আঁধার যখন/চারপর্বের গল্প/পর্ব -৩

আঁধার যখন/চারপর্বের গল্প/পর্ব -৩

আঁধার যখন

নন্দিনী চট্ট্যোপাধ্যায়

 

 

টম আজ গ্রামের বিশাল দিঘিটার পাশে গিয়ে বসেছিল বিকেল নামছিল অরণ্য ঘন হয়েছে দিঘির পিছন থেকে তবে এই অরণ্যে ভয় কিছু নেই ছোট কিছু জীব জন্তু ছাড়া এখানে ভয়ঙ্কর কোন সাপ বা হিংস্র কোন জানোয়ার নেই ম্যাথু তো অন্তত তাকে সেই রকমই বলেছিল কিন্তু সাবধানের মার নেই দিঘির চারপাশে নত হয়ে আসা গাছগুলোর মাথায় ঝুঁঝকো আঁধার নেমে আসছে আশে পাশে কেউ নেই শীত পড়েছে মানুষজন সব ঘরের ভিতরে সেঁধিয়ে গেছে জঙ্গল থেকে দুই একবার  ছাগল জাতীয় প্রাণী ক্যাময়েসের ডাক শোনা গেল একটা বন্য বিড়াল বোধহয় কাছাকাছিই আছে টম তার গা ঘষার আওয়াজ পেল হালকা গর্জন করছে প্রাণীটা লিংক্স নামে এই বন্য বিড়ালগুলোকে চট করে দেখা যায়না কিন্তু হঠাত এসে পিছন থেকে আঁচড় দিয়ে যাওয়া বিচিত্র নয়

রাতে বন্য জন্তুদের হাঁটা চলার শব্দ বদলে যায় সরসর শব্দ হয় গাছের পাতায় ওরা দ্রুত ছুটে চলে যায় হয়ত বিপদের গন্ধ পায় ওরা টম কান পেতে বসে একদল হরিণের সরে যাওয়ার শব্দ পেল একদল রো ডিয়ার বা রেড ডিয়ার ছুটে গেল কোথাও আকাশে শীতের চাঁদ যেন সেভাবে আলো ছড়াতে পারছেনা টমের খুব শীত করে উঠল আজকের রাতটা কি খুব ঠান্ডা হবে ? সে তার আস্তানার দিকে পা বাড়াল আর তখনই তার মনে হল আচ্ছা ঐ ভাঙাচোরা বাড়িটায় যে মাদাম এসেছেন তিনি তো এই গ্রামের অন্য লোকদের থেকে আলাদা নিশ্চয়ই ধনীই হবেন ওঁর ভৃত্যটি বৃদ্ধ হয়েছে ওঁকে একবার অনুরোধ করে দেখলে কেমন হয় ? যদি তিনি টমকে ভৃত্য হিসাবে রাখেন তাহলে তার বাকি জীবন নিশ্চিন্তে কেটে যাবে আজই একবার যাবে কি সে ? দেখাই যাকনা টমের অনুরোধ রাখতেও পারেন তিনি টম ঠিক করল যে আজই একবার ওঁর সঙ্গে দেখা করতে যাবে সে এখনো বেশি রাত হয়নি এখন কোন ভদ্রমহিলার সঙ্গে দেখা করতে যাওয়া অশোভন হবে না

পায়ে পায়ে সেই ভাঙাচোরা একটেরে বাড়িটার সামনের উঠোনে গিয়ে দাঁড়াল সে প্যামপন্ট গ্রাম দূরে ঐ ছবির মতন দেখা যাচ্ছে গরাদ ভাঙা জানালার ফাঁক দিয়ে দূর থেকে দেখা যাচ্ছে যে বাড়ির বাইরের ঘরে একটা মোমবাতি জ্বলছে তার আলো এতই ক্ষীণ যে আলোর চেয়ে অন্ধকার ছড়াচ্ছে অনেক বেশি একটা জানালার গরাদ ভাঙা বলে পাল্লাটা কিছুটা খোলা কিন্তু এঁটে বন্ধ করা রয়েছে কাঠের তৈরি মস্ত দুয়োরখানা শীতে গাছের পাতা ঝরছে বাড়ির বাইরে বেশ কটা ওক গাছের পাতা ঝরে  এলাকাটায় একটা ঝরা পাতার বিছানা তৈরি করেছে  হাঁটতে গেলে অদ্ভুত একটা শব্দ হয় নিজের পায়ের শব্দে নিজেরই ভয় করে ওঠে টমের কিন্তু এখানে কি সে একা নয় ! আরও কেউ কি আছে এখানে ! তার পায়ের শব্দও যেন কর্ণগোচর হচ্ছে !সে অতি সন্তর্পণে হাঁটছে ! বোধহয় টমকেই অনুসরণ করছে সে ঐতো তার পায়ের নড়াচড়ায় অনেকগুলো  শুকনো পাতা যেন আচমকা সরে গেল কে ও ? কোন বন্য জন্তু ? না মানুষ ? হা ঈশ্বর !  

হঠাত টমের দুই পায়ের মাঝখান দিয়ে অত্যন্ত নরম কিছু একটা দ্রুত সরে গেল টম ভারসাম্য হারিয়ে পড়ে যেতে যেতে কোনমতে সামলে নিলতীক্ষ্ণ এক পাশবিক আর্তনাদ ছড়িয়ে গেল চারপাশে মনে হল সন্ধ্যার জমে ওঠা আঁধারটাও যেন একটু  নড়ে উঠল টম এবার সত্যিই আতঙ্কিত হল কোনমতে সামলে নিতে গিয়ে আছড়ে পড়ল মস্ত সেই এঁটে রাখা দুয়োরটার উপর কাঁপা গলায় আর্তনাদ করে উঠল —বাড়িতে কেউ আছেন ? —বাড়িতে কেউ আছেন ?

 দরজাটার উপরে আছড়ে পড়ছিল টমের আর্ত করাঘাত 

ঝনাৎ করে শিকলের আওয়াজ হল কেউ দরজা খুলছে মোমবাতি নিয়ে কাঁপা হাতে দরজা খুলল এক অশীতিপর বৃদ্ধ কে ? এখানে কী চাই ?

অদ্ভুত কাঁপা ফ্যাঁসফ্যাঁসে আওয়াজ  বৃদ্ধের গলার

‘আমি একটু আশ্রয় চাই আশ্রয় — আশ্রয় —দিন আমাকে—‘

বলতে বলতে ধপ করে মেঝের উপর বসে পড়ল টম এই গ্রামে আসা পর্যন্ত এমন বিচিত্র অভিজ্ঞতা তার কখনো হয়নি টম বুঝতে পারছিল যে তার জ্বর আসছে তেড়ে জ্বর প্লেগ হল নাকি তার ? জ্বর মানেই প্লেগ আর প্লেগ মানেই জ্বর —- এখানে এই প্যামপন্ট গ্রামেও কি প্লেগ এসে উপস্থিত হল ?

ক্রমশ জ্ঞান হারাচ্ছিল সে আধো চেতনায় সে একটি সুমিষ্ট কন্ঠ শুনতে পেল —‘কে এসেছে আন্দ্রেকাকা ? কে ?’

‘গ্রামবাসী কেউ হবে

‘কিন্তু এখানে কেন ? আমি তো কারো সঙ্গে দেখা করিনা

‘জানিনা কেন এসেছে কিন্তু এসেই খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছে

‘ঠিক আছে অসুস্থ মানুষকে যেতে বলা যায়না ওকে শোওয়ার জন্য একটা বিছানা দাও

একটি সুমিষ্ট স্বর এবং এক বৃদ্ধের অদ্ভুত কাঁপা ফ্যাঁসফ্যাঁসে আওয়াজের সমন্বয় শুনতে শুনতে তার সম্পূর্ণ চেতনা বিলুপ্ত হল পরদিন যখন তার জ্ঞান ফিরল তখন সে দেখল যে এক মহিলা তার মাথার কাছে বসে রয়েছেন রোদে সমস্ত ঘর ভেসে যাচ্ছে জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে ওক গাছের পাতাঝরা গাছের ডালের উপর নাম না জানা সব পাখিরা এসে বসে রয়েছে হল ঘরের পলেস্তারা খসা দেওয়ালে রোদের ছোঁয়ায় নানান নক্সা তৈরি হয়েছে

মহিলাটি আলোর মত হেসে জিজ্ঞেস করলেন ’আজ কেমন আছেন মঁসিয়ে?’

সেই সুমিষ্ট কন্ঠ ! জীবনে আরো কেউ একজন তাকে এই মঁসিয়ে সম্বোধন করল তার গা ম্যাজম্যাজ করছে মাথা ভার তবু এই সম্বোধন তাকে তৃপ্ত করল সে আবারো বিড়বিড় করে বলতে গেল ‘ আমি সামান্য একজন – সামান্য মানুষ—

‘তাতে কী ? সকলেই সামান্য আবার চাইলেই অসামান্য হতে পারে যাহোক আজ বাড়ি যেতে পারবেন তো? কেমন আছেন এখন ?

‘গতকালের চেয়ে অনেক ভাল

‘তাহলে আসুন আপনি মহিলাটি পত্রপাঠ বিদায় জানাবার জন্য প্রস্তুত হল

ছোট্টখাট্টো সাধারণ দর্শন মধ্যবয়সিনী কিন্তু আশ্চর্য সুন্দর কন্ঠস্বরের অধিকারিণীতাঁকে দেখলে তাঁর দিক থেকে চোখ সরানো যায়না তাঁর  কালো রঙের গাউন সাদার মিশেল দেওয়া গাঢ় বাদামি চুল আর মায়াময় চোখ তাঁকে সাধারণের চেয়ে আলাদা করে তোলে মার্সাইতে থাকতে অভিজাতদের বাড়িতে দীর্ঘদিন কাজ করে সে অনেক অভিজাত সম্প্রদায়ের মানুষকে দেখেছে কিন্তু এমন বিভাময়ী তো কখনো চোখে পড়েনি মহিলার ব্যক্তিত্বে কী ছিল কে জানে ! টম  এখানে যা বলবে বলে এসেছিল সেইসব কথা ভুলে গিয়ে তাড়াতাড়ি মহিলাকে ধন্যবাদ জানিয়ে চলে আসার জন্য প্রস্তুত হয়

মহিলা বলেন ‘ আপনি বাড়ির পিছনের দরজা দিয়ে চলে যান আমার বাড়িতে আমি কারুকে ঢুকতে দিইনা আপনাকে বেরোতে দেখলে পাঁচজনে নানান কথা আলোচনা করবে

‘কিন্তু আমি এই বাড়ির কিচ্ছু চিনিনা

মহিলা হাসলেন ভুবন ভোলানো হাসি বললেন ‘ আন্দ্রেকাকা আপনাকে পথ দেখিয়ে দেবে ও বাইরেই দাঁড়িয়ে রয়েছে যান চলে যান

আন্দ্রেকে দেখা যাচ্ছিল ঘরের অন্যদিকটা দিয়ে বেরোলে একটি লম্বা বারান্দার একেবারে শেষে আন্দ্রে দাঁড়িয়ে রয়েছে তার পরণেও কালো পোষাকপোষাকের একাংশ বিবর্ণ হয়ে গেছে বিবর্ণতাটা এখান থেকেও ধরা পড়ছেএই বারান্দাটায় সূর্যের আলো সেভাবে ঢোকেনা বারান্দাটা পেরোবার সময় টমের কেন যেন মনে হচ্ছিল যে  লুকোনো ফোকর দিয়ে কারা যেন তাকে অবিরাম লক্ষ্য করে যাচ্ছে হালকা খসখস শব্দ ! অদ্ভুত অস্বস্তিকর একটা অনুভূতি !

  বাড়ির বাইরে বেরিয়ে স্বস্তি পেল সে আজ শরীরটা অনেক তাজা লাগছে নাহ প্লেগ হয়নি তার হয়তো ঠান্ডা লেগে গেছে এখানে প্লেগ আসবেই বা কিভাবে ? নিজেকেই নিজে প্রবোধ দেয় টম

সকালে মঁসিয়ে ভার্দুর বাড়িতে  গেলে তারা নানান প্রশ্ন করল গতকাল টম বাড়ি ফেরেনিএতে তারা খুব চিন্তিত হয়েছিল এসব কথাই বারবার বলল টমের ভারি ভাল লাগল এই আন্তরিকতাটুকু সে বলল যে সে  অন্য গ্রামে কাজ খুঁজতে গিয়েছিল রাত হয়ে যাওয়ায় আর ফেরেনি রাতে প্রাতরাশ খেয়ে টম জঙ্গলের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লসারাদিন সেই দিঘিটার ধারেই একা বসে রইল সে তার দুই কানে বাজছিল এক অপূর্ব সুমিষ্ট কন্ঠস্বর –মঁসিয়ে–মঁসিয়ে তার এই এত বছরের জীবনে কখনো কোন মহিলার কথা  ভাবতে ভাল লাগেনি তার মার্সাইতে তার বন্ধুবান্ধবেরা বলত যে টম হয় পাগল নয় অস্বাভাবিক নইলে একজন সমর্থ পুরুষমানুষ হয়েও মেয়েদের প্রতি তার আগ্রহ জাগেনা কেন ? বন্ধুরা কতদিন তাকে সস্তার গণিকালয়েও নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে কিন্তু সে স্রেফ পালিয়ে বেঁচেছে কিন্তু আজ এই চূড়ান্ত অসময়ে প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছে তার চুপ করে থাকা মন আজ কেন এত কথা বলে উঠল ! তার কেবলি মনে পড়ছিল সেই অনবদ্য কথাখানি –সকলেই সামান্য আবার চাইলেই অসামান্য হতে পারেতার মতন সামান্য মানুষও কি তাহলে অসামান্য হতে পারে ? বহু বেদনায় সহিষ্ণু টমের  পঞ্চান্ন বছরের  চেতনা কেমন বীণার মত বাজতে লাগল সারাটা দিন ! ভাঙাবাড়ির অপরিচিতা তার সমস্ত চেতনার উপর অধিকার বিস্তার করল একী হল তার ?

 বিকেল হতে বাস্তবে ফিরল সে আরে আজ তো সে মহিলাকে একবার কাজ দেওয়ার কথা বলতে পারত যে কথা বলতে ওখানে যাওয়া সেই কথাটিই কেমন করে ভুলে গেল সে ? নাহ আজ আবার সে সেখানে যাবে আর সেই কথা্টি সেই অসামান্যা মাদামকে জিজ্ঞেস করে আসবে বলবে ‘ মাদাম আমাকে আশ্রয় দেবেন ? আমি নিরাশ্রয় যে কাজ আমাকে দেবেন আমি সেই কাজই করব

কিন্তু আজ যাবে না আগামীকাল  সকালে যাবে এই কথা ভাবতে গিয়ে আরো কিছুটা সময় গেল   সন্ধ্যের আঁধার যথারীতি ঝরে পড়ল মাথার উপর বন্য জন্তুদের চলাচলের আগেই এই জায়গা ত্যাগ করা ভাল মোড়ল ম্যাথু বুড়ো যদিও বলেছে যে এখানে সাপ খোপ নেই তেমন তবু সাবধানের মার নেই টম উঠে পড়ল আর কী এক অমোঘ আকর্ষণে পায়ে পায়ে হাঁটতে লাগল মাদামের সেই ভাঙাচোরা অট্টালিকার দিকে গত রাতের সেই ভয় ভয় অভিজ্ঞতার কথা এখন সে মন থেকে মুছে ফেলেছে মনের মধ্যে আলতো ছোঁয়ায় জাগছে শুধু সুমিষ্ট কন্ঠস্বরে বলা একটি সম্বোধন –মঁসিয়ে—মঁসিয়ে মানুষ হিসাবে সম্মান পাওয়ার এক অপরূপ মুহূর্ত

 আজকেও সেই আঁধারভরা উঠোন পেরিয়ে বাড়িটার দিকে হাঁটছিল সে আজকে কিন্তু সেই ওক গাছের ঝরা পাতাগুলো বিছিয়ে নেই সেখানে হয়তো আন্দ্রে কাকা ঝাঁট দিয়ে পরিষ্কা্র করেছে সব নিঃশব্দে হাঁটছিল টম হঠাতই কোন একটা অস্বাভাবিক বোধ তার গতি রোধ করল সে ঝট করে একটা ওক গাছের আড়ালে সরে গেল আঁধারটা একটু চোখে সইলে অনুভব করল যে বাড়িটার আশে পাশে কারা যেন সব জড়ো হয়েছে কারা এরা ? এরা তো এই গ্রামের লোক নয় পরণে কালো আলখাল্লার মত পোষাক মাথা ঢাকা কালো কাপড়ে প্রত্যেকের হাতে একটা করে লম্বা সাদা মতন কিছু রয়েছে কিন্তু কী ওগুলো ? লাঠি  ? নাঃ লাঠির মত তো মনে হচ্ছেনা ! এক মুহূর্ত পরেই টম আবিষ্কার করল যে ওগুলো লাঠি নয় ওগুলো মানুষের হাড় ! টম আপাদমস্তক কেঁপে উঠল কিন্তু ওই যে কাদের কথা শোনা যায় ! একটি কন্ঠ অপরিচিত কিন্তু আর একটি যে ভীষণ চেনা ওই সুমিষ্ট  কন্ঠস্বরের অধিকারিণীকে সে চেনে তাঁর কাছে আসার জন্যই আজ সে এখানে আবার ছুটে এসেছে

টম কান পেতে শুনতে লাগল সেই কথোপকথন।।

পুরুষকন্ঠটি ভয়াল এবং কর্তৃত্বব্যঞ্জক ‘ আপনার কাছে যা আছে আমাদের হাতে ছেড়ে দিন মাদাম

‘আমার প্রাণ থাকতে আমি তোমাদের কিছু দেবনা ।‘

পুরুষকন্ঠ ব্যঙ্গাত্মক হাসল ‘ কিছুই আপনার হাতে থাকবেনা মাদাম ওই দেখুন আমার লোকেরা এসেছে আপনার কাছ থেকে সব কিছু ছিনিয়ে নেবে তারা

মহিলার সুমিষ্ট কন্ঠ এবার বিকৃত শোনায় ‘ জেনে রাখ শয়তানের শক্তি কখনো বেশি হয়না আমার ভালবাসা তোমাদের পরাজিত করবে

পুরুষকন্ঠ  আবার ব্যঙ্গাত্মক হাসল ‘ কে শয়তান মাদাম ? আপনি তো নিজেই শয়তানের দুত অশুভ প্রভাব ছড়িয়ে দিচ্ছেন ফ্রান্স ভয়াবহ মহামারীর কবলে পড়েছে এসবই শয়তানের অশুভ প্রভাবের কারণে হচ্ছে আমরা ফ্রান্সের দিকে দিগন্তরে  ঈশ্বরের আশীর্বাদ ছড়িয়ে দিচ্ছি শয়তানের প্রভাবকে ধ্বংস করছি আপনি আমাদের কথা শুনলে ভাল নইলে আমরা ফ্রান্সের ভালোর জন্য যে কোন কাজ করতে দ্বিধা করবনা

মহিলার কন্ঠে এবার স্পষ্ট কান্নার সুর ‘ তোমরা যাই করোনা কেন আমার ভালোবাসার কাছে তোমরা সকলে হারবে ঈশ্বর আমাকে সাহায্য করবেন তোমাদের নয় কেন পিছু করছ আমার ? মুক্তি দাও আমাকে

‘আপনি সকলের ক্ষতি করছেন তাই আপনাকে আমরা ছাড়বনা সমস্ত অশুভ প্রভাব ধ্বংস করে তবে আমরা যাব ঈশ্বর আপনাকে কখনো সাহায্য করবেন না

জানালা বন্ধ হওয়ার আওয়াজ কানে আসে টম বোঝে যে বাইরের ঘরের সেই আধভাঙা জানালাটার পিছন থেকে কথা বলছিলেন মাদাম জানালার ছিটকিনি অক্ষত রয়েছে তাহলে নইলে ও জানালার ভাঙা পাল্লাগুলো জড়ো করে আটকানো যেতনা

মাদাম জানালা বন্ধ করে দেওয়ার পরেই আক্রোশে ফেটে পড়ে লোকটি তার চাপা আক্রোশের জান্তব ধ্বনি রাতের আঁধারটাকে চিরে দিচ্ছিল মুখ থেকে অদ্ভুত একপ্রকার শিসের মত আওয়াজ করল সে দ্রুত সেই কালো পোষাক পরা লোকগুলি  প্রথম লোকটির কাছে এসে জড়ো হল কালো আঁধারের স্তূপের মত কয়েকটি আঁধারের মূর্তি হাতে ধরে থাকা হাড়গুলি মাটিতে বৃত্তের আকারে গোল করে পুঁতে দিল তারা তারপর প্রথম লোকটি সঙ্গের ঝোলা থেকে বের করল একটি মূর্তি পুঁতে রাখা হাড়গুলির মাঝমধ্যিখানে রাখল সেই মূর্তিটি শীতের মরা চাঁদের আলোয় মূর্তিটিকে ভয়াল দেখাচ্ছিলএকহাত লম্বা কাঠের  মূর্তি কিন্তু তার অবয়ব কঙ্কালের অবয়বের মত মূর্তির হাতে একটি কুঠার কালো পোষাক পরা ছায়ামূর্তির মত মানুষগুলি বৃত্তের চারপাশে ঘুরে ঘুরে নাচতে লাগল মুখে তাদের বিচিত্র ধ্বনি মাঝে মাঝে ‘আঙ্কু’ বলে একটি শব্দ শুনতে পাওয়া যাচ্ছিল আর প্রতিবার এই শব্দ উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে মূর্তিটা যেন একটু করে  কেঁপে উঠছিল

কিছুক্ষণ পরে হঠাত কোথায় যেন চলে গেল  লোকগুলি কিন্তু উঠানের মাঝমধ্যিখানে দাঁড়িয়ে রইল একহাত লম্বা  সেই কাঠের ভয়াবহ দর্শন মূর্তিটি নিষুত রাত তখন চাঁদের আলোর মায়ারাজ্য ভয়ালদর্শন সেই মুর্তি শুধু আতঙ্ক ছড়াচ্ছে মূর্তির গা থেকে অমন আলো বেরোচ্ছে কেন ? মার্সাইতে থাকতে টম দেখেছিল যে কুস্তিগীররা যখন রাতের বেলা চাঁদের আলোয়  কোন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করত তখন তারা গায়ে একরকম তেল মাখত তাতে তাদের গা চকচক করত এই মূর্তির গায়েও কি অমন কিছু মাখানো রয়েছে নাকি ঐ  চকচকে ভাব কোন অপার্থিব মায়া ? টমের বুকের মধ্যে ধড়াস ধড়াস করে নিজের হৃদপিন্ডের শব্দও কি শুনতে পাচ্ছে সে ?

পালাতে গেলে পথে যদি ঐ লোকগুলির সঙ্গে দেখা হয়ে যায় ? আজকের রাতটা কি মাদামের এই অট্টালিকায় কাটাবার সুযোগ পাওয়া যাবে ? কে ওই লোকগুলি ? হঠাত কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল ওরা ? কী আছে মাদামের কাছে ? লোকগুলি  মাদামকে শয়তানের দূত বলছেই বা কেন ? বহু প্রশ্ন  দলা পাকিয়ে টমের প্রৌঢ় চেতনায় শুধু আঘাত করতে লাগল হঠাত রাত্রির নিস্তব্ধতা ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে অট্টালিকার পিছন থেকে ভেসে এল এক আর্ত চিতকার রাতে অল্প আওয়াজও অনেক বেশি বলে মনে হয় কিন্তু কে চিতকার করল ? গলাটা যে বড্ড চেনা !আন্দ্রে কাকা না ? টম কোনোমতে হাঁপাতে হাঁপাতে গিয়ে পৌছাল বাড়ির পিছনদিকের সেই দরজাটার কাছে এই দরজাটা দিয়েই গতকাল আন্দ্রে কাকা তাকে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে যেতে সাহায্য করেছিল কিন্তু দরজা অবধি পৌঁছাবার আগেই থামতে হল তাকে পায়ে কী যেন লাগল ! চটচটে মতন কী যেন একটা ! নিচু হয়ে দেখতে গিয়ে স্থবির হয়ে গেল সে আতঙ্কে শীতল হয়ে যাওয়া হাতদুটি দিয়ে তুলে নিল  সেই গোলাকার বস্তুটি দুষ্কৃতীরা পালিয়ে যায়নি বাড়ির পিছন দিক দিয়ে দরজা ভেঙে বাড়িতে ঢুকেছিল তারা হয়ত অতিবৃদ্ধ আন্দ্রে তার সবটুকু ক্ষমতা ব্যয় করে ওদের ঠেকাতে চেষ্টা করেছিল কিন্তু ওরা বৃদ্ধের এই স্পর্ধার দাম চুকিয়ে গেছে তীক্ষ্ণ কোন অস্ত্র দিয়ে ধড় থেকে তার মাথাটি বিচ্ছিন্ন করে রেখে গেছে ওরা ঐতো ধড়টিও কয়েক হাত দূরে পড়ে রয়েছে রক্তের স্রোত বয়ে যাচ্ছে চারিদিকে !

হা ঈশ্বর ! বৃদ্ধের জীবনের এই পরিণতি হল ! কিন্তু ওরা এখন কোথায় ? টমকে এখানে এখন দেখলে টমের অবস্থাও যে আন্দ্রের মতই হবে এখন সবচেয়ে আগে খুঁজে বের করতে হবে মাদামকে তাঁকেও কি ওরা হত্যা করে রেখে গেছে ? হঠাত টমের বুকের ভিতরটা ধ্বক করে উঠল তার মনে হল যা থাকে কপালে সারা বাড়িটা একবার খুঁজে আসি যদি মাদামকে খুঁজে পাওয়া যায় ! হয়ত একা কোথাও লুকিয়ে বসে সময়ের পল অনুপলগুলি ভয়ঙ্করভাবে কাটিয়ে চলেছেন মাদাম এই মুহূর্তে মাদামকে রক্ষা করার বাইরে আর কোন কাজ যে তার থাকতে পারে একথা মনে এলনা টমের একটু আগে দেখা আন্দ্রে্র মৃতদেহ, এই অন্ধকার বাড়ি্‌, নিষুত রাত ,ওই কালো পোষাক পরা ভয়ঙ্কর লোকগুলির আগমন টমকে আতঙ্কের শেষ সীমায় নিয়ে গিয়ে ফেলেছিল তবু কোন এক বোধ তাকে এই মুহূর্তে পরিচালিত করল এই বোধের নাম কী সে জানেনা কিন্তু সেই বোধ তার চেতনাকে অধিকার করেছিল নিজের ভালর চেয়েও অন্যের ভাল চাইবার  আকাঙ্ক্ষায়  সে অতি সন্তর্পণে সেই অন্ধকার ঘরগুলি ঘুরে দেখবার চেষ্টা করছিল মোমবাতি জ্বলছিল একটা কোথাও কিন্তু সেই মোমের আলো তার উপস্থিতিকে চিহ্নিত করবে তাই সে আঁধারেই রইল টম এঘর থেকে সেঘর মার্জারগতিতে হাঁটতে লাগল

 

Nila Banerjee

পুকুরঘাট

একদিন আমরা মাত্র কয়েকজন সদস্য নিয়ে পুকুরঘাট নামের একটি মেয়েদের ভার্চুয়াল দল খুলে ছিলুম। অচিরেই সে কয়েকটি সদস্যের দল কয়েক হাজার সদস্যের মেয়েদের দল হয় ওঠে। পুকুরঘাট দলের মত এত গুণী মেয়েদের সমাহার বাংলাদেশে খুব কম ভার্চুয়াল দলে আছে। কাজেই সেই দল সেখানেই আটকে থাকবে না বলা বাহুল্য। তাই পুকুরঘাট দলের অন্যতম উদ্যোগ হিসেবে প্রকাশিত হলো পুকুরঘাট পত্রিকা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Others Episodes