বিলেতে দেহাতি-পর্ব ২

সুজাতা রায়
দোহা থেকে প্যারিস প্রায় সাতঘন্টার জার্ণি।প্রথম ঘন্টা চারেক ঝিমিয়ে থাকতে থাকতেই শুরু করলাম সেল্ফ কাউন্সেলিং। সামান্য কটা টাকার জন্য এমন করছি!কি হয় আটাশ হাজার টাকায়?একটা ভালো আঙটি ও হয় না!কর্তার দাঁত এ মুকুট পরাতেই(Crowning)তো এর তিনগুণ বেরিয়ে গেছিল – তারবেলা?হুঃ যত্তোসব!টাকা দিয়ে তাও জুতো তো পেয়েছি! কতোলোকের সোনার হার ছিনতাই হয় – ডাক্তার এর ভুলে কিডনি বাদ চলে যায় – তারপর ইয়ে,একগাদা টাকা খরচ করে বিয়ে করে একবছরে ডিভোর্স হয় না?ট্যাক্সিতে ভুলে টাকা ভর্তি ব্যাগ ফেলে আসে না লোকে? আরো কত কী হয় সে তুলনায় এ আর এমন কী! গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বসে পায়ের দিকে তাকালাম,আহা ধবধবে সাদা একজোড়া পক্ষীরাজ যেন আমায় পিঠে নিয়ে উড়ি উড়ি কচ্ছে!নিজের মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম – যা সিমরণ জি লে আপনি জিন্দিগী !
গ্রামে গ্রামে সেই বার্তা রটি গেল ক্রমে – দু’ বছর ধরে পেটে কথা পুষে রাখব এমন জব্বর হজম ক্ষমতা আমার কোনও কালে নেই।কাজেই আত্মীয় -স্বজন ঘনিষ্ঠ মহলে ছড়িয়েই গেছিল আমার সম্ভাব্য বিলেত ভ্রমণ এর কথা ব্যস শুরু ডুজ্ এন্ড ডোন্টস্ এর ফিরিস্তি।সিডনি থেকে ভাগ্নীর ফোন -‘ডাইজিন থেকে ইনসুলিন সব প্রেশক্রিপশন করে নেবে মামি ওখানে রাস্তার মোড়ে মোড়ে ওষুধের দোকান পাবে না কিন্তু !’বাগবাজারের জামাইবাবুর নিদান -‘প্রচুর ড্রাই ফ্রুট – শুকনো মিষ্টি নিয়ে যেও লাঞ্চ কিনে খেতে হলে ফতুর হয়ে যাবে!’ব্যাঙ্গালোর থেকে বোনের নিদান -‘সঙ্গে অঢেল খুচরো পয়সা রেখো দুজনেই সুগারের রুগী যতোবার হিসু করতে যাবে দশ সেন্ট করে মেসিনে গুঁজে দিলে তবে ওয়াশরুমের দরজা খুলবে!’বেহালার পিসির ফোন এলো – ‘ওরে আর কিছু নিস না নিস একখানা মগ অবশ্যই নিবি – বাথরুমে মগ বালতি কিচ্ছু পাবি না! বড় -ছোট-মাঝারি সব কাজ কাগজে সারতে হবে!’কাকার উপদেশ – একখানা খালি বোতল রাখবি – বেরোনোর আগে বাথরুমের জল ভরে নিবি – খাবার জল বলে কোনও পদার্থ কিন্তু ও দেশে পাবি নে’!সব থেকে মোক্ষম উপদেশ এলো আবাল্য বন্ধু ইন্দিরার কাছ থেকে -‘খবরদার কারুর কোলে বাচ্চা আর সঙ্গে কুকুর দেখলে আদিখ্যেতা করে আদর করতে যাবিনা – জেলের ঘানি ঘুরিয়ে ছেড়ে দেবে!’এতোশত উপদেশ আত্মস্হ করার জন্য দু’বছর সময় যথেষ্ট মনে হলেও আহাম্মকরা চিরদিন ই যথাকালে বিপরীত আচরণ করে – আমার ক্ষেত্রেই বা ব্যতিক্রম হবে কেন!বিকেল সাড়ে তিনটেয় প্যারিসের সি.ডি.জি বিমানবন্দরে পৌঁছলাম।চেন্নাই-মহারাষ্ট্র-দি ল্লী-পাঞ্জাব-গুজরাট-আসাম-কুয়েত মিলিয়ে আমাদের আটাশ জনের গ্রুপ।ট্যুর ম্যানেজার মুম্বাই এর রীতেশ গুজ্জর দোহাতেই এসে মৌখিক আলাপ সেরে গেছিল এখন পুরো গ্রুপের সঙ্গে আলাপ পরিচয় এবং সবার লাগেজ পেতেই প্রায় ঘন্টা দুয়েক কেটে গেল।এই দুঘন্টা এক জায়গায় বসে থেকে কাটানোর কোনও মানে হয়?উশখুশ করছি – এদিক ওদিক তাকাচ্ছি হঠাৎ দেখি একটা ফ্যামিলি আসছে সঙ্গে ফুটফুটে এক চতুষ্পদী – ব্যস আমায় আর পায় কে!রইলো ঝোলা ছুটলো ভোলা!কাছাকাছি যেতেই চকিতে ইন্দিরার সাবধান বাণী মনে পড়তেই সেকেন্ড এর ব্রেক,কিন্তু আমি থামলে কি হবে সে তো থামার নয় -সঙ্গী সাথী সক্কলকে তাজ্জব করে দিয়ে সে হামলে পরলো আমার ওপর!দূরে কর্তা কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে – পাশে চৈতীর ঠকঠক কাঁপুনি, চতুষ্পদর পরিবার কিংকর্তব্য বিমূঢ়। এসবের মধ্যে – তার ফরাসী ঘাউঘাউ আমার বাংলা – ছন্টা মন্টা মিলে আমাদের আলাপ পর্ব জমে উঠলো।মানুষজন যতোই আমায় দূরছাই করুক না কেন এই অবলা জীবেরা কোন জাদুতে জানিনা আমায় দেখলেই ভালোবেসে ফেলে – এই সাতসমুদ্দুর তেরোনদী পেরিয়ে এসেও তার অন্যথা হলো না-প্যারিসে পা রাখতে না রাখতেই আমার ভ্রমণ এর ভরপুর শুরুয়াত হয়ে গেল।

ট্যুর শুরুর দিন পনেরো আগেই আমাদের ট্যুর এজেন্সির তরফ থেকে একটা হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ খুলে দেওয়া হয়েছিল।তাতে গ্রুপের সবাইকে প্রয়োজনীয় তথ্য দেওয়া -কারুর কোনও জিজ্ঞাসা থাকলে ট্যুর ম্যানেজারের কাছে জেনে নেওয়া,বাঙালীরা বাঙালি খুঁজে নেওয়া(অন্যরা খুঁজেছে কিনা জানি না),করোনা জনিত কর্তব্য কর্ম জানা ইত্যাদি নানারকম আদানপ্রদানের মধ্যে একদিন হঠাৎ দেখি ট্যুর ম্যানেজার জানতে চেয়েছেন আমরা কে কে প্যারিসের বিখ্যাত Nude Show দেখতে আগ্রহী।আমরা যেদিন পৌঁছাবো সেদিন শনিবার।রাত ন’টায় শো,দেখতে হলে আগেই জানাতে হবে সেইমত টিকিট কাটা থাকবে।ডিনার সেরেই আমাদের নিয়ে যাওয়া হবে শো দেখতে।কমপক্ষে দশজন না হলে নিয়ে যাবে না।দেখেই তো আমার যাকে বলে পাথরে পাঁচ কিল।হুররে!এই সুযোগ ছাড়ার কোনও মানেই হয় না।বিদেশে বিভুয়ে কে চিনছে আমাদের?উচ্ছন্নে যাবার এমন সুবর্ণ সুযোগ ছাড়ে!
অনেক হয়েছে লক্ষ্মী মেয়ের সাজ।ভালো থাকবার চাপ ছুঁড়ে ফেলো আজ।চলো একবার দুজনে নষ্ট হই।দেশে ফিরে ফের সুবোধ বালক হবো।
যাকে বললাম তঁার মুখখানা দেখে মনে হলো এমন অশালীন প্রস্তাব পৃথিবীতে এর আগে কোনও দিন কোনো স্ত্রী তার স্বামীকে দেয়নি!অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললো ‘কেউ চেনেনা মানে?চৈতীর সঙ্গে আমি ন্যুড শো দেখব?তুমি নীরেনকে দাদা বলো না?সঙ্গে মেয়ের শাশুড়ি থাকবে ভুলে গেছ?’ রামঝাঁকুনি খেয়ে বাস্তবে ফিরলাম।শাল্লা এরেই কয় বাঙালের বলদামি!ফরেন ট্যুর তো না যেন মকরস্নানে গঙ্গাসাগর যাচ্ছি -সাতগুষ্টিকে বগলদাবা করে না নিলে মোচ্ছব জমে না।সত্যি! গোল্লায় যাওয়াও বড়ো সোজা কথা না – দম থাকতে হয়।


এয়ারপোর্ট এর বাইরে অপেক্ষায় আমাদের আগামী দশদিনের বাহন সাদা কালো ঝা চকচকে বিশাল বাস আর বিশালকায় পোলিশ ড্রাইভার। তিনি পোলিশ ইংরেজি তে আত্মপরিচয় দিলেন,সবাই চুপচাপ শুনলেও আমি নাম বুঝতে না পেরে আবার জিজ্ঞাসা করতেই তিনি বুঝলেন আমার ইংরেজির দৌড় কদ্দুর এবং কাঁধ ঝাঁকিয়ে বানান টি বলে দিলেন -WOJCIECH.হে পাঠকবৃন্দ এর উরুশ্চারণ আমার জিভের দৌড়ে কুলায় নি আমি তাকে রোজ ‘হাই খটোমটো’ বলেই সুপ্রভাত শুভরাত্রি জানিয়েছি,সে অত্যন্ত গদগদ চিত্তে মাথা নাড়িয়ে প্রত্যুত্তর দিয়েছে।


অক্টোবরের শেষ,আসন্ন শীতের সঙ্গে পাতাঝরার মরসুম।রাস্তা জুড়ে ম্যাপল পাতার কার্পেট বিছানো। এয়ারপোর্ট থেকে বেরোতে না বেরোতেই ঝিরঝির বৃষ্টি শুরু হলো সঙ্গে বেদম ঠাণ্ডা হাওয়া। হোটেলে পৌঁছনোর আগেই বৃষ্টি থেমে ঝকঝকে আকাশ।মিনিট কুড়ির রাস্তায় একটা জনমনিষ্যির দেখা নেই।চেক ইন করে রুমের দখল নিতেই মন ভরে গেল।আপাতত তিনদিনের আস্তানা।কোথায় আমার বাড়ি- কোথায় প্যারিসের আই.বি স স্টাইল হোটেলের পাঁচতলার পশ্চিম মুখী ঘরের কাঁচের জানলায় অস্তগামী সূর্যের ছটা।হঠাৎ ভেতরটা কেমন হু হু করে উঠলো,এই সূর্য টাই তো কাল ভোরে আমার ময়ূরাক্ষীর কোল আলো করে ভেসে উঠবে।ক্লান্ত অবসন্ন শরীর নিয়ে বিছানায় গা ঢেলে দিতেই ফোন বেজে উঠলো ডিনার টাইম।সভ্য দেশে আটটার মধ্যে খাওয়া সারতে হয়।নিতান্ত অনিচ্ছায় বাসে উঠে বসলাম।মিনিট দশেকের মধ্যে পৌঁছে গেলাম ‘দাওয়াত’ হোটেল এ।ধবধবে সাদা ভাত -মুগ ডাল-আলুভাজা- চাটনী -রুটি-তরকা-পনীর -মাংস-স্যালাড-পাপড়-টকদই-বিরিয়া নী-লাচ্ছা পরোটা -মিক্সভেজ – কি নেই?তেল মশলায় গড়গড়ে নর্থ ইন্ডিয়ান রান্না। শেষ পাতে চমকের ওপর চমক নলেনগুড় দিয়ে চিনি গুড়া চালের পায়েস।ওহো!সপ্তম স্বর্গে ভেসে গেল বাঙাল রসনা।

সুজাতা রায়
ওহঃ অনবদ্য। আপনিনযে কেন রম্যরচনা নিয়মিত লেখেন না কে জানে।একেই চোখ ধাঁধানো রূপের ছটা তায় আবার কলমের এমন জোর ক’ জনেরই বা আছে??? তবে ১ নং লেখাটির লিংক চাই।
দারুন লাগছে। অনেক মিল পাচ্ছি। প্রথম বিদেশে থাকতে এসেছিলাম যখন ওই সাবধান বাণী কেউ করেনি তাই ঠেকে শিখেছিলাম কত কি। পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।
ভারি মজা লাগছে পড়তে। পুরোটা পড়ার অপেক্ষায়।
দুর্দান্ত… ❤️❤️তবে ওই আর কি, ন্যুড শো টা মিস করে ফেললে!! আফসোস!
কি লিখছ গো! মন প্রাণ ভরে যাচ্ছে, তাড়াতাড়ি শেষ কোরো না প্লিজ। আমি টাইপ করছি আর হ তোমার কুপ্রস্তাব শুনে স্যারের মুখটা কল্পনা কিরার চেষ্টা করে হেসে মরছি। তুমি পারো। ওই বাঘা প্রফেসরের কপালেও ‘বাঙালের বলদামি’ উপাধি জুটল!!!
খুব সুন্দর লিখেছ
পরের পর্বের অপেক্ষায়।
ভালো লাগলো, পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম
চমৎকার চলছে। প্যারিসে ন্যুড শো কিন্তু অশ্লীল মনে হয় না। বরঞ্চ সামান্য জামাকাপড় পরে বেশ কিছু হিন্দী সিনেমা বা আজকালকার কিছু বাংলা সিনেমায় যা দেখায় তা অনেক বেশী অশ্লীল।
প্যারিসের এই ন্যুড শোয়ের ভীতি আমারও প্রবল ছিল। রাতে ফেরার পরে বরের সঙ্গে দুদিন কথা বলিনি এই বলে… তোমায় বিয়ে করে আমার পদস্খলন হল… ইত্যাদি ইত্যাদি। দারুণ রম্য গদ্য।
আহা, মরি মরি কি সুন্দর ঝরঝরে লেখা, আমিও তো সাথে মানস ভ্রমণ করছি।
বেশ লাগছে এমন সরস বর্ণনা পড়তে।
দুর্দান্ত… হেসে লুটোপুটি…
ভালো লাগছে। আমার প্যারিস ভ্রমণ নেহাতই পুরনো হয়ে গেছে।
উফফ, nude show টা যে আমাদেরও বাদ রয়ে গেল। শুরু থেকেই সঙ্গে আছি। খুব ভালো লাগছে। বারবার হয়তো কমেন্ট করা হবে না, তাই বলে গেলাম।