লক্ষ্মী বনাম অলক্ষ্মী

সাবিনা ইয়াসমিন রিংকু
লক্ষ্মী মেয়ে তো ছিলামই! নইলে আমি জন্মানোর পর বাবার উন্নতি হল কি করে! যদিও বাবার জীবনে মা আসার পর বাবার অর্ধেক উন্নতি হয়েছিল। আমি জন্মানোর পর পুরো উন্নতি হোলো। যেন বাবা কাজকর্ম সব বন্ধ করে মা লক্ষ্মী আর মেয়ে লক্ষ্মীর ওপর নির্ভর করে পরম নিশ্চিন্তে পায়ের ওপর পা তুলে বসেছিলেন! বরং উল্টোটা ঘটে ছিল। বিবাহ পরবর্তী কালে এবং আমার জন্মের পর উদাসীন পিতা বুঝতে পেরেছিলেন মাথার ঘাম পায়ে না ফেললে সংসার রক্ষা করা মুশকিল। তাই তিনি তিন ডবল খাটনি খেটে সংসারের অবস্থা ফিরিয়েছিলেন। ফাঁকতালে ক্রেডিট নিয়েছিলেন লক্ষ্মী দেবী।
আমাদের চোখে কোন একটা মেয়ে লক্ষ্মী তো আর একটা মেয়ে অলক্ষ্মী। জন্মেই বড় জ্যাঠাকে খেল। বড়ো জ্যাঠা যেন মশলা মাখানো একটা দুর্দান্ত চিকেন লেগ পিস! বড়ো জ্যাঠা যে গোপনে মদ্য পান করে লিভারটাকে ফুলিয়ে ঢোল করেছিলেন সে কথা কেউ বললো না।
এই মেয়েটা খুব লক্ষ্মী । মাথা নিচু করে চলাফেরা করে। নিচু স্বরে কথা বলে। ওই মেয়েটা চূড়ান্ত অলক্ষ্মী । মোড়ের মাথা থেকে গলার আওয়াজ শোনা যায়। ধাঁই ধপা ধপ শব্দ করে হাঁটা চলা করে।
সন্ধ্যে বেলা এলো চুলে ছাদে কাপড় তুলতে যায়!
আশ্চর্যের বিষয় হল যে নিচু গলায় কথা বলা অনেক লক্ষ্মী মেয়েদের মধ্যে অবস্থা বিশেষে চণ্ডীর প্রভাব লক্ষ্য করেছি।
আর কিছু অলক্ষ্মীদেরও দেখেছি লক্ষ্মী হবার অক্লান্ত চেষ্টায় বাকি জীবনটুকুতে নিজের অস্তিত্বটাকেই হারিয়ে ফেলেছে।
স্কুল জীবনে সরস্বতীর স্নেহ পাইনি বলে চিরটাকাল আমি টেনেটুনে অঙ্কে ১৫,ইতিহাসে ২৫। ভৌত বিজ্ঞানের কথা আর বললাম না। লক্ষ্মীরও কমতি ছিল। সেই কালে সবার তালা লাগানো টিনের স্কুল বাক্সে চার আনা থাকলেও আমার থাকতো ১০ পয়সা। তাও রোজ নয়। লক্ষ্মীমন্ত মেয়েরা যখন টিফিনের সময় ভালো ভালো জিনিস কিনে খেতো,আমি তখন মটর মাখা খেতাম। কাঁচা পেঁয়াজ,কাঁচা লঙ্কা,তেল আর বিট নুন দিয়ে মাখা। এক একটা শক্ত মটর মোটর গাড়ির মতো কটাং করে দাঁতের ওপর আছড়ে পড়তো। লক্ষ্মী সরস্বতী এবং দাঁতের অবস্থা খারাপ হলে যেটা হয়….তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ ছিলাম আমি। অথচ উঁচু ক্লাসের দিদিরা আমার ফুলো ফুলো গাল দুটো টিপে দিয়ে এক জন আরেক জনের দিকে তাকিয়ে বলতো “দ্যাখ মেয়েটার মুখটা একদম লক্ষ্মী ঠাকুরের মতো গোল।”
ওই পুঁচকে বয়সেই বুঝে গিয়েছিলাম গোল মুখ বা এক মাথা কোঁকড়া চুল থাকলেই লক্ষ্মী হওয়া যায় না। টিনের বাক্সে মিনিমাম পাঁচ টাকার নোট থাকতে হয়। বড়ো এবং বুড়ো হওয়ার বুঝেছি শুধু নোট আর গা ভর্তি গহনা থাকলেই লক্ষ্মী হওয়া যায় না। কম্প্রোমাইজ করতে জানতে হয়। উপস্থিত বুদ্ধি ধরতে হয়। সময় ও সুযোগের সদ্ব্যবহার করে তাক লাগিয়ে দিতে হয়। আবার মাঝে মাঝে রণদা সর্বনাশী হতে জানতে হয়।
লক্ষ্মী অলক্ষ্মীর সমীকরণটাই তো অবাস্তব এবং ভুলে ভরা। এক সো কলড লক্ষ্মী “প্রতিমা” আমাকে জানিয়েছিল সে তার শ্বশুরকে পোকা ভর্তি আটা দিয়ে বানানো রুটি খাওয়ায়। শ্বশুরের অপরাধ রাতে তাঁর ভাত সহ্য হয় না এবং সেই লক্ষ্মী প্রতিমাকে প্রতি সন্ধ্যেবেলা ভাত ছাড়াও শ্বশুরের জন্য বাড়তি খাটুনি খেটে দুটো রুটি বানাতে হয় ।
পুরুষালী চেহারার এবং কর্কশ কণ্ঠের এক লক্ষ্মী আমাকে শিখিয়েছিল মিষ্টি কুমড়োর দানাগুলোকে ফেলে না দিয়ে কীভাবে সুস্বাদু ভাপা বানানো যায়!
ধুনোর সঙ্গে কতোটা শুকনো নিমপাতা বা শুকনো গাঁদা ফুলের পাপড়ি জ্বালালে ঘরে মশা মাছির উৎপাত থাকে না।
তাই লক্ষ্মী বা অলক্ষ্মী নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। আপনারাও মাথা ঘামাবেন না। তার চেয়ে কুমড়োর বীজের ভাপার রেসিপিটা দিয়ে দিচ্ছি। কোনোদিন একটু বেশি লক্ষ্মী হতে মন চাইলে কুমড়োর দানাগুলো জঞ্জালের পুঁটুলিতে না ঢুকিয়ে ভাপা বানান । বাড়ির বাকি সদস্যদের সামনে নিজের লক্ষ্মীমন্ত ভাবমূর্তিটি নতুন মহিমায় উজ্জ্বল করুন।
মিষ্টি কুমড়োর দানা ভাপা:


