আশ্রিত সুখ পর্ব ২

আশ্রিত সুখ পর্ব ২

কস্তুরী চট্ট্যোপাধ্যায়

 

আঠেরোয় পা দিতেই বন্যার জন্য পাত্র খোঁজা শুরু হয়ে গিয়েছিল। আত্মীয় পরিজন, পাড়া প্রতিবেশী যে যেখান থেকে পারে পাত্র এনে হাজির করছে। নানা ধরনের নানা রকমের হরেক কিসিমের বিবিধ পাত্র। পাত্রপক্ষের চাহিদা অনুযায়ী বন্যা একেবারে স্টার মার্কস পেয়ে পাশ করা পাত্রী। লম্বা, ফর্সা, কোমর ছাড়ানো এক ঢাল কালো চুল, সুন্দরী, লাবণ্যময়ী,

গৃহকর্মে নিপুনা, সেলাই এ দক্ষ, নকশিকাঁথায় ফুল তুলতে পারে নিপুন হাতে, একেবারে নিরক্ষর নয় লেখাপড়াও শিখেছে বেশ খানিকটা ইত্যাদি প্রভৃতি নানান বিশেষণে ভূষিতা। কাজেই এহেন পাত্রীর জন্য পাত্রদের লাইন পড়ে যাওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। আঠেরোর বন্যা অনেক বোঝানোর চেষ্টা করলো বাবাকে আর বিন্নিপিসিকে। সে তো আরও অনেক অনেক পড়তে চায়। নিজের জীবন নিজে গড়তে চায়। বাবা তো ছোটবেলায় তেমনটাই বলতো। নিজের ভাগ্য নিজে গড়ে নিতে হয়। এইতো ও সদ্য চলতে শুরু করেছে। নিজের পরিচয় গড়া এখনও যে বাকি। এখনও কতো আখর কতো অনুভব কতো দেখা কতো জানা কতো শোনা বাকি। মায়ের চোখে জলের সঙ্গে কষ্ট ঝরছিল। তাঁর হাতে কিছুই ছিলনা বন্যা জানতো। মা তো সংসারে এক কোণায় নিজেই এখন কুন্ঠিত হয়ে, বাড়তি বোঝার মতো থাকে। বাবা আস্তে আস্তে বলেছিল, বিয়ের পরও পড়াশুনো করা যায়, কেউ তো বারণ করেনি। যদিও আত্মীয় পরিজন থেকে শুরু করে সেইসব পাত্রপক্ষদের মতে মেয়েদের বেশিদূর লেখাপড়া করবার কোন প্রয়োজনই নেই, লেখাপড়া ছাড়া বাকিগুলোই তো মেয়েদের প্রধান গুণ। সংসারধর্ম করবে মন দিয়ে যার জন্য মেয়েজন্ম। সেবাযত্ন করে স্বামীসোহাগ আদায় করবে, তারপর বচ্ছর ঘুরতে না ঘুরতে কোল আলো করে ছেলে আসবে। তবেনা মেয়েজন্ম সার্থক। বন্যা সেদিন নিজের মৃত্যু কামনা করেছিল। অনেক ভেবেও বুঝে উঠতে পারেনি বিন্নিপিসি তার এই সর্বনাশটা কেন করতে চাইছে। লেখাপড়া যেটুকু করেছিল বন্যা, তার সেদিকটাও আলো ঝলমলে ছিল। ভালো ছাত্রী ছিল। স্কুলের মুখ উজ্জ্বল করে স্কুল ডিঙোনোর শেষ পরীক্ষায় খুব ভালো ফল করেছিল। তাদের জেলায় প্রথম হয়েছিল সে। স্কুল পেরিয়ে সবে কলেজে পা দেবার স্বপ্ন দেখছিল। তারপর আরও কতো কতো স্বপ্নেরা বন্যার হাত ছুঁয়ে ছুঁয়ে রেখেছিল।

মা ছিল বন্যার একমাত্র বন্ধু, একমাত্র আলো, ভরসার জায়গা। একমাত্র আশ্রয়স্থল। খাওয়া দাওয়ার পর রাতে ছাতে বসে দুজনে রূপোয় মোড়া সুন্দর একটা রূপকথা জীবনের গল্প বুনতো। সেই গল্পের রাজকন্যা ছিল বন্যা। আর মা ছিল দুঃখিনী দুয়োরানী। দূরে দাঁড়িয়ে তাঁরই নিজের হাতে গড়া সংসার রোজ একটু একটু করে ক্ষয়ে যেতে দেখতো। দিনেগুলো আস্তে আস্তে রঙহীন ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছিল। জীবনের সাঁঝবেলার আলোগুলো একটা একটা করে নিভছিল। দুয়োরাণীর মনভরা কষ্ট ছিল। সে কষ্টের কথা বন্যা জানতো। কিন্তু মাকে সেটা কখনও বুঝতে দেয়নি। সেসব লজ্জার রাতদিন মায়ের একার ছিল। বন্যা জানতো।

আকাশভরা তারার মাঝে নরম চাঁদের স্ফটিক আলোয় মা মেয়ে ভিজত রোজ অনেক রাত পর্যন্ত। দুজনের শূন্য গলিপথে ছড়ানো কতো সুখ দুঃখের কথা ভাগ করে নিত। মা তাঁর অতীত জীবনের ঢেউ আসা ঢেউ যাওয়ার গল্প বলতো। বন্যা তার ভবিষ্যতের সমুদ্দুরে পাল তোলা ময়ূরপঙ্খীর কথা বলতো। মায়ের মনে আরও একটা চাপা দুঃখ ছিল। ইচ্ছে থাকা সত্বেও অভাবের সংসারে বেশি লেখাপড়া করতে পারেনি মা বিয়ের আগে। অথচ লেখাপড়া করবার সাধ ছিল বুক জুড়ে। অনেক কম বয়সে বিয়ে হয়ে সংসার জীবনের ভাঙাচোরা পথে প্রায় কিশোরী পায়ে হাঁটা শুরু করতে হয়েছিল। তখন গাঁ গঞ্জে মেয়েরা ঋতুমতী হলেই বিয়ে দেওয়ার তোড়জোড় শুরু হতো। নইলে সমাজে নিন্দেমন্দ হতো। বয়সে দ্বিগুণ বড়ো স্বামীর সঙ্গে শ্বশুরবাড়ি গিয়ে শ্বশুর শাশুড়ী জা ভাশুর দেওর ননদ সোয়ামী সন্তান নিয়ে প্রাণপাত করে সংসার করা, মেয়েদের জীবনে এটাই তো দস্তুর, কপালের লিখন। দরিদ্র ঘরের মেয়েদের স্বপ্ন বলতে তখন এই। আর কী চাই। দুবেলা দু মুঠো খেতে পাবে, মাথার উপর সংসার নামক বিষম বস্তুটি আগলে রাখার জন্য একটা ছাত পাবে এইনা কতো! ইচ্ছেমতো অন্য কোন জীবন চাওয়া, রাঙা স্বপ্ন দেখা, একঘর বিলাস চাওয়া, আরণ্যআলোর দিকে যাওয়া, মোহবাতাসে শ্বাস নেওয়া, বৃষ্টির ফোঁটা মুঠোয় নেওয়া মেয়েদের সে সময় নিষেধ ছিল। নিষেধ ছিল আরও কতকিছু। পায়ে পায়ে ঘেরাটোপ। এক টুকরো জানলা দিয়ে কোনমতে আকাশ ছোঁয়া। মাত্র ওইটুকুই। মনের ভিতর চুপিসারে সদ্য কিশোরীবেলা ছেড়ে আসা কতো বানভাসি ইচ্ছের মৃত্যু ঘটতো। গেরস্থালি চৌকাঠে পড়ে থাকতো শুধু আমন ধানের গন্ধ, উঠোনের তারে মেলা আবছা শাড়ির ছায়া, ন্যাপথলিনের গন্ধমাখা পুরোনো আলমারি, বিছানায় পড়ে থাকা সেলাই এর বাক্সে আটপৌরে বন্দী জীবন। শুধু চাঁদ উঠলে নদীর গন্ধ ওড়ে, বেড়ার গায়ে তারারা নামে আগের মতোই। তবুও আগের জীবনের সঙ্গে যেন এক আয়ুষ্কাল দূরত্ব।

মায়েদের আট ভাইবোনের মধ্যে ছটি মেয়ে। তাই বংশ ভালো হলেই যেমন হোক একটা পাত্রের সঙ্গে জুড়ে দিয়ে এক সংসার থেকে অন্য সংসারে পাঠানো। চোখ বুজে আগল ভেঙে ঝাঁপ দেওয়া। বাঁচতেও পারো মরতেও পারো। কর্তব্য শেষ।

ভাইবোনদের মধ্যে মা ছিল সবচেয়ে ছোট। ততদিনে এক দিদি অসুস্থ বৃদ্ধ স্বামী হারিয়ে সিঁদুর মুছে বাড়িতে ফিরে এসেছে। আরও এক দিদি সন্তানবতী না হওয়ায় স্বামী ত্যাগ করে অন্য বিয়ে করেছে। এক দিদি শ্বশুরবাড়ির অত্যাচারে ‘মানিয়ে গুছিয়ে’ না থাকতে পেরে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মঘাতী হয়েছে। মাকে তাই আরেকটু বুঝেসুনে বিয়ে দেওয়া হয় কাছের শহরে। পাত্র ব্যবসা করে। আয়মন্ত ভালোই। স্বভাবশান্ত। মা তখন তেরো। পুকুর থেকে নদী। অতোবড়ো সংসারে থই পেতোনা মা। ডুব ডুব জলে রোজ উথালপাথাল। শাশুড়ী জা ননদদের ঝড়ের মুখে নিজেকে খড়কুটোর মতো লাগতো। ওই বয়সে অপমান অসম্মান এই শব্দগুলোর সঙ্গে জানাশুনোই হয়নি। বোধ হওয়া তো দূর। তবে এতকিছুর মধ্যে মায়ের স্বামীভাগ্যটি ভালো ছিলো। নিপাট ভালোমানুষ স্বামীর জন্যই সব অনাদর অসম্মান মা হাসিমুখে সইতেন। মা চাইতেন বন্যার ভাগ্য যেন তাঁর মতো না হয়। যেখানে গ্রহণের অন্ধকার ছায়া জীবনভর।

পুকুরঘাট

পুকুরঘাট

একদিন আমরা মাত্র কয়েকজন সদস্য নিয়ে পুকুরঘাট নামের একটি মেয়েদের ভার্চুয়াল দল খুলে ছিলুম। অচিরেই সে কয়েকটি সদস্যের দল কয়েক হাজার সদস্যের মেয়েদের দল হয় ওঠে। পুকুরঘাট দলের মত এত গুণী মেয়েদের সমাহার বাংলাদেশে খুব কম ভার্চুয়াল দলে আছে। কাজেই সেই দল সেখানেই আটকে থাকবে না বলা বাহুল্য। তাই পুকুরঘাট দলের অন্যতম উদ্যোগ হিসেবে প্রকাশিত হলো পুকুরঘাট পত্রিকা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

One thought on “আশ্রিত সুখ পর্ব ২

  1. কয়েকদিন আসা হয়নি পুকুরঘাটে। অনেকটা হাতছাড়া হয়ে গেছে। ঘনঘন এসে পুষিয়ে নিতে হবে।