ভাষা সন্ত্রাস

ভাষা সন্ত্রাস

অমিতাভ রায়

 

নাকা শব্দের অর্থ খুঁজতে খুঁজতে রীতিমতো নাকাল। অভিধানের পর অভিধান ঘাঁটাঘাঁটি করে অনেক নাকানিচোবানি খাওয়ার শেষে জানা গেল যে শব্দটির একটাই অর্থ, – অনুনাসিক বা চলতি কথায় খোনা । অথচ নির্বাচনের, তা সে পঞ্চায়েত পুরসভা বিধানসভা বা লোকসভা যাই হোক না কেন, প্রস্তুতি পর্বে প্রায়শঃই শুনতে কিংবা পড়তে হয় এলাকা জুড়ে নাকা চেকিং শুরু হয়ে গেছে। সংক্রমণ জনিত কারণে জনজীবন অবরুদ্ধ হয়ে যাওয়ার পর হঠাৎ করেই নাকা চেকিং শব্দবন্ধের প্রয়োগ বেড়ে গেল। সংবাদমাধ্যমে প্রতিদিন বা প্রতিনিয়ত প্রচার শুরু হল আজ কোন কোন জায়গায় নাকা চেকিং রয়েছে আর আগামীকাল কোথায় কোথায় হবে। 

 

হিন্দি এবং উর্দুতে নাকা বলতে বোঝায় সীমান্ত চৌকি। আন্তর্জাতিক নয়। প্রতিবেশী রাজ্য জেলা থানার সীমান্তে বসানো থাকে প্রশাসনিক নজরদারির বন্দোবস্ত যা সীমানা চৌকি বলেই পরিচিত। পথচারী থেকে যানবাহন চলাচলের উপর এখান থেকেই নজরদারি খবরদারি করা হয়। এমন খানাতল্লাশির প্রথা প্রাচীন কাল থেকে প্রচলিত। তখন অবিশ্যি নাকা চেকিং শব্দবন্ধের আবির্ভাব ঘটেনি। কিন্তু চৌকি তল্লাশির কাজ নিয়মিত হয়ে চলত। কিন্তু প্রচারের দাপটে চৌকি শব্দটাই হারিয়ে গেল। অথচ সহজেই চৌকি-তল্লাশি বলা যেত। হয়নি। অতএব, নাকা না মেনে উপায় কী!  

 

সাম্প্রতিক অতীতেও আইনসভায় নতুন আইন প্রণীত হওয়ার পর কার্যকর করার পর বিধি প্রণয়ন করে তা প্রয়োগ করা হত। এবং তার জন্য জারি করা হত প্রয়োজনীয় নির্দেশ। ইদানিং তা লাগু করা হয়। কেন? কেউ জানে না। তবে সংবাদমাধ্যম যখন কোনো শব্দ নিয়ে আগ্রাসী ভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে তখন সাধারণ মানুষের পক্ষে  সেই শব্দকে এড়িয়ে যাওয়া কঠিন। লাগু শব্দ প্রচলনের বিষয়ে বোধ হয় এমনটাই ঘটেছে। ফলে বাংলা ভাষায় কথা বলতে পারা মানুষ লাগু শব্দকে আত্মীকরণ করে নিতে দ্বিধা করেননি। এই পরিস্থিতিতে সকলেই ভুলে গেলেন বাংলায় জারি শব্দের অস্তিত্ব ছিল।

 

কলকাতা ঢাকা আগরতলা শিলচর তো বটেই পশ্চিম বঙ্গের বিভিন্ন শহরে পরিক্রমার সময় ইদানিং একটা কথা কানে আসে। ‘চাপ নিস না।’ পথ চলতে কানে আসে উচ্ছ্বসিত কৈশোর অথবা উল্লসিত যৌবন এই শব্দবন্ধে বেশ স্বচ্ছন্দ। রাস্তা রেস্তোরাঁয় প্রায়শঃই শোনা যায়। প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সময় জানা গেছিল ইংরেজি কমপ্রেশন শব্দের যথার্থ বাংলা হল চাপ। আর টেনশন শব্দের বাংলা হল টান। হঠাৎ কী করে সকলেই টান নিয়ে এত চিন্তিত হয়ে গেল কে জানে! হবেও বা! সমবয়সীদের সঙ্গে কথা বলে কোনও সদুত্তর পাওয়া গেল না। যেসব নবীন ‘জ্যেঠু’ বা  ‘দাদু’ সম্বোধন করে তাদের শরণাপন্ন হয়ে জানা গেল চাপ মানে টেনশন । মাত্র পাঁচ দশকে একেবারেই বিপরীত শব্দ কী করে বাংলাভাষী মানুষ শুধুমাত্র আয়ত্ত্ব করে নেওয়া নয় নিয়মিত প্রয়োগ করতে অভ্যস্ত হয়ে উঠলেন তার উত্তর কে দেবেন?

 

প্রবীণ শব্দকে হিন্দিতে বলে বরিষ্ঠ। ভুল বানানে বরিস্ট। বিভিন্ন বাংলা অভিধান ঘেঁটে জানা গেল বাংলায় বরিষ্ঠ বা বরিস্ট শব্দের অর্থ একেবারেই ভিন্ন। তবুও নিয়মিত শব্দটি ব্যবহার করা হচ্ছে। প্রবীণ বলতে অসুবিধা কোথায়?  

 

তালিকা দীর্ঘ করে লাভ নেই। সর্বগ্রাসী ভাষা সন্ত্রাসের আগ্রাসনে বাংলা ভাষার অস্তিত্ব সঙ্কটাপন্ন। এই আগুনে ধুনো ছড়িয়ে চলেছে বিজ্ঞাপন। বিন্দাস্, ধামাকা ইত্যাদি শব্দ তো এখন বহুল ব্যবহৃত। তার উপরে রয়েছে বিজ্ঞাপনের বিচিত্র বানান। এত শত অ-শুদ্ধ বানান প্রতিদিন ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত হচ্ছে অথবা টিভির পর্দায় ভেসে উঠছে যে মাঝে মাঝেই ঠিক বানানটিই মনে পড়ে না। 

 

পৃথিবীর সব ভাষাই অন্য ভাষার প্রয়োজনীয় শব্দ নিয়ে নিজের শব্দভাণ্ডার সমৃদ্ধ করে। এ বিষয়ে সবচেয়ে এগিয়ে ইংরেজি ভাষা। সেটাই স্বাভাবিক। সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে থাকা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অসংখ্য ভাষার সঙ্গে দীর্ঘদিনের পরিচয়। যে শব্দের যথার্থ ইংরেজি নেই সেই শব্দকে অবলীলায় ইংরেজি ভাষার শব্দভাণ্ডারে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। যেমন, – পন্ডিত। এর যথাযথ ইংরেজি হয় কি? কাজেই ইংরেজি ভাষার অভিধানে পন্ডিত জায়গা পেয়ে গেছে। এভাবেই জায়গা করে নিয়েছে বাবু, সাধু, ঘেরাও ইত্যাদি। 

 

ব্রিটিশ জীবনে দিবানিদ্রার  বালাই নেই। কাজেই দিবানিদ্রার কোনও ইংরেজি ছিল না। স্পেনের উপনিবেশগুলি করায়ত্ত্ব করার পর ব্রিটিশের নজরে আসে দিবানিদ্রা সেইসব দেশের সংস্কৃতি। তাকে অবহেলা করা মুশকিল। অথচ তাকে বোঝানোর জন্য কোনো ইংরেজি শব্দ নেই। স্প্যানিশ বা হিস্পানি ভাষার সিয়েস্তা টুক করে ইংরেজি অভিধানে জায়গা পেয়ে গেল। সিয়েস্তা বাংলার একান্ত প্রিয় দিবানিদ্রা। 

 

শব্দের অভাবে অন্য ভাষা থেকে যথার্থ শব্দের আমদানি করা যেতেই পারে। সব ভাষাই এভাবে সমৃদ্ধ হয়। বাংলা ভাষাও ব্যতিক্রমী নয়। ফার্সী, ইংরেজি, ফরাসী, পর্তুগিজ ইত্যাদি ভাষার বহু শব্দ বাংলা ভাষায় সংযুক্ত হয়েছে। কিন্তু যথাযথ শব্দ থাকা সত্ত্বেও অন্য ভাষার শব্দের ব্যবহার, সময় বিশেষে ভুল ব্যবহার করা হলেই মুশকিল। এখন তো শুধু ব্যবহার নয়, রীতিমতো আগ্রাসী অভিযান চলছে। সংবাদমাধ্যম, বিজ্ঞাপন ইত্যাদি এই আগ্রাসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ফলাফল,- শুদ্ধ শব্দ পরিহার করে বাংলা ভাষায় প্রচলিত হয়ে যাচ্ছে অন্য ভাষার শব্দ। এমন আগ্রাসী ভাষা সন্ত্রাসের কাছে মাথা নত করেও বচ্ছরকার দিনগুলোতে গাওয়া হয়, – ‘মোদের গরব মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা’?

অমিতাভ রায়

পুকুরঘাট

পুকুরঘাট

একদিন আমরা মাত্র কয়েকজন সদস্য নিয়ে পুকুরঘাট নামের একটি মেয়েদের ভার্চুয়াল দল খুলে ছিলুম। অচিরেই সে কয়েকটি সদস্যের দল কয়েক হাজার সদস্যের মেয়েদের দল হয় ওঠে। পুকুরঘাট দলের মত এত গুণী মেয়েদের সমাহার বাংলাদেশে খুব কম ভার্চুয়াল দলে আছে। কাজেই সেই দল সেখানেই আটকে থাকবে না বলা বাহুল্য। তাই পুকুরঘাট দলের অন্যতম উদ্যোগ হিসেবে প্রকাশিত হলো পুকুরঘাট পত্রিকা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

6 thoughts on “ভাষা সন্ত্রাস

  1. ভাষা সন্ত্রাস— আগাগোড়া একটি উপভোগ্য লেখা।খুব ভাল লাগল।

  2. ভালো লাগলো।
    নাকাবন্দী কথাটা অনেকদিন যাবত আছে বাংলায়।
    বরিষ্ঠ আর প্রবীণ বোধহয় একটু ভিন্ন। প্রবীণ বয়েসে প্রাচীন, আর তা না হয়েও অভিজ্ঞতা বা পদের নিরিখে কেউ বরিষ্ঠ বা সর্বাগ্রে বরণীয় হতে পারে। এমন আমার মনে হলো।

  3. একটি তথ্যসমৃদ্ধ ও উপভোগ্য লেখা। খুব ভালো লাগল।বাংলা ভাষার চর্চা এখন সীমিত। রাস্তাঘাটে চলতে ফিরতে বেশ কিছু কথা কানে আসে যেমন মাজাকি মারা , ঝাড়ি মারা, ল্যাদ খাওয়া, ঝক্কাস এমনতরো অজস্র অজানা শব্দ যা আজকালকার প্রজন্মের কাছে বহুল ব্যবহৃত। কিন্তু আমার মতো মানুষের কানে ভীষন লাগে- অনেকটা ওই সন্ত্রাসের মতোই।
    এমন পরিবেশনার জন্য অনেক ধন্যবাদ

  4. ভাষা সন্ত্রাস বেশ তথ্য সমৃদ্ধ লেখা।বেশ উপভোগ করলাম।