অব্যাহতি/ চার পর্বের গল্প/প্রথম পর্ব

অব্যাহতি/ চার পর্বের গল্প/প্রথম পর্ব

অব্যাহতি-পর্ব ১

সুপর্ণা ভট্টাচার্য

 

 

 

আজ স্বাতী চলে গেল। সার্থক যাবে ভেবেছিল একবার হাওড়া স্টেশন। আ্যলার্ম দিয়ে রেখেছিল। পাঁচটা পাঁচে ট্রেন। আ্যলার্ম বেজে বেজে থেমে গেল।সারাটা রাত চোখ মেলে থেকে থেকেও বিছানা ছেড়ে উঠল না। স্বাতী হয়ত ভেবেছিল,সে একবার অন্তত যাবে। হয়ত আর কখনও দেখা হবেনা তাদের। কেমন একটা কষ্ট আর আনন্দ মেশানো মনের ভাব হয়ে আছে কাল রাত থেকে। ছবি আঁকেনি। শুধু ছবি দেখছিল। ঘন্টার পর ঘন্টা। যে কয়েকজনের ছবি তার কাছে বড়ো আশ্চর্যজনক মনে হয়,তাদের আঁকা ছবি।সেই সব ছবি দেখতে দেখতে সে অন্য এক জগতে চলে যায়।যে জগতে ঘুরে বেড়ালে নিজের পিঠের দুপাশে দুটো ডানা থাকার অনুভব হয়। মাটিতে পা থাকে না। শরীরটা হালকা হয়ে যায়। একটা সময় সারা ঘরে রঙের বন্যা হয়ে যায়। সে ডানা মেলে উড়ে বেড়ায়। রঙ লেগে যায় মুখে,বুকে,পেটে। হাত আর পায়ের রঙ দ্যাখে চোখের সামনে এনে। মাথার কোষে কোষে ঘোরে টুকরো ছবির কোলাজ। সার্থক কাঁদে। যে কান্না কাঁদলে ভার শূন্য হয়ে যায়। একসময় ক্লান্ত হয়ে বিছানায় এসে শুয়েছিল। কিন্তু ঘুম আসেনি।
ভোরবেলা একটা কাক এসে বসে জানলার ওপর। রোজ। এসে লাফায় না। ডাকে না। চুপ করে বসে থাকে। সার্থক একটু মুড়ি দেয় বা বাসি রুটির টুকরো।
কাকটা খায়। জুলজুল করে তাকায় সার্থকের মুখের দিকে। তারপর উড়ে যায়।
আজও এসেছে।
সার্থক উঠে বসে বাবু হয়ে বিছানার ওপর।
স্বাতী চলে যাচ্ছে। ট্রেনের চাকার শব্দ নিয়ে যাচ্ছে সব মান,অভিমান। সত্যিই এভাবে চলে যাওয়া যায়!চাইলেই?
আজ কাকটা বসেই থাক। কিছু খেতে দেবেনা সার্থক । কষ্ট দেবে ওকে। ইচ্ছা করে। কাকটা কেমন স্থির।
সার্থক বালিশের পাশ থেকে ড্রইং খাতাটা নেয়। যাতে সে হিজিবিজি আঁকে। এ ক্যানভাস নয়। এ খাতা ডায়েরীর মতো। পেনসিল প্রাণ পায় বিষণ্ণ কাকের রেখা আঁকতে আঁকতে। পিছনে সকালটা বোঝাতে চায় সার্থক প্রাণপণে,পেন্সিলের হালকা শেডে। খোলা জানলার পাল্লাটা ফুটে ওঠে পৃষ্ঠায়। কাকটার চোখের মণিতে অবাক ভাব। হঠাৎ উড়ে যায় কাকটা। ছবিটা শেষ হয়না। সার্থকের গা শিরশির করে ওঠে। শীত আসছে।
সামনের আয়নায় তার মুখের ছবি। চিত্রকররা বহু বহু বছর আগে আয়নায় দেখে দেখে প্রতিকৃতি আঁকত। ছবি দেখে দেখে নয়।তখন তো ফটোগ্রাফি ছিলনা। আয়নায় কী ভিতরের ভাবটা ফুটে ওঠে বেশি?স্বাতীর এলাহাবাদ পৌঁছাতে কত দেরী হবে?সার্থক জানতে চায়নি এলাহাবাদ পৌঁছানোর সময়টা। স্বাতী অনায়াসেই ফ্লাইটে যেতে পারত। কিন্তু গেলনা। সার্থককে বলে গেল,’আমার কোনো তাড়া নেই পৌঁছানোর। দীর্ঘ পথ মানুষ দেখতে দেখতে,মাঠ,ক্ষেত,পুকুর,দিঘী,বাড়িঘর দেখতে দেখতে যেতে চাই। ‘
‘তোমার এসি কামরায় তো জানলা বন্ধ থাকবে স্বাতী’
‘সেই কাঁচের ভিতর দিয়েই দেখব। কবে আর স্বচ্ছ ভাবে কিছু দেখতে পেলাম বলো?’
‘দেখতে চাইলে না বলো’
‘তা বটে। দেখতেই চাইলাম না। এই যে তুমি ছবির মধ্যেকার রহস্যের কথা বলো,আমি তা দেখতেই পাইনা। চাইনা বলেই মনে হয় দেখতে পাইনা। আমি যে পোট্রেটে সৌন্দর্য দেখি,ঘন কালো বা সমুদ্রের মতো নীল অথবা সবুজ,বা কফির মতো কালচে বাদামী চোখের মণিতে খুশি দেখি,তুমি সেখানে বিষাদ খোঁজো’
‘বিষাদ থাকে স্বাতী। আমি দেখতে পাই’
‘ আমি তো শিল্পী নই সার্থক। সমালোচনা করার স্পৃহাও নেই। আমি ঔজ্জ্বল্য দেখি। আমার মন শান্ত হয় তাতে’
‘বিদ্রূপ করছ!’
‘না। দুজনের অবস্থান বোঝাতে চেষ্টা করছি মাত্র’
সার্থক স্বাতীর মুখের মধ্যে রাগ দেখতে পেয়েছিল। সে কথা বললে,স্বাতী  স্বীকার করবে না ।
স্বাতীকে একদিন চলে যেতেই হবে। এ সার্থক প্রথম দিন থেকেই জানত।
হেমন্তকাল।বড়ো প্রিয় ঋতু সার্থকের। বারান্দায় এসে দাঁড়ায়।আকাশে হালকা মেঘ। এ সময়ে বৃষ্টি হলে তো ধানের সাড়ে সব্বোনাশ। শীষে সবে পাক ধরতে শুরু করেছে। ইসস,তাদের গ্রাম এই অসময়ে বৃষ্টি হলে আবার ভাসবে।এবছরটা বেশ নির্বিঘ্নে কাটছিল। খবর টবর তো শোনেই না।খবরের কাগজ তো কোন কাল থেকেই বন্ধ। ফোনটাও অবসাদের জন্য দিন তিনেক চার্জ বিহীন পড়ে আছে। বৃষ্টি হওয়ার ঘোষণা আছে কিনা জনেনা সে।
বাড়িতে ফোন করা উচিত একবার। দ্রুত চার্জে দেয় ফোনটা।
এক নেশাগ্রস্থর মতো টানে  তাকে,তার গ্রাম। পাথরপ্রতিমা। ঠাকুরান নদীর বাঁধ ভাঙে প্রতিবছর। নোনাজল দাপিয়ে ঢুকে পড়ে ধান ক্ষেতে। জমি জিরেতে। ম্যানগ্রোভ গাছগুলোর মাথাও ডুবে যায় । ছোটবেলায় আরো উঁচু বাঁধের ওপর উঠে যেত সকলে। নাহলে স্কুল বাড়ি। এখন তবু কিছু কিছু শেল্টার হয়েছে। ভারী বৃষ্টি বা ঝড় আসার  আগাম সতর্ক বার্তা হয়। অনেক মানুষ এখন সাহায্য করে,সে যে কোনো কারণেই হোক।
ফোন করে সার্থক বাড়িতে। খানিকটা চার্জ হয়েছে।
‘বৃষ্টি হচ্ছে বাবা?’
‘এখনও হচ্ছে না। তবে হবে’
‘আবার ভাসবে সব’
‘ভাসবে। অসময়ের বৃষ্টি। ঝড়ও হবে’
‘ধান,,,’
‘কোটালের জল ঢুকলে পাব না কিছু’
‘মানুষের কষ্ট বাড়বে’
‘আমাদের ও’
‘আমাদের কষ্ট তো সারাজীবন’
‘মায়ের সঙ্গে কথা বলবি?’
‘থাক। পরে বলব’
‘কবে আসবি?’
‘দেখি’
‘ভাবছি,ছাগল গুলো নিয়ে রিলিফ সেন্টারে চলে যাব’
‘তাই যাও। তারপর যা হওয়ার হবে’
‘হ্যাঁ। জল নামলে আসিস একবার’
‘আসব’
বাবার কাঁচা পাকা দাড়ি ভর্তি মুখ মনে পড়ে। খটখটে দুটো হাত। পায়ের আঙুল গুলো মাটিতে হেঁটে হেঁটে মাটিরঙ। মায়ের টানটান মেদহীন শরীর। মা এখনও কত খাটতে পারে। সার্থক নামটা মা রেখেছিল। বেশি লেখাপড়া শেখেনি মা। তবু মা জানে,বোঝে অনেক কিছু। কথা কম বলে। যেটুকু বলে,তা বড়ো শক্ত ভাবে বলে। এড়িয়ে যাওয়া যায়না।
তার নিজের ওপর কেমন ঘেন্না হলো। জলে জঙ্গলে বড়ো হওয়া সে কেন পড়ে আছে এখানে। কিসের আশায়!
অজান্তেই হঠাৎ ফোন করে স্বাতীকে।
সুইচড অফ।
হঠাৎ সারা শরীর অবশ হয়ে গেল সার্থকের। বিজবিজে ঘামে ভিজে উঠল মুহূর্তে।
কেমন ফাঁকা হয়ে গেল ভিতরটা।
হারিয়ে ফেলছে সে তার গ্রাম,তার নদী,তার ক্ষেত খামার,ঘর দুয়ার,তার প্রেম।
ছবির ক্যানভাসের মতো নিপাট সাদা লাগছে নিজেকে।
রঙ ভরাতে হবে। পৃথিবীর রঙ।
চায়ের জল বসিয়ে ভাবল সার্থক,বেঁচে থাকাটাই প্রতি মুহূর্তে সত্যি।
সুপর্ণা ভট্টাচার্য
Nila Banerjee

পুকুরঘাট

একদিন আমরা মাত্র কয়েকজন সদস্য নিয়ে পুকুরঘাট নামের একটি মেয়েদের ভার্চুয়াল দল খুলে ছিলুম। অচিরেই সে কয়েকটি সদস্যের দল কয়েক হাজার সদস্যের মেয়েদের দল হয় ওঠে। পুকুরঘাট দলের মত এত গুণী মেয়েদের সমাহার বাংলাদেশে খুব কম ভার্চুয়াল দলে আছে। কাজেই সেই দল সেখানেই আটকে থাকবে না বলা বাহুল্য। তাই পুকুরঘাট দলের অন্যতম উদ্যোগ হিসেবে প্রকাশিত হলো পুকুরঘাট পত্রিকা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

One thought on “অব্যাহতি/ চার পর্বের গল্প/প্রথম পর্ব

Others Episodes