আশ্রিতসুখ পর্ব – ৩

আশ্রিতসুখ পর্ব – ৩

কস্তুরি চট্টোপাধ্যায়

 

নিঃসঙ্গ নির্জনাবাসে মাঝে মাঝে চলে যাওয়া ভালো। আমাকে ঘিরে থাকে যেসব মানুষজন তাদের একটু একটু করে পড়া যায়। এই পড়ার শেষ নেই। এই বুঝি কাউকে পড়তে পারলাম, তাকে কিছুটা বোঝাও গেলো, পরের মুহুর্তেই যেন আর তাকে ধরা গেলো না। তারপর একটা অদৃশ্য গোলকধাঁধায় পড়ে যেতে হয়। তখন এই চেনা মানুষটা খুব সহজে হাঁটতে হাঁটতে অক্লেশে কেমন অচেনার দিকে চলে যায়। কখনও মনের একেবারে বাইরে। তখন আবার নতুন করে তাকে জানতে বসি। এই জানাশোনার গল্পটা চলতেই থাকে। এই একা থাকাটা তাই আমাকে খুব টানে। একাত্মবাসে বসে এই জানাশোনার খেলায় কখনও জিতি কখনও হেরে যাই। জেতাটাও কী জেতা? সেটাও তো একরকমের হেরেই যাওয়া। এই হার জিতের মধ্যেই নিজেকে খুঁজে পাওয়া যায়। অনেক অঙ্কের উত্তর মিলে যায়। অনেক সহজ অঙ্কের উত্তর আবার মেলেওনা। সব অঙ্কের উত্তর মিলে যাবে এমনটাও হবার কথা ছিল কি?’

 

লাল মলাটের ডাইরীর পাতাটা বন্ধ করে মালিনী। ডাইরী লেখবার অভ্যেস ধরিয়েছিল ছোটকাকা। তখন কাঁচা বয়েস। বয়সটাকে তখন ওভাবেই বেঁধে দেওয়া হতো। মন খারাপের অলিতে গলিতে ঘোরাফেরা করবার সহজ উপায়। নানারকম আরোপিত নিয়মকানুনের বেড়াজালে ওই ছোট্ট বয়েসটাকে যেন একটানে বড়োরা বাড়িয়ে দিতেন। একা রাস্তায় বেরিও না, পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে রাস্তায় কথা বোল না, পাড়ার দাদাদের দিকে এখন আর তাকিও না, বড়ো হয়েছ। ফ্রকটা টেনেটুনে বসো, এমন কি বাবা কাকাদের সামনেও। যাঁদের কোলে পিঠে বড়ো হয়েছি। সেই বয়সে বড়ো কি সত্যিই হয়েছিলাম? না ছোট্টকালটাকে, তাদের শৈশবটাকে জোর করে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছিল? জেদ করে যেন টেনে বড়ো করে দেওয়া হতো ওদের মেয়েবেলাটাকে। নিষেধের বেড়াজালে ছটফটিয়ে মরতো নিষ্পাপ শিশুমন। কফির কাপটা নিয়ে বারান্দায় বেতের দোলনাটায় বসে রোজ এসব এলোমেলো কথা ভাবে ও। ওর সঙ্গে দুলতে থাকে শৈশবের নরম হলদেআভার দিনগুলো। দুলতে থাকে কিশোরীবেলার আলোআঁধারি মাখা ফিসফিসে গুনাহ। বাতাসে তিস্তার গন্ধ ভেসে আসে। ভেসে আসে জলপাইগুড়ির ঋতুকালগুলো, শেষ বিকেলে সূর্যাস্তের মৃতআলো, সন্ধের আকাশে তারাদের বিলাস সব ভেসে আসে কলকাতার দশতলার জানালায়। না চাইলেও ওরা আসে। কোনটার ভার বেশি কোনটার কম। সুখ দুঃখের কথা বলে। পারস্পরিক দেওয়া নেওয়ার সেই সময়টুকু মালিনীর কাছে খুব দামি।

বিকেল নামছে আস্তে ধীরে। শহরের গায়ে আবছা অন্ধকারের চাদর। শিলিগুড়িতে ওদের যৌথ পরিবারে মালিনীর ছোট্টকাল ঠাকুমা দাদু কাকা পিসিদের নিয়ে বড়ো ভালো কেটেছিল। মালিনী যখন ক্লাস এইটে তখন বাবা হঠাৎ জলপাইগুড়িতে বদলি হয়ে যান। বাবা ছিলেন ব্যাঙ্কের ম্যানেজার। চাকরির দায়, এড়ানোর উপায় ছিলনা। স্ত্রী আর দুই কন্যা নিয়ে তারপর জলপাইগুড়িতে থিতু হন বাবা। মালিনী তখন ক্লাস এইট, তেরো। যে সময়টাতে তখন কিছু নিরিবিলি কথা মনের ভিতর ফাঁক ফোকর খুঁজতো কাউকে বলার জন্য অথচ বলা যেতোনা, কাউকে দেখে বুকের ভিতর রাঙা ঢেউ উঠতো অথচ বলা হতোনা, কিছু অসমাপ্ত স্বীকারোক্তি যা হয়তো কখনও করা হতোনা, কিছু নিয়মভঙার খেলা যা হয়তো খেলা হতোনা, সেইসব কথাই সেই বয়সে ডাইরীর পাতায় উজার করে দেওয়া যেতো। যেন মনের আয়না। সব কথা ফিসফিসিয়ে যার কাছে বলা যায় নিশ্চিন্তে। প্রতি রাতে ঘুমোতে যাবার আগে কিছুটা প্রাণের কথা ডায়েরীর পাতায় লেখাটা ওর অভ্যেস হয়ে গিয়েছিল তখন থেকেই।

