পুতুল রানির সংসার

পুতুল রানির সংসার

 

তন্বী হালদার

 

ডিমান্ড। সাপ্লাই। ক্যাপিটাল। রানি ভাবছিল। অনেক দিন আগে পাঠ্য বইয়ে পড়ে আসা শব্দগুলো মাথার ভেতর ঢালা উপুড় করছিল রানি। সাপ্লাই কম থাকলে ডিমান্ড বাড়বে। আবার ক্যাপিটাল যদি স্থির মানে ধ্রুবক হয় তাহলে সাপ্লাই বাড়ানো অসুবিধা। তাহলে জীবনের সব ক্ষেত্রেই এই ডিমান্ড, সাপ্লাই আর ক্যাপিটালের সমীকরণটা কি সমানুপাতিক বা ব্যস্তনুপাতিকের জটিল অঙ্ক! না একটা ধাঁধাঁ। কিংবা চোখে দেখতে না পাওয়া ভীষণ কোনো আবেগ। তা ভালো খারাপ দুইই হতে পারে। কিন্তু এসব বইয়ে পড়া ডুবজল চৈতন্যের সাথে একটু পিপাসা মেটানোর জলের জন্য আকচাআকচি লড়াইয়ের আদৌ কোনো সম্পর্ক আছে! না কি না থাকলে কেড়ে খাও এই থিওরিই ঠিক যুক্তিবাদ আর ভাববাদ সব যেন ঘেটে “ঘ” হয়ে যাচ্ছে রানির

চায়ের জল চাপানো গ্যাসে সেটা বেমালুম ভুলে অর্থনীতি এবং দর্শনের মায়াজলে এক হাঁটু ভিজিয়ে  দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভেবে যাচ্ছে রানি জল শুকিয়ে চায়ের সস প্যানের  চড়চড় আওয়াজ আর স্টিলের বাসনের পোড়া গন্ধে বিছানা থেকে দৌড়ে গিয়ে গ্যাস বন্ধ করে রজত। মনে মনে বিরক্ত হয় রজত। রানির এই যে থেকে থেকে ভাবরাজ্যে বিচরণ করা এটা মোটেই ঠিক না। 

বিয়ের তিন চারদিন পরেই রজতের মা বলেছিল, “বাবাই এ কাকে বিয়ে করে আনলি রে! মাথায় ছিট নেই তো?” 

রজত যখন ঘটনাটা মায়ের মুখে শোনে তখন নিজেরও মনে হয় সত্যি এর মাথা খারাপ নেই তো। রজতদের পুরোনো আমলের বাড়ি। প্রত্যেক ঘরে বেশ দু’তিনটে করে ঘুলঘুলি আছে আর সেই ঘুলঘুলিতে চড়ুই পাখি বাসা বাঁধে। টিকটিকি ডিম পাড়ে। রানি প্রথম দিনই বলেছিল, “এই জানো তোমার থেকেও তোমাদের বাড়িটা বেশি সুন্দর। কি সুন্দর সব ঘরে ভেন্টিলেটর আছে। আমাদের তো ফ্ল্যাট বাড়ি তাই ওসবের বালাই নেই। কেমন ঢাকনা দেওয়া চৌকো বাক্সের মতো” 

রজতের কানে কথাটা খটকা লাগলেও এক্কেবারে নতুন বৌকে কিছু বলতে পারেনি। কাজের মেয়ে ঝুলঝাড়ু দিয়ে কি একটা উঁচু থেকে নামাতে গিয়ে ভেন্টিলেটার থেকে কতগুলো টিকটিকির ডিম ফেলে দিয়েছিল। কিন্তু মাটিতে পড়ে ফেটে যাওয়া টিকটিকির ডিমের ভেতরকার লতপতে বস্তুটিকে দেখলে ঘৃণা উদ্রেকের বদলে কেউ হাপুস নয়নে কাঁদতে পারে এমনটা কেউ কোনোদিন দেখেছে বা শুনেছে বলে রজতের জানা ছিল না। কিন্তু বাস্তবে সত্যিই এই ঘটনাটা ঘটেছে। আর এই ঘটনাটা মিসেস রজত ঘটিয়েছে। 

