অব্যহতি/চার পর্বের গল্প/ শেষ পর্ব

অব্যহতি/চার পর্বের গল্প/ শেষ পর্ব

অব্যহতি

সুপর্ণা ভট্টাচার্য

মা,
    ভালো আছি। আমার এই বাড়িতেও একটা ছাদ আছে। অফিস থেকে ফিরে স্নান করে ছাদে এসে দাঁড়াই। আমার তোমার কাছ থেকে আর তারা দের চেনা হলোনা। সব তারাই আমার কাছে একরকম। শুধু কোনোটা ছোটো দেখি,কোনোটা বড়ো। এখানকার হাসপাতালটা অনেক সুন্দর,পরিচ্ছন্ন,গোছানো। হাসপাতালে প্রথম থেকে কাজ করতে করতে আর অন্য কোথাও কাজ করতে ইচ্ছা হয়না। প্রথম প্রথম ওষুধ,ফিনাইল,ক্লোরোফর্ম,বিভিন্ন অসুখের গন্ধে অস্বস্তি হত। এখন কিছু মনে হয়না। একমাত্র তোমার জন্য আমাকে ছুটি নিয়ে যেতে হবে।বাবা,জ্যাঠামশায়ের মুখ এখন আর একটুও মানুষের মতো লাগেনা। কেমন শকুনের মতো মনে হয়। এতো টাকা কার জন্য গচ্ছিত রেখে যাবে বলোতো?তুমি যে কেন টেনে বের করে আনতে পারোনা নিজেকে। ভালোবাসা তো কখনো ছিলনা। তাহলে?অবশ্য ভালোবাসা থাকলেও নিজেকে টেনে বের করতেই হয়। এটা তুমি বুঝতে পারবেনা। আমি বুঝি। উপচে পড়া ভালোবাসাও বড়ো অসহনীয়।
এখান থেকে একদিন তাজমহল দেখতে যাব। আগ্রা তো আর বেশি দূর নয়। তুমি কাঁদো জানি। এ চিঠি পড়তে পড়তেও কাঁদবে,জানি। এবার একটা মোবাইল ফোন কিনে দিয়ে আসব তোমাকে। কোনো বারণ শুনব না। আস্তে আস্তে অভ্যস্থ হও। কথা বলব। তোমার ওই ভাষা শুনতে খুব ইচ্ছা করে। স্বাতী তারাকে দেখো। ওটা আমিই।
                            মামণি।
সার্থক,অনন্যদের নিয়ে গ্রামে পৌঁছায়। অনন্য,সুস্মিতা আর প্রদীপ। তাদের গ্রামের জল সরে গেছে। ফসলের ক্ষতি হয়েছে বেশ। বুভুক্ষু মানুষ এখন সর্বত্রই। তাই অনন্যদের ত্রাণের জিনিস নিমেষে বিলি হয়ে যায়।
সার্থক নিজের জমানো টাকা সব তুলে এনেছে ব্যাঙ্ক থেকে। বাবার হাতে দিয়ে যাবে। বাবার কেমন শূন্য দৃষ্টি দেখল সার্থক। মায়ের মুখে এখন বয়সের ছাপ বোঝা যাচ্ছে।
অনন্যরা আজ রাতে থেকে যাবে। মা কোনরকমে রান্না চাপিয়াছে। খিচুড়ি আর বেগুন ভাজা। তাদের ক্ষেতের বেগুন। মা তুলে রেখে গিয়েছিল মাচায়। ছাদের নীচ বরাবর মাচা করা আছে। কারেন্ট নেই। রান্নাঘরে একটা লম্ফ জ্বলছে। অনন্যরা মোমবাতি এনেছিল। তাই জ্বলছে ঘরের কোণে। এটা সার্থকের ঘর। একটা চৌকি আছে আর গোটা দুই প্লাস্টিক চেয়ার। ছোটো টেবিল একটা। ঘরের সামনের দাওয়ায় সা
সুস্মিতা গান গাইছে,’তুমি বন্ধু কালা পাখি,আমি যেন কী/বসন্ত কালে তোমায় বলতে পারিনি’
বলতে পারা যায়না যে কত কিছুই।
অনন্য অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে বলে,’সার্থক,আমরা খুব ছোট জায়গা ধরে ধরে কিছু করতে পারিনা?’
‘যেমন?’
‘এই ধর,তোর এই গ্রামটা,বা অন্য কোনো গ্রামে আমরা,তোর বাবার মতো চাষীদের পাশে থাকতে পারিনা?’
‘থেকে?’
‘আমাদের পার্টি অফিসে কথা হচ্ছিল সেদিন। সরাসরি চাষীদের থেকে ফসল বিক্রি করার চেষ্টা করার ব্যাপারে। বীজধান ঠিকঠাক বন্টন করার ব্যাপারে। ‘
‘এসব ভাবতে ভালো। করতে গেলে কিন্তু হাতে হ্যারিকেন’
‘আচ্ছা সার্থক,তোর সব কিছুতে এতো নেগেটিভ ভাবনা কেন বলত?’
‘পজেটিভ কিছু দেখতে পাইনা বলে’
‘উফফ,আরে এক জায়গায় থেমে থাকলে তো মুশকিল’
‘অনন্য,সত্যিই যদি আমাদের কিছু করতে হয়,তাহলে আঘাতের জন্য তৈরী থাকতে হবে। সেটা কিন্তু বেশ কঠিন’
সুস্মিতা গান শেষ করে কথা শুনছিল ওদের।
খুব মিঠে গলা সুস্মিতার। ছিপছিপে,কালো ধারালো ইস্পাতের মতো মেয়েটা।
‘সার্থকদা,আমার দাদাকে পিটিয়ে মেরে আধমরা করে দিয়েছিল,ভোটের প্রচারের জন্য দিনরাত এক করে দিয়েছিল বলে। একমাস হাসপাতালে থেকে বাড়ি ফিরেছিল। একটা পা টেনে টেনে চলে। তবু,এখনও ব্লগ লেখে,ছোটো ছোটো জমায়েত করে কথা বলে। চে গুয়েভারার ছবি পড়ার টেবিলে এখনও যত্ন করে রাখা। কী বলবে তুমি দাদাকে?নিজের সঙ্গে নিজের যুদ্ধটা যে সব থেকে জরুরী সার্থকদা। ‘
‘আসলে কী জানো মা,আমাদের সব ভরসাটা চলে গেছে ধীরে ধীরে। কেমন একটা গা ছাড়া ভাব হয়ে আছে আমাদের। দান নিতে আর লজ্জা লাগেনা। মানুষের শক্ত হাত নেই আর আশ্বাস দেওয়ার জন্য। ‘
সার্থকের বাবা অন্ধকারের মধ্যে থেকে কেটে কেটে বলেন।
খিচুড়ির গন্ধ ভাসে ঘরের মধ্যে।
স্বাতী ঠিক যেসময় মাকে চিঠি লিখছিল,ঠিক সেসময় সার্থক অনন্যদের সঙ্গে খেতে বসল।
স্বাতী অর্ধেক সময়ই খিচুড়ি বানাত। রান্না করা পছন্দ করত না। সংক্ষেপে সারত। সঙ্গে গোল গোল আলু ভাজা।
সার্থক খিচুড়ি মুখে তুলতে পারছে না। এমন তো হওয়ার কথা ছিল না। এলাহাবাদ যাওয়ার অনেকটা আগে থেকেই তো স্বাতী আর ছিলনা তার সঙ্গে। তখন তো এতোটা খালি লাগেনি!অনেকটা দূরে চলে গেছে বলেই কী এমনটা মনে হচ্ছে!
রামকিঙ্কর বেইজের কথা মনে পড়ে। অপার প্রেমে নিবেদিত কোমল মণিপুরী রাজকন্যাকে নির্মম হৃদয়ে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন যিনি। কাজে মনোনিবেশ করতে পারবেন না বলে,অথচ আমৃত্যু যন্ত্রণায় দগ্ধ হয়েছেন। রাজকন্যা বিনোদিনী ভরা সংসারের মধ্যেও সুখী হতে পারেন নি,স্বাতীরও কী তেমন জীবন হবে!
ধুসসস,কী সব আবোলতাবোল ভাবছে!সে তো জীবনেও ঋষি শিল্পী হতে পারবেনা। এই গ্রাম,এই পরিবারের অংশ হতে পারত না স্বাতী। তার জীবনটা চেনা খাতে বইবে না। এ তো নিশ্চিত।
‘অনন্য,আমরা তাহলে এই পাথরপ্রতিমায় একটা সেন্টার করি। এদের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে না থাকলে,এদের জানতে পারবিনা। রোটেশনালি যাতায়াত করব কয়েকজন মিলে। ‘
অনন্য ঝলমল করে ওঠে। জড়িয়ে ধরে সার্থককে।
সার্থক রান্নাঘরে যায়।
মা আর বাবা খেতে বসেছে। লম্ফর শিখার স্তিমিত আলো দুজনের মুখে। কেমন অপার্থিব। কেমন অচেনা।
সার্থকের গলার কাছে ব্যথা করে।
‘মা,এবার থেকে মাঝেমধ্যে আসব’
খেতে খেতে মুখ তোলে মা।
‘আসিস। ‘
‘স্বাতী,আমরা বড়ো আলাদা। দুই পৃথিবীর। প্রেম হয়ত মুক্তি তেই। বন্ধন আমার জন্য নয়। এলাহাবাদের ত্রিবণী সঙ্গমে একদিন যেও। গঙ্গা,যমুনা,সরস্বতী আলাদা আলাদাভাবে এসে মিলেছে। ওই সঙ্গমই ধ্রুব। তোমার বুকে একটি তিল আছে। ওই তিলটি আমি। আমরা গোপনে থাকব। সেই অনিত্য। একদিন বহু বহু বছর পর দেখা হবে,সে আকাঙ্ক্ষা থাক। ‘
সার্থকের এই মেসেজ পড়েই মুছে ফেলে স্বাতী।
আলতো হাত রাখে বুকের তিলটিতে।
স্বাতীর মা মেয়ের কথা ভেবে কয়েক ফোঁটা জল ফেলে বালিশের কোলে।
সার্থকের মা আজ গভীর ঘুমায়।
সার্থক খাতা বের করে অনন্যদের জন্য কাস্তের মতো চাঁদ আঁকে,অনন্ত নীল আকাশে।
Nila Banerjee

পুকুরঘাট

একদিন আমরা মাত্র কয়েকজন সদস্য নিয়ে পুকুরঘাট নামের একটি মেয়েদের ভার্চুয়াল দল খুলে ছিলুম। অচিরেই সে কয়েকটি সদস্যের দল কয়েক হাজার সদস্যের মেয়েদের দল হয় ওঠে। পুকুরঘাট দলের মত এত গুণী মেয়েদের সমাহার বাংলাদেশে খুব কম ভার্চুয়াল দলে আছে। কাজেই সেই দল সেখানেই আটকে থাকবে না বলা বাহুল্য। তাই পুকুরঘাট দলের অন্যতম উদ্যোগ হিসেবে প্রকাশিত হলো পুকুরঘাট পত্রিকা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

One thought on “অব্যহতি/চার পর্বের গল্প/ শেষ পর্ব

Others Episodes