সকাল থেকেই আজ শরীরটা ভালো লাগছিল না। ক্লান্ত অবসন্ন মনটাও আজ সঙ্গ দিচ্ছিলনা। ভেবেছিল আজ অফিস যাবে না। আজ ও ভালো নেই। অফিসে গেলেও মন দিয়ে কোন কাজ করতে পারবেনা ও। অনেকক্ষণ মালিনী চুপ করে বসে রইল। কাল ফোনটা পাবার পর থেকে কেমন যেন অকারণ অবসাদ ঘিরে আছে। শরীর কাঁপছে। কেন জানিনা কাল থেকে সারাক্ষণ জলপাইগুড়ি ওর মন জুড়ে বসে আছে। যখন ফোনটা কাল এসেছিল তখন খুব মন দিয়ে একটা স্টোরি লিখছিল। কালকের কাগজেই ধরাতে হতো। তাই অন্য কোন দিকে মন ছিল না ওর। ফোনটা বাজলে বিরক্তমুখে ধরে। অচেনা নম্বর। ‘হ্যালো’ বলতেই ভারী একটা গলা ভেসে আসে।

 

— মালিনী? আমি জয়। জয়ব্রত চিনতে পারছো?

 

মালিনীর সারা শরীর যেন টলে উঠেছিল। জয়ব্রত!! এতোদিন পরেও এই স্বর ভোলেনি ও। বুকের মধ্যে যেন চলকে উঠলো পুরোনো কিছু সময়ের সোঁদা গন্ধ। পলিপড়া এতোগুলো দিন মাস বছরের জমাটবাঁধা অন্ধকারের সরিয়ে আচমকা…কেন? কিছু সময় পড়ে থাকে তুমুল অবহেলায় মনের গহীন এক কোণায়, শূন্য গোলার্ধে যেন একমুঠো আয়ুষ্কাল নিয়ে। সময় যতো যায় পরতে পরতে বহুসংখ্যক জড়ত্ব নামে যেন ইহজীবনের গায়ে। তবুও ওই একমুঠো কোটরবন্দী সময় ধমনীর মধ্যে দিয়ে যেন নিরঙ্কুশ বয়ে চলে। সে যেন এক দাহনক্ষেত্র। শুধু পোড়ায়। সেই দ্রোহকাল অনেককাল পেরিয়ে এলেও মন অন্তরীক্ষে জীবিত শেষ প্রণয়টুকু বোধহয় খোঁজে জীবনভর। এক ফালি চাঁদের ফিকে আবছা আলোর মতো রয়ে যায় কোষের ভিতর। নিরুদ্ধ, স্থরিত। সেই কবে থেকে অনেক শঙ্কাবীজ অনেক ঘৃণা অনেক বিরাগ অনেক কষ্ট মনের ভিতর জমিয়ে রেখেছে। রোজকার জীবনের হাজারো কাজের মধ্যেও ওরা ফিরে ফিরে আসে। শিকড়ের গায়ে ঘূণ ধরেছে তবুও গলানো বিষাদের মতো ওরা শরীর জুড়ে থাকে, থেকে যায়।

অনেকগুলো দিন, অনেকগুলো বছর মালিনী ভালো ছিল না। কোনমতে ভেসে থাকা কিনারাহীন হয়ে। শুধুমাত্র এই মানুষটার জন্য। ভিতরে ভিতরে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছিল সেইদিন, হঠাৎ যেদিন কাউকে কিচ্ছু না বলে একেবারে উধাও হয়ে গিয়েছিল জয়ব্রত। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস খুঁজেছিল মালিনী। বাবাকে সঙ্গে নিয়ে কলকাতায় এসেও অনেক খুঁজেছিল। পায়নি, তারপর থেকে শুরু হয়েছিল নিজের সঙ্গে লড়াই। যন্ত্রনার সেইসব দিন একটু একটু করে পার হতে গিয়ে ও সবকিছু হারিয়েছে। সর্বশান্ত হয়েছে। চরাচর জুড়ে শুধু লজ্জা অপমান আর অবসাদ পড়েছিল। অনেকগুলো বছর লেগেছিল। শরীর থেকে জীবন থেকে দাগ তুলতে। একটু একটু করে জীবনে ফিরেছিল ও। অস্থির রৌদ্রদহন শেষে শোক ভুলে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল আবার। দিনের পর দিন লড়াই চলেছিল নিজের সঙ্গে। সব ভুলে এখন ভালো থাকার চেষ্টা করে। চোরা স্রোতের মতো নির্বাসিত কিছু সময়ে একেবারে একা অনেকটা পথ হেঁটেছিল মালিনী। সম্পূর্ন একা ভিজেছিল রাতগভীরের অন্ধকারে। মা বাবা ছাড়া কেউ ছিলনা পাশে।

— মালিনী কথা বলো প্লিজ। চিনতে পারছো আমায়?

