দোয়া

দোয়া

মৌমিতা ঘোষ

 

 

আজ সকাল থেকে আবার বৃষ্টি।হাসিনার রাত থাকতে ওঠা অভ্যাস।ভোর না হতে দুই মেয়েকে নিয়ে পদ্ম তুলতে যায় ও বিলে। শহরে বৃহস্পতিবার করে পদ্ম বেশী যায়, তার জন্য সোম থেকে বুধবার ওদের কাজ বেশী। আর ক’দিন পরেই দুগ্গাপুজো কে বলবে? এবছর চাষের সময় বৃষ্টি হল না, হালিফ মিঞা গরজ শেখের বীজ সব নষ্ট হয়ে গেল।একে একফালি জমিতে চাষ,তাও বৃষ্টি নেই। ওদের পদ্ম না তুললে একদিন ও চলবে না।বৃষ্টির মধ্যে হলেও।প্রাণপণে আল্লাহর কাছে দোয়া চাইতে থাকে হাসিনা।”আজ একটু রোদ্দুর দিয়ে দাও আল্লাহ।” এত বৃষ্টিতে সাপ -পোকামাকড়ের কাটার সম্ভাবনা আরও বেড়ে যায়।মেয়ে দুটোকে ডাকতে মায়া লাগে হাসিনার।একটা কাঁথা ভাগ করে ঘুমিয়ে আছে খাদিজা আর আমিনা।ওদের বাপ দাওয়ায় গুটিয়ে শুয়ে আছে। বৃষ্টির ঝাপটা আসছে তো।ঘরে দুটো মেয়ে শুলে, আর হাসিনা শুলে জায়গা হয় না। মেয়ে দুটো একটা এগারো,একটা তেরো হল।ওদের সঙ্গে গা ঘেঁষে অস্বস্তি হয় গরজের।ওদেরও নিশ্চয়ই হয়।হাসিনা দুই মেয়েকে টেনে তোলে।ভোরের আগেই পদ্ম পৌছাতে হবে স্টেশনে।ওখান থেকে রশিদ চাচা নিয়ে যাবে পদ্ম।পঞ্চাশ টা পদ্ম তুললে পঁচিশ টাকা দেয়।তার জন্য কত বৃষ্টি মাথায় করে যাওয়া।ওই টাকাটা হলেও যে কত কাজে লাগে কাকে বোঝাবে হাসিনা?তিন জনে গেলে একটু সাহস বাড়ে। সাপ খোপ আছে।কে জানে ভোরের আলো ফোটার আগে রাস্তায় ঘাপটি মেরে থাকতে পারে ভুলু শেখ। খাদিজার উপরে ওর চোখ। গরজকে ডাকতে ইচ্ছে করে না।লোকটা একটা কাশি তে ভুগছে গত পাঁচ মাস। ওরা তিন জনে আল্লাহর নাম করে বেরিয়ে পড়ে। এই গ্রামে আরো চার পাঁচ জন পদ্ম তোলে।মালতীর দুই বোন,সুহাসিনী রা মা-ঝি। যারা আগে গিয়ে তাড়াতাড়ি ফুল তুলে নিতে পারবে,তাদের সেদিন রোজগার।তাড়াতাড়ি পা চালায় হাসিনা।বৃষ্টির মধ্যে হাঁটতে থাকে।মাঝে মাঝে থমকে থমকে দাঁড়িয়ে ছাতার তলায় হ্যারিকেনের আলোয় চারিদিক তাকায়।হঠাৎ যেন কার উপস্থিতি টের পায় হাসিনা।পিছন থেকে খাদিজার পিঠের উপরে হাত রাখে ভুলু শেখ।খাদিজা চিৎকার করে ওঠে ভয়ে।ভুলু শেখ খ্যাক খ্যাক করে হাসে। “বাপরে,এক্কেরে ভয় পেয়ে গেলি বড়। ও হাসিনা,তোর মেয়ে যে এমনিই বড় হল রে,এত ভীতু এখনো।আমি কি ভুত নাকি?” “কী দরকার তুমার?” হাসিনা বলে ওঠে। “তোদের কষ্ট দেখে রাতে ঘুম হয় না রে ! নিকা করিয়ে দে আমার সঙ্গে খাদিজার। রোজ আর পদ্ম তুলতে আসতে হবে না। তাছাড়া হিঁদুদের পুজোর জন্য পদ্ম তুলে পাঠাস,আল্লাহ পাক কখনো মাফ করবে না তুদের।”
“থাক্…আল্লার ভাবনা আল্লাকে ভাবতে দাও।তুমার বয়স দেখেছ? পঞ্চাশ বছরের বুড়া,আমার বিটি কে বিয়ে করবে? বিটিটা কে মারব না কি?যাও তুমি পথ দেখ।”
