লক্ষ্মী-অলক্ষ্মী

লক্ষ্মী-অলক্ষ্মী

ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়

 

ঘটনা- ১ স্নেহলতার দীপান্বিতা

আজ কালীপুজো। আজকের দিনে স্নেহলতার শ্বশুরবাড়ির দীপাণ্বিতা লক্ষ্মীপুজোর আয়োজন অনেকদিনের। স্নেহলতার পরের প্রজন্ম অর্থাত তাঁর ছেলে, বৌমাও প্রতিবছর সামিল হয় এই পুজোর যজ্ঞির ভার নিয়ে।সেদিন ভোর থেকেই বাড়িতে যেন সাজোসাজো রব। আগেভাগেই পুজোর দশকর্ম, ভোগের বাজার সব থরেথরে কিনে কেটে গুছিয়ে ফেলে অপূর্ব । তন্দ্রা ধোপদুরস্থ হয়ে একা হাতেই পুজোর কাজে লেগে পড়ে ভোর থেকেই। স্নেহলতাও একাহাতেই সব করতেন।
ছাদবাগান থেকে বিকেলে গিয়ে তাজা ফুল তুলতে হবে। ঠাকুরকে বাড়ির ফুলে মালা গেঁথে দিতেন স্নেহলতা । এ পুজো হয় প্রদোষকালে, সন্ধে নামার ঠিক আগে। অলক্ষ্মী বিদেয় করে দীপাণ্বিতা লক্ষ্মীর পুজোয় বসবেন পুরুতমশাই। স্নেহলতা যখন পুজো করতেন পুরুতমশাই এসেই আগেভাগে কলার পেটোয় রাখা একটু গোবর, চুলের নুড়ি, ভাঙা একখন্ড মোমবাতির টুকরো জ্বেলে, ফুল বেলপাতা দিয়ে তাকে রান্নাঘরের বাইরের নর্দমার ধারে রেখে আসতেন। এই নিয়ম দেখে আশ্চর্য হত প্রতিবার অপূর্ব। পুরুতমশাই চেঁচিয়ে বলতেন, কই হে খোকা? এবার চাটাইটা বাজাও দেখি জোরেজোরে আর মুখে বল “অলক্ষ্মী বিদেয় হোক, ঘরের লক্ষ্মী ঘরেই থাক”। তিনবার বলবে কিন্তু। অপূর্বর মুখস্থ হয়ে গেছিল ছোটো থেকে বলে বলে। কিন্তু সে কিছুতেই বুঝে উঠত না এই অলক্ষ্মী আর লক্ষ্মীর মধ্যে ফারাক কোথায়?

স্নেহলতা তখন ভোগঘরের শেষ পর্যায়ে। লুচি ভাজা শেষ করে পঞ্চব্যাঞ্জন পেতলের থালায় সাজিয়ে ঠাকুরের সামনে নিবেদনে ব্যস্ত হয়ত। মনে মনে হাসতেন। ছেলেটাও সব শিখে যাচ্ছে এই ভেবে। ঠাকুর তুমি ওকে রক্ষে কোরো, ওর যেন ভালো চাকরিবাকরি হয় দেখো। ওর বৌ যেন এবাড়ির সব ঠাটবাট আমার মত  বজায় রাখে। এসবের মধ্যেও মা লক্ষ্মী কে  ভোগ বেড়ে দিয়ে ওপরে দু-চারটে তুলসীপাতা ছড়াতেও ভুলতেন না। তামার তাটে সযত্নে নারায়ণ শিলা রেখে পুরুত পুজোয় বসতেন। অপূর্ব সব চেয়ে চেয়ে দেখত । পঞ্চশস্য, মধুপর্ক, নৈবেদ্য, ধূপ, দীপ সবের মাঝে মায়ের হাতের ভোগের গন্ধ ছাপিয়ে যেত সবকিছুকে। কখন ভোগ খাবে সে সেইকথা বললেই মা বকুনি দিত।
আচ্ছা মা অলক্ষ্মী ভোগ খায় না কেন? অপূর্ব জিগেস করলেই স্নেহলতা বলতেন, ঐ তো কুচোনো ফল বাতাসাই বরাদ্দ তাঁর জন্যে।
লক্ষ্মী আর অলক্ষ্মীর মধ্যে তফাত কোথায় মা? অলক্ষ্মী কি দুষ্টু? তাই ওকে ঘরের বাইরে বের করে তবেই আসল পুজো করতে হয়? ও কে এত কম কেন খেতে দেওয়া হয় মা?