 

বাড়তি আশ্রয়টুকুর জন্য পাশের খালি চেয়ারটার হাতলে হাত রাখে মালিনী। নিজেকে সামলায়। একসময় মেঘপুরুষের মতো লাগতো জয়দাকে। হ্রদয় মন অথবা অলৌকিক কোন স্বপ্নচারণ নিয়ে জয়দার সঙ্গে কতো হিমরেখা পার করতো। দিনের পর দিন। জয়দা জানতও না।

 

— না। পারছি না। কুড়িটা বছর খুব কম সময় নয় কাউকে ভুলে যাবার পক্ষে। আমি এখন এই

সময়টা নিয়ে বাঁচছি। বাকিটা ভুলে গিয়েছি।

— জানি। এটাই তো স্বাভাবিক। কেমন আছো?

— আমি কেমন আছি তা জানবার অধিকার আমি কাউকে দিইনি। যেমন আপনি কেমন

আছেন তা জানবার বিন্দুমাত্র আগ্রহ আমার নেই।

— তাও জানি। জেনেই তোমাকে ফোন করছি।

— আমি ব্যস্ত…

— রেখো না মালিনী, প্লিজ। কিছু কথা তোমাকে বলার আছে। পুরোন দিনের চেনা পথে

আরেকবার নাহয় হাঁটলে কিছুক্ষণ। ক্ষতি তো নেই।

— ক্ষতি? জ্বলে উঠল নদীর চোখ। চাইলেও গলার স্বরে ঘেন্না লুকোতে পারল না ও। এতোদিন

পর লাভ ক্ষতির হিসেব?

একসময় নদীকে সর্বস্বান্ত করে দিয়েছিল এই মানুষটা। এখন ওর এই নিভাঁজ সময়ে নতুন

করে কোন ঝড় তুলতে দেবে না ও।

 

— ফোনটা রেখো না মালিনী প্লিজ। শোন, এতোদিন পর এই শহরে এসেছি দুটো কারণে। প্রথম

কারণ তোমার সঙ্গে দেখা করা আর দ্বিতীয় কারণটা হলো-

— এক মিনিট, থামিয়ে দেয় মালিনী। সারা শরীর ঘেন্নায় কুঁকড়ে যাচ্ছে ওর।

এতোদিন পর আপনি কেন এই শহরে এসেছেন জানতে চাই না জয়ব্রত। কোন আগ্রহ

নেই। আপনার মতো একটা মেরুদন্ডহীন কাপুরুষের সঙ্গে আমার কখনও দেখা হয়েছিল

ভাবতেই এখন আমার ঘেন্না হয়।

— মালিনী, অনেক কষ্টে তোমার মোবাইল নম্বরটা পেয়েছি। একবার দেখা করো প্লিজ, অনেক

কিছু বলবার আছে তোমাকে, বিশ্বাস করো অনেক কিছু শোনারও আছে।

— এখন চৌকাঠের ওপারে কিছু দেখতে পাইনা আমি, যেখানে শুধু অন্ধকার।

— রাত শেষ হলে অন্ধকার কেটেও যায়। হাত বাড়িয়ে আলোটুকু তখন নেওয়াই যায়।

— এসব কথা আমাকে আর স্পর্শ করে না। বহু পুরোন লজ্জার রাতদিন আমি অনেক আগেই

পেরিয়ে এসেছি। আমার কাছে এখন কুটোর মতো ভাসে ওসব ধুলোখেলা।

আগাম কোন আভাস না দিয়েই ফোনটা কেটে দিয়েছিল নদী।

কস্তুরি চট্টোপাধ্যায়

 

Nila Banerjee

পুকুরঘাট

একদিন আমরা মাত্র কয়েকজন সদস্য নিয়ে পুকুরঘাট নামের একটি মেয়েদের ভার্চুয়াল দল খুলে ছিলুম। অচিরেই সে কয়েকটি সদস্যের দল কয়েক হাজার সদস্যের মেয়েদের দল হয় ওঠে। পুকুরঘাট দলের মত এত গুণী মেয়েদের সমাহার বাংলাদেশে খুব কম ভার্চুয়াল দলে আছে। কাজেই সেই দল সেখানেই আটকে থাকবে না বলা বাহুল্য। তাই পুকুরঘাট দলের অন্যতম উদ্যোগ হিসেবে প্রকাশিত হলো পুকুরঘাট পত্রিকা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *