আঁধার যখন/চারপর্বের গল্প/পর্ব -২
আঁধার যখন
নন্দিনী চট্ট্যোপাধ্যায়
২
হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেল টম কিন্তু হাসতে হাসতে ঘরে ফিরতে পারলনা সে । আজ থেকে তার মনিব সব চাকর বাকর সহিসকে কাজ থেকে ছাড়িয়ে দিয়েছে।পৌরসভা থেকে পাড়ায় পাড়ায় মহল্লায় মহল্লায় জানিয়ে দেওয়া হয়েছে যে কুখ্যাত বিউবোনিক প্লেগ ভয়ঙ্করভাবে ছড়িয়ে পড়ছে।পৌরসভা সন্দেহ প্রকাশ করছে যে এই বার মহামারী ১৩৪৭খ্রিঃ থেকে ১৩৫২খ্রিঃর মধ্যে যেভাবে ছড়িয়েছিল এইবারও সেইভাবেই অতি দ্রুত এবং ভীষণভাবে ছড়াচ্ছে ।অন্যান্য বছরের মত দশ বিশ পঞ্চাশটা লোককে মেরে ক্ষান্ত হচ্ছেনা ।জ্বর হলে বগলে কুঁচকিতে বা ঘাড়ে ফোলা গ্ল্যান্ড দেখা গেলে সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালের ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে এবং বাড়িতে দীর্ঘদিন কোয়ারেন্টাইন অবস্থায় থাকতে হবে । হাসপাতালে ভর্তি হতে পারলে সবচেয়ে ভাল কিন্তু এর মধ্যেই হাসপাতালে স্থান নেই প্রায় । অগত্যা সবই ভাগ্যের হাতে —-
মাথা নিচু করে বাড়িতে ঢোকার সময় মায়ের সঙ্গে ধাক্কা লাগল টমের । ওঃ মা ! কী হল ?
বেটি ঠান্ডা গলায় বলল —নতর দাম দ্যু মঁতে যে বারে জন কাজ করে সেখানে সকলেরই প্লেগ হয়েছে শুনলাম। কাজেই বুঝতেই পারছ জনেরও প্লেগ হয়েছে।
–কী ? আমি যাব তাহলে ? টমের গলায় ভয় ঝরে পড়ল।
–নাহ তুমি যাবেনা । আর গিয়েই বা কী করবে ? খবর পেলাম জনের দুই ছেলেরই জ্বর এসেছে ।একজনের কুঁচকিতে ডিমের মত ফোলা জায়গাও দেখা গেছে। জনের বউ সারা ওদের মহল্লার একজন স্ট্রিট আর্টিস্টকে দিয়ে আমাকে খবর পাঠাল একটু আগে ।জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
–মা! টম কাতরোক্তি করে উঠল । কী বলছ তুমি ?
—সব ঠিক বলছি।তোমার বাবারও দুপুর থেকে হাতে পায়ে যন্ত্রণা হচ্ছে।
টম ঘরে ঢুকতে গেল –মা বাবার হয়ত ঠান্ডা লেগেছে । তাই এমন হচ্ছে ।
—না টম হাডসনের ঠান্ডা লাগেনি । প্লেগ হয়েছে । আজ না হোক কাল সব কটা লক্ষণ প্রকাশ পাবে । হাডসন মারা যাবে টম ।আমি আবার বিধবা হব ।
–মা !! টম কেঁদে ফেলল । কী সব বলছ তুমি ?কারো কিচ্ছু হবেনা মা । সব আমি সেবা যত্ন করে ঠিক করে ফেলব । বাবাকে কাল আমি হাসপাতালে নিয়ে যাব । আর আমি বলছি বাবার কিচ্ছু হবেনা ।
বেটির গলা আগের মতই ঠাণ্ডা ‘আমি প্লেগের লক্ষণ চিনি টম । একবার প্লেগ আমার সব কেড়ে নিয়েছিল । এবারো প্লেগ সেটাই করতে এসেছে ।আবার আমি সব হারাতে চলেছি । কিন্তু আমি কোন অবস্থায় তোকে হারাতে চাইনা টম । একবার দুধের শিশু তোকে আমি লন্ডনের প্লেগ থেকে বাঁচিয়ে এখানে এই মার্সাইতে নিয়ে এসেছিলাম । হাডসনের হাত ধরে নতুন করে বাঁচতে শিখেছিলাম । কিন্তু আবার আমি সব হারাতে বসেছি ।‘
টম মাকে সরিয়ে দিয়ে ঘরে ঢুকতে গেল —‘দেখি বাবা কেমন আছে ।‘
বেটি উন্মাদের মত গর্জন করে রুখে দাঁড়াল –‘কোন অবস্থাতে তুমি ওই ঘরে ঢুকবে না টম । আজ কেনি আর জামাই মার্সাই ছেড়ে প্রভেন্সের সেন্ট মেরী গ্রামে ওদের দেশের বাড়িতে চলে গেছে ।জিমি আর ওর বউও ওদের মহল্লার একদল লোকের সঙ্গে মার্সাই ছেড়ে দূর কোন গ্রামে চলে যাচ্ছে ।আমাদেরকেও যেতে বলেছিল কিন্তু আমি কিভাবে যাব ? হাডসনের মৃত্যু পর্যন্ত আমাকে ওর সেবা করতে হবে যে —- অবশ্য আমি যদি ততদিন বাঁচি—‘
‘মা—!’ টম আর কথা বলতে পারেনা ।
—আমি বলি কি টম তুমিও এই মার্সাই ছেড়ে অনেক দূরে কোথাও পালিয়ে যাও । অনেক অনেক দূরে ।এত দূরে যেখানে এই কালান্তক মহামারী তোমাকে ছুঁতে পারবেনা ।‘
‘তোমাকে ছেড়ে বাবাকে ছেড়ে জনকে ছেড়ে আমি কোথায় যাব মা ? তোমরা ছাড়া আমার কে আছে মা ?আমি মরলে তোমাদের সঙ্গেই মরব । এখানেই মরব ।‘
বেটি যেন আঁতকে ওঠে –‘তুমি আমার আর হাডসনের সন্তান নও টম । তুমি অ্যালেক্সের বড় আদরের সন্তান । তোমাকে বাঁচানোর জন্য সে মৃত্যুশয্যায় শুয়েও আমার সেবা নেয়নি । বন্ধুর সঙ্গে আমাকে আর তোমাকে ফ্রান্সে পাঠিয়ে দিয়েছিল । সে মনে প্রাণে চেয়েছিল যে তুমি অন্তত বাঁচ । আমি তার কথা রেখেছিলাম । আমি তোমাকে বাঁচাতে পেরেছিলাম । আজো আমি আমার আর অ্যালেক্সের বড় আদরের সন্তান টমকে এই মারী আক্রান্ত শহর থেকে দূরে বহুদূরে নিয়ে গিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে চাই সুস্থ রাখতে চাই। তুই পালিয়ে যা টম । যত তাড়াতাড়ি হয় পালিয়ে যা ।যাঃ যাঃ।‘
বেটি সম্পূর্ণ উন্মাদিনীর মত আচরণ করছিল ।টম দিশেহারা হয়ে পড়ছিল । আজ এলাকাটাও কেমন শুনশান লাগছে ! লোকজন সব ঘরের মধ্যে বসে আতঙ্কের নিশি যাপন করছে । আতঙ্কের শহর মহামারীর শহর !
টম মায়ের সঙ্গে আর কথা না বাড়িয়ে নিস্তব্ধ পাড়াটা দিয়ে কিছুটা হেঁটে গিয়ে একটা পাঁচিলের গায়ে ঠেস দিয়ে বসল । খিদেতে পেটের ভিতরটা মোচড় দিচ্ছে ! আকাশে একফালি চাঁদ । স্তিমিত জোছনা। চেনা পরিবেশ সম্পূর্ণ অচেনা লাগছে ।কটা চামচিকে উড়ে গায়ে বসল ।ওটা কী ? উফ মাগো ! নর্দমার ধারে মরে পড়ে রয়েছে কটা নেংটি ইঁদুর।রাতের বেলা ড্রেনটা শুকনো । ইঁদুরদের লীলাক্ষেত্র ।ওইতো ইঁদুর আসছে । আরো ইঁদুর ! এতো ইঁদুর কোথা থেকে এল ? সে কি সত্যি দেখছে নাকি সব তার বিভ্রম! টম আতঙ্কে এই এলাকা ছেড়ে পালাতে লাগল । দৌড় দৌড় দৌড়——–ইঁদুর মানে প্লেগের অগ্রদূত !! পালাও টম পালাও–
কতক্ষণ সে দৌড়েছিল সে জানেনা । খুব সকালে পৌরসভার গাড়ি চলার শব্দ ও কিছু মানুষের বিকট কলরবে ঘোর ভাঙল তার । পৌরসভার ঘোষক শিঙা ফুঁকে ঘোষণা করছে যে মার্সাই নগর এখন প্লেগ মহামারীর কবলে রয়েছে । এই নগরকে রক্ষা করতে বর্তমানে ব্যাপক ধোয়ামোছার কাজ শুরু হয়েছে । ঘরে ঘরে খানা তল্লাশি করা হচ্ছে । কোন প্লেগ রোগীর সন্ধান পেলেই তাকে জোর করে ধরে হাসপাতালে ভর্তি করে দেওয়া হচ্ছে । নগরবাসীর স্বাস্থ্য রক্ষায় পৌরসভা যেকোন ব্যবস্থা নিতে প্রস্তুত।
সে বিস্ফারিত নয়নে দেখল যে পৌরসভার লোকেরা ঘরে ঘরে ঢুকে পড়ছে । কোন মানুষের মধ্যে বিন্দুমাত্র রোগলক্ষণের প্রকাশ দেখলেই তাকে টেনে হিঁচড়ে বের করে এনে পৌরসভার গাড়িতে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে । বলা হচ্ছে যে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে রোগীকে ।
এক বৃদ্ধের আর্তনাদ শোনা গেল ‘হাসপাতালে তো এত লোকের জায়গা নেই তাহলে তোমরা আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছ ?’
এক পৌরসভার কর্মী ব্যাঙ্গের হাসি হেসে বলল ‘হাসপাতালে গিয়েও তো মরবি । তারপর এমনিতেই নরকে যাবি । এখনো ধরে রাখ সেখানেই তোদের নিয়ে যাচ্ছি । আর তোরা কেন ? দুদিন বাদে আমরাও তোদের সঙ্গে নরকে গিয়ে শুয়ে থাকব পাশাপাশি ।সব্বাই মরবে বুঝলি।‘
লোকটার হুংকারে কান্না ঝরে পড়ছিল।
কিছু লোক ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে পালাচ্ছিল । পালানোর সময় উদভ্রান্ত টমকে রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলে গেল ‘পালাও পালাও । গণকবর খোঁড়া হয়েছে । জ্যান্ত মরা সব একসঙ্গে ফেলা হচ্ছে সেখানে । তারপর সবটা একসঙ্গে মাটি চাপা দিয়ে দেওয়া হচ্ছে ।‘
কোন জায়গা এটা ? হঠাত দেখে যেন চেনাও যায়না । ওঃ এতো ওল্ড পোর্ট । বন্দর এলাকার একটা অংশে এখন দাঁড়িয়ে রয়েছে সে।পরপর মাছ ধরা নৌকোগুলো ছবির মত দাঁড়িয়ে রয়েছে ।স্তব্ধ জনজীবন।দক্ষিণে প্রাচীন কোন দৈত্যের মত দাঁড়িয়ে রয়েছে সেন্ট ভিক্টরস অ্যাবি। অ্যাবির সামনে প্রাচীন কবরস্থান ।টমের গা ছমছম করে উঠল ।রাস্তাঘাট শুনশান । মার্সাইয়ের সবচেয়ে জনবহুল স্থান এই পোর্ট এলাকা । তবু মানুষজন আজ কেউ পথে নেই । শিঙা ফুঁকতে ফুঁকতে শোভাযাত্রার মত ধেয়ে আসছে পৌরসভার কর্মচারীরা । মাঝি মাল্লা ধীবরদের ছোট ছোট খুপরি থেকে টেনে বের করে আনছে শিশু ও বৃদ্ধকে ।মহামারী থেকে নগরীকে বাঁচাতে আক্রান্তদের জনজীবন থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে ।হাসপাতালে স্থান নেই । গণকবরেও কি স্থান হবে সকলের ?
