আফগান কন্যাদের কথা

আফগান কন্যাদের কথা

ঈশিতা ভাদুড়ী

 

বিষণ্ণ সূর্যাস্তের রঙ / লাল ছিল,/ রক্তাভ…/ এমন কী আমার দুঃস্বপ্নের রঙ / সবই লাল, / রক্তবর্ণ, রক্তাভ লিখেছেন যে কবি, তাঁর নাম লায়লা সারাহাত রুশানি, একজন আফগান কবি। ১৯৫২ থেকে ১৯৫৪-র মধ্যে কখনও জন্মগ্রহণ করেছেন, কাবুলের উত্তরে পেরওয়ান প্রভিন্সের রাজধানী চারিকারে। ১৯৭৭এ কাবুল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হন। তাঁর বাবা সারশার রুশানি সাংবাদিক ছিলেন, ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টি মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল সারশার রুশানিকে। সারাহাত রুশানি কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। 

ও আমার হৃদয়! আমি জানি বসন্ত অস্তমান, এবং তার আনন্দও, / কিন্তু কীভাবে আমি উড়তে পারি এই উপড়ে-নেওয়া ডানা দিয়ে লিখেছেন যে কবি, তাঁর নাম নাদিয়া আঞ্জুমান, একজন আফগান কবি। ১৯৮০ সালের ২৭শে ডিসেম্বরে উত্তর-পশ্চিম আফগানের হেরাট শহরে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৯৫ সালের সেপ্টেম্বরে তালেবানরা যখন হেরাট দখল করে, তখন মেধাবী ছাত্রী হওয়া সত্ত্বেও নাদিয়ার স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল ক্লাস টেনে পড়ার সময়।

একসময় শত শত আফগান মেয়েদের স্কুলে যাওয়ায় বাধা ছিল, স্কুল পোড়ানো, বিষ খাওয়ানো, মুখে অ্যাসিড নিক্ষেপ করা থেকে শুরু করে হত্যা, অপহরণ সবই করা হতো। ফলত বেশির ভাগ মেয়েদেরই ভবিতব্য ছিল স্কুলে যাওয়া বন্ধ, কিন্তু সেই অবস্থাতেও লক্ষ লক্ষ বালিকা/ কিশোরী ভাঙা বিল্ডিং, তাঁবু, এবং উন্মুক্ত মাঠকে স্কুল জেনেছে এবং সাহসের সঙ্গে লেখাপড়া চালিয়ে গেছে, সেলাই স্কুলে সেলাই শিখতে যাওয়ার নাম করে গোপনে তাদের শিক্ষা জারি রেখেছিল ইউনিভার্সিটির প্রফেসরদের তত্ত্বাবধানে। বাইরে বাড়ির বাচ্চাদের খেলাধুলোর নামে পাহারায় রাখতো, টহলদার এলেই যাতে তারা সাবধান করে দিতো, তখন বিদ্যার্থীরা বই-খাতা সরিয়ে সেলাইয়ের সরঞ্জাম সামনে রাখতো। বিষয়টি যদিও খুবই বিপজ্জনক ছিল, ধরা পড়লে চরম নির্যাতন, এমন কী ফাঁসিও হতে পারতো। 

শুধু কিশোরী বা বালিকা নয়, সমস্ত আফগান মেয়েদেরই যাবতীয় অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে বারংবার। তখন মেয়েদের উচ্চস্বরে হাসার বা সশব্দে হেঁটে যাওয়ার বা নিজের মনের কথা বলার অধিকার ছিল না। নিজের মনের ভাব প্রকাশে বহু মেয়েই কবিতাকে মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছিল। যদিও কবিতা লিখলেও নারীরা সম্পুর্ণভাবে স্বাধীনতা কখনওই পান নি। প্রেম ও সৌন্দর্য বিষয়ে কোনও নারীর কবিতা লেখাও পরিবারের পক্ষে অবমাননাকর আফগানিস্তানে।

নিজের মনের ভাব প্রকাশে তাই লায়লা বা নাদিয়ার মতো মেয়েরা কবিতাকে মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছিল। তালেবানরা ক্ষমতা থেকে বিচ্যুত হলে ২০০১ সালে মেয়েদের জন্যে শিক্ষা-ব্যবস্থা পুনরায় স্বীকৃত হলে নাদিয়া আঞ্জুমান হেরাট বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্য-বিভাগে ভর্তি হন। যদিও নাদিয়া বা তাঁর মতন বহু নারী সম্পুর্ণভাবে স্বাধীনতা কখনওই পান নি। তাই তো নাদিয়া লেখেন ইচ্ছে নেই কোনও আমার মুখ খোলার। কী বলবো আমি! / বলি বা না বলি,আমি বয়ক্রমেও উপেক্ষিতই রয়ে যাবো

২০০২ সালে নাদিয়া স্নাতক হন এবং তারপর তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ গুল-এ-দোদি (স্মোকি ফ্লাওয়ার) প্রকাশিত হয়, ফারসির একটি উপভাষা দারি-তে লিখতেন তিনি। এই কবিতা-চর্চায় অধ্যাপক রাহিয়াব না্দিয়াকে বিভিন্নভাবে উদ্বুদ্ধ করতেন, অনেক কবি-লেখকের সঙ্গে তাঁর পরিচয়ও করিয়ে দিয়েছিলেন, যাঁদের কলম নাদিয়াকে তাঁর সাহিত্যকৃতিতে বিস্তৃত হতে সাহায্য করে। ক্রমশ নাদিয়ার লেখনী স্বতন্ত্র হয়ে উঠেছিল, কবিকৃতিতে খুবই প্রতিভাময়ী ছিলেন তিনি, এবং তাঁর পাঠক-সংখ্যা শুধুমাত্র আফগানিস্তানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, গুল-এ-দোদিইরান, পাকিস্তান ও আরও অনেক দেশে খ্যাতিলাভ করেছিল, বইটির তিনটি সংস্করণ হয়। তাঁকে আফগানিস্তানের অন্যতম আধুনিক কবি বলে আজও গন্য করা হয়। 

রাবিয়া বালখি পারস্য সাহিত্যের একজন আধা-কিংবদন্তী ব্যক্তিত্ব এবং সম্ভবত প্রথম মহিলা কবি ছিলেন মডার্ন ফার্সি কবিতার ইতিহাসে। তাঁর জন্ম ও মৃত্যুর সঠিক তারিখ অজানা, তবে জানা যায় যে তিনি আফগানিস্তানের খোরাসানের বালখ শহরের অধিবাসী ছিলেন। তিনি একটি রাজপরিবারের বংশোদ্ভূত বলে কথিত আছে। তাঁর পিতা কাব আল কুজদারির মৃত্যুর পর তাঁর ভাই হারেস উত্তরাধিকারী হয়। কিংবদন্তী অনুসারে বাখতাশ নামে হারেসের একজন তুর্কি ক্রীতদাস ছিল, সেই বাখতাশের সঙ্গে বালখির গোপন প্রণয়ের কথা হারেসের কানে আসে। তিনি বাখতাশকে একটি কূপে বন্দী করেন এবং রাবিয়াকে বাথরুমে আটকে রাখেন। সেইখানে রাবিয়া তাঁর শিরা কেটে ফেলেন, এবং মারা যাওয়ার আগে অবধি বাথরুমের দেয়ালে নিজের রক্ত দিয়ে তাঁর শেষ কবিতা লিখেছিলেন। এই খবর জানার পর বাখতাশ কূপ থেকে পালিয়ে যায় এবং গভর্নর অফিসে গিয়ে হারেসকে হত্যা করে, এরপর নিজে আত্মহত্যা করে। লাইব্রেরী অব কংগ্রেস বালখি-র নামই প্রথম পার্সিয়ান নারী কবি হিসেবে নথিভুক্ত করেছে। বালখি আফগানিস্তানে খুবই বিখ্যাত কবি, তাঁর জন্মের প্রায় বারো শতাব্দী পরেও তাঁর নাম উল্লিখিত হয়। 

লায়লা লেখেন আমার হৃদয় হিমায়িত কুঁড়ির মতো, / আমার কণ্ঠ একটি বধির আর্তনা্‌দ, /আমার শরীর হেমন্তের ঠান্ডা্য় একটি শুকনো ডাল তালেবানদের দ্বারা নারী নির্যাতনের কারণে তাঁকে আফগানিস্তান থেকে চলে যেতে বাধ্য করা হয় এবং তিনি নেদারল্যান্ডে চলে যান ১৯৯৮ সালে। তিনি বেশ কয়েকটি কবিতা-সংকলন প্রকাশ করেছিলেন, যার মধ্যে প্রধানত আধুনিক ফার্সি কবিতা ছিল। তাঁর কবিতায় মূলত দুঃখ-যন্ত্রণার বহিপ্রকাশ দেখা যায়, যে অভিজ্ঞতা তাঁর আফগানিস্তানের যুদ্ধ থেকে হয়েছিল। তাঁকে আফগানিস্তানের অন্যতম আধুনিক কবি বলে গণ্য করা হয়। তিনি কম্যুনিস্ট শাসন এবং তালেবান সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে তাঁর প্রতিবাদী মনোভাব এবং সাহসী সত্তার জন্যে পরিচিত ছিলেন। তাঁর কাব্যগ্রন্থের মধ্যে দ্য কন্টিনুইং স্ক্রীম, দ্য গ্রীন ডন, ফ্রম স্টোন্‌স, এবং এ নাইট স্টোরি বিশেষ উল্লেখযোগ্য। তিনি সেখানে ফারসি ভাষায় একটি সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন, ইভ ইন এক্সাইল। ২০০৪ সালের ২১শে জুলাই তিনি মস্তিষ্কের ক্যান্সারে মারা যান, মাত্র ৪৬বছর বয়সে। ২৯শে জুলাই তাঁর মরদেহ কাবুলে পৌঁছায়, তাঁর বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-স্বজন এবং বুদ্ধিজীবিদের উপস্থিতিতে তাঁকে কবর দেওয়া হয়।

আমি সেই নারী, জেগে উঠেছি আজ। / আমার সন্তানদের চিতাভস্ম থেকে উৎসারিত ঝড়ে প্রবুদ্ধ হয়েছি আমি, / আমি আমার ভাইয়ের রক্তস্রোত থেকে উঠে এসেছি,লিখেছেন মীনা কেশোয়ার কামাল। তিনি ১৯৫৬ সালে ১৭ ফেব্রুয়ারী আফগানের কাবুল শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর স্কুলে পড়ার সময় কাবুল এবং আফগানিস্তানের অন্যান্য শহরে ছাত্র-ছাত্রীরা সামাজিক ভাবে এবং গণয়ান্দোলনে সক্রিয় ছিল। মীনা নারীদের সংগঠিত এবং সচেতন করার জন্যে বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে দিয়ে পুরোপুরি সমাজকর্মী হিসেবে নিজেকে নিয়োজিত করেন। তিনি ১৯৭৭ সালে রেভলুশন্যারী অ্যাসোসিয়েশন অব দ্য উওমেন অব আফগানিস্তান (RAWA) তৈরী করেন। ১৯৭৯ সালে রুশ শাসনের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেন, কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ে মিটিং মিছিল ইত্যাদি করতেন। ১৯৮১ সালের শেষে ফরাসি সরকারের আমন্ত্রণে ফ্রেঞ্চ সোস্যালিস্ট পার্টি কংগ্রেসে আফগান প্রতিরোধ আন্দোলনে প্রতিনিধিত্ব করেন। সোভিয়েত প্রতিনিধি দলের নেতৃত্বে ছিলেন বরিস পোনামারিয়েভ, তিনি লজ্জিত হয়ে হল ত্যাগ করেন, তখন সবাই উল্লাসে মেতে ওঠে। মীনা ফ্রান্স ছাড়াও ইয়রোপের আরও কয়েকটি দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। তাঁর সক্রিয় সামাজিক কাজের জন্যে মৌলবাদীরা ১৯৮৭সালের ৪ঠা ফেব্রুয়ারীতে পাকিস্তানে তাঁকে হত্যা করা হয়। তাঁর মৃত্যুর চারমাস আগে তাঁর স্বামী ফয়েজ আহমেদকে হত্যা করা হয়, ফয়েজ আফগানিস্তান লিবারেশন অর্গানাইজেশনের নেতা ছিলেন। তাঁদের তিন সন্তানের কোনও খবর জানা যায় নি।

আমি সুদূরে, নির্জন তীরে / পড়ে থাকা মাছ একটি / আশাহীন, ইচ্ছেবিহীন লিখেছেন যে কবি, তাঁর নাম শাকিলা নাসির, একজন আফগান কবি। ১৯৪৯ সালের জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৮১ সালে কাবুল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হন ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে। সেখানেই ১৯৯২ সাল অবধি লেকচারার ছিলেন। ১৯৯৪ সালে তাঁকে দেশত্যাগ করতে হয়, তিনি অস্ট্রেলিয়া চলে যান। ১৯৯৭ সালে অস্ট্রেলিয়ার ভিক্টোরিয়ার ইস্টার্ন কলেজ অব টাফে থেকে সমাজ-বিজ্ঞানে ডিপ্লোমা করেন। ১৯৯৮ সাল থেকে ভিক্টোরিয়া ও অস্ট্রেলিয়ার অন্যান্য রাজ্যে দোভাষীর কাজ করেন। তাঁর চার পুত্র। শাকিলা দশ বছর বয়স থেকে কবিতা পড়া শুরু করেন তাঁর মায়ের উৎসাহে। তাঁর মতে তাঁর সেই বয়স থেকেই কবিতার ভাব ও গঠন-পদ্ধতি বোঝা শুরু হয়ে গিয়েছিল, এবং  নারী হওয়ার কারণে তাঁকে বিভিন্ন বিধি-নিষেধের সম্মুখীন হতে হয়েছে, এবং তিনি স্বাধীন এবং স্বচ্ছন্দ যাপন করতে পারেন নি, তাই তাঁর মনের ভাবনা কবিতা আকারে এসেছে। 

ব্যর্থতা থেকে জন্ম আমার, জন্মেছি মূক হয়ে থাকার জন্যেই মাত্রনাদিয়া লিখেছিলেন। হেরাট বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ফরিদ আহমেদ মজিদ নেইয়ার সঙ্গে নাদিয়ার বিবাহ হয়। নেইয়া সাহিত্যে স্নাতক এবং হেরা্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের মুখ্য লাইব্রেরিয়ান হওয়া সত্ত্বেও শিক্ষার আলো আসে নি তাদের ঘরে। যতই নাদিয়া লেখেন ইচ্ছে করে আমি তার সৌন্দর্যের নেশায় নেশাতুর হই, / অথবা, তার ভালোবাসার আগুনে পুড়ে তার হৃদয়ের কর্ত্রী হয়ে উঠি। / ইচ্ছে করে আমি তার মুখের অলঙ্কারে অশ্রুবিন্দু হই, / অথবা, তার সুগন্ধিযুক্ত চুলে ঢেউ হই ততই তিনি তাঁর স্বামীর এবং পরিবারের বিরাগভাজন হয়ে উঠলেন, কারণ প্রেম ও সৌন্দর্য বিষয়ে কোনও নারীর কবিতা লেখা পরিবারের পক্ষে অবমাননাকর আফগানিস্তানে। সেই অবস্থায় দাঁড়িয়ে নাদিয়া আঞ্জুমান যখন লেখেন ভালোবাসায় প্রশ্ন কোরো না, কারণ তোমার অক্ষরবিন্যাসে প্রেরণা সে / আমার প্রেমময় অক্ষরে মৃত্যু বাস করে তখন নাদিয়ার ভাগ্য যে সুপ্রসন্ন হবে একথা তো অভাবনীয়ই। কিন্তু নাদিয়ার কী অপরাধ ছিল! একজন নারী বলে? একজন কবি হতে চেয়েছিলেন বলে? মেয়েদের কথা বলতে চেয়েছিলেন বলে? তিনি লিখেছিলেন কোনও একদিন ভেঙে ফেলবো এই খাঁচা, এর ভয়ানক নির্জনতা / উল্লাসের নেশায় মত্ত হবো আমি, গেয়ে উঠবো বসন্তে পাখি গায় যেমন 

কিন্তু নাদিয়া খাঁচা ভেঙে ফেলতে পারেন নি, বসন্তের গান গেয়ে উঠতে পারেন নি। তার আগেই মৃত্যু বরণ করেছিলেন, কেননা তাঁর স্বামী এবং শ্বশুরবাড়ীর আপত্তি সত্ত্বেও তিনি কবিতা লিখতেন। এবং তিনি ইয়েক সাবাদ ডেলহোরেহ (অ্যান অ্যাবান্ডান্স অব ওরি) শিরোনামে দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ২০০৬ সালে প্রকাশের জন্যে প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। কিন্তু বই-প্রকাশের পূর্বেই ২০০৫ সালের ৪ঠা নভেম্বর তাঁর স্বামী কর্তৃক প্রহৃত হন এবং মারা যান ছমাসের একটি সন্তানকে রেখে। ২০০৭ সালে দ্য ইরানিয়ান বার্ন্ট বুক্‌স ফাউন্ডেশন আঞ্জুমানের সমস্ত রচনাগুলি মূল ফারসি-দারি ভাষায় প্রকাশ করে। 

পারউঈন পাঝওয়াক, আফগানিস্তানের একজন বিশিষ্ট শিল্পী, লেখক এবং  কবি হিসেবে পরিচিত। ১৯৬৭ সালে আফগানের কাবুল শহরে জন্মগ্রহণ করেন। বিখ্যাত কবি আবদুর রাহমান পাঝওয়াকের পৌত্রী পারউঈন মালালাই হাই স্কুলে লেখাপড়া করেন এবং আবু আলিস সিনা এ বালখি মেডিকাল ইন্সটিটিউটে মেডিসিন নিয়ে পড়েন। কিন্তু আফগানিস্তানের যুদ্ধের জন্যে ডাক্তারী প্র্যাক্টিস করতে পারেননি। অনেকের মত পারউঈনের পরিবারকেও নিরাপত্তার জন্যে দেশত্যাগ করতে হয়েছিল। পারউঈন পাঝওয়াকের সাহিত্যকর্মের মধ্যে মডার্ণ ফার্সি কবিতা, উপন্যাস এবং ছোটগল্প রয়েছে। তিনি শিশুদের জন্যেও অনেক বই লিখেছেন। অনুবাদও করেন তিনি, এবং ছবি আঁকেন। তাঁর বই ইংরেজি এবং ফরাসী ভাষায় অনূদিত হয়েছে। পারউঈন পাঝওয়াকের বিখ্যাত বইগুলির মধ্যে রিভার ইন ডিউ, নেগিনা অ্যান্ড দ্য স্টারস, দ্য ডেথ অব সান, এবং সালাম মারজান। তিনি এখন সপরিবারে কানাডার অন্টারিওতে থাকেন। 

আমাকে সান্ত্বনা দিও না, / আমার অশ্রুর জন্য লজ্জিত আমি, / আমার দিকে না তাকিয়ে চলে যাও। / আমি চাই না আমাকে দুর্বল মনে করো তুমি, / যাও। / এবং আমাকে সুযোগ দাও / আমার চিবুক-উপযুক্ত / পাথরের মুখোশ নির্মাণে / লুকোচুরি করার জন্য তাঁর মুখোশ নামের এই কবিতাটি সুইডেনের আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদযাপনে পঠিত হয়েছিল।

শুধুমাত্র নাদিয়া আঞ্জুমান, লায়লা সারাহাত রুশানি, শাকিলা নাসির বা পারওয়াঈন পাঝোয়াক নয়, আফগানিস্তানে বহু মহিলা-কলম অচিরেই থেমে যায়, নয়তো দেশান্তরী হতে বাধ্য হন তাঁরা। অনেক কবি-লেখকদেরই দেশত্যাগী হতে হয়েছিল। যাঁরা দেশ ছেড়ে যান নি বা যেতে পারেন নি, তাঁদের কণ্ঠ অচিরেই থেমে গেছে হত্যায় বা আত্মহত্যায়। যদিও ২০০১-এর পর কিছু সময়ের জন্যে তাদের লড়াই তাদেরকে স্বাভাবিক যাপনে কিছুটা সাহায্য করেছিল, কিন্তু আজকের আফগানিস্তান তাদের এই লড়াইকে আবার অনেকই পেছনে নিয়ে গেল, ১৯৯৬ থেকে ২০০১-এ যেমন অবস্থা হয়েছিল, ঠিক সেই অবস্থারই পুনরাবৃত্তি। আজ ২০২১-এ পুনরায় আফগান মেয়েরা বোরখার নিচে, অন্ধকার কুঠরীতে, যৌনদাসী হিসেবেই। যে দেশে স্বগৃহে নারীরা নিরাপদ নয়, সেখানে জনপদ কী-ই বা নিরাপত্তা দেবে তাদের? যে দেশে বহু সংগ্রামের পরেও নারীদের সামনে শুধুমাত্র অন্ধকার, যেখানে ঘরের থেকে বাইরে যাওয়া নিয়ন্ত্রণ করে অন্য মানুষেরা, যেখানে তালেবানরা ফতোয়া জারি করে মেয়েদের কোনও অংশ দেখা যেতে পারবে না, আঙুলে নেলপালিশ লাগালে সেই আঙুল কেটে দেওয়া হবে, মহিলাদের ঘরের জানলা-দরজা কালো রঙ করে দিতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি, সেখানে আলো আসবে কোন পথ দিয়ে? কীভাবেই বা মুক্তি? 

তাই লায়লা লেখেন   আমিও উড়তে ভালোবাসি কত! / কিন্তু অদৃশ্য রজ্জু এক / যত দীর্ঘ সময়সম / বেঁধে রেখেছে ডানা আমার। 

আর, নাদিয়ার মতন কবিরা লিখে যান নমনীয় তরু আমি, দুলে উঠবো না কখনও মৃদু সমীরণে / আমি একজন আফগান-কন্যা ধ্বনিত হবে ফাগান* আমার, / আমি কেঁদে যাবো অনন্তকাল ধরে

পারউঈন পাঝওয়াকের ভাষা ভিন্ন, তিনি লিখলেন এবং আমরা / অনেক অন্তহীন রাত পেরিয়ে / চাপা কান্নায় / প্রার্থনার জ্বলন্ত মশাল জ্বালিয়ে / অপেক্ষা করি, থাকি প্রতীক্ষা্য় আগত ভোরের।

পারউঈনের কবিতার লাইন ধরে আমরাও আশা করি আফগানিস্তানে একটি নতুন ভোরের।

 

[*ফাগান অর্থ কান্না, দুঃখ এবং বেদনার একটি অভিব্যক্তি, অনুবাদে মূল শব্দটি রাখা হয়েছে শব্দটির গভীরতা বোঝানোর জন্যে।]

ঈশিতা ভাদুড়ী

পুকুরঘাট

পুকুরঘাট

একদিন আমরা মাত্র কয়েকজন সদস্য নিয়ে পুকুরঘাট নামের একটি মেয়েদের ভার্চুয়াল দল খুলে ছিলুম। অচিরেই সে কয়েকটি সদস্যের দল কয়েক হাজার সদস্যের মেয়েদের দল হয় ওঠে। পুকুরঘাট দলের মত এত গুণী মেয়েদের সমাহার বাংলাদেশে খুব কম ভার্চুয়াল দলে আছে। কাজেই সেই দল সেখানেই আটকে থাকবে না বলা বাহুল্য। তাই পুকুরঘাট দলের অন্যতম উদ্যোগ হিসেবে প্রকাশিত হলো পুকুরঘাট পত্রিকা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

13 thoughts on “আফগান কন্যাদের কথা

  1. আফগান কন্যাদের কথা —খুব ভাল লাগল ও সমৃদ্ধ হলাম ।

  2. আমরা এত কিছু পেয়েও নিজেদের বঞ্চিত মনে করি, আফগান মহিলাদের লড়াইটা উপলব্ধি করলে বুঝব ঝলকে ওঠা ঠিক কতটা কঠিন। অসম্ভব ভালো লেগেছে পড়তে। আরো পড়তে চাই…

  3. গায়ের রক্ত গরম করা লেখা। অনেক শ্রদ্ধা রইলো দিদি।

  4. অসাধারণ লেখা। এই সব লড়াকু মেয়েদের কথা পড়লে মনে হয় আমরাও পারব, পারতেই হবে!

  5. খুব ভালো লাগলো। সমৃদ্ধ হলাম আফগান কন্যাদের অদম্য প্রাণশক্তির কথা জেনে।

  6. কিছুদিন আগে সংবাদ পত্রে পড়েছিলাম আফগান কবিদের কথা।
    আজ এ লেখা আবার ভারাক্রান্ত করল।
    কত প্রতিভা নিয়ে কবিরা কত যন্ত্রণায়।
    অশেষ শ্রদ্ধা লেখিকাকে।

  7. সমৃদ্ধ হলাম। তথ্যসমৃদ্ধ মূল্যবান লেখা।