আশ্রিতসুখ পর্ব – পঞ্চম
কস্তুরি চট্টোপাধ্যায়
(৬)
সহজদা ছিল বিনতাপিসির ছেলে। একদিন কাকভোরে সহজদাকে নিয়ে ওদের কলকাতার বাড়িতে এসে উঠেছিল বিনতাপিসি। মাসখানেক হলো সদ্য স্বামী হারিয়েছে। গাঁয়ে শ্বশুরবাড়িতে তেমন কেউ নেই, থাকলেও বিন্নিপিসির কোন জায়গা হয়নি সেখানে। বিনতাপিসিকে বাবা ডাকত বিন্নি বলে। তাই বন্যারও সে ছিল বিন্নিপিসি। অসহায় বিন্নিপিসি ছেলের হাত ধরে তাই কলকাতায় দূর সম্পর্কের দাদার কাছে এসে দাঁড়ালো। মা সেই প্রথম বিন্নিপিসিকে দেখল। সেই থেকে সহজদা আর বিন্নিপিসি রয়ে গেলো তাদের বাড়িতে। বন্যা তখন বছর আটেক, সহজদা দশ। ইস্কুলের সময়টুকু বাদ দিলে বাকি সময়টা কাটে দুজনের খেলায় খেলায়। ছেলেবেলা থেকে মেঘ রোদ্দুর ভাগ করে ওদের একসঙ্গে বড়ো হয়ে ওঠা। বৃষ্টিদিনে একসঙ্গে মাঠময় ছুটে জলফড়িং ধরা, মেঘ ভাঙা বর্ষায় হাপুস ভেজা, সরস্বতীপুজোয় একসঙ্গে আনন্দে বনমাতাল হওয়া, বৈশাখীঝড়ে আম কুড়োনো, ছাতের আলসেতে লুকিয়ে বসে আচার খাওয়া, আরও কতো টুকরো স্মৃতি পায়ে পায়ে জড়িয়ে এখনও। তখন দাদার সঙ্গে কয়েকবার সহজদাকেও ভাইফোঁটা দিয়েছিল বন্যা।
মা বলত- যা সহজ চান করে আয়, ফোঁটা নিয়ে লুচি খাবি।
হাতে পায়ে সর্বাঙ্গে কাদা নিয়েই দাদার পাশে বসে পড়ত সহজদা। একমাথা অগোছালো চুল।
বলত- চানটান পরে হবে মামি, আগে লুচি দাও। ফোঁটা পরে দিস বন্যা আগে লুচি দে।
হেসে গড়াত ওরা। ঠাকুমা সহজদাকে পাগলাঠাকুর বলে ডাকত। শুধু ঠাকুমাকেই ওই নামে ডাকার অধিকার দিয়েছিল পাগলটা। অন্য কেউ ওই নামে ডাকলে আর রক্ষে ছিল না।
একটু বড়ো হতেই বন্যা লক্ষ্য করেছিল বিন্নিপিসিকে মা যতো সহজে আপন করে নিয়েছিল, বিন্নিপিসির ক্ষেত্রে ততটা নয়। কোথায় যেন তাঁর একটা কুন্ঠা কাজ করত। একটা ভয়, একটা আড়ষ্টতা যেন সবসময় ঘিরে থাকতো তাঁকে আলতো করে। খুব সুক্ষভাবে হলেও বন্যা বুঝতে পারত। মাও কি পেরেছিল? হয়তো পেরেছিল। মা চিরকালই চাপা স্বভাবের ছিল। নিজের আশা নিরাশা, হাসিকান্না, আনন্দ বেদনা কাউকে সেভাবে জানতে দিত না। জীবনের এইসব ছোটবড়ো নুড়িপাথরের ওপর দিয়ে চলা ঢেউগুলোকে বুকের মধ্যেই আড়াল করে রাখত। বন্যা তখন বারো কী তেরো। খুব ছোট নয়। বিন্নিপিসিকে দেখে প্রথম প্রথম কষ্ট হতো বন্যার। নিরুপায়, নিঃসহায়, নিঃসম্বল পিসিকে পিতৃহারা সন্তানের জন্য মাথা নুইয়ে থাকতে হচ্ছে অন্য কারো সংসারে। যতদিন গেছে বন্যাদের বাড়িতে বিন্নিপিসির অধিকার একটু একটু করে যেন ফিকে থেকে গাঢ় হচ্ছিল। প্রথম প্রথম যে কুন্ঠাটা কাজ করতো অন্যের সংসারে এসে, যতো দিন গেলো সেটা কমতে লাগলো। বরং সেই সংসার যা তাঁকে একদিন আশ্রয় দিয়েছিল, নির্ভরতা দিয়েছিল, সুখ স্বাচ্ছন্দ্য দিয়েছিল, তার প্রতি, সেই সংসারের মানুষজনদের প্রতি তার আধিপত্য, কতৃত্ব যেন ধীরে ধীরে ডানা মেললো। প্রভুত্ব বাড়লো। মায়ের কাছ থেকে ধীরে ধীরে একদিন রান্নাঘরের দায়দায়িত্বটাও পিসির কাছে চলে গেল। ভাঁড়ারের চাবির গোছা তখন বিন্নিপিসির আঁচলে। ভিতরে ভিতরে মা কেমন যেন আরও গুটিয়ে গেল। যে সংসার ছিল মায়ের কাছে সবটুকু, আস্তে ধীরে সেটা কেমন অচেনা ঝাপসা হয়ে গেল। আর একটি কাজ মায়ের বড়ো আপন ছিল, সেটা হলো নিজের হাতে বাবার সেবাযত্ন করা। সে কাজটি মা খুব যত্ন আর আনন্দের সঙ্গেই করতেন। বাবাও তাতেই অভ্যস্ত ছিলেন। বিন্নিপিসি মায়ের সেই একান্ত জায়গাটাও কেড়ে নিল। বাবা প্রথমদিকে বলার চেষ্টা করতেন, মায়ের খোঁজ করতেন, বিন্নিপিসি তখন এমন করে বাবার মন ছোঁয়া কিছু কথা বলত যে পরেরদিকে বাবা আর মায়ের খোঁজ করতেন না কুন্ঠায়। ভাবতেন বোধহয় এতো সেবাযত্ন করছে যখন মেয়েটা তখন আর তার মনে কষ্ট দিয়ে লাভ কি? যতদিন গেল বাবার প্রতি বিন্নিপিসির ওই সেবাযত্নের বহরটা এতো বেড়ে গেল যে কাজের লোকেরাও মুখ টিপে হাসত।
(৭)
একটা বুক কাঁপানো হিম শীতল আতঙ্ক তাড়া করে বেড়াচ্ছে মালিনীকে কাল থেকে।
অস্থির অস্থির লাগছে ওর সর্বক্ষণ। যেন মনে হচ্ছে অগাধ সমুদ্দুরে ডুবে যাচ্ছে ও। ডুবতে ডুবতে ও যেন সাত হাত জলের তলায়। কষ্ট করে শ্বাস ফেলছে। শরীরটা কাঁপছে। এসব ছায়াময়তার কথা কত সহস্র পা পিছনে ফেলে এসেছে। এভাবে, এতোদিন পর অতীত তার আঁচড় কাটা ক্ষতবিক্ষত সময় নিয়ে সামনে এসে দাঁড়াবে কোন জানান না দিয়েই কে জানতো? পাতালঘর থেকে হঠাৎ করে তার অতীতবাস এমন করে সামনে এসে দাঁড়ালো, এবং এমন একজন মানুষের হাত ধরে যে তার কাছে এখন মৃত এক অবসিত সময়। রাগ, বিরক্তি আর ক্ষোভে মনের ভিতরটা কাল থেকে টালমাটাল হয়ে আছে। অথচ এমনটা হবার কথা ছিল না।
জয়ব্রতকে মন থেকে কবে ও সরিয়ে দিয়েছে। যাকে আজ মনের কোথাও, এক চিলতে কোণেও ফেলে রাখেনি ও, এতোদিন পর তার ফোন পেয়ে এতো উতলা হবার কোন কারণ তো নেই। জয়ব্রত তার কাছে এখন আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের মতোই। মৃত। সমাপ্ত এক অধ্যায়। কিছুটা জোর করেই মন থেকে জয়ব্রতর চিন্তা সরিয়ে অফিস যাবার জন্য তৈরি হতে উঠে পড়ল মালিনী। বাড়িটা নিঝুম হয়ে আছে। শুধু রান্নাঘর থেকে টুংটাং বাসনপত্রের আওয়াজ ভেসে আসছে। আরতি কাজ করছে। এবার ওও চলে যাবে কাজ শেষ করে। একা বাড়িতে ওর আরও দমবন্ধ হয়ে আসবে। অন্যদিকে মন দেবার অনেক চেষ্টা করেও পারল না। মনটা অনেকটা পথ পিছিয়ে যাচ্ছে মাঝেমাঝেই। বুঝতে পারছে কাল থেকে মনের কোনায় পড়ে থাকা গুটিশুটি অবসাদটুকু একটু একটু করে যেন গোটা মনটায় কালো মেঘলা আকাশের মতো ধীরে ধীরে ঢেকে যাচ্ছে।
জলপাইগুড়িতে মালিনী বড়ো পরিবারে মানুষ। জয়েন্ট ফ্যামিলি আবার কি? শব্দটাতে আপত্তি আছে ওর। ফ্যামিলি তো একটাই। বড়ো বা ছোট। জন্মকাল থেকে যাদের সঙ্গে বেড়ে ওঠা তারা তো ওর পরিবারই। পরিবার ভাঙ্গে, টুকরো হয়। জোড়া কি লাগে কখনও? মালিনী আর নলিনী ওরা দু বোন ছোটবেলায় কাকা পিসিদের সঙ্গে মানুষ হলেও একটু বড়ো হলে বাবা পরিবার নিয়ে শিলিগুড়িতে চলে যান। মালিনী তখন ক্লাস সেভেন। নীলু আরও ছোট। বাবা অধ্যাপক ছিলেন। বাকি জীবনটা শিলিগুড়ি কলেজেই কাটে তাঁর। কিন্তু বাবার সঙ্গে ওদের শেষ পর্যন্ত থাকা হয়নি। সে আরেক গল্প।
ক্লাস নাইনের প্রথম দিকে জয়ব্রতর সঙ্গে প্রথম দেখা পাখিদের বাড়িতে। পাখি ওর স্কুলের বন্ধু। এক পাড়াতেই দুই বন্ধু। জয়ব্রত ছিল পাখির মাসীর ছেলে। ওদের থেকে বছর চারেকের বড়ো। কলকাতায় যাদবপুরে ইন্জিনিয়ারিং পড়তো। ভারি সুন্দর দেখতে ছিল জয়ব্রত। কথাও বলতো খুব গুছিয়ে। যে যেরকম পছন্দ করে তার সঙ্গে ঠিক সেইভাবে মিশতো। পাখি ছিল মালিনীর একেবারে প্রাণের বন্ধু। রোজ বিকেলে দুই সখীর একবার দেখা না হলে যেন সন্ধে নামত না। মাঝেমধ্যেই ওদের দুই বন্ধুর গল্পগাছায় জয়দা ঢুকে পড়তো আলগোছে। আলগোছে না ইচ্ছে করে? কী করে যে কী হয়ে গেল, জয়দার প্রেমে পড়ল সদ্য কৈশোর পেরোনো মালিনী। সবকিছু কেমন পালটে গিয়েছিল ওর জয়ব্রতকে দেখবার পর থেকে।। কী যে হতো ওর জয়দাকে দেখলে, বুকের ভিতর যেন উতল হাওয়ায় ভাসা নদীর স্রোত, তাতে জোয়ারের টান। ময়ূরপঙ্খী চলতো যেন উজান ঠেলে। প্রতিদিন বিকেল হলেই পাখিদের বাড়িটা ওকে যেন নেশার মতো টানতো। সেসব কিছু দিন ছিল। সদ্য প্রেমের নতুন উপলব্ধি। নতুন স্পর্শ। জয় বোধহয় বুঝেছিল মালিনীর মনে ঢেউ উঠেছে। গেলেই এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতো। ঠোঁটের কোণায় চিলতে হাসি। সেবার ফিরে যাবার আগে একদিন অন্ধকার সিঁড়ির নীচে দাঁড়িয়ে ওকে জড়িয়ে কানে কানে বলে গেল, ভালোবাসি। মন খারাপ করো না, আবার আসছি।
কস্তুরি চট্টোপাধ্যায়