রজত কিছু বলবার আগে রানি বলে ওঠে, “আচ্ছা শোনো, একটা দেশের আপামর জনসাধারণের উন্নতি করতে গেলে, ভর্তুকী দেওয়া ভালো সব কিছুতে না কি জনসংখ্যা কমানো ভালো” 

রজতের রাগের ঝাঁঝে কে যেন ওডিকোলোন মাখিয়ে দেয়। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, “চা খাবে? বানাবো?” 

বিস্ফারিত নেত্রে লাফ দিয়ে ওঠে রানি সরির বন্যা বইয়ে দেয়। “আরে আমি চা বসিয়েছি তো” বলে রান্নাঘরমুখো যেতে গেলেই বাধা দেয় রজত। একটু গম্ভীর ভাবেই বলে, “জল পুড়ে গেছে। ঐ সসপ্যান জলে ডুবিয়ে এসেছি স্টিলের বাসন পোড়ার গন্ধ পাওনি?” 

বার কয়েক নাক-চোখ মুখ কুঁচকে শ্বাস প্রশ্বাস নেয় রানি কিন্তু গন্ধ পায় না। রজতকে খুশি করতে বলে, “হ্যাঁ তো একটু একটু পাচ্ছি” 

রজত বলে, “বসো আমি করে আনছি” 

রানি বলে, “একটু বেশি করে করো। তুলির বাবা বিমান কাকু আজ বিকেলে আসবেন বলেছেন”

রজত এবার একটু ঝাঁঝিয়েই বলে, “উনি আমাদের ঘরে কিছু কি খান? সেদিন আম পোড়া সরবত নিয়ে কত সাধাসাধি করলে, খেলেন উনি?” 

রানি বিছানায় বসে মাথা নাড়ে। নিজের মনে বিড়বিড় করে, “দ্যাটস আ ভাইটাল পয়েন্ট। শুধু উনি কেন বাড়িওয়ালার নাতনী সেদিন সত্যনারায়ণের প্রসাদ দিতে এসেছিল, সেও কিছুতেই খেল না। কিন্তু কেন 

রানিরা পুরুলিয়া আসার পর প্রথম থেকেই পুতুল ওদের কাজ করে। প্রায় রানিরই সমবয়সি। ছোটোখাটো আঁটোসাটো চেহারার মেয়ে। মুখটা একটু চ্যাপ্টা আর চৌকো ধরনের। নাকে নীল রঙের পাথরের নাকচাবি। তিনটি ঝুরি আছে নাকচাবিটায়। তড়বড়িয়ে কথা বললে বা খিলখিল করে হাসলে নাকের ঝুরিগুলো দোলে। সিঁথিতে চওড়া করে সিঁদুর পরলেও টিপ পরে না পুতুল। রানি একবার খয়েরি রঙের এক পাতা টিপ দিলেও নেয়নি। বলে, “ও আমি পরিনে। লাজ লাগে বটে” 

বাঁ হাতের বাহুতে অলচিকি ভাষায় কি যেন উল্কি করা। রানি একদিন জিজ্ঞাসা করেছিল, “কি লেখা গো ওটা?’ 

শুনে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে পুতুল, “ও শুনতে হবেক লাই তুকে। শরমের কথা বটে” 

কি এমন শরমের কথা শোনবার আগ্রহ থাকলেও স্বভাবজাত সৌজন্যে আর জিজ্ঞাসা করেনি রানি

 

রজতের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বিয়ের পরেই বলেছিল বৌকে বাড়ির লোকের সঙ্গে খুব বেশি ভিড়তে দিলে বিয়েটা টিকবে না। মেয়েটা অন্যায় কিছু করে না ঠিকই কিন্তু এমন কিছু করে যা সংসারে ঠিক কেউ করে বলে মনে হয় না। তাই আর একদম দেরি না করে নতুন বৌকে বিয়ের একমাসের মধ্যেই নিজের কর্মস্থলে নিয়ে এসেছিল। সারাদিন অফিসের কাজে ব্যস্ত থাকে রজত। প্রথম দিকে খুব খারাপ লাগতো। বেচারিকে সারাদিন একা থাকতে হয়। কি করে যে সময় কাটাবে! 

এটা যে সময়ের কথা তখন মুঠোফোন তো অনেক দূর, ঘরে ঘরে ফোনও আসে নি। রানির টিভি দেখার নেশা নেই। বই পড়তেও ভালো লাগে না। সমস্যার সমাধান করে দেয় পুতুল  

রজতকে একদিন খুব উচ্ছ্বসিত হয়ে রানি জানায়, “এই জানো পুতুলেরও না নতুন বিয়ে হয়েছে’’

রজত কি যেন একটা বলতে গিয়েও কথাটাকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে বলে, “ভালোই তো ওর থেকেও একটু বরকে আদর করার নতুন নতুন টিপস শিখে নিও তাহলে। তবে তুমি আবার যেন নিজের গল্প করতে যেও না। শত হলেও তুমি মনিবপত্নী” 

আপাত সরল কথাটায় ফুঁসে উঠেছিল রাণী 

“তার মানে? পুতুল কি আমাদের ক্রীতদাসী নাকি!” 

সেদিন সত্যিই বিরক্ত হয়ে উঠেছিল রজত। কোথাকার কে পুতুল তার জন্য ঝগড়া করছে রানি 

রানি গলা খুলে ঝগড়া করতে করতে বলে, “আসলে পুতুল, আমি, তুমি, পুতুলের বর ধনচাঁদ সবাই আমরা একদম প্যারালাল লাইনে কিন্তু পাশাপাশি চলেছি আর তাই আমরা কেউ কাউকে কোনোদিন ছুঁতে পারবো না। মনিব আর ক্রীতদাসের গল্পটা চলতেই থাকবে”। 

সে রাতে বৌয়ের দিকে পেছন ফিরে শুয়ে একসঙ্গে ইউনিভার্সিটিতে পড়া পাপিয়ার কথা বারবার মনে হয় রজতের। 

পুতুল প্রতিসপ্তাহে দু’বার করে পায়ে আলতা পরে । ওর পা’দুটো সবসময় লাল টুকটুক করে। আর বেশ মোটা চাঁদির নূপুর। ঝমঝম করে আওয়াজ হয় হাঁটলে। হাঁটে তো না যেন খরগোশের মতো দৌড়ে দৌড়ে কাজ করে। পুতুল দু’দিন ছুটি নিলে রানির ভেতরটা যেন হাঁফ ধরে যায়। 

পুরুলিয়া জেলা সদরে ওরা যে পাড়াটায় থাকতো তার নাম ছিল “নাপিত পাড়া” জাত ধর্ম দিয়ে এরকম করে জায়গার নাম হলে কেমন অশুচি অশুচি লাগে। প্রথম প্রথম তো কোনো বন্ধুকে ঠিকানাই দিতে চাই তো না রানি পুতুলের দেখাদেখি রানিও মাঝে মাঝে পায়ে আলতা লাগায়। পুতুলই পরিয়ে দেয়। পরিয়ে দিয়ে প্রতিবারই বলে, “কি সোন্দর লাগেরে তুকে রাঙা পায়ে। যেন ভাদু বিটিটোর পা দু’খানি” 

রান্নাঘরে জাবর কেটে বসে বিকেলবেলার চা খায় রোজ রানি আর পুতুল পুতুল তাকে এই মানভূম অঞ্চলের কত রকম গল্প শোনায়। চুলে তেল লাগিয়ে লম্বা বিনুনি বানিয়ে দেয়। মাঝে মাঝে লুডুও খেলে 

সবই চলছিল দুলকি চালে। কিন্তু গোল বাঁধলো মনসা পুজোর হাঁসের মাংস খাওয়া নিয়ে পুতুলদের বাড়ির পরে টাঁড় জমিটা কুমীরের পিঠের মতো কিছুটা উঁচু লম্বা মতো হয়ে দক্ষিণ দিকের যে বাবুপাড়ার নাবাল জমিতে মিশে গেছে সেখানে নাকি খুব জাগ্রত মনসা মন্দির আছে। এ দিন অনেক হাঁস বলি হয়। বাবুপাড়ার ভদ্রলোকেরা যে হাঁস মানত করে সেগুলো বলির পরে আর নিয়ে যায় না। ওগুলো পুতুলদের ভেতরেই ভাগ-বাঁটোয়ারা হয়। 

রানি শুনে বলেছিল, “আমি কোনো দিন হাঁসের মাংস খাইনি” 

কিশোরী সুলভ চপলতায় পুতুল বলে, “খাবি দিদি। আনি দিব আমি। আমি রান্ধি আনলিয়ে তু খাবি তো বটে?” 

রানির বিস্ময়ের সীমা থাকে না। বলে, “আরে কেন খাবো না। নিশ্চয় খাবো” 

বাড়িওয়ালার নাতনী না অন্য কোনো ভাড়াটে কাকে যেন রানি হাঁসের মাংস খাওয়ার পুলক ধরে রাখতে না পেরে গল্প করে ফেলে পর দিন পুতুল কাঁদতে কাঁদতে এসে বলে, ‘‘দিদি তু’কে হামি এত ভালোবাসি আর তু উদেরকে বইলে দিলি বটে যে হামি তুকে হাঁসের মাংস রেন্ধে এনে খাঁওয়ানছি” 

রানি পুতুলের কথার মুন্ডু বুঝতে না পেরে রেগেই যায়। 

 

“হ্যাঁ বলেছি। কি হয়েছে তাতে?’’ 

পুতুল বুঝতে পারে রানির অজানা সরলতা। তাই দম ধরে রাখা কান্নাটা ঠিকরে বেরিয়ে আসে গলা দিয়ে গোঙানির মতো হয়ে, “হামরা ছোটো জাত আছিরে। ডোম বটে। অচ্ছুত আছিরে” 

পুতুলের দিকে আগুন চোখে তাকিয়ে থাকে রানি রাগে মনেহয় সমস্ত শরীর যেন দাবানল হয়ে গেছে। পুতুলের হাত ধরে টানতে টানতে ঘরে নিয়ে এসে বলে, “এই তুমি আজ আমার সঙ্গে এক টেবিলে বসে ভাত খাবে” 

ধনুকের ছিলার থেকে তূণ বেরিয়ে যাওয়ার মতো হাঁকপাঁক করে ওঠে পুতুল হাতজোড় করে চোখের জলে নাকের জলে একাকার হতে হতে বলে, “নাই পারবোক হামি নাই পারবোক বটে। তু বুইঝতে পারছিস না বটে হামার সুংগে তুরাও এক ঘরে হবি বটে” 

রানিরও জেদ তখন অষ্টমে, “হই হবো। যা খুশি হয় হবে। তোমাকে খেতেই হবে” 

শত চেষ্টাতেও পুতুলকে চেয়ার টেবিলে বসানো যায় না। শেষ পর্যন্ত পর্বত মহম্মদের

 কাছে আসার মতোই রানি পুতুলের সঙ্গে মেঝেতে বসে। 

খাওয়া কি আর হয়। কোনোরকমে দুটি ভাত মাথায় ঠেকিয়ে পুতুল বলে, “পেসসাদ 

খেলুমরে দিদি আজ। ভগমানের পেসসাদ” 

 

ছোট্ট একটা ঘটনা এতদূর যেতে পারে তা ভাবতেও পারেনি রানি তার ধারনার বাইরে ছিল চারপাশের সব কিছু এত ক্লেদাক্ত থকথকে। মানুষের একে অপরের প্রতি ঘেন্নার বিষ উগলানোর এত ঝাঁঝ। আপাত দেখা মানুষটার মনের ভেতর জটিল গিটের ধাঁধাঁ। বাইরে থেকে ঝকমকে মুখ দেখলে কে বলবে ভেতরে এই মানুষটারই ভীমরুলের শরীরের মতো মিশকালো অন্ধকার আর হুল ফোটানো বিষ। 

রজতকে রাস্তায় প্রায় পাকড়াও করে বিমানবাবু। একদম চাঁছাছোলা কণ্ঠে বলে, “এসব আপনার বৌ কি শুরু করেছে রজতবাবু। আপনারা কলকাতার মানুষ আপনাদের কাছে মানামানির বিচার না থাকতে পারে। আমাদের আছে। আর সেটা তো আপনাদের জন্য ফেলে দিতে পারি না” 

রজত কিছু বুঝতে না পারলেও বৌভাতের পরদিন টিকটিকির ডিম ফাটার ঘটনাটা মনে পড়ে যায়। মাথার ভেতর কিরকিরে একটা রাগ তেঁতুলবিছের মতো চলতে থাকে। 

বিমানবাবু জানায়, “দেখুন আপনাদের কাজের মেয়ে জাতে ডোম। অচ্ছুৎ। তাকে আপনারা কাজে রেখেছেন, ভালো কথা। সে আমাদেরও কাজের লোক না আসলে, ওকে ডেকে বাইরের কাজ করিয়ে নেয় আমার গিন্নি। কিন্তু কখনোই ঘরে ঢুকতে দেয় না। আমাদের কোনো বাসনে খেতে দেওয়ার প্রশ্নও ওঠে না। কিন্তু আপনার বৌ ঘরের ভেতর ঢুকিয়ে ছোঁয়াছুঁয়ির দফারফা করে ছেড়েছে। আমরা তাই আপনাদের হাতে মানে ঘরে জলটুকুও খাই না। কিন্তু হাঁসের মাংস যা কিনা পুতুলদের ঘরে রান্না তাই খেয়েছে আপনার বৌ। আপনি মশাই বৌকে শাসন করুন। রাশ টানুন। আমার বৌ হলে তো চুলের মুঠি ধরে টানতে টানতে রাস্তায় বের করে দিতাম” 

রজতের মনে হয় সমস্ত শরীর মনে কে কালমেঘ বেটে দিয়েছে। 

ঘরে ঢুকতেই রানি হাসিমুখে বলে, “এই দেখো আমি আজ নিজে নিজে পায়ে আলতা পরেছি” 

রজত সেদিকে না তাকিয়ে বলে, “তোমাকে এইসব রঙ মাখলে সঙের মতো কুৎসিত লাগে” 

রানি কিছু বুঝে উঠতে পারে না। কোনোরকমে বলে, “এসব কি বলছো তুমি?” 

রজত আগ্নেয়গিরির মতো ফেটে পড়ে, “যা বলছি ঠিক বলছি। তুমি কি ঐ কাজের মেয়েটা হতে চাও?” রানির মুখটা চেপে ধরে বলে, “এই মাগী তুই কেন খেয়েছিস বল ঐ পুতুলের ঘরের হাঁসের মাংস?’’

রানি কোনোরকমে উ উ করে আওয়াজ বের করে গুঙিয়ে গুঙিয়ে বলে, “আমার লাগছে” 

রজত দাঁতে দাঁত ঘষে বলে, “কেনরে ওর বর কি যেন নাম ধনচাঁদের সঙ্গে শোওয়ার ইচ্ছা আছে? নতুবা আশপাশে এত মানুষ থাকতে তোর ঐ ঝি মাগীর সঙ্গে এত পিরিত করা কেন”

রানি কোনোরকমে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে হা করে তাকিয়ে থাকে রজত নামে একটা লোকের দিকে যাকে সে স্বামী বলে জানে। যাকে সে শরীর মন দিয়েছে 

 

পরপর তিনদিন পুতুল কাজে আসেনি। রানি দুপুরবেলা টুক করে ঘরে তালা লাগিয়ে একটা রিক্সা নিয়ে ডোমপাড়ার দিকে যায়। বেশ খানিকটা আগে নেমে যায়। মিনিট দশেক হেঁটে একে ওকে জিজ্ঞাসা করতে করতে পুতুলের ঘর পর্যন্ত চলে যায়। তিন চারবার পুতুল পুতুল বলে ডাকলে ভেতর থেকে পুতুল বেরিয়ে আসে। পুতুলকে দেখে চমকে ওঠে রানি। এ কে! সারা মুখে নীল কালশিটে পড়া। ডান চোখের নিচে ফুলে আছে। ঠোঁটেও ক্ষত। পুতুল রানির হাত ধরে হিড়হিড় করে নিজের ঝুপড়ির ভেতর ঢুকিয়ে নেয়। ফিসফিস করে বলে, “কেনে ইসেছিস ইখানে? কেউ জানলে সব্বোনাশ হবেক” 

রানি ঘোলাটে গলায় বলে, “এগুলো কিসের দাগ পুতুল? কে মেরেছে তোমাকে?” 

পুতুল ঘরের অন্য দিকে তাকিয়ে বলে, “হামার বর” 

“কেন?” বলে রানি চোখের জল ধরে রাখতে পারে না। 

পুতুল রানির মুখের দিকে তাকিয়ে করুণ হাসে, বলে, “তু বড়ো ভালো দিদি। বড়ো সরল বটে। তুকে হাসের মাংস খাওয়াইছি বুলে হামার বরের জরিমানা হইয়েঁছে বটে। ই জন্য উ হামাকে পিটাইছে” 

ডুকরে কেঁদে ওঠে রানি। পুতুলের হাত দুটো নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে চুপ করে বসে থাকে কিছু সময়। 

একসময় পুতুল বলে, “তু যা দিদি। জানবরটার আসবার সময় হতিছে” 

রানি আঁচলে চোখ মুছে বলে, “তুমি আর কাজে যাবে না” 

আঁতকে ওঠে পুতুল, “জরুর যাবো বটে। রোজগার না করলি উ হারামিটো ফের ঘরে অন্য লোক ঢুকাইবার চেষ্টা করবেক। লিজের পায়ে দাঁড়ানোটো খুব দরকার বটে। তবে তুর ঘরে আর কাজ করতি লোকে দিবে কিনা জানিনারে” 

রানির যেন পুতুলের কথাগুলো বিশ্বাস হয় না। 

“কি বলছো পুতুল! তোমার স্বামী টাকার জন্য অন্য লোক ঢুকিয়ে দেয় ঘরে!” 

পুতুল আর কিছু বলতে দেয় না রানিকে। একরকম ঠেলেই বের করে দেয়। 

 

আরও তিনদিন পার হয়ে গেছে। পুতুল কাজে আসে না। রানি নিজেই সব করে। এমনকি নিয়ম মাফিক রজতকে শরীরও দেয়। 

রজতই একদিন বলে, “বিমানবাবুর বৌকে বলেছি, একটা কাজের লোক দেখে দিতে। সব কাজ করলে আমার সুন্দরী বৌটার শরীর নষ্ট হয়ে যাবে না?” 

রানি কিছু না বলে স্বামীর দিকে তাকিয়ে থাকে। বলে, “চা খাবে?” 

এখন আর সে চায়ের জল বসালে ভুলে যায় না 

রজত কিছুটা স্বগতোক্তির মতো বলে যায়, “কি করবো বলো, এখানে জাতপাতের এত সমস্যা। আমাদের তো বিমানবাবুদের সাথেই চলতে হবে তাই না?’’ 

রানির খুব বলতে ইচ্ছা করে, “কেন? আমরা তো পুতুলদের সাথেও চলতে পারি”। 

আর তখনই ডিমান্ড, সাপ্লাই, ক্যাপিটালের ইকুয়েশানটা মনে পড়ে যায়। ক্যাপিটাল বেশি থাকলে ডিমান্ড কম থাকলেও সাপ্লাই ঠিক বা বেশিই থাকবে। পুতুলদের শ্রমের ক্যাপিটাল তাই অচ্ছুৎ করে রাখলে মানে মূলস্রোতে ভিড়তে না দিলে ডিমান্ড কমবেশি যাইহোক সাপ্লাই অনায়াসে পাওয়া যাবে। চিরকালীন শোষণ প্রক্রিয়া।

রান্নাঘর থেকে রানি চা নিয়ে আসলে রজত বৌকে দু’হাতে কাছে টেনে নেয়। বলে, “তোমাকে একটা খুব বড়ো দায়িত্ব দেব। সামনের সপ্তাহে শুক্রবার রাঁচীতে আমাদের কোম্পানীর এনুয়াল পার্টি। জি.এম. আসবে। তোমাকে কিন্তু জি.এম.কে একটু খুশি করতেই হবে” 

রানি স্থির দৃষ্টিতে তাকায় স্বামীর দিকে, “কীভাবে?” 

রজত বৌয়ের থুতনি ধরে বলে, “সে আমি কি করে বলবো। হাসি গল্পে হয়ে গেলে ভালো নতুবা…… বুঝতেই পারছো চার বছর এক পোস্টে ঘষ্টাচ্ছি। এবার দেখি বৌয়ের ভাগ্যে শিকে ছেঁড়ে কিনা” 

রানি বলে, “আমি একটু বাইরে বের হবো”। 

বিমান “আচ্ছা যাও” বলে হাজার টাকা দেয় রানির হাতে। বলে, “বিউটিপার্লার ঘুরে এসো। উফ এ ক’দিন কোথাকার পুতুল পুতুল করে কি ছিরি করে রেখেছো নিজের”।

 

রানি এসটিডি বুথে ঢুকে ভালো করে দরজাটা আটকে দেয়। বিয়ের আগে একটা বাচ্চাদের প্লে-স্কুলে কাজ করতো সে। ব্যাগের ভেতর থেকে ফোনের নাম্বারের ডায়েরিটা বের করে। স্কুলের বড়দির ফোন নাম্বারে ফোন করে। 

ওপাশ থেকে “হ্যালো” বললেই, রানি বলে ওঠে, “বড়দি আমি রানি” 

বড়দি “কেমন আছিস” বলবার আগেই রানি বলে ওঠে, “শোনো না আমার জায়গায় লোক নিয়ে নিয়েছো তোমরা?” 

বড়দি “না” বলতেই রানি কান্না চাপা গলায় বলে, “প্লীজ নিও না। আমি তিন চার দিনের ভেতর গিয়েই আবার জয়েন করছি” 

বড়দি আবার “কেন রে কি হয়েছে” বলবার আগেই ফোন রেখে দেয় রানি। ব্যাগের ভেতর বিউটি পার্লারের খরচ এক হাজার টাকাটার কথা ভেবে একটু মুচকি হাসে। ট্রেন ভাড়া হয়ে যাবে।  

তন্বী হালদার

পুকুরঘাট

পুকুরঘাট

একদিন আমরা মাত্র কয়েকজন সদস্য নিয়ে পুকুরঘাট নামের একটি মেয়েদের ভার্চুয়াল দল খুলে ছিলুম। অচিরেই সে কয়েকটি সদস্যের দল কয়েক হাজার সদস্যের মেয়েদের দল হয় ওঠে। পুকুরঘাট দলের মত এত গুণী মেয়েদের সমাহার বাংলাদেশে খুব কম ভার্চুয়াল দলে আছে। কাজেই সেই দল সেখানেই আটকে থাকবে না বলা বাহুল্য। তাই পুকুরঘাট দলের অন্যতম উদ্যোগ হিসেবে প্রকাশিত হলো পুকুরঘাট পত্রিকা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *