আশ্রিত সুখ পর্ব – ৪

আশ্রিত সুখ পর্ব – ৪

 

কস্তুরী চট্টোপাধ্যায়

সাবি তখন পেটে। বাপটা একদিন গলা পর্যন্ত মদ খেয়ে এসে ভর সন্ধেবেলা মালতিকে মেঝেতে ফেলে মারতে মারতে আধমরা করে পালাল। মালতির কাছে যা কিছু জমানো ছিল নিয়ে সেই যে গেল আর ইদিকপানে আসেনি। জন্ম ইস্তক সাবি তার বাপকে দেখেনি। জন্মানোর পর দুধের শিশুকে এর তার বাড়িতে ফেলে রেখে মালতি একদিন পেটের দায়ে কাজে নামে। নইলে না খেতে পেয়ে মা মেয়ে মরতো। তার আগে গেরামের বাইরে কোনদিন পা রাখেনি। দরকারই পড়েনি। সাবির বাপ যা দিত তাতে ভাতটুকু জুটতো। শহরে মিস্ত্রীদের যোগানদারের কাজ করতো। তাও মর্জিমতো। কোনদিন যেতো কোনদিন যেতোনা। বেশিরভাগ দিন হাতে পয়সা থাকতোনা। মালতি জলা জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে শাকপাতা, কচুপাতা, এর তার বাড়িতে চেয়েচিন্তে লাউপাতা কুমড়ো পাতাটুকু জোগার করতো। তাই সেদ্ধ করে একটুস সরষের তেল আর লবণ দিয়ে গরম ভাতে খাওয়াটা জুটে যেতো। তারপর কী যে হলো সাবির বাপটা একটু একটু করে বদলে যেতে লাগলো। প্রথম প্রথম ভাব ভালোবাসা বেশ ছিল মালতির উপর। সোহাগ করতো যখন তখন। মালতি লজ্জা পেতো। গায়ে গায়ে সব বাড়ি। কে দেখে ফেলবে। মানুষটা মন্দ ছিলনা। তারপর দু চারটে বন্ধু জুটলো। এ গেরাম সে গেরামের সব। সন্ধে হলেই মদ গিলতো নন্দীদের বাগানের পুকুরঘাটে বসে। দিশি মদ। মালতির গন্ধে বমি আসতো।

একদিন শুনলো পাশের গেরামের কোন ছুঁড়ির সঙ্গে নাকি সম্পক্ক হয়েছে। এদিক ওদিক নাকি দুজনকে ঘুরতে দেখা যায়। তখন সাবি পেটে। মালতি কেঁদে ভাসালো। রোজ রোজ অশান্তি। পড়ে পড়ে একা ঘরে মাতাল সোয়ামীর হাতে মার খেতো মালতি। গেরামের সালিশি সভায় একদিন এনিয়ে মাতব্বরেরা কথাও বললো সাবির বাপের সঙ্গে। তখনকার মতো ভালোমানুষ সেজে কইলো আর এমনধারা করবেনি। কোথায় কী, তারপরের দিনই ভরা পোয়াতি মালতিকে মেরেধরে সব নিয়ে পালালো। গেলো তো গেলো আর এলোনি। কোনরকমে মাস খানেক পাড়া প্রতিবেশিরাই এগিয়ে এসে সাহায্য করলো। দুটো ভাত এ বাড়ি সে বাড়ি থেকে জুটে যেতো। বদলে শরীর খারাপ নিয়েও তাদের বাড়ির সব কাজ করে দিত। একদিন ব্যাথা উঠলো। বাড়িতেই দাই এসে মালতিকে মা বানালো। তাদের গাঁয়ে গরীবদের দাইই ছিল ভরসা। হাসপাতালে যাবার ক্ষ্যামতা কই? চিকণ গলায় কাঁদতে কাঁদতে সাবি এলো পোড়াকপালি মায়ের কোলে। চাদ্দিক যেন আলো করে। সূয্যির আলো যেন কম পড়েছিল সেদিন। মাথা ভর্তি চুল, বড়ো বড়ো ভাসা ভাসা চোখ। মালতির সব কষ্ট যেন জুড়িয়ে গেলো।

আরও মাস দুই তিনেক কোনরকমে চালালো মালতি। ছুটকো কিছু বিয়ের পাতলা দু এক চিলতে সোনা, যা বুক বুক করে লুকিয়ে আগলে রেখেছিল এতদিন, বিয়েতে বাবার দেওয়া পেল কাঁসার কিছু বাসনপত্র এসব বিক্কিরি করে কোনরকমে চালালো। তারপর কিছুদিন পাড়ার হরিকাকার মুদীর দোকানে তাঁর হাতে হাতে বিক্রিবাটার কাজ করে দিতো সাবিকে মেঝের এক কোণায় শুইয়ে রেখে। দিন গেলে হরিকাকা সামান্য কিছু দিতো, তাই দিয়ে সাবির দুধটুকু জুটতো, আর নিজের জন্য মোটা চালের নুন ভাত।