“তুরা মরবি,এই বলে রাইখলাম,হিঁদুদের ফুল পাঠিয়ে তুরা মরবি।” চলে যায় ভুলু।
ওরা একে একে জলে নেমে পড়ে গাছতলায় ছাতা আর হ্যারিকেন রেখে।
“রশিদ চাচা,আরেকটু বেশি পয়সা দাও।আমরা শুনেছি একেকটা পদ্ম দশ টাকা,বারো টাকায় বিক্কিরি হয়।”
“যা যা,বেশি সেয়ানা হয়ে গেছিস,”
পঁচিশ টাকা হাতে গুঁজে দিয়ে রশিদ হনহন করে চলে যায়।ওরা তিনজন মুড়ি,ছাতু কিনে বাড়ি ফেরে।সকালের খাবার টা হয়। বেশি জল দিয়ে ছাতু মেখে মুড়ি খায় ওরা।পেটে বেশিক্ষণ থাকবে।
“আজ খাদিজার জামা ধরে টানায়,খাদিজা খুব চমকে,ছিটকে গিয়েছিল বলে; ওর জামাটা খানিকটা ছিঁড়েছে”; হাসিনা সেলাই করতে বলে।গরজ শেখ ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে।
আজ রোদ্দুর উঠেছে।আর চারদিন পর দুগ্গা পুজো।আজ বৃষ্টি না হলে ফোটোক দিদিমণি গুলা আসবে।সকাল থেকে মন ভালো খাদিজাদের। শহর থেকে ছবি তুলতে আসে ওরা।জলে শরীর ভাসিয়ে পদ্ম ধরে বেশ হেসে তাকাতে পারে ওরা দুই বোন। দিদিমণিরা মালতীদের ছবি তুলতে চায় না।ওদের টা বেশি তোলে। নজেন দেয়,বিস্কুট দেয়,পঞ্চাশ -একশো টাকাও দেয়।ওর মধ্যে একটা মোটাপানা দিদিমণি আছে,জয়ী দিদি,ও সবসময় একশো টাকা দেয়,আবার খাবার ও দেয়। ওরা সকাল ছটা থেকে গিয়ে বসে আছে ঝিলের ধারে।দিদিমণিদের দল এলো আটটার সময়,খুব খিদে পেয়েছিল আমিনার। ছুটে গেল জয়ী দিদির কাছে।বিস্কুটের প্যাকেটটা খুলে গোগ্রাসে খেল দুজন।এবার জলে নামার পালা।ছবি তোলা হল।তারপর জল থেকে উঠে ওরা ছবি গুলো দিদিমণিদের ক্যামেরায় দেখলো। কী সুন্দর দেখাচ্ছে ওদের!জয়ী দিদি দুটো ছিটের জামা বের করল। বলল ‘পুজো তে পরিস। ওরা বলল, ‘ঈদে পরব।’
“যখন প্রাণে চায় পরিস।”
জয়ীকে ওরা অন্য সময় গ্রামে ঘুরতে নিয়ে যায়।জয়ী দিদি জেলে দের ছবি তোলে, তাড়ি কাটার ছবি তোলে,পোকার ছবি তোলে। দেখে তো ওরা আগে হেসে অস্থির হত।
জয়ী একটা ছবি ফেসবুক পোস্ট দেয় : “সব শিশু কন্যার মধ্যে এক পবিত্র সরলতা দেখা যায়,শিউলির মতো।”
আজ অষ্টমী । ওরা দুজনে আজই নতুন জামাটা পরে নিয়েছে।একটু পরে মালতীদের সঙ্গে ওদের পাড়ার প্যান্ডেলে যাবে।আজ সকাল থেকে এত পদ্ম তুলেছে ওরা  যে গায়ে শ্যাওলা পড়ে গেছে।মালতীরা এলে ওরা হাঁটা দেয় প্যান্ডেলের দিকে। হাসিনা বুঝিয়ে দেয় বারবার,”কিছু ছুঁসনি।” ওরা প্যান্ডেলে ঢোকে না। একটু দূর থেকে দেখে।তারপর সবাই মিলে কিতকিত খেলা শুরু করে বেলা গড়িয়ে আসে।আজ এখানে ভিখারি ভোজন আছে।দুজনে বসে পড়ে খেতে। খেয়ে দেয়ে আবার ওরা ভাঙা মন্দিরের ওখানে লুকোচুরি খেলতে যায়। সন্ধ্যে হয়ে যায়। মালতী বলে “এবার চল,মা বকবে।” আমিনাও দিদির হাত ধরে টান লাগায়। একটা মাঠের পরে মালতীরা অন্য পাড়ায় চলে যায়।আমিনারা বাড়ির দিকে পা বাড়ায়।হঠাৎ খাদিজার পায়ে কি কামড়ায় যেন। ‘মাগো ‘ বলে বসে পড়ে খাদিজা।আমিনা বলে ‘আপু,সাপ নয়তো? ‘ খাদিজা জোরে জোরে কাঁদতে থাকে।আমিনা ছুট লাগায় আম্মি কে ডাকতে।হাসিনা মেয়ের ডাকে পাগলের মতো ছুটতে ছুটতে আসে।কোথাও নেই খাদিজা।গরজ আসে অসুস্থ শরীরে।গ্রামের আরও লোক আসে।নাহ্ কোথাও নেই খাদিজা।দুদিন পরে মন্দিরের ভাঙা দেউলে শুধু শরীর পড়ে থাকে,নতুন জামাটা ছেঁড়াখোঁড়া।ভুলু শেখ,সবাই কে বলতে থাকে, ‘দেখো দেখো হিঁদুর জন্য পদ্ম পাঠাতো,তাই মন্দিরে মরে পড়ে রয়েছে,হিঁদুর পুজোয় নতুন জামা পরেছে তাই আল্লাহ ওই জামা ছিঁড়ে নিয়েছে।” ভুলুর থেকে ওদের মতো গরীব লোকেদের অনেকের অনেক ধার। তারা সবাই ওই একই কথা বলতে লাগলো। “এ কাজ তুমি ঠিক করোনি গরজ।আল্লাহর কাছে গুনাহ করেছ। আল্লাহ গুনাহ মাফ করেননি।” হাসিনা মেয়ের নিথর দেহ শাড়ি পরিয়ে,আলতা পরিয়ে দুগ্গার মতো সাজায়।জয়ী দিদি এসেছে হঠাৎই। হাসিনা বলতে থাকে “একটা ফোটোক তুলে দাও তো মেয়েটার।দেখবো তোমাদের দুগ্গার সঙ্গে মেলে কি না।”
 ফটো তোলা হয়।এ বছরের সেরা ছবির নমিনেশন। “সব গলে যাওয়াই বিসর্জন।মানুষের রক্ত ভিজে শরীর গলে যাওয়া যেমন।”
 হাসিনা এখন শহরে বাসন মাজে।বস্তিতে থাকে।নিজের হাতে ভুলুর সাথে আমিনাকে বিয়ে দিয়ে যে কটা টাকা আদায় করেছে তা দিয়ে বস্তিতে ঘর নিয়েছে।একটা পুরোনো কালার টিভি ও।ও মেয়েও মরবে জানে। অত বুড়োর অত্যাচারে বাঁচবে না কি?
বরটা আগেই মরেছে।হাসিনা এখন টিভি দেখে।ছিরিয়াল।ছিরিয়ালে অনেক খারাপ খারাপ মা দেখায়।হাসিনা ওদের মতো হতে চায় রোজ রোজ।আর নামাজ পড়ার সময় রোজ দোয়া চায়।ছোট মেয়েটা মরুক,সবাই জানুক – ওর মেয়েদের খুনি কে? নামাজের সময় কী পবিত্র দেখায় ওর চোখ মুখ!
লেখক-মৌমিতা ঘোষ
পুকুরঘাট

পুকুরঘাট

একদিন আমরা মাত্র কয়েকজন সদস্য নিয়ে পুকুরঘাট নামের একটি মেয়েদের ভার্চুয়াল দল খুলে ছিলুম। অচিরেই সে কয়েকটি সদস্যের দল কয়েক হাজার সদস্যের মেয়েদের দল হয় ওঠে। পুকুরঘাট দলের মত এত গুণী মেয়েদের সমাহার বাংলাদেশে খুব কম ভার্চুয়াল দলে আছে। কাজেই সেই দল সেখানেই আটকে থাকবে না বলা বাহুল্য। তাই পুকুরঘাট দলের অন্যতম উদ্যোগ হিসেবে প্রকাশিত হলো পুকুরঘাট পত্রিকা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

5 thoughts on “দোয়া

  1. অসাধারণ। বাস্তব বড় মানবিক চেহারায় ধরা দিয়েছে।