টমের মনে পড়ল যে আসবার সময় সে পথে একটিও আক্রান্ত মানুষ বা মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখেনি । নাহ পৌরসভার কৃতিত্ব আছে বলতেই হবে ! কিন্তু মা যে বলেছিল পালাও । পালাও এই মারী আক্রান্ত মার্সাই নগরী থেকে । কিন্তু কোথায় পালাবে সে ? মার্সাইয়ের বাইরের পৃথিবীটা কেমন সে তো তেমন জানেনা । তবু যেতে হবে । খুঁজে নিতে হবে নিরাপদ স্থান ।
কিন্তু কোথায় সেই নিরাপদ স্থান ? বিগত দুই বছর যাবত টম শুধু খুঁজে বেড়াচ্ছে । দক্ষিণ ফ্রান্স চূড়ান্ত ভাবে আক্রান্ত । প্রভেন্স, এরিস, অ্যাপ্ট , তুলোঁ যেখানেই সে যায় শুধু মৃত্যুর মিছিল দেখে। লোকমুখে সে শুনেছে যে সেন্ট অ্যান্টনি নামে একটি মালবোঝাই জাহাজ মে মাসে মার্সাই বন্দরে আসার পর থেকেই এই প্লেগ ছড়াতে শুরু করে । প্রথমদিকে পৌরসভা ব্যাপারটা চেপে রাখতে চেষ্টা করেছিল কিন্তু সুরক্ষা ব্যবস্থা নিতেও গাফিলতি করেনি। তবু শেষরক্ষা হয়নি ।
জনস্বাস্থ্যের সুরক্ষায় চিকিৎসকদের পরামর্শমত আবর্জনা পুড়িয়ে ধোঁয়া দিয়ে ভিনিগার স্প্রে করে রোগ প্রতিরোধক শিকড় বাকড় গুঁড়ো সর্বত্র ছড়িয়ে এই কালরোগকে দমন করতে চেষ্টা করেছিল মার্সাই পৌরসভা। ।মাছি মশার প্রকোপ কমাবার চেষ্টা করা হয়েছিল । বিপুল পরিমাণ ইঁদুরও মেরে দেওয়া হচ্ছিল। কিন্তু কোথায় কী? যা হওয়ার তাই হল । এই ভয়াবহ রোগকে দমন করা গেলনা ।
প্রথম প্রথম এক শহর থেকে আর এক শহরে যাতায়াত করা যত সহজ ছিল।অতিমারীর প্রকোপ যত বৃদ্ধি পেল ততই এই যাতায়াতের সুবিধা কমে আসতে লাগল। টম জানতে পারল যে অতিমারীর কেন্দ্রস্থল মার্সাই নগরের সীমানার বাইরে প্লেগে মৃত শবের স্তূপ জমে উঠেছে । মৃতদেহগুলির ব্যাপারে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছেনা । পশু পাখিরা প্লেগে মৃত শবগুলির মাংস নিয়ে টানা হেঁচড়া করছে।শহরগুলি প্লেগ প্রাচীর নির্মাণ করে প্লেগমুক্ত অবশিষ্ট মানুষদের নিয়ে কোনভাবে বাঁচতে চেষ্টা করছে। জায়গায় জায়গায় নির্মাণ করা হয়েছে আপতকালীন চেক পোস্ট ।
হা ঈশ্বর এ কোন পৃথিবীতে নিয়ে এলে তুমি ! একদিন যার সব ছিল আজ তার কিছু নেই ! মা বাবা ভাই বোন সব এক নিমেষে কোথায় হারিয়ে গেল ! এই প্রৌঢ় বয়সে শরীরের উপরই বা আর কত ধকল সয় ? এতদিন যে তারও প্লেগ হয়নি এও কি বিধাতার এক অদ্ভুত কৃপা নয়?
টম বুঝতে পারল যে আর এভাবে পালিয়ে বেড়া্নো সম্ভব নয় ।কোথাও স্থিতু হতে না পারলে সেও শেষ হয়ে যাবে । প্রায়দিন অভুক্ত থাকে সে । মহামারীর ভয়ে কোথাও কোন খাবার কিনে খায়না । মানুষের সংগ যথাসম্ভব এড়িয়ে চলে । গাছের ফল বা আটা ময়দা গুলে খেয়ে এতদিন চালিয়েছে সে । এদিকে পয়সাও শেষ হয়ে এসেছে ।যেদিন মনিব তাকে কাজ থেকে ছাড়িয়ে দিলেন সেদিন পুরো মাসের মাইনে দিয়ে দিয়েছিলেন। সেই টাকাতেই এতদিন কোনমতে চলছিল । কিন্তু আর যে সওয়া যাচ্ছেনা । মাঝে মাঝে মা বাবার কথা মনে পড়ে ভিতরটা হু হু করে ওঠে । কিন্তু এই নিষ্ঠুর সময়ের কাছে মানুষের যন্ত্রণার কোন মূল্য নেই ! টম ঠিক করল যে প্লেগ আক্রান্ত দক্ষিণ ফ্রান্স ত্যাগ করে সে উত্তর ফ্রান্সে যাবে । সেখানে কোন প্রত্যন্ত গ্রাম গঞ্জে যেখানে প্লেগের কোন দাপট পৌঁছায়নি বা অদুর ভবিষ্যতে পৌঁছাবার কোন সম্ভাবনা নেই সেইরকম কোথাও গিয়ে সে আপাতত স্থিতু হবে । প্রয়োজনে গ্রামবাসীদের মধ্যে মিশে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেবে । মধ্য পঞ্চাশে পৌঁছে গেছে সে । আর কটা দিনই বা বাঁচবে ? কোনমতে আতঙ্কমুক্ত দিন গুজরান হয়ে গেলেই চলবে তার ।
সেই ভাবনা থেকেই অনেক ঘুরে ঘুরে ব্রিটানিতে এসে পৌঁছেছে সে। ফ্রান্সের একেবারে উত্তর পশ্চিম কোণে ব্রিটানির অবস্থান।এটি মূলত একটি উপদ্বীপ যার একপাশে ইংলিশ চ্যানেল অন্যপাশে বিস্কে উপসাগর । এখানে এসে বেশ কিছুটা আশ্বস্ত বোধ করল টম।খোঁজ করে করে গিয়ে পৌঁছাল প্যামপন্ট গ্রামে । ছায়া সুনিবিড় শান্ত সুন্দর গ্রাম।ব্রসেলিয়াঁ অরণ্যের বুকের উপর টলটলে একখানা দিঘির তীরে অদ্ভুত সুন্দর এই শান্ত গ্রামখানা । এমন একটি সুন্দর স্থান যে এই পৃথিবীতে থাকতে পারে একথা টম কখনো ভাবতে পারেনি । অল্প কিছু নির্বি্রোধী মানুষ বেলে পাথরের ছোট ছোট বাড়িতে বসবাস করে । ছোট্ট একটি শান্ত গির্জা ।গ্রামের লোকেরা বলল যে এই গির্জা নাকি সপ্তম শতাব্দী থেকেই এই গ্রামে রয়েছে। এছাড়া এই গ্রামে রয়েছে একখানা বেখাপ্পা রকমের বড় ভগ্নপ্রায় অট্টালিকা ।কে যে কবে এই একটেরে বাড়িখানা নির্মাণ করেছিল কে জানে ! এবাড়িতে অনেকদিন কারুকে সেভাবে আসা যাওয়া করতেও দেখেনি এই গ্রামের মানুষ । কিন্তু এই কদিন হয় দেখা যাচ্ছে এক মহিলা আর তার এক সহকারী বা ভৃত্য গোছের কেউ বিশাল সব পোঁটলা পুঁটলি নিয়ে এখানে এসে উঠেছে । মহিলা বলছে যে সেই নাকি এই বাড়ির প্রকৃত উত্তরাধিকারিণী ।
টম এক নিরাশ্রয় মানুষ ।মারীভয়ে ভীত ত্রস্ত হয়ে তাড়া খেতে খেতে সে এতদুরে এসে উঠেছে ।এই গ্রামে একখানা ভাঙা বাড়ি দেখে সে ভেবেছিল যে তার অন্তত মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকু জুটবে।কিন্তু সে এখানে আসার পরের দিনই এই মহিলা যে কোথা থেকে এসে উদয় হলেন কে জানে ! নতুন লোক সে এখানে ।কাকেই বা কী জিজ্ঞেস করবে ? তবু ওরই মধ্যে একজন মুরুব্বি মতন গ্রামবাসীকে ধরে সে বলল ‘বাপু হে প্লেগ লেগেছে দূরের শহরগুলোয় । মানুষজন পালাচ্ছে শহর ছেড়ে । এই মহিলা কোথা থেকে এল আর এল যখন তখন কোন রোগ নিয়ে এল কিনা খোঁজ খবর নিয়েছ তোমরা ?কে বলতে পারে কার কী রোগ আছে এখন ? ওর বা ওর চাকরের রোগ থাকলে এই গ্রাম কিন্তু উজাড় হয়ে যাবে বলে দিলাম ।‘
উত্তরে সেই গ্রামবাসী হেসে বলল ‘ দেখ বাপু আমরা গ্রামের মানুষ।। লোককে বিশ্বাস করতে ভালবাসি ।শহরে রোগ যেমন হয়েছে চেক পোস্টগুলোয় চেকিংটাও তেমন নিশ্চয়ই হয়েছে । নইলে তুমিই বা সুস্থ শরীরে আমাদের এই গ্রামে কোথা থেকে এলে শুনি ?’
