মেয়ে জীবনের ভাষ্য-মেয়েলি ভাষা

মেয়ে জীবনের ভাষ্য-মেয়েলি ভাষা

রুমা মোদক

 

অভিযোগটি অর্জুনের লক্ষ্যভেদী তীরের মতো আমার দিকে ছুটে এসেছিলো যেদিন, সেদিনই প্রথম আমি সচকিত হয়েছিলাম ব্যাপারটি নিয়ে। বেশ আগে। বছর ত্রিশ হবে।এর আগে আমি সত্যি তলিয়ে ভাবিনি বিষয়টি নিয়ে। শব্দটি আমার জন্য প্রয়োগ করেছিলো আমার এক বন্ধু,লিংগে পুরুষ। এক বন্ধুর ছোটবোনের বিয়ে নিয়ে আমার কৌতুহল ছিলো এমন! বিরক্ত পুরুষ বন্ধুটি বলেছিলো, একদম মেয়েদের মতো করে করছো  প্রশ্নগুলো।”মেয়েদের মতো”! আমি একদম প্রতিক্রিয়াহীনভাবে তার অভিযোগের মর্ম উপলব্ধি করেছিলাম। সৎ স্বীকারে সুস্পষ্ট পার্থক্যটা নির্ণয়  করেছিলাম। কাকে বলে ‘মেয়েদের মতো’, ঠিক কী বললে তাকে বলে মেয়েলিপনা। কথায় কিংবা আচরণে মেয়েদের আলাদা ভাষা থাকে। মেয়েলি ভাষা। সাধারণে তাই বলে। আক্রমণে বলে,নেতিবাচকতায় বলে। মেয়েদের মতো কথা বলোনা।

মেয়েরা কী ভাষায় কথা বলে? সেকি আমাদের নিত্যদিনের ব্যবহার্য ভাষা থেকে আলাদা কোন ভাষা?  আলাদা বর্নমালায় গড়া? কেনোই বা সে ভাষা ‘মেয়েলি ভাষা’ বলে আলাদা হয়ে যায়? এই মেয়েলি ভাষার ব্যবহার কেন আমাকে কিংবা মেয়েদেরকে আলাদা করে দেয় নেতিবাচক অর্থে? এর কারণ শুধুই লিঙ্গ বিশেষে উদ্দেশ্য প্রণোদিত কোন বৈষম্য? নাকি সমাজ ও ব্যবস্থা আরোপিত অনস্বীকার্য বাস্তবতা। ব্যবস্থায় অংকুরিত বীজের অনিবার্য ফলন। মেয়েরা কেন শুধুই “মেয়ে”? কেন মেয়ে কেবলই ন অর্থক শব্দ? মেয়েকেই কেন বলি মেয়ে নয়, মানুষ হও? মেয়ে কি তবে মানুষ নয়?

আমি লিংগ পরিচয়ে নারী। প্রাকৃতিক ভাবে নারী। জৈবিকতায় নারী। মেয়ে। ব্যক্তিগত ভাবে আমার সকল সম্ভাবনা এবং সীমাবদ্ধতা নিয়ে আমি কখনোই অস্বীকার করিনা, করতেও চাইনা আমি নারী কিংবা মেয়ে। বরং এই নারীত্ব নানা কারণে আমার অহংকার। কিন্তু তবুও আমি অন্য নারীর সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারিনা।মেয়েলি ভাষায় কথা বলতে পারিনা। এটা আমার ইগোও নয়, অক্ষমতাও নয়। অন্য নারী যে আমার সাথে তাল মিলিয়ে যেতে পারেনা, এটা তাঁরও অযোগ্যতা নয় , অহমিকাও নয়। আমি বরং স্বভাবজাত কারণ আবিষ্কার করি এবং বিবেচনাসম্মত সিদ্ধান্ত নিতে পারি।ফলে সে নারী যে মেয়েলি ভাষায় কথা বলে তাকে মোটেই করুণা করিনা,দোষ দেয়ারতো প্রশ্নই উঠেনা।বরং তাঁর সীমাবদ্ধতা আমাকে অপরাধী করে দেয়। পুরো সিস্টেমকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দেয়।আমাদের পারিবারিক, সামাজিক,ধর্মীয় মূল্যবোধ আর প্রথাগত ব্যবস্থা বিবেচনা করলে মেয়েদের এই ‘মেয়ে’ হয়ে থাকার কারণগুলি স্পষ্ট চিহ্নিত করা যায়। চিহ্নিত করা যায় তাকে মানুষ হয়ে উঠতে বলার প্রবণতার উৎস।

তার আগে দেখি মেয়েরা কি ভাষায় কথা বলে, যাকে আমরা বলছি ‘মেয়েলি ভাষা’। মূলত তাদের সে ভাষা অধিকাংশ ক্ষেত্রে সীমায়িত থাকে শাড়ি গয়না গাড়ি বাড়ি সংক্রান্ত বৈষয়িক লক্ষনগণ্ডীতে। সে লক্ষনগণ্ডী পোক্ত হয় স্বামীদের প্রতিষ্ঠাগত অবস্থানে।তারপরের ধাপে সন্তান কেন্দ্রিকতা আর সবশেষে আলোচনা উপসংহারে যায় পড়শী, পরিচিত দের হাড়িখুড়ি খুঁটে ভেতরের সত্য-অসত্য নানা রঙের কাহনে। মেয়েদের আড্ডা মানে তাই এক বহু বর্নিল ট্যাবলয়েড।সত্য মিথ্যায় মাখামাখি, মুখোরোচক।আর  মেয়েলি ভাষা তার অনুগামী। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মানুষের সংকীর্ণ অভ্যাস,হীনতা, হীনমন্যতার আকর এসব মেয়েলি আসর। এখানে জ্ঞান নেই, বিজ্ঞান নেই, দর্শন নেই। সমাজ, রাষ্ট্র কিচ্ছু নেই। সৃষ্টিশীলতা নেই, এমনকি সমাজ সংসারের জন্য দায়ও নেই।

একসময় দৈনিক পত্রিকায়, ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় মেয়েদের জন্য আলাদা পৃষ্ঠা ছিলো, ছিলো আলাদা বিষয়। আর সেসব বিষয় আশয় আয়োজন ছিলো ফ্যাশন, সাজগোজ আর রান্নাঘরে সীমাবদ্ধ। এমনকি মেয়েদের লেখা সাহিত্যও স্থান পেতো শুধুই মেয়েদের পাতায়। সেসবের ভাষা ছিলো আলাদা। কিংবা আলাদা ভাষার কারণেই সম্পাদক -পাঠক মহলে এ লেখাগুলো পরিগণিত হতো মেয়েদের লেখা বলে।আরেকটি খুব প্রচলিত বক্তব্য, মেয়েরাই মেয়েদের শত্রু। শাশুড়ি বঊয়ের কিংবা বউ শাশুড়ির। পড়শি বধুটি পড়শী বধুর। ননদ – ভাবির, কিংবা ভাবি- ননদের।নারীদের যতো অশান্তি অসুখের সমীকরণ অধিকাংশই নারীতে নারীতে।

এর দায় কী কেবল নারীরই? মেয়েরই? প্রশ্নটি আমি আমার শ্রেণিকক্ষে ছুঁড়ে দেই। আমাদের এই পশ্চাৎপদ সমাজে একটি মেয়ে যেভাবে বড় হয়, তার বাস্তব প্রেক্ষিত দেখি। স্কুল, কলেজ কিংবা কর্মজীবন শেষে মেয়ের জন্য চারদেয়ালের বন্দি জীবন। রান্নাবান্না, কাটাকুটি। ঘর-গেরস্থালী। সংসার- সন্তান। বড়জোর ঘরের অন্য নারীর শ্যেনদৃষ্টি, বাক্যবাণ। পুকুরঘাট থেকে রান্নাঘর, হালের হোয়াটস আ্যাপ,ম্যাসেঞ্জার। সময়, প্রযুক্তি এগিয়ে যাচ্ছে।নারী তাল মেলাতে পারছে না, কিংবা তাকে তাল মেলাতে দেয়া হচ্ছেনা। সে পরে আছে কূপমণ্ডূকতায়, প্রথাবদ্ধ গণ্ডিতে।চ্যানেলে চ্যানেলে যে সিরিয়ালের হাজার পর্ব, তারও বিষয় সেই সংকীর্ণ ঈর্ষা,হিংসা,পরশ্রীকাতরতা।

নারীর জন্য অবকাশ কই?  সুস্থ ভাবনার,সৃষ্টিশীল চর্চার? কোথায় গেলে সে পায় নিজেকে সমৃদ্ধ করার উন্মুক্ত মাঠ? আছে কি কোথাও?

একটি ছেলে কিংবা পুরুষ যেভাবে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে পারে বিশ্ববীক্ষণে। চা খানায়, মাঠে ময়দানে তুমুল আড্ডায়। ক্লাবঘর, স্টল,রেস্টুরেন্ট কিংবা পাড়ার মোড়ে হুমড়ি খেয়ে পড়া দৈনিক পত্রিকার হালনাগাদ সংবাদে। তার জন্য যতোটা খোলা পৃথিবী, জানা পৃথিবী, অজানা পৃথিবী মেয়েদের জন্য ততোটাই অবরুদ্ধ। এই মেয়ে ঘরে ঢুকেই শুনছে, জানছে দেখছে মা-চাচীর কটুকথা। পাড়া পড়শি নারীর গায়ে পড়া কৌতুহল। এতোসব হীনতার পাহাড় ডিঙিয়ে সুযোগ  কই তার নিজের জগত গড়ার, নিজেকে গড়ার। উচ্চ মানসিকতার সৃষ্টিশীল জগত গড়ার? আমরা তাকে গড়ে উঠার সামান্য সুযোগ না দিয়েও তার ভাষাকে অপরাধী করছি মেয়েলি ভাষা বলে। তার অযাচিত আচরণকে হেয় করছি মেয়েলিপনা বলে!

নিশ্চয়ই ব্যক্তি মানুষের হোক সে নারী কিংবা পুরুষ তার নিজস্ব দায় রয়েছে মানুষ হয়ে উঠার। সকল সুকোমল বৃত্তির উন্মেষের অনুকূলে নিজেকে পরিচালিত করা। কিন্তু বাইরে বাদ থাকুক ঘরের জগতই বা তার জন্য কতোটা নিরাপদ নির্ভীক করে রাখা হয়েছে মেয়ের জন্য যে সে তার নিজের ভুবন গড়বে! ধর্ষণ, নিপীড়ন,নির্যাতন অভিধানের এই শব্দগুলো তো নারীর জন্যই প্রযোজ্য কেবল।চোখের সামনে কতো মেধাকে বিসর্জিত হতে দেখলাম জীবনসঙ্গী, পরিবার কিংবা সমাজের যুপকাষ্ঠে। কতো সম্ভাবনাময় নারী শিল্পী, নারী অভিনেত্রী, নারী লেখক নিজের প্রচন্ড ইচ্ছা আর চেষ্টাকে ভাসিয়ে দিলেন শুধু অন্যের ইচ্ছায়।

অর্থনৈতিক স্বাধীনতা তাঁকে নিজের ইচ্ছে পূরনের সামর্থ্য দেবে আমাদের সমাজে এও বড় জটিল অংক। মূল্যবোধ বদলায়নি,দৃষ্টিভঙ্গি বদলায়নি অর্থনৈতিক প্রয়োজনে যে নারী বেরিয়ে এসেছে বাইরে তার ঘাড়ে মরার উপর খাড়ার ঘায়ের মতো চেপে বসে সবদিক দুহাতে সামলানোর দায়। এ হয়তো শুধু লাঘব করেছে তার আধিপত্য হারানোর অনিশ্চয়তা। যেমনটি এক প্রজন্ম আগেও চরম ছিলো বউ শাশুড়ির দ্বন্দ্বে।

হায় মেয়েজন্ম! জন্মই তাঁর আজন্ম পাপ। তবু সব প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে বের হয়ে আসে যে মেয়ে, আসতে পারে সে সেই মেয়েদের কথা বলুক, যে বলতে পারেনি তার না পারার কারণ। মেয়ের মেয়েলি ভাষা হোক তার জীবনেরই বিশ্বস্ত ভাষ্য।নিশ্চয়ই মানুষের কিছু দায় থাকে মানুষের জন্য। নারী হোক কিংবা পুরুষ। সক্ষম ও সফল নারী তার দায় বোধ করুক।

রুমা মোদক

বাংলাদেশ

 

পুকুরঘাট

পুকুরঘাট

একদিন আমরা মাত্র কয়েকজন সদস্য নিয়ে পুকুরঘাট নামের একটি মেয়েদের ভার্চুয়াল দল খুলে ছিলুম। অচিরেই সে কয়েকটি সদস্যের দল কয়েক হাজার সদস্যের মেয়েদের দল হয় ওঠে। পুকুরঘাট দলের মত এত গুণী মেয়েদের সমাহার বাংলাদেশে খুব কম ভার্চুয়াল দলে আছে। কাজেই সেই দল সেখানেই আটকে থাকবে না বলা বাহুল্য। তাই পুকুরঘাট দলের অন্যতম উদ্যোগ হিসেবে প্রকাশিত হলো পুকুরঘাট পত্রিকা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

4 thoughts on “মেয়ে জীবনের ভাষ্য-মেয়েলি ভাষা

  1. অতন্ত্য বাস্তবিক ও অপরিহার্য লেখা সর্বকালের জন্য। এমন অকপট ও শাণিত লেখনীকে কুর্নিশ জানাই। অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে।

  2. বেশ ভাল লাগল। বাস্তব পটভূমিকায় স্পষ্ট কথন।