স্নেহলতা বলতেন জানিনা, তোমার ঠাম্মাও এমন করতেন, আমিও তাই দেখে শিখেছি।
একবার অপূর্ব বলেছিল মা লক্ষ্মী ঠাকুর তো ধনসম্পদের দেবী তাহলে অলক্ষ্মী কিসের দেবতা?
স্নেহলতার তখন পাখীর চোখ অপূর্ব কে ভালো করে মানুষ করে তোলা। উজ্জ্বল কেরিয়ার, মোটা মাইনের ভালো চাকরী আর একটা ভালো বৌ ।
তিনি বলতেন মেয়েদের যা কিছু খারাপ সেই সব বদ গুণ গুলো নিয়ে নাকি অলক্ষ্মী কল্পনা করা হয়। সংসারে অলক্ষ্মী অশুভ তাই তাকে বিদেয় করে শুভ লক্ষ্মীর পুজো করি আমরা।

ছেলের জন্য সারাজীবন ভক্তিভরে দীপান্বিতা পুজো করেছেন বৈকি স্নেহলতা। তাই বুঝি সব দিয়েছেন মা লক্ষ্মী তাঁকে উজাড় করে। ঠিক যেমনটি চেয়েছিলেন। ধনলক্ষ্মী যেন ছপ্পড় ফুঁড়ে দিয়েছেন তাঁকে । আজ অপূর্বর কলকাতা শহরে কেতাদুরস্ত ফ্ল্যাট, দুটো গাড়ী। কর্পোরেট কেরিয়ার, সোশ্যাল স্টেট্যাস, টুকটুকে বৌ । এসবের জন্য স্নেহলতার যেমন গর্ব তেমনি কৃতজ্ঞতা দীপান্বিতা লক্ষ্মীর কাছে।
আজ প্রদোষে এবছরের কালীপুজোর অমাবস্যার সূর্যটা তখন দিনের সব রঙ চুরি করে পশ্চিম আকাশে অস্ত যাচ্ছিল ।
বাণপ্রস্থ বৃদ্ধাশ্রমের সতেরো নম্বর ঘরের জানলা দিয়ে আকাশের মাঝে সেই অস্তরাগের রঙ খেলা দেখতে দেখতে স্নেহলতা  ভাবছিলেন এসব। হঠাত কেন যেন নিজেকে মনে হল তাঁর সেই অলক্ষ্মীর মত। অথচ তিনিই তো এতদিন ছিলেন বসুবাড়ির কুললক্ষ্মী। সবাই একবাক্যে একথা বলত  শ্বশুরবাড়িতে। জোরে দুম করে একটা পটকা ফাটালো কেউ। সম্বিত ফিরল স্নেহলতার। চিন্তার সুতোগুলো এক লহমায় কেউ ছিঁড়ে খুঁড়ে সরিয়ে দিল। স্নেহলতা তন্দ্রার রাঁধা ভোগের খিচুড়ির গন্ধ পেলেন যেন। সব চিন্তাভাবনা ছাপিয়ে সেই গন্ধ নাকে এল । কিন্তু তিনি তো অলক্ষ্মী । ভোগ প্রসাদে তাঁর কি অধিকার আছে?