টম বুঝল বেগতিক । এখানে বেশি ঘাঁটালে সে নিজেই বিপদে পড়ে যাবে । তাই বুদ্ধিমানের মত চুপ থাকাই সঙ্গত বলে মনে করল ।
কিন্তু প্যামপন্টে এসে মারীভয় থেকে মুক্ত হতে পারলেও মাথা গোঁজার মত একটা বাসস্থান আর রোজগার করার মত একটা পথ কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছিল না টম । প্যামপন্ট ছোট্ট একটি গ্রাম । চারপাশে শোভাময়ী অরণ্য । গ্রামের লোকেরা অতি সাধারণ জীবন যাপন করে । বেশিরভাগ মানুষ নিজেদের বাড়ির লাগোয়া ছোট ছোট ক্ষেতে নিজেরাই চাষ করে । গিন্নিরা কিচেন গার্ডেনে শাকসবজি ফল ফলায় । দিঘির মাছ ক্ষেতের ফসল বাগানের শাকসবজি ফলেই সন্তুষ্ট থাকে গ্রামের মানুষ ।কেউ কেউ পশু পাখির খামার করে । মুরগির মাংস ডিমের যোগানটায় টান পড়েনা । কারো যদি কখনো সখনো কোন কাজে শহরে যেতে হয় তাহলে তার সঙ্গে আরো দু একজন জুটে যায় । কজন মিলে শহর থেকে কাজ সেরে ঘুরে আসে তারা । জটিলতাবিহীন শান্ত নিস্তরংগ জীবন।
এই গ্রামে এসে অবধি মঁসিয়ে ভার্দু বলে এক গৃহস্থের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল টম।মঁসিয়ে ভার্দুর বাড়ির বাইরের ঘরে গ্রামের অতিথি হিসাবে আশ্রয় পেয়েছিল ।এদেরকে বলেছিল যে সে ব্রিটানির রাজধানী রেনে শহরের বাসিন্দা ।একা মানুষ । প্রৌঢ় বয়সে এসে মনে হয়েছে যে নিজের দেশকেই দেখা হলনা । তাই একা দেশ ভ্রমণে বেরিয়ে পড়েছিল সে । ব্রিটানির লালচে বালির রুক্ষ পাথুরে সমুদ্রসৈকত ধরে একা বহু পথ হেঁটে ক্লান্ত সে । এই প্যামপন্ট গ্রামে এসে মনের আরাম মিলেছে তার । সে এখন ভাবছে যে এখানেই স্থিতু হবে।
প্যারিস প্রভেন্স কি মার্সাইয়ের মানুষ হলে এমন একখানা আষাঢ়ে গল্প বিশ্বাস করত কিনা সন্দেহ । কিন্তু জায়গাটা ব্রিটানির প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল । এখানে কালে কপিশ্যেও বাইরের লোক আসেনা । গ্রামের মানুষের কাছে চুরি ডাকাতি করার মতোও কিছু নেই । কাজেই তাকে মোটামুটি সহজভাবেই নিয়েছিল গ্রামের মানুষ ।তার গল্পেও অবিশ্বাস্য কিছু পায়নি তারা ।তবে তার রোজগারের পথ সেভাবে কেউ দেখিয়ে দিতে পারছিল না ।নিজেদেরই চলা মুস্কিল তায় আবার অন্য কারুকে পথ দেখানো ! গ্রামের মোড়ল বুড়ো ম্যাথু তো বলেই দিল যে বেশিদিন কেউ কারুকে বসে খাওয়াতে পারবেনা । হয় সে নিজের ব্যবস্থা নিজে করে নিক নয় প্যাঁপোঁ ছেড়ে চলে যাক ।
টম এদেরকে কিকরে বোঝাবে যে কত কষ্ট করে সে এমন একটি মারীভয়হীন নিশ্চিন্ত জীবনের সন্ধান পেয়েছে ! এখানে শহরের কলকোলাহল নেই ধনীর ছুঁড়ে দেওয়া যন্ত্রণা বা অপমান নেই দারিদ্র্যকে সঙ্গী করে প্রাত্যহিক জীবনযাত্রার গ্লানিও নেই ! আছে শুধু উজ্জ্বল আকাশ নির্মল বাতাস আর পাখির কলতান । দুটি খাওয়ার জন্য মাথা বিকিয়ে দিতে হয়না এখানে ।