উপকরণ: মিষ্টি কুমড়োর দানা। অনেকক্ষণের জন্য নেট বিভ্রাট হলে অথবা ফেসবুক হোয়াটস অ্যাপ করতে মন না চাইলে আপনি একটা একটা করে শুকিয়ে রাখা কুমড়োর বীজের খোসা ছাড়িয়ে রাখুন। আর লাগবে অল্প সাদা সর্ষে বাটা, নারকেল কোরা বাটা,কাঁচা লঙ্কা বাটা, নুন,চিনি, সর্ষের তেল। অল্প কুমড়োর দানা নারকেল কোরার সঙ্গে বেটে নিন। আর কিছুটা আস্ত রেখে দিন। এবার একটা বাটির মধ্যে কুমড়োর দানা সহ সব উপকরণগুলো ভালো করে মেখে সেই মিশ্রণটাকে সর্ষের তেল ব্রাশ করা এক টুকরো কলাপাতার ওপর রাখুন। পাতাটা ভালো করে মুড়িয়ে নিয়ে সুতো দিয়ে বেঁধে নিন। মোড়ানো কলাপাতাটাকে একটা টিফিনবক্সের ভেতরে রেখে বক্সের ঢাকনা এঁটে দিন। প্রেশার কুকারে একটু জল দিয়ে তার ওপর টিফিন কৌটোটা রেখে দিন । তিনটে সিটি পড়লেই বুঝবেন কুমড়ো বীজের ভাপা রেডি।

রণদা সর্বনাশী হয়ে তুমি পুষ্পের হাসি টা কেমন হাসো, ওটা দেখতে মন চায়। লেখাটা চমৎকার।
তোমার অন্য সব লেখা থেকে একটু আলাদা ফ্লেভারের – অপূর্ব আর অনন্য। পড়ে পড়ে সাধ মিটছে না। আর কুমড়োদানার রেসিপিটা … লাজবাব !