ঘটনা ২ – লক্ষ্মীদেবপুরের অলক্ষ্মী

এক টুকরো পুকুর পাড়। বোঝাই পেতল, কাঁসা, তামার পুজোর বাসনকোসন নিয়ে, এক তাল তেঁতুল দিয়ে মাজতে বসেছে বারোক্লাস পড়ুয়া রাজলক্ষ্মী।  আহা! এক পিঠ কোঁকড়ানো কালো চুল। মেয়ের গায়ের মাজা মাজা রঙ তবুও নজর কেড়ে নেবে ভীড়ের মধ্যেও। একরত্তি মেয়ের হাত ধরে মা যেত বৌদির বাড়ির কাজে। কালো মেয়ের ঢলঢল রূপ দেখে রাজলক্ষ্মী নাম দিতেই মানদা বলেছিল “বৌদি, হাসালে তুমি। আমরা দোখনেরা ও নাম জম্মেও মুখে আনতি পারবো নি। আজনক্ষ্মী বলবে সবাই। তোমাদের ঝ্যামন খুশি ডেকোখনে। আমরা ওকে গাঁ শুদ্ধু পম্পা বলেই ডাকব গো”
বৌদি তা শুনে বলেছিল, “জানিস? পম্পা মা দুর্গার আরেক নাম। পম্পা সরোবরে চান করেছিলেন তাই। খুব সুন্দর নাম তোর মেয়ের মানদা।  তবে আজ থেকে মেয়ের ইশকুলের পড়ার খরচ আমার। ইশকুলে ভর্তি করে ওর নাম রাজলক্ষ্মীই রাখিস কিন্তু”।

পুকুরঘাট আলো করে বসে রাজলক্ষ্মী ভাবে এসব । মাইমার মুখেই শুনেছিল সে তার নামের মাহাত্ম্য। অভিভূত হয়েছিল শুনে। সেই থেকেই মাইমা কে পম্পার কেমন যেন অত্রিমুণির সেই পত্নী অনসূয়ার মত মনে হয়। মাধ্যমিকে পড়েছে পম্পা। মাইমা কে সে খুব শ্রদ্ধা করে আর ভালবাসে। এবার তার উচ্চমাধ্যমিক। তার মায়ের কাজের বাড়ির সেই মাইমা ছোটবেলায় ইশকুলে না পড়ালে পড়াশুনো  হতনা ওর। ওদের বাড়ির দীপান্বিতা লক্ষ্মীপুজোর বাসন নিয়ে বসেছে সে পুকুরঘাটে। মেজে ঘষে তার মা আবার দিয়ে আসবে বাবুদের বাড়িতে।
এদিকে মাইমা তাকে পড়ালো বলে মায়ের রাগের শেষ নেই। অথচ মাইমার বাড়ির পুজোর বাসন তাকে দিয়েই ওর মায়ের মাজানো চাই প্রতিবার।
বাসনের ঝাঁকা দেখিয়ে ফি বছর বলাও চাই। ” এই যে তোর পেয়ারের মাইমার বাসন গুলো চকচকে করে দে”

পুকুরে মেয়ের দেরী দেখে মানদা গিয়ে চুপচাপ দাঁড়ায় মেয়ের পেছনে। কতবার তোকে বলেছি, এই ভর সন্ধেয় এলোচুলে পুকুর ঘাটে না বসতে। অনক্ষ্মী মেয়ে কোথাকার । ঐ রূপটুকুনিই এই অনক্ষ্মী রে খাবে।
পম্পা বলে, আহ! মা। তুমিই তো বললে, পুকুরঘাটে গিয়ে চকচকে করে মাইমাদের পুজোর বাসন গুলো ধুতে।
তাই বলে খোলা চুলে? অনক্ষ্মীদের মত?
কী করব। দুটো হাত আমার। মাইমা যতই বলুক পম্পা মা দুর্গার নাম । দাও দেখি বেঁধে পেছন থেকে।
মানদা এগিয়ে এসে বেশ রাগে রাগে মেয়ের চুলের ঢাল সামলিয়ে টেনেটুনে একটা এলো খোঁপা বেঁধে দেয়। নিজের খামচি কিলিপটা খুলে লাগিয়ে দেয় মেয়ের খোঁপায়। তা বলি, এই কটা বাসন মাজতে এত দেরী তোর? না কী সেই মাস্টারের কথা ভাবছিলি পুকুর ঘাটে বসে? অলুক্ষুণে মেয়ে কোথাকার! ঐ বৌদি তোর মাথাটা খে নেল নেকাপড়া শিকিয়ে। আমাদের ঘরে এত বড় সোমত্ত মেয়ের আজ ছেলেপুলের মা হয়ে যাবার কথা।
পড়াশুনো করে বলে মানদার খুব রাগ মেয়ের ওপর। মাসিক হবার পর থেকেই চিন্তা করে মরে গেল সে। রূপসী মেয়ের যেন পেট না হয়ে যায়। তার চেয়ে পড়াশোনা না করে বে দে দিলে ঘাড় থেকে ঝামেলা নামে। তা সে মেয়েরও জেদ। আরও পড়ে সে চাকরী করবে। মাদ্দমিক পাশ করেছে ফাস ডিবিশানে। উচ্চমাদ্দমিকের পর তার মামী বলেছে নার্সিং এর কোর্সে ভর্তি করে দেবে।
মাইমা এক্কেবারে চক্ষেহারা তার রাজলক্ষ্মী কে নিয়ে। গড়িয়াহাটে নিয়ে গিয়ে হাল ফ্যাশনের পালাজোর সঙ্গে ম্যাচিং লং কুর্তি  কিনে দেয়। হইল তোলা দেওয়া জুতো কিনে দেয়। এগরোল খাওয়ায় গাড়ী থেকে নেমে। আহা! বড় মুখ চাওয়া নাগো আমাদের রাজলক্ষ্মী? খাবার টেবিলে কর্তা কে বলেন তিনি।

বাসন গুলো মেজে ঘাটের শানের মেঝেতে উপুড় করে ধুপধাপ বড় বড় পা ফেলে পম্পা উঠে আসে ডাঙায়। তা দেখে মানদা বলে, মেয়ের আমার আজকাল কথায় কথায় রাগ। যত নষ্টের গোড়া এই নেকা পড়া। মেয়েছেলে অমন বড় বড় পা ফেলে শব্দ করলে লোকে বে’র পর শ্বশুরবাড়িতে অনক্ষ্মী বলবে ।
পম্পা বলে, বিয়ে করলে তো! এবার যাও তোমার বৌদির বাসন গুলো শুকনো কাপড় দিয়ে মুছে ব্যাগে ভর  গিয়ে। কাল বাদে পরশু কালী পুজো। সব বুঝিয়ে গুণেগেঁথে দিয়ে এসো দিকিনি মাইমা কে।মনে মনে বলে সে ” মা, নিজে মুখ ঝামটা দিতে ওস্তাদ। আর আমি মুখ খুললেই অলক্ষ্মী”
মানদা বলে তুই যাবিনে কাল আমার সঙ্গে?
পম্পা বলে, না। আমার কাল প্রাইভেট পড়া আছে।  আমি পুজোর দিন সকালে যাব। পিটুলি বেটে দেব। কলার পেটো কেটে লক্ষ্মী নারায়ণ আর কুবের পুতুল গড়ে দেব। পুজো তো সেই বিকেলে। অলক্ষ্মী পুজোর আগেই পৌঁছে যাবে আমার লক্ষ্মী মাইমার অলুক্ষুণে এই রাজলক্ষ্মী। মাইমা কে বলে দিও…

 

ঘটনা- ৩  লক্ষ্মীশ্রী অ্যাপারটমেন্টের সব মা লক্ষ্মীরা

লক্ষ্মীশ্রী অ্যাপারটমেন্টের বাসিন্দা শ্রুতির মতই সব আধুনিকা গৃহিণীদের হাতে স্মার্টফোন। হোয়াটস্যাপ গ্রুপে সারাদিন ধরে তর্কের তুফান তোলেন তাঁরা। সেই আগুণের ঢেউয়ের দু একটা ফুলকি এসে আবার ঠিকরে পড়ে সোশ্যাল মিডিয়ায়।
কোজাগরী লক্ষ্মী পুজোর দিন থেকে সবাই আজ ওর লেগ পুল করতে ব্যস্ত। কালীপুজো এসে গেল। তবুও সেই থ্রেডে অনর্গল বকবক চলছে তাঁদের ।
” কী গো? আজ তোমার বাড়ির লক্ষ্মী পুজোর ভোগ খাওয়াবে না আমাদের?”
শ্রুতি বলে, “বিশ্বাস কর সবাই। আমার শ্বশুরবাড়িতে কস্মিনকালেও লক্ষ্মীপুজোর চল নেই। আর বাবার বাড়িতে খুলনা কানেকশন থাকায় ছবিতেই মালা পরিয়ে ধূপ ধুনো জ্বেলে মা নিজেই দই, চিঁড়ে, মুড়কি, বাতাসা আর তালের ফোপল দিয়ে পুজো করেন। আমি আর ভাই বসে থাকতাম ছোটবেলায় কোজাগরী স্পেশ্যাল বিকেলের জলখাবারের দইকর্মার জন্য”
আসলে শ্রুতির জীবন দর্শন একটু অন্যরকম। সবার চেয়ে আলাদা। সে পুজো আচ্চায় নেই কিন্তু সনাতন ধর্মের আখ্যান বা বারব্রত এসবের গল্পগুলো নিয়ে তাদের আধুনিক ব্যাখ্যা লেখে ফেসবুকে। তা দেখে সবাই ভাবে বুঝি শ্রুতি খুব ভক্তিমতী। গলবস্ত্র হয়ে পুজো টুজো করে। এই আর কী।
শ্রুতিরা এবারে একজোট হয়ে সবাই লক্ষ্মীর পাঁচালী লিখেছে ফেসবুকের একটা থ্রেডে। লক্ষ্মীর পাঁচালীর এই নবীকরণ করতে এসে হাজির হয়েছেন এক নব্য প্রকাশনা সংস্থাও। “লক্ষ্মী পাঁচালী রিভিজিটেড” নামে পয়ার ছন্দে একটা চটি বইও প্রকাশিত হচ্ছে এবার বইমেলায়।
গাঁয়েগঞ্জে এমন কী শহরের মেয়েরা এখনও এ যুগে না বুঝে প্রতি বেস্পতিবার গলবস্ত্র হয়ে মান্ধাতা আমালের এই পাঁচালী যে কেন পড়ে! মেয়েরাই নিজেদের খাল কেটে কুমীর আনছে সারা জীবন। নয়ত এ যুগেও কেউ আদ্যিকালের পুরুষদের লেখা এই বই পড়ে দুলে দুলে?
এহেন আধুনিকা শ্রুতিই এই পাঁচালীর মুখ্য হোতা। তাকেই কী না ফেসবুকে ট্রোল্ড হতে হল?
সবাই খাপ পঞ্চায়েত খুলে বসে পড়ল অমনি। লক্ষ্মীপুজোর ভোরে। কী না শ্রুতি স্ট্যাটাস দিয়েছিল এই বলে
“আজকের নারায়ণ রা সবাই লক্ষ্মীদের জন্য ভোগ রাঁধবে তো?”

কালীপুজোয় দীপান্বিতা লক্ষ্মী পুজোর চল ওদের বাড়িতে। শ্রুতি আবারও লিখেছিল স্টেট্যাসে। “অলক্ষ্মীরা সব পুজো পাবে তো আজ?”
ব্যাস! আর কোথায় যাবে সে! অমনি কাটা ছেঁড়া তার পোষ্ট নিয়ে…
এ যুগে লক্ষ্মী-অলক্ষ্মী নিয়ে বিভাজন? এই আপনি আধুনিক? লক্ষ্মীর পাঁচালী নিয়ে কোবতে লেখেন?

তার উত্তরে লিখেছিল,
আমার মতে মেয়েরা সবাই কন্যাশ্রী। শ্রী শব্দের অর্থ লক্ষ্মী। তার সঙ্গে বাচ্ছা হল কী না হল বা স্বামী থাকল না গেল, জাতপাত কী হল এসব কেন দেখব? সধবাই কেন সিঁদুর খেলবে? বিধবারা কেন সিঁদুর দেবেনা? টিপ পরবে না? মাছ খাবেনা, লাল পরবে না এসব দোলাচলে আজও আমি জর্জরিত।
এই পোষ্টে কমেন্ট আর লাইক এ বানভাসি শ্রুতির ফেসবুক।

একজন লিখলেন “তবে আপনার মতে অলক্ষ্মীর সংজ্ঞা কী তবে?”

শ্রুতি সেদিন আজকের যুগে দাঁড়িয়ে অলক্ষ্মীর সত্যি ডেফিনিশন দিয়েছিল নিজের মত করে।

“আচ্ছা বলুন তো? আজকের সমাজে যে মেয়েগুলো বিয়ের পরে শ্বশুরবাড়িতে পান থেকে চুন খসলে মিথ্যে ৪৯৮ এর মিস ইউজ করে? ফাঁসিয়ে দেয় শ্বশুরবাড়ির প্রত্যেককে? ভেঙে ফেলে সংসার আর আইনের কারসাজিতে টাকা আদায় করে বিয়ের বন্ধনে রণে ভঙ্গ দেয় তারা কেমন লক্ষ্মী?”

পাপিয়া সোচ্চার হয়েছিলেন।
“আর গ্রামেগঞ্জের মেয়েরা তো আজকাল শহরের এককাঠি ওপরে। ৪৯৮ বাদ দিন। বিয়ের একবছরের মধ্যে বাচ্ছা পেটে না এলে  নীরিহ গোবেচারা বরটিকে ” ধ্বজভঙ্গ” বলে ফাঁসিয়ে লক্ষটাকা দাবী করে বসে। শুধু বাপেরবাড়ির মা লক্ষ্মীটির প্ররোচনায়? এরাও মা লক্ষ্মী ?
শাশুড়িমা বা নিজের মা’কে যারা “জ্যান্তে দেয় না দানাপানি, মরার পরে ছানাচিনি” টাইপ হয়ে বৃষোতসর্গ করে শ্রাদ্ধশান্তি করে? সেসব আপাত সতী লক্ষ্মীরা আমার মতে ঘরের কুল-অলক্ষ্মী।”

শ্রুতি হাততালির ইমোজি দিয়ে সম্মতি জানিয়েছিল ।

নন্দিতা লিখল,
“যারা জীবনে নিজের মা বা শাশুড়ি কে একথালা ভাত বেড়ে দেয় না কিন্তু তাঁদের ব্যাঙ্ক এফডি ম্যাচিওর করলেই মায়ের কথা যাদের মনে পড়ে সেইসব অজ্ঞাতকুলশীল অলক্ষ্মীদের মাথায় আজ পড়ুক বাজ!
শ্রুতি লিখল,
“আবার দেখুন, উল্টোটাও সত্যি। সমাজ সংসারে সেইসব শাশুড়ি বা ননদরা? যারা নতুন বউকে প্রতিমুহূর্তে  অত্যাচার করে? তাদের বাধ্য করে ঘর ছাড়তে? কিম্বা পণ না দিলে তাদের পুড়িয়ে মারে সেই দেবযানী বণিকের মত? কিম্বা বিষ খাইয়ে মেরে ফেলে সুরূপা গুহর মত? তাদের প্রকৃতপক্ষেই অলক্ষ্মীর আসনে বসাই আমি”
পাপিয়া লিখলেন,
“আনাচেকানাচে সত্যি রেপকেসের ফাঁকেফাঁকে  যেসব মেয়েরা মিথ্যে ধর্ষণের অভিযোগ এনে গ্রামেগঞ্জে unnecessary হ্যারাস করে পুরুষকে? সেগুলোর কথা ভাবব না আজ? সেই মেয়েগুলো কি লক্ষ্মীমেয়ে?”
শ্রুতি লখে তার উত্তরে…
“আর সারাজীবন কপাল ঢেলে সিঁদুর পরে, লক্ষ্মীর ঘট পেতে দুলে দুলে পাঁচালী পড়া সেই মেয়েগুলো? যারা ঘরে শান্তশিষ্ট স্বামী নামক গৃহপালিতের চোখে ধুলো দিয়ে পরকীয়ায় লিপ্ত হয়ে স্বামীর প্রতি বেইমানি করে? ওপরে সাজানো সংসার আর নীচে পরকীয়ার কেত্তন গায়? নিজের স্বার্থসিদ্ধির আশায়? এরাও মা লক্ষ্মী?
তাপস নামে এক ভদ্রলোক লিখলেন…
“আর যে মেয়েগুলো “মি টু” বদনাম দিয়ে আপিসের বসের কাছ থেকে বিশাল অঙ্কের টাকা দাবী করে চাকরী থেকে ইস্তফা দেয়? সেই মেয়েরাও লক্ষ্মী?”
শ্রুতি লেখে,
বাহ! দারুণ দারুণ সব ইন্টারেস্টিং পয়েন্ট উঠে আসছে লক্ষ্মী-অলক্ষ্মী তরজায়।
নন্দিতা লেখেন,
“আর ওপরে শান্তশিষ্ট ল্যাজবিশিষ্ট সেই রমণী? যার পরণে লাল পাড় শাড়ি, কপালে সিঁদুর, লক্ষ্মীপুজো করে সে গদগদভাসি। ঘরের লক্ষ্মী শাশুড়ি মা’ কে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে অথবা সপরিবারে বেড়াতে চলে যায় শাশুড়িমা কে একটি ঘরে জল, বিস্কুট দিয়ে তালা বন্ধ করে রেখে? সে ও মা লক্ষ্মী তো?”
পাপিয়া লেখেন…
“আর সর্বোপরি যে মেয়েগুলো শ্বশুরবাড়ির প্ররোচনায় বোকার মত নিজের পেটের কন্যাভ্রূণটিকে চুপুচুপি ওষুধ খেয়ে ন্যাকড়া জড়িয়ে বনের মধ্যে বা নর্দমায় ফেলে আসে? সেই মেয়েগুলো কেমন লক্ষ্মী?”
শ্রুতি লেখে,
“এদের নিজেদের কোনো সম্বিত নেই? কোনো বুদ্ধিশুদ্ধি নেই? এযুগে দাঁড়িয়ে এই সব ধরণের অলক্ষ্মীদের আজ বুদ্ধি লোপ পেয়েছে। তাই মা লক্ষ্মীর কাছে এইসব অলক্ষ্মীদের শুভবুদ্ধির জন্য প্রার্থনা করছি”
পাপিয়া লেখেন…
এটাই তো লক্ষ্মী পুজোয় আসল পুজো মেয়েদের উদ্দেশ্যে মেয়েদের।

তাদের উৎসাহে শ্রুতি লিখেছিল সহজ করে।

অবনীন্দ্রনাথের মতে কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর ব্রত কথাটি এক আদিম অনার্যা কন্যা কে ঘিরে।

সংসারে ভাল এবং মন্দ মেয়ের  টানাপোড়েনের গল্পটি উঠে আসে। লক্ষ্মী এবং অলক্ষ্মীর পুজোর তাই বুঝি চল। কারোকে ফেলো না। সব মেয়েই সমান ভাবে পূজ্য। দোষে গুণে গড়া মানুষ। লক্ষ্মীকে বরণ করলেও অলক্ষ্মীকেও ফেলে দেওয়া চলবেনা…ইহজগতের মানুষের জন্য সেই শিক্ষামূলক বার্তা আজো পাই এই পুজোর থেকে। লক্ষ্মী সুরূপা আর অলক্ষ্মী কুরূপা। লক্ষ্মী শান্ত আর অলক্ষ্মী চঞ্চলা। তারা তো আমাদের ঘরের আর পাঁচটা মেয়েরি মতন। তাই অলক্ষ্মীর পুজো করে নিয়েই লক্ষ্মী পুজোর রীতি চিরন্তন বাস্তব।

দীপান্বিতা পুজোর আগেও শ্রুতির কাছে সবাই জানতে চায় সেই পুজোর ব্রত নিয়ে। মনের আনন্দে শ্রুতি জানিয়েছিল।

সেখানেও কন্যা সন্তানের ওপর তার পিতার একহাত নেবার মানসিকতা।অথচ সেই মেয়েরই জয়লাভ নিজগুণে, নিজের বুদ্ধিবলে।   

ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়

 

পুকুরঘাট

পুকুরঘাট

একদিন আমরা মাত্র কয়েকজন সদস্য নিয়ে পুকুরঘাট নামের একটি মেয়েদের ভার্চুয়াল দল খুলে ছিলুম। অচিরেই সে কয়েকটি সদস্যের দল কয়েক হাজার সদস্যের মেয়েদের দল হয় ওঠে। পুকুরঘাট দলের মত এত গুণী মেয়েদের সমাহার বাংলাদেশে খুব কম ভার্চুয়াল দলে আছে। কাজেই সেই দল সেখানেই আটকে থাকবে না বলা বাহুল্য। তাই পুকুরঘাট দলের অন্যতম উদ্যোগ হিসেবে প্রকাশিত হলো পুকুরঘাট পত্রিকা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *