম্যানেজার রীতেশ

এতদিন একসঙ্গে ঘুরলেও টুকটাক কথা ছাড়া সেভাবে গ্রুপের সবার সঙ্গে সবার পরিচয় হয়নি। যে যার নিজের ভাষাভাষী লোক খুঁজে নিয়ে আলাপ করেছে এই পর্যন্ত।এই প্রথম টানা আট ঘন্টা আমরা একসাথে থাকছি।রীতেশ মাইক্রোফোন নিয়ে ঘোষণা করলো এখন আমরা সবাই সবার পরিচয় জানবো। কে কোথায় থাকে কি করে পরিবারে কে কে আছে সঙ্গীর পরিচয় ইত্যাদি। একে একে সবাই মাউথ স্পিকার হাতে নিয়ে নিজেদের পরিচয় দেবে। প্রথমেই বলতে ডাকা হলো চেন্নাই-এর অনন্তরামন পরমেশ্বরনকে। গোলগাল শ্যামবর্ণ ছেলেটি আমার নজর কেড়েছিল তার নির্জন একলাকুট্টি স্বভাবের জন্য। সবার সঙ্গে ঘুরছে কিন্তু কারুর সঙ্গে নেই। চুপচাপ দেখে যায়। উচ্ছ্বাস নেই  বিস্ময় নেই আনন্দ নেই বিরক্তিও নেই। অদ্ভুত নিঝুম নিরালা মানুষ। একদম একা একা বেড়াতে এসেছে শুধু নয়, একাই কাটাচ্ছে। কারুর সঙ্গে একটাও কথা বলতে দেখিনি। রীতেশ হয়তো ইচ্ছে করেই ওকে প্রথমে ডাকলো। একদম পেছন থেকে উঠে এসে সামনে দাঁড়িয়ে স্পিকার হাতে নিয়েও প্রায় মিনিট দেড়েক চুপ করে রইলো তারপর ও যা বলেছিল আমি ফোনে রেকর্ড করে রেখেছিলাম,হুবহু অনুবাদ করে দিলাম – ‘ আমি অনন্তরামন পরমেশ্বরন,চেন্নাই এর কাছে একটা গ্রামে আমার বাড়ি। I.T Sector এ কাজ করি, মানে করতাম,এখন আমি কিছুই করি না। ২০২০-এর ফেব্রুয়ারি তে মানে করোনার ঠিক আগে আমি অফিস থেকে ফেরার পথে সন্ধ্যায় মোটরবাইক অ্যাক্সিডেন্ট করি। হাইওয়ের পাশ থেকে পরদিন ভোরে আমাকে উদ্ধার করে হসপিটালাইজড করা হয়।নাকমুখ দিয়ে প্রচুর ব্লিডিং হয়,আমি কোমায় চলে যাই,প্রায় দেড়মাস আমি অচেতন ছিলাম,সবাই আশা ছেড়ে দিলেও আস্তে আস্তে আমি চেতনা ফিরে পাই। আমার শরীরের সব ক্ষত সুস্হ হয়ে বাড়ি ফিরতে আরও আট মাস সময় লাগে। হাসপাতালে থাকাকালীন আমার করোনাও হয়েছিল, সব মিলিয়ে বলা যায় মৃত্যুর মুখ থেকেই আমি ফিরে এসেছি। বাড়ি ফেরার পর নতুন উপসর্গ দেখা দিল আমার চোখের লোম থেকে মাথার চুল সব ঝরে পরতে লাগলো এর সঠিক কারণ জানা যাচ্ছে না। ডাক্তারদের সন্দেহ কোনও ওষুধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হতে পারে। এই যে আমার মাথায় আপনারা চুল দেখছেন এটা কিন্তু উইগ। ইতিমধ্যে আমি আমার চাকরি খুইয়েছি। আমার সমস্ত সঞ্চয় শেষ হয়ে গেছে চিকিৎসার পেছনে।আমার স্ত্রী ডিভোর্স এর আবেদন করেছে সে আর আমার সঙ্গে থাকবে না।আমি খুব ঘুরতে ভালোবাসতাম, খুবই। আমার স্কুল শিক্ষিকা মা তার সঞ্চয় উজার করে আমাকে এই ট্যুরে পাঠিয়েছে যাতে আমি আনন্দ পাই হাসি কথা বলি। স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসি। রীতেশ কয়েকদিন ধরেই রোজ আমার রুমে আসছে। ওর সঙ্গে আমার মা কথা বলে নিয়মিত,আমার খোঁজ নেয়। রীতেশই আমাকে বলেছে আজ থেকে কথা বলা শুরু করতে। এই সম্পূর্ণ অপরিচিত মানুষদের কাছে নিজের সব কথা বলতে,আপনাদের আমি আগেও চিনতাম না। এই ট্যুর শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই আর যোগাযোগ ও থাকবে না। তাই সবটা খুলে বললাম। রীতেশের ধারণা বললে কষ্ট কমে। সত্যি বলতে কি আমার কোনও কষ্ট নেই কিন্তু। আমি জানি আপনারা বোর হচ্ছেন। আমারও অস্বস্তি হচ্ছে।আমি অনেকদিন পর একসঙ্গে এতো কথা বললাম। ক্ষমা করবেন! ধন্যবাদ।’

