লক্ষ্মী মেয়েরা

লক্ষ্মী মেয়েরা

রঞ্জন বোস জয়

সেরিব্রাল অ্যাটাকের পর মায়ের ব্রেন ছোটো হ’তে লাগলো। আস্তে আস্তে সব ভুললো। নিজেকেও। বিছানা ছেড়ে উঠতে চাইতো না। হুট ক’রে তার মধ্যে বাবা চলে গেlলো। পুজোর পর থেকে মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত বিভিন্ন জায়গায় কল শো থাকে। রাজ্যের বাইরেও। মায়ের জন্য তখন আয়া সেন্টার থেকে আয়া নিতে বাধ্য হলাম। ভদ্রমহিলা মধ্য চল্লিশের। রোগাটে গড়ন, শ্যামলা রং, চোখে চশমা। সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যে ৬টা মা’কে দেখবেন। আসেন ৯টার খানিক পরে, বেরোনোর তাড়া থাকে ৫টা বাজলেই। সারাদিন তিনি তাঁর নিজের কাজের গুণগানে ব্যস্ত থাকতেন, মা’কে দেখার সময় থাকতো কম। তাঁর অসামান্য কৃতিত্বে মায়ের বেডসোর হ’ল। ডাক্তার যখন বাড়িতে এসে তাঁকে দোষারোপ করলেন, তিনিই উল্টে ডাক্তারবাবুকে ধুনে দিয়েছিলেন। সব বাজির সেরা বাজি- গলাবাজি ফাটিয়ে তিনি প্রমাণ করেছিলেন, বেডসোরের সম্পূর্ণ দায়, আমার শয্যাশায়ী মায়ের, তাঁর নয়। মা চলে গেছে, রেখে গেছে এমন মোক্ষম আয়ার স্মৃতি- নাম ছিলো তাঁর লক্ষ্মী।
এমন আরেক লক্ষ্মীর স্মৃতি রেখে গেছে মা ঠাকুরঘরে। এঁরও রোগাটে গড়ন, তামাটে রং, চেহারাখানা ছোটো খাটো। হাত পুড়িয়ে নিজে রোজ খাই না খাই, এঁকে সকাল সন্ধ্যে ধূপ-ধুনো নকুলদানা দিতেই হবে। মনে করে প্রতি বৃহস্পতিবার ফুল মালা চন্দন দিয়ে এঁরই কানের কাছে বসে শোনাতেই হবে এঁরই নামকীর্তন পাঁচালি। কোজাগরী পূর্ণিমায় তো প্রাণ ওষ্ঠাগত হয় উপোস করে এঁর ভোগ রান্নার ঠ্যালায়। ফি বছর ভাবি, আর নয়, সামনের বার থেকে এসব বন্ধ, কিন্তু আবারও নতুন দম নিয়ে করি। আসলে মায়ের বড়ো সাধের প্রতিষ্ঠা করা এই পিতলের মূর্তি মায়ের কাছে লক্ষ্মী ঠাকুর ছিলো ঠিকই, আমার কাছে তো মা-ই।
কোনোদিন মায়ের কাছে হাত পাততে হয়নি, মা নিজেই দু’হাত ভ’রে দিয়েছে। সরকারি চাকরির স্বনির্ভর মা শুধু আমাকে নয়, আমার বহু আত্মীয়েরই দু হাত ভরিয়েছে। যেমন এখনও মায়ের আর আমার নামের জয়েন্ট অ্যাকাউন্টে বছরে বছরে সুদ জমছে। ওই অ্যাকাউন্টটার কাছেও আমাকে হাত পাততে হয় না, ও এমনিই দেয়, মায়ের হাতের মতো। ওই অ্যাকাউন্টটার অফিসিয়াল নাম, নম্বর যাই-ই থাক না কেন, আমার কাছে ওরও নাম- লক্ষ্মী।
লোকে বলে, ‘বাপের ভিটে’, ‘বাপের সম্পত্তি’, ‘বাপের বাড়ি’, আমার কিন্তু ‘মায়ের সম্পত্তি’, ‘মায়ের ফ্ল্যাট’। উঁহু, মামার বাড়ির দান-অনুদান নয়, রীতিমতো মায়ের গ্যাঁটের কড়িতে বাবা কিনেছিলো এই ফ্ল্যাট। আমার কলকাতা শহরে মাথা গোঁজার ঠাঁই। আমার লক্ষ্মী আবাস।

আনাচে কানাচে নানান অছিলায় এমন নানান লক্ষ্মীদের দিয়ে আমার জীবন ভরিয়ে রেখে গেছে মা। ভাবি, কেন? আমি তার সৃষ্টিছাড়া লক্ষ্মীছাড়া সন্তান বলে! যে সন্তান অনায়াসে নারায়ণ হয়েও লক্ষ্মী সাজতে উন্মুখ, যে সন্তানের মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির হাতের লক্ষ্মী পায়ে ঠেলে গ্রুপ থিয়েটারের অনিশ্চয়তায় গা ভাসানোতেই সুখ, যে সন্তানকে সমাজ ‘অ’লক্ষ্মী ‘ই করে রাখতে চায়- সেই সন্তানের জন্য বোধহয় মায়েদের কমলা রূপ ধরতেই হয়। আসলে যাপনে-জীবনে মা-ই ছিলো আমার লক্ষ্য, মা-ই ছিলো আমার লক্ষ্মী। শেষ ক’টা বছরে কতোবার ‘ লক্ষ্মী মেয়ে’ ব’লে আদর ক’রে ভুলিয়ে ভুলিয়ে খাইয়ে দিয়েছি মা’কে ঠিক আমাকে যেমন মা ছোটোবেলায় দিতো। সামনেই দীপাবলি লক্ষ্মী পুজো আসছে। এখনও পর্যন্ত প্রতিজ্ঞায় অটল আছি, পুজো তেমন ভাবে করবো না, কিন্তু ‘ লক্ষ্মীর পরীক্ষা’য় প্রতিজ্ঞা ভাঙতে কতোক্ষণ? আসলে পুজো কি আর পাঁচালির লক্ষ্মীর, পুজো তো আমার ঘরের লক্ষ্মীর, আমার মায়ের। আমার না-হওয়া হ’ল লক্ষ্মী, না হলাম নারায়ণ। পেন্ডুলামের দোলাচল আমার দেহে-মনে। তাই, হেঁসেলে, ঠাকুরঘরে, বাজারে, শোবারঘরে, ব্যাঙ্কে, স্টেজে, রিহার্সাল রুমে – একজন লক্ষ্য লক্ষ্মী হয়ে থাকুকই না- শ্রীমতি অঞ্জলি বোস। আমার লক্ষ্মী মা।
পুনশ্চ। এখানে ওখানে লক্ষ্মী গুঁজে রেখে যাওয়া মা, আমার জীবনে একটা লক্ষ্মী পেঁচাও রেখে গেছে। ইয়াব্বড়ো সাহসী ডানা তার। বুড়ি চাঁদ বেনোজলে ভেসে যাক না যাক, এই পেঁচা বেরিয়ে পড়েই। তক্ষুনি তার পিঠে ভর করে মঞ্চ নামের মুক্তির আকাশে চক্কর মারি আমিও। এ লক্ষ্মী পেঁচার নাম- রাকেশ ঘোষ। আমাদের সম্পর্ক জেনে বুঝেই মা ওকে বড়ো ভালবাসতো। মায়ের সঙ্গে ওরও নৈকট্য ছিলো খুব। সাজিয়ে গুছিয়ে কথা বলতে পারি কিন্তু লিখতে ভয় করে খুব। এ লেখায় সাহস জুগিয়েছে সে’ই, যেমন আমার আর সমস্ত কাজে সাহস দেয় আমায়। আমার গুরু, বন্ধু, পথ প্রদর্শক, ভালোবাসার মানুষ রাকেশ ঘোষ আমাকে ভীষণ লক্ষ্মী মেয়ে হয়ে উঠতেও সাহায্য করে যে।

রঞ্জন বোস জয়

পুকুরঘাট

পুকুরঘাট

একদিন আমরা মাত্র কয়েকজন সদস্য নিয়ে পুকুরঘাট নামের একটি মেয়েদের ভার্চুয়াল দল খুলে ছিলুম। অচিরেই সে কয়েকটি সদস্যের দল কয়েক হাজার সদস্যের মেয়েদের দল হয় ওঠে। পুকুরঘাট দলের মত এত গুণী মেয়েদের সমাহার বাংলাদেশে খুব কম ভার্চুয়াল দলে আছে। কাজেই সেই দল সেখানেই আটকে থাকবে না বলা বাহুল্য। তাই পুকুরঘাট দলের অন্যতম উদ্যোগ হিসেবে প্রকাশিত হলো পুকুরঘাট পত্রিকা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *