আশ্রিতসুখ পর্ব-১

আশ্রিতসুখ পর্ব-১

কস্তুরী চট্ট্যোপাধ্যায়

প্রথম যেদিন মায়ের হাত ধরে কলকেতা শহরটায় পা রাখে সাবি তখন তার বয়স দশ। ক্যানিং থেকে বালিগঞ্জ ইস্টিশন।তারপর এ গলি সে গলি হেঁটে মায়ের পিছু পিছু বড়ো সাদা বাড়িটার সামনে এসে যেদিন পেরথম  দাঁড়িয়েছিল, মনে হয়েছিল সেই কোন ছোট্টকালে রূপকথার গল্পে শোনা রাজার বাড়ি যেন। তিনতলা বাড়িটার ধবধবে সাদা দেওয়াল জুড়ে একপাশে বেগুনী ফুলের ঝাড় মাটি থেকে উঠে ছাদ ছুঁইছুঁই। তখন এই রূপসী গাছখানার নাম জানতো না সাবি। পরে জেনেছে। বাহারী গাছের নামটিও বেড়ে। বোগেনভেলিয়া। কোন সাত সমুদ্দর পার থেকে এসেছিল কে জানে। চোখ জুড়োন গাছ বটে। পরে এ বাড়ির দাদু বলেছিল আরও হরেকরকম রঙও নাকি আছে সুন্দরপানা এই গাছটার। অহংকারে যেন চাদ্দিক আলো করে রেখেছে। সাবিদের গাঁয়ে এমনতর গাছ একটাও নেই। বেল গাঁদা দোপাটি জুঁই আর নয়তো শাল বট আম জাম।

সেই প্রথম শহর কলকেতায় পা রাখা কচি মেয়েটার। বড়ো বড়ো চোখে অগাধ পাগলপারা বিস্ময়। চোখের সামনে রাজার বাড়িটা দেখে হঠাৎ কেন জানি না তাদের গেরামের উঠোনঘেরা ছায়া মাখা মাটির ঘরটা একঝলক মনের ভিতর ভেসে উঠেছিল সাবির। ঘরের সামনে এক চিলতে মাটির দাওয়া। তারই একপাশে দরমা দিয়ে আড়াল করে মা পাঁচ বাড়ি কাজ সেরে এসে রান্না করে। বাকি এক টুকরো উঠোনে বসে সাবি রান্নাবাটি খেলে। সন্ধে নামলে ঘরের ভিতর মেঝেতে ছেঁড়া মাদুরটা পেতে কুপী জ্বেলে একখানি রঙচটা বই নিয়ে বসে। মলিন খাতায় ঝুঁকে বসে লেখে তিন এক্কে তিন, তিন দুগুনে ছয়…।

ওদের গেরামের মধ্যিখানে খড়ের ছই দেওয়া একখানা গোলমতো জায়গা আছে। অবিন মাস্টার তার চারিপাশে সরু বাঁশের কঞ্চির বেড়া দিয়ে দিয়েছে। গোল করে বেড়ার ধারে ধারে কয়েক খানা ফুলের গাছও লাগিয়েছে। তার ভিতরে জনা তিরিশেক বাচ্চা জুটিয়ে রোজ সকালে সেখানে পড়ায়। ওটাই অবিন মাস্টারের ইস্কুল। ইস্কুল বলতে ছই দেওয়া জায়গাটুকুতে মাটি লেপা একটু উঁচু মেঝে। সেখানে সকালে সাবির মতো জনা কয়েক জড়ো হয়। চার থেকে বারো। খান কয়েক মাদুর আর চাটাই পাতা। সেখানে বসে সকলে মন দিয়ে লেখাপড়া করে। অবিনমাস্টার লেখাপড়ার বাইরে অনেকরকম গল্পও শোনায়। দুচোখে আবিল বিস্ময় নিয়ে সাবিরা যেন কল্পনায় গল্পের এক একটি চরিত্র হয়ে ওঠে। রাজা রাণী রাজকন্যে পাইক বরকন্দাজ। সন্ধেবেলায় সেখানে অবিন মাস্টার বড়োদেরও ক্লাস নেয়। কারো বাপ, কারো কাকা, কারো মা আসে পড়তে। কয়েকখানা হ্যারিকেন জ্বলে। লাজুক মুখে দুলে দুলে পড়ে ওরা, যেমন মাস্টার বলে। ইস্কুলে একখানা মলিন হাতল ভাঙা কাঠের চেয়ার আর একখানা পুরোন ব্ল্যাকবোর্ডও আছে। চকখড়ি দিয়ে তাতে বড়ো বড়ো করে লেখে মাস্টার- পড়াশুনা করে যে…। একটু আধটু লেখাপড়া শেখার ওই একটি সম্বলমাত্র তাদের গেরামে। সাধাসিধে মানুষগুলোর যেন এক চিলতে খোলা জানলা। অসহ্য গ্রীষ্মজীবনে একটু বৃষ্টির ছাঁট, একঘেয়ে জীবনের দৃশ্যকল্পের গায়ে একটুখানি বসন্তের হাওয়া। একটু দূরেই বুড়ো বটগাছটার নীচে শান বাঁধানো চন্ডীমন্ডপ। এখন তার ভগ্নদশা। সকাল বেলায় সাবিরা যখন অবিন মাস্টারের কাছে পড়ে তখন চন্ডীমন্ডপে গেরামের বয়স্করা বসে গল্পগাছা করে। উল্টোদিকে কানাইদাদার ঝুপড়ি চায়ের দোকানের চা খায় আর সুখ দুঃখের গপ্প করে।

পদ্মপুকুরের পাশ দিয়ে তাল সুপারি গাছের ফাঁক দিয়ে তাদের গ্রাম ঘিরে যে কালো পিচঢালা রাস্তাটা চলে গেছে সেটা দেখা যায়। সেখান দিয়ে গাড়ি চলে হুসহাস। ভোট আসলে ওই রাস্তা ছেড়ে গ্রামের ভাঙা মাটির রাস্তা পেরিয়ে জল কাদা পেরিয়ে ধুলো উড়িয়ে কিছু গাড়ি আসে। সাবি জেনেছে, অবিন মাস্টার বলেছে ওরা হলো গিয়ে নেতা। কেউ কেউ মন্ত্রী। রাজা নেই? সাবি বোকার মতো জিজ্ঞেস করেছিল। রাজা নেই, রাণী নেই, সৈন্য সামন্ত নেই কিন্তু রাজ্য নাকি আছে। তাতে মন্ত্রীরা ঠিক রয়ে গেছে। ওদের লয়ক্ষয়ও নেই। একজন গেলে নাকি আরেকজন আসে। লুটেপুটে খায় যে যেমন পারে। তাদের মতো গরীবদের মধ্যে কথা বিলোয় হাসি হাসি মুখে। এমন সব কথা তেনারা বলে যায় সাবি তার বিন্দু বিসর্গও বুঝতে পারে না। হাঁ করে ওদের বড়ো বড়ো সাদা সাদা গাড়িগুলো দ্যাখে। তাদের ধবধবে সাদা পোশাক আসাক দ্যাখে, আয়নার মতো পালিশ করা জুতো দ্যাখে, আর মনে মনে ভাবে বড়ো হয়ে সে মন্ত্রীই হবে। মেয়ে মন্ত্রীও নাকি আছে। অবিন মাস্টার বলেছে। মন্ত্রীদের যে হেড দিদিমনি তিনিও নাকি মেয়ে তবে সাবি কেন পারবে না? চেষ্টা করলি সব হয়। রাতের বেলায় মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে মা বলেছিল,

— শুধু চেষ্টা থাকলেই হবে নি, মনে জোর রাখতি হবে। লক্ষ্য ইস্থির রাখতি হবে।

— লক্ষ্য কি মা?

— লক্ষ্য হইলো গিয়া তুমার মনের একটা ইচ্ছা। হেই ইচ্ছাটার কাছে পৌঁছাতে হলি তুমাকে অনেক অনেক পরিশ্রম করতি হবে মা। হেইটাই হইলো চেষ্টা, বুঝলি?

বোঝে না বোঝে সাবি ঘাড় নেড়েছিল, বলেছিল,

— চেষ্টা করলি তালি তো মন্ত্রীও হওয়া যায় তাই না রে মা? রাজ্য তো আছে শুনিছি তা রাজার বাড়িটা কই মা? রাজা রানী তো মইরেছে তা মন্ত্রীগুলান থাকে কই? করেই বা কি?

মালতী হেসে ফ্যালে।

— হেই কোলকাতায়, ও আম্মোও দেখি নাই। এখন আর কি সেই রাজা রাণীর আমল আছে? যা গপ্পে শোনা যায়, এ হলো গিয়া অন্য ধারার মন্ত্রী। ও তুই বুঝবি নি। এখন ঘুমা দেখি।

চোখ ভরে ঘুম নামে সাবির।ঘুমের মধ্যে ঘোড়ায় চড়ে মন্ত্রী আসে। লোক লস্কর সেপাই    পিয়াদা সব আসে। শুধু রাজা আসে না। রাজপুত্তুরও আসে না। দূর এ আবার কি দ্যাশ, ঘুমের মধ্যে পাশ ফেরে সাবি।

 ২

 শীত ফিকে হচ্ছে এখন। এখানে শীত একেবারে যায়না কখনও, হয়তো একটু আলগা হয়। এলোমেলো হাওয়া জানান দিচ্ছে বসন্ত আসছে। কলকাতায় থাকলে এসব সময়ে মিঠে বাতাসটুকু গায়ে মাখতে ইচ্ছে হয় আদরে। ওখানে থাকতে শীত যাবার মুখে মনটা খুব খারাপ লাগত বন্যার। প্রতিবছরই মনে হতো সলজ্জ বউটির মতো ঘোমটা খুলতে না খুলতেই কোথায় যেন কিচ্ছুটি না বলে চলে গেলো। শীত শীত ভেজা মনটা একটু একটু যেন উষ্ণ হতো খানিক অভিমানে। তখন বসন্তের হাতটি ধরে গোপন চলা উত্তুরে হাওয়ার দিশায়। এসব জায়গায় অবশ্য শীতের মোড়কেই সমস্ত ঋতু আসে। এখানে শীতের হিমেল হাওয়া বারোমাস। শুধু পুজোর পর থেকেই কয়েকটা মাস জাঁকিয়ে শীত আসে। বাকি সময়টা চারিদিকে ঘন কুয়াশায় আবছা প্রকৃতির গায়ে গায়ে সব ঋতুর আনাগোনা। পশ্চিমের জানলাটা খুললেই পাইনের সারির মধ্যে একলা রবিচূড়া গাছটা অর্ধেক আকাশ আড়াল করে দাঁড়িয়ে থাকে। শীত যাবার মুখে পাতা খসা শুকনো গাছটা যখন ডালপালাগুলো নিয়ে বিষন্ন হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে তখন রোদে ভেজা গাছটাকে খুব চেনা লাগে বন্যার। ঠিক যেন ওরই মতো একা, নিঃসঙ্গ। সবটুকু শূন্যতা নিয়েও কি আশায় যেন আবার সেটি নতুন করে জীবন বোনার অপেক্ষায় থাকে। নতুন কচি সবুজ পাতা এসে শূন্যবুকের মধ্যে বসন্তের পরাগ বিছোবে কখন, চাতকপাখির মতো সেইদিকে চেয়ে থাকা।

এমনিতেই অনেক রাত পর্যন্ত ঘুম আসে না বন্যার। শেষরাতের নিভু নিভু তারারা তখনও হয়তো আকাশে। শুধু মেঘের পরতে ঢাকা। ভোর ভোর আলগা ঘুমটা ভেঙে গেল বৃষ্টির শব্দে। শীতবাতাসের ওড়াউড়ির সঙ্গে টিপটিপ বৃষ্টির শব্দ ঝিম ধরায় বুকে ঘন ভেজা কুয়াশা গা এলিয়ে রয়েছে জানলার কাঁচে। এসব অঞ্চলে শীতের হাওয়ারা হামেশাই বৃষ্টি নিয়ে আসে। বন্যা বেশ কিছুদিন হলো এখানে এসেছে। ছোট্ট পাহাড়ী গ্রামটার নাম রিয়ং। পাহাড়ের গায়ে ঘন বনের মধ্যে কিছুটা খোলা জায়গা। তার মধ্যেই গোটা পঞ্চাশেক বাড়ি ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। হিমালয়ের গায়ে যেন একটা আদুরে টিপ। গ্রামের কোল দিয়ে বয়ে চলেছে ছোট্ট একটা পাহাড়ী নদী। তিস্তা আর রঙ্গীতের মিলনস্থল থেকে বেরোনো একটা সরু শাখা। বড়ো ছোট অজস্র নুড়ি পাথর বুকে নিয়ে কলকল করে বয়ে চলেছে ছটফটে কিশোরী মেয়ের মতো। কাছাকাছি আরও কিছু বনঘেরা গ্রাম আছে। তুনাং ফরেস্ট, রাম্থি ফরেস্ট। কাছেই আছে রাম্বি বাজার, যেখানে বন্যা পাহাড়ী রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে কুয়াশা গায়ে মেখে চলে যায় ও। এখান থেকে দশ এগারো কিলোমিটার গেলেই বড় শহর কালিম্পং। দু তিন মাস পর পর মাঝে মাঝে ও কালিম্পং চলে যায়। বেশিরভাগ সময়ে বইপত্র খাতা কলম কিনতে, যা রিয়ং এ তেমন পাওয়া যায়না। বিস্তর সময় এখানে। বছর দুয়েক আগে পাহাড়ের কোলে এই এক টুকরো নির্জন স্বর্গে আসবার পর প্রথমদিকে বন্যার বিষন্নতা যেন কূল পেতোনা। অতল শব্দহীনতার ডুবজলে যেন ও ক্রমশ তলিয়ে যাচ্ছিল।

ক্রমশ…

পুকুরঘাট

পুকুরঘাট

একদিন আমরা মাত্র কয়েকজন সদস্য নিয়ে পুকুরঘাট নামের একটি মেয়েদের ভার্চুয়াল দল খুলে ছিলুম। অচিরেই সে কয়েকটি সদস্যের দল কয়েক হাজার সদস্যের মেয়েদের দল হয় ওঠে। পুকুরঘাট দলের মত এত গুণী মেয়েদের সমাহার বাংলাদেশে খুব কম ভার্চুয়াল দলে আছে। কাজেই সেই দল সেখানেই আটকে থাকবে না বলা বাহুল্য। তাই পুকুরঘাট দলের অন্যতম উদ্যোগ হিসেবে প্রকাশিত হলো পুকুরঘাট পত্রিকা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

15 thoughts on “আশ্রিতসুখ পর্ব-১

  1. শুরুটা শুরুর মতোই টাটকা সতেজ ও ঘুম ভাঙা সকালের মতো। এবার অপেক্ষা শুরু❤️

  2. আশ্রিতসুখ প্রথম কিস্তি পড়লাম। মন কেমন করা এক অজানা সুখ জড়িয়ে ধরল যেন। চলুক লেখা।

  3. শুরুটাই মন কেড়ে নিল। কী মায়ামেদুর রিয়ংএর ছবিটি ! অপেক্ষায় থাকব।

  4. খুব ভালো লাগলো… আরো পড়তে চাই… শুভেচ্ছা রইল…

    1. খুব ভাল লাগছে ‘আশ্রিত সুখ’। দারুণ সুখপাঠ্য।