একলা কোনও মানুষ

বাস জুড়ে অখন্ড নীরবতা।অনন্তরামন পরমেশ্বরন তার সিটে ফিরে গেছে।উঁচু উঁচু ব্যাক সীট কেউ কারুর মুখ দেখতে পাচ্ছি না। কিছুক্ষণ পর রীতেশ ঘোষণা করলো আমাদের টয়লেট – টিফিনের জন্য চল্লিশ মিনিটের ব্রেক। আমরা বাস থেকে নামলাম। লাল কমলা হলুদ গাছের ফাঁক দিয়ে চুঁইয়ে পরা সোনালী রোদের নীচে রাশিরাশি ঝরাপাতার বিছানা বিছানো। দূরে দূরে ঠিক পৃথিবীর মতো গোল গোল অজস্র বসার জায়গা। একদিকে কাফেটেরিয়া আর অন্যদিকে নিঝুম জঙ্গলের মধ্যে কাঠের ছাউনির নিচে বসো আড্ডা মারো গালে হাত দিয়ে প্রকৃতির সম্ভার দেখো মুগ্ধ হও আনন্দিত হও শোক ভুলে যাও। এই যে এতো আয়োজন সবই তো তোমার জন্য দেখে ধন্য করো। আমি ঘাড় ঘুড়িয়ে অনন্তরামনকে দেখলাম, সে গুটিগুটি পায়ে একা একা সেই কমলারোদ গায়ে মাখতে মাখতে হলুদবনে হারিয়ে গেল।

 

বাস চালু হতেই এবার এলেন বিজয় সীমারিয়া ঠক্কর। কুয়েত নিবাসী এই দম্পতি তাদের বিপুল কেনাকাটার সুবাদে অনেকেরই কৌতূহলের তালিকায়। জানা গেল গুজরাতি ভদ্রলোক হীরে ও পর্যটন ব্যবসায়ী এবং ওনার অতি স্বাস্হবতী স্ত্রীটি পেশায় ডায়েটিশিয়ান। সুঠাম স্বামীটি বেশ রসিক বোঝা গেল যখন বললেন – ‘ও খুবই সফল ডায়েটিশিয়ান এটা আমাকে দেখে নিশ্চয়ই বিশ্বাস করবেন।’ বাস জুড়ে হাসির তুফান বয়ে গেল। দেখলাম অনন্তরামন ও হাসছে! এরপর নীরেনদার পালা। ডাক্তার শুনে বয়স্করা সবাই নড়েচড়ে বসলেও গাইনোকলজিস্ট শুনেই হতাশ!
তিন পাঞ্জাবি বন্ধুর গ্রুপ থেকে বলতে এলো আমনদীপ সিং।আম্বালা ক্যান্টনমেন্টের বাসিন্দা তিন বন্ধুই বিবাহিত ও সন্তান আছে। ব্যাচেলর জীবনের স্বাদ ভুলে গেছে তাই সেটা ঝালাই করতে ঝামেলা বাড়িতে রেখে এসেছে। মনে পড়ে গেল ন্যুড শো-এ দশজন না হওয়ায় যাওয়া বাতিল হওয়ায় এই মক্কেলই রাগারাগি করে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে লিখেছিল ‘ইয়ে ট্যুর কোম্পানিবালে কৌন সা বুঢ্ঢা কা গ্রুপ মে ঘুঁষা দিয়া!’
অজিথকুমার আর সঙ্গীতাপ্রিয়া চেন্নাই নিবাসী এই নববিবাহিত ইঞ্জিনিয়ার ডাক্তার দম্পতি আমাদের গ্রুপের সর্বকনিষ্ঠ এবং সবার স্নেহধন্য। অজিথের ইচ্ছে ছিলোনা গ্রুপের সঙ্গে হনিমুনে আসার কিন্তু দুজনের মা বাবাই বিদেশে একা ছাড়তে রাজি না তাই বাধ্য হয়ে এসেছে। এখন তাদের মনে হচ্ছে ভাগ্যিস একা আসে নি! এতো অপরিচিত মানুষের উষ্ণতায় ভালোবাসায় ওরা ধন্য ইত্যাদি। সত্যি আমাদের গ্রুপে সব পঞ্চাশোর্ধ দম্পতিদের মধ্যে ওরা যেন একঝলক টাটকা হাওয়া,ওদের ভীড়ের মাঝে একলা হতে চাওয়া, চোখ এড়িয়ে ছোঁয়াছুঁয়ি খেলা, জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া সেসব পেলব দিন যেন হাল্কা করে আমাদেরও ভিজিয়ে যাচ্ছিল। একদিকে অজিথ সঙ্গীতার মধুচন্দ্রিমা অন্যদিকে রাখাল দম্পতির শুকসারি সংবাদ। আমাদের ভ্রমণ জমে ক্ষীর যাকে বলে।
হাতিবাগানের ব্যবসায়ী পরিবারের চারজন।হাওড়ার জুলফিকার আলি (যাকে আমি আড়ালে ভুট্টো বাবু বলতাম) গোয়ার সাভারকর দম্পতি,সোনারপুর সম্বুদ্ধ মৌলিক আরো সবার পরিচয় পর্ব হতে হতে কর্তামশাই-এর ডাক পরলো। নিজের পরিচয় পর্ব সমাধা করেই গিন্নির পরিচয় দিলেন কবি -লেখক-সমালোচক আমার তো চোয়াল ঝুলে বোয়াল যাকে বলে! লোকটা করে কি? নেহাৎ চোদ্দআনা অবাঙালি আর যে দু আনা বাঙালি তারা ওসব সাহিত্য ফাহিত্যর ধার ধারেনা নৈলে কি হতো ভাবুন তো!
পরিচয় পর্ব শেষ হতেই শুরু হলো বিচিত্রানুষ্ঠান। সবাইকেই কিছু না কিছু করতেই হবে। গান আবৃত্তি জোক্স গল্প যা হোক যেমন ই হোক। শুরু হলো রীতেশ এর গান দিয়ে। প্রেমপূজারী সিনেমার – ‘ফুলো কি রঙ সে দিল কি কলম সে…লেনা হোগা জনম হামে। রীতেশের গান অনুষ্ঠানের মান এমন উচ্চতায় বেঁধে দিল যে আর কেউ গাইতে চায় না। সবাই জানে এসব সময় বুক ঠুকে লোক হাসাতে বাঙালের জুড়ি মেলা ভার। চৈতী বেলুনে হাওয়া ভরার কাজটি করলো  ‘ও সুজাতাদি তুমি তো দারুণ গান গাইতে এককালে’ ওমনি সুজাতাদি একদম সপ্তম স্বর্গে চড়ে গান জুড়লো। ব্যস এরপর সবাই গাইতে আসে। সবাই তো বুঝে গেছে যতোই খারাপ গাক না সবচেয়ে খারাপ কিছুতেই হবে না।মাঝেমধ্যে জোকস সব মিলিয়ে জমজমাট অনুষ্ঠান।কখন ফ্রান্স ছেড়ে বাস সুইজারল্যান্ডের সীমা ছুঁয়েছে কেউ টেরই পাইনি। এমন সময় সুসংবাদ এলো আমাদের কোনও টেস্ট করতে হচ্ছে না ফ্রেঞ্চ হেল্থ পাসেই কাজ হবে। হুররেএএএএএ!

শুধু যে র‍্যাপিড অ্যান্টিজেন করতে হলো না তাই নয় আমাদের বাস থেকেই নামতে হলো না। কোনও রকম চেকিং ছাড়াই আমরা সুইজারল্যান্ডে প্রবেশ করলাম। এখনও জুরিখ পৌঁছতে দেরি আছে। বেশ ফুরফুরে মন নিয়ে প্রকৃতিতে চোখ দিলাম। দুদিকে সবুজ মাখা অনন্ত চাষ ক্ষেত। দূরে দূরে পাহাড়ের আবছা আভাস। রাস্তা আর জমির মাঝে লাল নীল হলুদ কমলা পাতা সাজিয়ে ঝরিয়ে মাতন জুড়েছে নাম না হাজারো গাছের মেলা, আর কি? আর গরু! হ্যাঁ ঠিকই পড়েছেন হাজার হাজার গরু! আমাদের যাদের গরু বললেই ‘গোমাতা’ আর ‘গো-পাচার’ মনে পড়ে তাদের গরু দেখলে অবাক লাগবে কেন? লাগবে বৈকি! কী তাদের রাজকীয় রূপ চালচলন ভাব ভঙ্গি। মাইলের পর মাইল জুড়ে এতো এতো গরু অথচ কোথ্থাও একফোঁটা গোবর নেই কেন? ওরা পটি করে না?

 

জুরিখে পৌঁছতেই রীতেশের ঘোষণা –
“জুরিখে আমাদের তিনদিন থাকা তারপর একদিনের জার্মানি ভ্রমণ সেরেই আমরা ফেরার পথ ধরবো কাজেই দেশে প্রবেশ করতে হলে যে RTPCR রিপোর্ট লাগবে তা আজই জুরিখে করতে হবে। আমরা প্রথমে টেষ্ট করতে যাবো সেখান থেকে ডিনার করে এসে হোটেল।”
সুইস খোঁচা খাওয়ার জন্য মনে মনে প্রস্তুতি নিয়ে আমরা পৌঁছে গেলাম।কোথায় নাকে খোঁচাখুঁচি – হ্যাচ্চো সুড়সুড়ি ! হাতে ধরিয়ে দিলো ছোট্ট ছোট্ট শিশি মুখে ফানেল লাগানো নির্দিষ্ট দাগ অবধি থুথু ফেলো ফানেলটি মুচড়ে ফেলে ছিপি এটে দিয়ে দাও,ব্যস কেল্লাফতে।থুথু জমা দিয়ে বেরোতে যাবো দেখি একটা চেম্বার থেকে ‘ওয়াক ওয়াক মাগো বাবাগো মরে যাবো’ চিৎকার আসছে। সেই সঙ্গে – ‘mother please don’t vomit only spit’ শুনে পা আটকে গেল। ঘুরে চেম্বারে উঁকি দিতেই দেখি মিসেস রাখাল সাহাকে ঘিরে দুটি বাচ্চা নার্স নাজেহাল। সকালে বাসের ব্যাপারে ভেতরটা তেতেই ছিল এবার ফেটে পড়লো।’থুথু আর বমির তফাত বোঝেন না? দু ফোঁটা থুথু ফেলে দিলেই কাজ শেষ, আপনি কি শুরু করেছেন?’ ‘আমার থুথু বেরোয় না!’ এবার বললাম -‘ঠিক আছে ওদের বলছি আপনার গলায় চামচ ঢুকিয়ে থুথু বের করতে!’
ওষুধে কাজ হলো পিচিক করে দুফোটার জায়গায় দশফোটা। ইতিমধ্যে হন্তদন্ত হয়ে সাহাবাবুর আগমন। গিন্নী হাত পা নেড়ে মহাভারত শুরু করার আগেই আমি প্রেসি সাবমিট করলাম। নৌটঙ্কী কাকে বলে!

এতক্ষণ টেনশনে চারিদিকে তাকানো হয়নি এবার হসপিটালের চারিদিক দেখে মাথা ভোঁ ভোঁ করে উঠলো। কর্তার জন্য অপেক্ষা করতে করতে এদিক ওদিক ঘুরঘুর করছি। কাচের ওপারে বিশাল হল ঘরে প্রচুর মানুষ খানাপিনা করছে।ওপরে অজস্র ঝাড়বাতি থেকে মৃদু নীলাভ আলো এক স্বপ্নময় বাতাবরণ তৈরি করেছে। এপাশে বসার জায়গা। অজস্র সোফা-কৌচ।  দেওয়াল জুড়ে থরেথরে কোল্ড ড্রিঙ্কস। কফি মেসিন। দূর থেকে কর্তাকে আসতে দেখে উঠে দাঁড়িয়েছি। আমার ভেবলে যাওয়া মুখ দেখে তেনার উক্তি -‘শুধু সাজগোজ দেখলে হবে দেশের সঙ্গে RTPCRএর খরচটাও তুলনা করতে হবে তো!’ ‘কতো নিল গো?’
‘মাথাপিছু একশো তিরিশ ইউরো,দুজনের দুশো ষাট। মানে তেইশ হাজার চারশো টাকা!’
ধপ করে সোফাতে বসে পড়তেই আমার গলা অবধি ডুবে গেল

সুজাতা রায়

 

পুকুরঘাট

পুকুরঘাট

একদিন আমরা মাত্র কয়েকজন সদস্য নিয়ে পুকুরঘাট নামের একটি মেয়েদের ভার্চুয়াল দল খুলে ছিলুম। অচিরেই সে কয়েকটি সদস্যের দল কয়েক হাজার সদস্যের মেয়েদের দল হয় ওঠে। পুকুরঘাট দলের মত এত গুণী মেয়েদের সমাহার বাংলাদেশে খুব কম ভার্চুয়াল দলে আছে। কাজেই সেই দল সেখানেই আটকে থাকবে না বলা বাহুল্য। তাই পুকুরঘাট দলের অন্যতম উদ্যোগ হিসেবে প্রকাশিত হলো পুকুরঘাট পত্রিকা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

3 thoughts on “বিলেতে দেহাতি- পর্ব ৭

  1. প্যারিসে জুরিখের হাওয়ায় হাওয়ায় ভাসছি… তোমার সোফার মতো। কি আরাম হলো লেখা পড়ে।

  2. এইরকম গ্রুপ ট্যুরে আমরাও বার কয়েক গেছি, ছবির মতো মনে পড়লো সব। এরকম ট্র্যাভেলগ লেখার ইচ্ছে আছে আমারও হয়ে উঠছে না, তাছাড়া সেভাবে কোথাও লিখে রাখা হয়নি হয়তো মনে পড়বে না কত গল্প পথের। তোমার লেখাটা ভীষণ ভালো লাগলো, বিশেষ করে টিপটা খুলে আলমারির পাল্লায় লাগিয়ে আসা…আগেরগুলোও পড়ে নিচ্ছি, মনে হচ্ছে যেন নিজেও ঘুরছি। লেখা চলুক…

  3. এইরকম গ্রুপ ট্যুরে আমরাও বার কয়েক গেছি, ছবির মতো মনে পড়লো সব। এরকম ট্র্যাভেলগ লেখার ইচ্ছে আছে আমারও হয়ে উঠছে না, তাছাড়া সেভাবে কোথাও লিখে রাখা হয়নি হয়তো মনে পড়বে না কত গল্প পথের। তোমার লেখাটা ভীষণ ভালো লাগলো, বিশেষ করে টিপটা খুলে আলমারির পাল্লায় লাগিয়ে আসা…আগেরগুলোও পড়ে নিচ্ছি, মনে হচ্ছে যেন নিজেও ঘুরছি। লেখা চলুক…