গেরামের অনেক মেয়েই ভোরবেলায় ট্রেনে করে শহরে যায় কাজ করতে। মরদগুলো বাড়ি বসে বসে ওদের উপার্জনে খায়। সন্ধে হলি এক গলা চোলাই খেয়ে বউদের ধরে ধরে মারে। একদিন সাহস করে পাড়ার নমিতার হাত ধরে কাজের সন্ধানে সেই পেরথম মালতির কলকেতায় যাওয়া। নমিতাই ঘুরে ঘুরে দু বাড়ি কাজ খুঁজে দিল। তারপর আস্তে আস্তে আরও দু তিন বাড়ি ধরলো। সেই কাকভোরে বেরিয়ে এখন দিনভর পাঁচ বাড়ি কাজ করে। মালতি যখন কাজে বেরোয় তখনও সকালের প্রথম রোদ্দুরের আলো এসে ওদের দাওয়া ছোঁয়না। আবছায়া ফিকে আলোয় চাদ্দিক তখনও ঘুমের চাদরে ঢাকা। সাবি তখন গভীর ঘুমে। পাশের ঘরের বেলাকাকি সাবিকে দেখে। নিজের কোন ছেলেপুলে হয়নি। সাবিকে বড্ড ভালোবাসে। কাকিই ডেকে দেয় ওকে। ঘুম থেকে উঠে নিজে নিজেই হাতমুখ ধুয়ে মায়ের ঢেকে রাখা দুধে মুড়ি ঢেলে খেয়ে জামাখানা পালটে একছুট্টে আমবাগানের ভিতর দিয়ে অবিন মাস্টারের চালাঘর।

বেলা পড়লে মালতি ঘরে ফেরে। বিকেলের আলো তখন প্রায় মরে আসে। ক্যানিং ইস্টিশনে নেমে আরও মাইলখানেক হাঁটা পথ। তারপর নারকোল গাছের ফাঁক দিয়ে তাদের গেরামের কাঁচা সড়ক দেখা যায়। পিচঢালা রাস্তা থেকে নেমে গিয়েছে মাটির সরু রাস্তাটা ওদিকপানে। সূয্যি তখন ঢলে পড়েছে পশ্চিমদিকে। আকাশ তখন কমলা রঙের ছটায় বানভাসি।

নয় পার হয়ে দশে তখনও পা রাখেনি সাবি। গুটি গুটি ডাগর হয়ে উঠছিল অগোচরে। মালতির আজকাল চিন্তা হয়, বুক কাঁপে। সারাটাদিন ছন্নছাড়া হয়ে একা একা ঘোরে মেয়েটা। সাবির চেয়ে বয়সে কিছু বড়ো ছেলে ছোকরাগুলো আজকাল ওর দিকে যেন কেমনতর করে তাকায়। ওদের চোখগুলো যেন অন্যকথা কয়। মালতি রোজরাত্তিরে বসে বসে ওকে বোঝায়  মেয়েমানুষের যন্তরণার কথা। গাঁ গঞ্জের মেয়েমানুষদের আরও যেন বেশি জ্বালা। মরে মরে বাঁচা। কোণায় কোণায় আড়ালে আবডালে যেন সর্বনাশ ওৎ পেতে থাকে।

— সব্বনাশ মানে? সরল দুটি চোখে নিরীহ প্রশ্ন সাবির।

— আরে এ সব্বনাশ কি সে সব্বনাশ? যেমন আগুনে বাড়ি ঘরদোর পুইড়্যা গেল কিংবা নাইতে

নেমে কেউ জলের তলে তলায় গেলো কিংবা ধর না গাড়িতে অ্যাক্সিডেন হলো.. না রে

বোকা এ সব্বনাশ হেইরকমটা নয় রে।

— তাহলে কোন সব্বনাশের কথা কইছিস তুই মা?

— এ সব্বনাশ শুধু মেয়েদেরই হয়রে মা। কপালখানা শুধু মেয়েদেরই পোড়ে। মরলে শুধু

মেয়েরাই মরে। অপরাধ শুধু মেয়েদেরই হয়রে মা, ছেলেদের গায়ে আঁচটুকুও লাগেনা।

— সেই যেবার পারুলদিদি দরজায় খিল তুলে দিয়ে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়ল তখনও সবাই

কইতিছেল, এই সব্বনাশ ম্যায়াটার কে করল কে জানে। তোর মনে আছে মা?

— হ্যাঁ রে মনে আছে, এই তো সেইদিনের কথা। মনে থাকবেনি? তাই তো বলতিসি মেয়েরা

বড়ো হইলে বড়ো জ্বালা। নিজের শরীরখান বাঁচাইয়া চলবি রে মা। কেউ যেন তোর শলীলে

হাত না দিতি পারে বুঝেছিস? কোন পুরুষমানুষ কে কাছ ঘেঁষতি দিবিনে।

— সরলকাকা? অবিনমাস্টার? ও বাড়ির বড়োজ্যাঠা? পটলদাদু কাউয়েরে না?

কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে মালতি। তারপর আস্তে আস্তে সাবির মাথায় চিরুনী চালাতে

চালাতে বলে,

— হ্যাঁ কাউয়েরে না। কার মনে কি আছে সে বুঝ তো তোরেই বুঝে নিতে হবে মা। আর এট্টু

বড়ো হ, তারপর নিজেই বুঝে নিতে পারবি কার হাতের ছোঁয়া ময়লা কার লয়।

শুনতে শুনতে সাবির চোখে ঘুম নেমে আসে। হাত ময়লা, সে তো ধুয়ে নিলেই হয়। মা যে

মাঝে মাঝে কি সব কয় বুঝতে পারিনে।

পরেরদিন ইস্কুলে সব নামতা বলতে পারার জন্য অবিনমাস্টার যখন সাবির মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় তখন তো ওর একটুও খারাপ  লাগলো না। বরং চোখে জল এসে যাচ্ছিল। এ ছোঁয়ায় কোন ময়লা নেই সাবির মনে হলো। কারো কারো হাতে স্নেহও থাকে। ও বাড়ির জ্যাঠা যে সামনে সাবিকে দেখলেই কারণে অকারণে কাছে টানার চেষ্টা করে, তখন সাবির এক্কেবারে ভালো লাগেনা। কেমন যেন গাটা ঘিনঘিন করে। জ্যাঠার হাতে ময়লা আছে।

অবিন মাস্টারের সাত কুলে কেউ নেই। বয়েসও এমন কিছু নয়। মায়ের কাছে শুনেছে তাঁর এক মামার নাকি অনেক সম্পত্তি ছিল। মামার এক ছেলে এক মেয়েও ছিল। ছেলেটি হঠাৎ মারা যায় অল্প বয়সেই। মেয়ের নাকি অনেক বড়ো ঘরে বিয়ে হয়েছিল। তাই সমস্তকিছু দানপত্র করে অবিন স্যারকেই দিয়ে যান মামা। অবিন স্যারের কোন সংসার নেই। একা ভবঘুরে মানুষ। ঘুরতে ঘুরতে তাদের গেরামে এসে তাঁর খুব ভালো লেগে যায়। এখানেই গ্রামের প্রান্তে একটা ছোট বাড়ি নিয়ে থাকা শুরু করেন। তারপর আস্তে আস্তে ছোট এই ইস্কুলটা গড়েন একা হাতে। তার আগে তাদের গ্রামে কোন ইস্কুল ছিল না। ইস্কুলটা এখন নাকি অনেক বড়ো হবে। শালবনের গা ঘেঁষে অনেকখানি জায়গা জুড়ে সে ইস্কুলের কাজ শুরুও হয়ে গেছে। মাটি খুঁড়ে দালান বাঁধা হচ্ছে। সাবির খুব আনন্দ। রোজ অবিন মাস্টারের কাছে ওরা শোনে সেই ইস্কুলের কথা। অবিন মাস্টারও তার সেই স্বপ্নের গল্প একটু একটু করে ওদের শোনায়। ওদের আশেপাশের ছয় সাতটা গ্রামে কোন বড়ো ইস্কুল নেই। তাই এই ইস্কুলটা হলে সাত গেরামের বাচ্চারা পড়ার সুযোগ পাবে। আরও কিছু মাস্টার আর দিদিমনিও নাকি আসবে নতুন ইস্কুলে। শুনেই সাবিরা খুব উত্তেজিত। সামনে অনেক কাজ। অবিন মাস্টারের হাতে সময় নেই। স্কুলের পাশে নাকি ছাত্র ছাত্রীদের আর স্যর দিদিমনিদের জন্য থাকার বাড়িও হবে। তাকে নাকি হোস্টেল বলে। একবার এই ইস্কুলটা হয়ে গেলে তাদের এই গেরামটা আরও বড়ো হয়ে যাবে। নাম ডাক হবে, অবিন মাস্টার বলেছে। সাবির কাছে অবিন মাস্টার যেন দ্যাবতা। কী সোন্দর কথা বলে, সবকিছু কেমন সহজ লাগে। সাবির লেখাপড়ায় মন দেখে অবিনস্যার বুঝেছিলেন মেয়েটা বুদ্ধিমতী। ঠিকমতো করে পড়াশুনো করলে ও অনেকদূর যাবে। অবিনস্যারের খুব প্রিয় ছাত্রী সাবি। সবিতা ঘোষ।

কস্তুরী চট্টোপাধ্যায়

 

Nila Banerjee

পুকুরঘাট

একদিন আমরা মাত্র কয়েকজন সদস্য নিয়ে পুকুরঘাট নামের একটি মেয়েদের ভার্চুয়াল দল খুলে ছিলুম। অচিরেই সে কয়েকটি সদস্যের দল কয়েক হাজার সদস্যের মেয়েদের দল হয় ওঠে। পুকুরঘাট দলের মত এত গুণী মেয়েদের সমাহার বাংলাদেশে খুব কম ভার্চুয়াল দলে আছে। কাজেই সেই দল সেখানেই আটকে থাকবে না বলা বাহুল্য। তাই পুকুরঘাট দলের অন্যতম উদ্যোগ হিসেবে প্রকাশিত হলো পুকুরঘাট পত্রিকা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *