আমার যে সব দিতে হবে

আমার যে সব দিতে হবে

                    নিবেদিতা ঘোষ মার্জিত

 

     পোস্টঅফিসে আজ একবার যাবে ময়না। লুকিয়ে যে কটা টাকা রেখেছে এবার সেগুলো জমা দেবে। ছেলে জানলে আবার বায়না করবে। জোর করে তিরিশ হাজার টাকা নিল ঘর ঠিক করবে বলে। এখন ছেলের বউ সারাদিন হাতে একটা বড় ফোন নিয়ে ঘোরে। ময়নার কি ইচ্ছে করে না,বড় ফোনে সিরিয়াল দেখতে। দূরে থাকা মানুষের সাথে ভিডিও কল করতে। ময়না টাকাটা শখের জন্যে নষ্ট করেনি,জমিয়ে রেখেছিল।মাথা গরম হয়ে যায়।বরের চোখের চিকিৎসার জন্যে আগের বারের টাকাটা খরচ হল। এখন থেকে আর সব টাকার খবর ছেলে আর বর কে দেবে না। নিজে বুড়ো হলে তখন কে দেখবে! বাড়ি এসে কদিন আরামে কাটাবে ভেবেছিল। ছেলের বউ ন্যাকামো করে বলল, “তুমার মতুন রান্না আমি এ জন্মে শিখতে পারবো না গো, তুমি রাঁধলে আঙুল চেটে চেটে খায় তুমার ছেলে।” প্রায় চারমাস পর  বাড়ি এসে সংসারের মায়ায় ডুব দিতে ইচ্ছে করে ।নিজের রান্নাঘর গুছিয়ে যে কি সুখ…। ছেলের জন্যে ঝাল করে  মাংস রান্না করে। বুড়োকে তেল গরম করে রাতে পা মালিস করে দেয়। তারপর দুদিন পরে বুঝতে পারে আসলে তাকে দিয়ে সকলে কাজ করিয়ে নিল। কেউ তার জায়গা ছেড়ে দেয়নি। ছেলের বউ এটা ওটা খুলে খুলে দেখে অদ্ভুত চোখে তাকায়। যেন বেশি খরচ হয়ে গেল।কেউ তার জন্যে অপেক্ষা ও করছিল না।বুকের মধ্যে ঝিমঝিম করে দুঃখ নামে। মিথ্যে করে বলে,“ আমার খুব পিঠে বেদ্‌না করছে।কানে কট্‌ কট্‌ করছে।” বর হোমিওপ্যাথি ওষুধ এনে দেয়। চুপ করে শুয়ে থাকে।টাকাগুলো পোস্টঅফিসে জমা দিয়ে শান্তি পায় ময়না। এই টাকার খবর কিছুতেই জানাবে না।যে বাড়িতে কাজ করে সেই দিদিভাই এই মাস থেকে হাজার টাকা বাড়িয়ে দেবে বলেছে। এক লাখ টাকা করতে হলে কতগুলো হাজার টাকা লাগে?বাকু বলছিল দুবার পঞ্চাশ হলে একশো টাকা হয়। আর দুবার পঞ্চাশ হাজার হলে তাহলে এক লাখ।ময়না পেঁপে গাছের নিচে বসে মাথা চুলকায়। প্রথম থেকে যদি টাকা লুকিয়ে টাকা জমিয়ে রাখত তাহলে এখন কয়েক লাখ টাকা জমত। মনের মধ্যে খুব দুঃখ হয়।বাকু থাকলে হিসাব করে দিত সে আসলে কত টাকা রোজগার করেছে সে এতদিন।বাকু দিদিভাইএর ড্রাইভার।বুড়ো বর কে এসব  বলে কোন আনন্দ পায় না ময়না। বর কেবল বিড়ি খায় আর ঝিমোই। অথচ গায়ে কি জোর ছিল। জলের কল বসানোর সময় হাতের পায়ের পেশি সব ফুলে ফুলে উঠত। জোয়ান বয়সের স্মৃতি মনে আসে ময়নার। একবার ছোট দেওরের সাথে ঝগড়া করে দরজা ভেঙ্গে দিয়েছিল।কতদিন যে কাঁদিয়েছে ময়না কে। রাস্তার কলে পায়ে সাবান মাখছিল বলে,দিয়েছিল ঘা কয়েক কষিয়ে। বিয়ে হবার পর বেশ কয়েক বছর ময়নাকে একা বাপের বাড়ি যেতে দিত না। ময়নার খুড়তুতো জামাইবাবু কে সন্দেহ। পরে আবার তার সাথেই বসে ‘বাংলা’ খেত।এলাকার কলের মিস্ত্রির ডানহাত বলে খুব নাম ছিল বরের। ‘মোহন দাস’ গোটা গোটা অক্ষরে নিজের নাম সই করতে পারত ময়নার বর। একবার চালের ড্রামে আলতা দিয়ে ‘ময়না’ লিখেছিল বর। সে কি লজ্জার ব্যাপার। ছেলে লিখতে শেখার  পর ঐ ড্রামে ,নিজের নাম আর বাপের নাম লিখেছিল। ময়নার তখন কি সুখের সংসার। উঠোনে এক গাদা মুরগী কক্‌ কক্‌ করে ঘুরে বেড়াচ্ছে, মাচাতে লক লক করছে পুইশাক,হাড়িতে জিওল মাছ খলবল করছে। গন্ধতেল মাথায় দিয়ে  টেনে চুল বেঁধে ঘোমটা দিয়ে প্রদীপ জ্বালায় সূর্যি নিভে আসা সন্ধ্যেবেলায়।তারপর ছোট ভাইয়ের সাথে জমির ভাগ নিয়ে ছোট ভাইয়ের সাথে ঝামেলা। কেমন যেন হয়ে গেল মোহন। ভাই কে ভালবাসত। ছোটবেলায় ভাইয়ের পা ভেঙ্গে গেলে সে কাঁধে করে রামপুরহাটের হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল। মা মরে যাওয়া ভাই তাকে না জানিয়ে তিন বিঘা ধানী জমি বেচে দেবে ভাবতে পারেনি সে। মন খারাপ শরীরে এসে থাবা বসাল।তারপর সব বদলাতে থাকে। ডাক্তার, ঝাড়ফুঁক, পুলিশ, পাড়ার মস্তান,টাকা ধার দেওয়া খারাপ বন্ধু– আরও কত কি যে ঘটতে থাকল। রোজগার চলে গেল। জমানো টাকা নষ্ট হল। ধারের তাগদা আসতে লাগল। মোহন দাস লুকিয়ে লুকিয়ে বেড়াতে লাগল।ময়নাকে সংসারের হাল ধরতে হল।আসেপাশে কাজ ধরল ময়না। ছেলে ইস্কুল পাস দিয়ে বড় রাস্তার ধারের একটা দোকানে ঢুকল। ময়না নিঃশ্বাস ফেলে ভাবল,এবার সব ঠিক হবে।হল না,সংসারের খরচ হাঁ করে গিলতে আসে। মন্দিরে সিঁদুর দিয়ে ছেলে ঘরে নিয়ে এল জেলে পাড়ার মেয়ে ঝুম্পা কে। ঝুম্পা এসে উদব্যস্ত করে দিল সংসার। তার টগবগে যৌবন কে বাগে নিয়ে আসতে পারে না ময়নার ছেলে। মোহনের আবার শরীর খারাপ হয়। ঝুম্পার মার চেনা লোক শহরের কাজের খোঁজ আনে। ‘বাচ্চছেলে দেখার কাজ’ বেশি তেমন কষ্টের নয়, জানায় সেই লোক।ময়না যেদিন যাত্রা করেছিল সেদিন মোহন কে যখন বলল, ‘তাহলে আমি আসি’ ,মোহন নিরুত্তর । একটা বিড়ি ধরিয়ে ঘোলাটে চোখে তাকিয়ে থাকল। যৌবন থাকতে এই লোক কেমন আগলে রেখেছিল, তার একবার মনে হল না, বলল না, “ ওগো ময়না তুমি যেও না, আমার টাকার দরকার নাই।”নতুন কাজের বাড়িতে , একটা বাথরুম দেখিয়ে বলল, “তুমি এই বাথরুম ব্যবহার করবে।”সেই বাথরুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে রাতে বুক ভাসিয়ে কেঁদেছিল ময়না। তারপর , উপচে যাওয়া  সুখী জীবনের উচ্ছিষ্টে সে কেমন অভ্যস্ত হয়ে গেল। তেল ,সাবান, ওষুধ, চারবেলা খাওয়া, ফ্যানের হাওয়া, টিভি দেখা… সাথে কাজ ছিল কিন্তু ওসব তো ফাঁকি দিতে শিখেও গেল। বাচ্চা কিছুদিন পর নিজের মতই থাকে।দিদিভাইএর বরের সাথে মাঝে মাঝে সম্পর্ক নড়বড়ে হয়। তখন দিদিভাই মদ খায়। বাচ্চাটা তখন ময়না কে আঁকড়ে থাকে। আদর দেয় ময়না। কিন্তু বুকের গহীনে জানে ,এ বড় হলে আর কাছে আসবে না।টাকা বাড়াবে বলেছে এবার। ঐ টাকা গুলো জমিয়ে বুড়ো বয়সের জন্যে কিছু করতেই হবে। চিরকাল শরীর থাকবে না।নতুন চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়াতে থাকে। ঝুম্পা শাশুড়ির পরিস্কার পায়ের পাতা তাকিয়ে দেখে ঈর্ষা করে। তার পায়ের আঙ্গুলে নেলপালিস থাকলেও এমন সাদা গোড়ালি তার নেই। সে তাকিয়ে দেখে শ্বাশুরির  চিরুনি।এমন স্বচ্ছ চিরুনি পাড়ার দোকানে দেখা যায় না। মনে হয় মালকিনের চিরুনি। সে চোখ সরু করে নাটকীয় ভাবে বলে, “ এই কোম্ব খানা আমাকে দ্যাও না মা।একেবারে বিউটি পার্লারের মতুন।টিভিতে অ্যাডে এমুন দেখায়। হেবি দেখতে।”হিহি করে হাসে আর বলে, “তুমার তো সব চুল পেকে দড়ি দড়ি …” ।মনে মনে কালো হয়ে যায় ময়না। সব কিছুতে লোভ এই মেয়ের। চিরুনি তে লেগে থাকা চুল পরিস্কার করে কোন কথা না বলে ঝুম্পার দিকে চিরুনিটা বাড়িয়ে দেয়। একটা নতুন সায়া নিয়ে এসেছিল। সেটাও ব্যাগ থেকে বার করে ঝুম্পা কে দিয়ে দেয়।  ছুটি শেষ ময়নার। আগে বাড়ি থেকে চলে যাবার সময় মন খুব খারাপ হত। এখন হয় না। সব টাকা এবার খরচ করেনি । ট্রেনে ছেলে তুলে দেবে বলেছিল। কিন্তু কি একটা কাজে চলে গেল। একায় বার হল রাস্তায়। ঘর থেকে বার হয়ে নিজেকে বেশ ফুরফুরে লাগে ময়নার। কুচি দিয়ে গুছিয়ে সিন্থেটিক কাপড় পড়েছে। অন্যবার এতটা স্বাধীন লাগে না।

          দিদিভাই হাওড়াতে বাকুকে গাড়ি দিয়ে পাঠিয়েছে।বাকু কে দেখে খুব আনন্দ হল ময়নার। “কি গো মাসি, মেসো কেমন আছে?” “কেমন আবার আছে? ঐ ঝিমাই আর বিড়ি ফুকফুক করে।সারারাত  কাশছে। তা এখানকার খবর কি?” ময়না গাড়িতে গুছিয়ে বসে বলে। ট্রেনে বেশ কয়েক টা বাদামের প্যাকেট কিনেছিল ময়না সেটা বাকুকে দিল। বাকু জানায় ,বাচ্চা নিয়ে ম্যাডাম খুব বিব্রত। সমস্তক্ষন বাচ্চা মাসির কথা জিজ্ঞেস করে।স্যার ইদানিং একটু নরম হয়েছে। একদিন বাইরে খেতে নিয়ে গিয়েছিল। ময়নার জন্যে একটা বিছানার চাদর কিনেছে। বাকু আরও কত কি বলে চলে।  শহর দেখতে তার ভালো লাগছে। বাড়িতে বেল বাজানো মাত্র দিদিভাই এক মুখ হাসি নিয়ে দরজা খুলে দিল। “উফ তুমি এসে গেছ মাসি। তুমি এবার ঘর সামলাও। আজ আমার রাত নটার আগে ফেরা হবে না”।দিদিভাইএর বাচ্চা অনলাইন ক্লাস ।করতে করতে মিষ্টি হেসে বলল, “তোমার জন্যে চুলের গার্ডার কিনে রেখেছি।” ময়না দেখতে পায় একটা না-কাচা কাপড়ের ছোটখাটো পাহাড় হয়ে আছে ঘরের কোণে।হাতে সুগন্ধিত স্যানিটাইজার লাগায় ময়না।

 

নিবেদিতা ঘোষ মার্জিত

পুকুরঘাট

পুকুরঘাট

একদিন আমরা মাত্র কয়েকজন সদস্য নিয়ে পুকুরঘাট নামের একটি মেয়েদের ভার্চুয়াল দল খুলে ছিলুম। অচিরেই সে কয়েকটি সদস্যের দল কয়েক হাজার সদস্যের মেয়েদের দল হয় ওঠে। পুকুরঘাট দলের মত এত গুণী মেয়েদের সমাহার বাংলাদেশে খুব কম ভার্চুয়াল দলে আছে। কাজেই সেই দল সেখানেই আটকে থাকবে না বলা বাহুল্য। তাই পুকুরঘাট দলের অন্যতম উদ্যোগ হিসেবে প্রকাশিত হলো পুকুরঘাট পত্রিকা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

5 thoughts on “আমার যে সব দিতে হবে

  1. ছবির মত দেখতে পেলাম পুরোটা। সুন্দর লেখা।

  2. সাধারন সমাজের সাধারন ঘটনা। পড়তে গিয়ে মনে হল চোখের সামনে দেখছি সে চিত্র। বেশ ভালো লাগল।