বিলেতে দেহাতি- পর্ব পাঁচ

শ্যেন নদীর তীর ঘেঁষে সোজা তাকান ঐ যে বিস্তীর্ণ সবুজ ভেলভেটের মতো ঘাসে মোড়ানো ধুধু তেপান্তরের মাঠ ওর ওপাশেই আছে যুগান্তরের ইতিহাস।এত্ত বড়ো মাঠে একটাও গাছ গজাতে দেওয়া হয়নি যাতে আপনার দৃষ্টি না আটকায়। এক্কেবারে চোখ গিয়ে ঠিকরে পড়বে সোনায় মোড়া সমাধি চূড়ায়।ঐ সমাধি ঘিরে যে বিশাল প্রাসাদ ওটিই Les Invalids। যুদ্ধে আহত সৈনিকদের হাসপাতাল আর ঐ যে রোদে ঝলসাচ্ছে সোনালী টুুম্ব তার নীচে রয়েছে নেপোলিয়ন বোনাপার্টের দেহাবশেষ।১৮২০সালে সেন্ট হেলেনা দ্বীপে মৃত্যুর ২০ বছর পর তার দেহাংশ পুনরায় এখানে সমাধিস্থ করা হয়েছিল।
নেপোলিয়ানের দেহাংশের সমাধিস্থল
এই থমকানো ইতিহাসের সামনের বিস্তীর্ণ মাঠ জুড়ে হাজারো মানুষের ভিড়।গোটা প্যারিসে অসংখ্য পার্ক যার প্রতিটি গাছ আর ফোয়ারায় সাজানো কিন্তু যা অবাক করবে তা হলো সর্বত্র কুঁচোকাঁচাদের ভিড়। আসলে প্যারিসের বাড়িগুলো বেশিরভাগ রাস্তা থেকে সটান উঠে গেছে। বাড়িতে বা আবাসনের ভেতরেও খেলাধুলোর জায়গা দেখিনি বললেই চলে। তাই পার্কে মাঠে সর্বত্র বাচ্চাদের ভিড়।কোথাও কুকুর আর ইয়া ফুলো গোঁফ ওয়ালা বিড়াল নিয়ে মা বাবা সহ গোটা পরিবার, কোথাও একলা মা সঙ্গে চারপেয়ে ছা, দুজনেই মাঠ দাপিয়ে খেলে বেড়াচ্ছে।ফোয়ারার ঝিরঝির শিশুদের কলরোল আর পাখির ডাক মিলে যেন অনিঃশেষ আনন্দমেলা।আপনি তাদের চিনুন নাই চিনুন তারা আপনাকে চেনে,ছোটাছুটি খেলতে খেলতে আপনাকে ঘিরেই হয়তো শুরু হলো ছোঁয়াছুঁয়ি খেলা। ইলেকট্রিকের পোলের মতো দাঁড়িয়ে উপভোগ করুন বা আমার মতো দলে ভিড়ে যান তারপর হাঁসফাঁস করতে করতে মাঠে এলিয়ে পড়ুন হঠাৎ চমকে উঠুন অচেনা পুষ্যির ভিজে নাক আচমকা আপনার গাল ছুঁয়ে গেলে, ধড়মড় করে উঠে দেখবেন একগাল হাসি নিয়ে বিদেশি হাসিনা বিব্রত মুখে দুর্বোধ্য ভাষায় আপনার কাছে ক্ষমা চাইছে। আপনিও হাসুন না বুঝে বোকার হাসি বা সবজান্তার মিচকি হাসি, দেখবেন চারিপাশটা কেমন ঝলমল করছে। এর নাম প্যারিস সব্বাই সব্বার চেনা।চোখাচোখি হলেই হাসি ছোঁড়াছুঁড়ি।
আজ আমাদের একদম সময় নেই। শুয়ে গড়িয়ে খেলে বেরিয়ে দিন কাটানোর জো’টি নেই, চলো চলো বাসে উঠে পরো গন্তব্য প্যারিস থেকে বারো মাইল দূরে ভার্সাই প্যালেস। তেইশশো ঘর ষাট হাজার শিল্পকর্ম আর পাঁচ শতকের ইতিহাস নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ভার্সাই প্রাসাদ।
ভার্সাই প্যালেস
১৬০৭ সালে ত্রয়োদশ লুই এর আমলে ভার্সাই ছিল ছোট্ট একটা হান্টিং লজ। ১৬৩৪ এ এই প্রাসাদ তৈরী শুরু হয় পরবর্তী পঞ্চাশ বছর ধরে গড়ে উঠেছে এই অবিশ্বাস্য প্রাসাদ। রাজা বা রাজপরিবারই নয় ফরাসী অভিজাত সম্প্রদায় এবং উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী সহ প্রায় দশহাজার মানুষ বাস করতো এই প্রাসাদে। চারশো বছর আগে চতুর্দশ লুই এর আমল থেকে ষোড়শ লুই প্রায় একশো বছর এটি ছিল রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্র। চূড়ান্ত রাজতন্ত্রের প্রতীক এই ভার্সাই প্যালেসে ফ্রান্সের লুভ্যর মিউজিয়াম এবং আইফেল টাওয়ারের পর সবচেয়ে বেশি পর্যটক সমাগম (বছরে প্রায় আশি লক্ষ)হয়। টিকিটের মূল্য ন্যুনতম পনেরোশো টাকা। কমপক্ষে চারঘন্টা সময় লাগে এক ঝলক ভার্সাই প্যালেস ঘুরে দেখতে। রাজপরিবারের ব্যবহৃত জিনিসপত্র, থরেথরে সাজানো, অমূল্য সব শিল্পকর্ম অনিঃশেষ বিলাসব্যসনের নির্লজ্জ ইতিহাস নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এই প্রাসাদ। এর বিখ্যাত কক্ষটি হলো ‘হল অব মিররস’। সত্তর মিটারের বেশি চওড়া কাচ দিয়ে সাজানো এই ঘরে ঢুকলে শুধু চোখই ধাঁধায় না মাথাও ঝিমঝিম করে,কতো আয়োজন বেঁচে থাকার! প্রাসাদে রয়েছে কুইন মেরি আতোনিয়েৎ-এর ব্যক্তিগত থিয়েটার হল। বাগানে ঢুকলে দিশাহারা লাগে হারিয়ে যাওয়া অনিবার্য এমন তার আয়তন। সুপরিকল্পিত সুসজ্জিত বাগান চারিদিকে রাজাদের বোটিং করার নীল টলটলে লেক। ভোগ বিলাসিতা কোন চূড়া স্পর্শ করলে গিলোটিন এ মাথা গুঁজে তার প্রায়শ্চিত্ত করতে হয় তারই সাক্ষী ভার্সাই প্রাসাদ।
হল অফ মিরর
১৭৮৯এর ৬ই অক্টোবর বিপ্লবীদের কাছে পরাহত রাজপরিবার বাধ্য হয় ভার্সাই ছেড়ে প্যারিসের Tuleries Palace এ চলে যেতে। ১৭৯১ সালের একুশে জুন ষোড়শ লুই এর গ্রেফতারীর সঙ্গে সঙ্গেই ভার্সাই প্যালেসের ওপর রাজপরিবারের অধিকার চিরতরে চলে যায়।ফরাসী বিপ্লবের সময় যুগযুগান্তের নিপীড়ন আর অত্যাচারে জর্জরিত প্রজাদের ক্ষোভের মুখে এই প্রাসাদ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় পরে সংস্কার করে আগের অবস্হায় ফিরিয়ে এনে খুলে দেওয়া হয় পর্যটকদের জন্য। আজ এই প্রাসাদে আমার আপনার মতো রাম-শ্যাম-যদু-মধুর দল দাপিয়ে বেরাচ্ছি, যে অজস্র বিপ্লবীর প্রাণের বিনিময়ে তাঁদের কৃতজ্ঞ চিত্তে স্মরণ করে রওনা দিলাম প্যারিসের উদ্দেশ্যে।
ভার্সাইয়ের অন্দরে
Perelachise Cemetery
১৮০৪ সালে স্থাপিত ১০০একর জায়গা জুড়ে প্যারিসের আর এক দর্শনীয় জায়গা। সাত হাজার মৃত শৌধের মধ্যে রয়েছে অস্কার ওয়াইল্ড, জিম মরিশন, বালজাক এর সমাধি। শত শত মানুষ ঘুরছে দেখছে অথচ নিথর নীরব চারিপাশ।পাখির ডাক আর পাতা খসার আওয়াজও যেন উচ্চকিত মনে হয়। যারা চিরঘুমে শায়িত তাদের যেন ঘুমের ব্যাঘাত না ঘটে। এমন সুসজ্জিত সুপরিকল্পিত দর্শকধন্য সমাধিক্ষেত্র দেখলে মৃত্যু সত্যিই শ্যাম সমান মনে হয়।
Perelachise Cemetery
সমাধি ক্ষেত্রটেত্র দেখিয়ে শ্মশান বৈরাগ্য জাগিয়ে আমাদের এনে ছেড়ে দেওয়া হলো বিখ্যাত অপেরা হাউসের সামনে।ফরাসী সুগন্ধি থেকে আইফেলটাওয়ার আঁকা টি-শার্ট, ফ্রিজ ম্যাগনেট থেকে চিকিমিকি আলো জ্বলা আইফেল টাওয়ার, যা খুশি কেনো। অভিজাত সুগন্ধির দোকান বাদ দিয়ে সব জায়গায় গড়িয়াহাটিয় দরাদরি করো,খাও দাও -ঘুরে বেড়াও। ঘড়ি ধরে তিনটি ঘন্টা সময় নিয়ে বাস থেকে বেরিয়ে আমরা ছড়িয়ে গেলাম অপেরা হাউস চত্বরে।
অপেরা হাউস
সুগন্ধির দোকানের কাছাকাছি আসতেই টের পেলাম ফরাসি সুগন্ধি কাকে বলে! মৃদু আলতো স্নিগ্ধ সুবাস যেন দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলো – সারা শরীরে জেগে উঠলো এক পেলব শিহরণ ।এতো মৃদু যেন আছে আবার নেই ও – এত সতেজ যেন মাথার মধ্যে গেঁথে যাচ্ছে সুগন্ধের স্মৃতি!ফ্রেঞ্চ হেল্থ পাস দেখিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে সে দোকানে প্রবেশাধিকার মেলে।চারিদিকে কাচের ভিতরে মৃদু আলোয় তুলোর বিছানায় কেউ আলগোছে বসে – কেউ হেলে দাঁড়িয়ে- কেউ পাশ ফিরে শুয়ে,সোনালী – রুপালি তরল বুকে নিয়ে স্ফটিক স্বচ্ছ শিশিতে মহার্ঘ্য সব সুগন্ধি।বেশ কিছু বছর আগে শঙ্করলাল ভট্টাচার্যর একটা লেখা পড়েছিলাম আনন্দর কোনও একটা পূজাবার্ষিকী সংখ্যায় ‘শ্যানেল’কে নিয়ে।তাঁর কষ্টকর প্রথম জীবন তারপর নিজস্ব ব্রান্ড এর উত্থান কাহিনী যা রূপকথাকেও হার মানায়।ব্রান্ডেড সুগন্ধির যেটুকু জ্ঞান আমার ঐ পর্যন্তই। বছর তিনেক আগে আমার এক অকালমৃত বান্ধবীর শেষ উপহার Gucciর একটি সুগন্ধি আমার ভাঁড়ারে একমাত্র ব্রান্ডেড পারফিউম।এখন নাতনী আর বিজ্ঞাপনের দৌলতে কিছু সিক্রেট টেম্পটেশন জ্ঞানভাণ্ডারে যুক্ত হলেও আসলে আমার দৌড় সেই ‘কান্তা’তেই থেমে আছে। তিশ হাজারি জুতো পরে ধুধু পকেটে হাত ভরে বেজায় কায়দা মেরে আমি শ্যানেল ফাইভের দাম জিজ্ঞাসা করতেই চোখধাঁধানো সেলসম্যান অতি নম্রতার সঙ্গে১০০ml.এর যা দাম বললেন(ভারতীয় টাকায় প্রায় কুড়ি হাজার। আমি কাচের শোকেস ধরে টাল সামলিয়ে মৃদু হেসে ধীর পদক্ষেপে গুটিগুটি নিষ্ক্রান্ত হতেই বাইরে দাঁড়ানো ভদ্রলোক আমাকে জলের বোতল এগিয়ে দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন – “শরীর খারাপ লাগছে নাকি?”
মেরিলিন মোনরোর সেই বিখ্যাত ছবিটা মনে আছে? লোহার জালিপাতা রাস্তার নীচ থেকে হঠাৎ হুহু হাওয়া শুরু হলো আকাশপানে ছুট লাগানো স্কার্ট সামলাতে নাজেহাল মোনরো মুখে মোহিনী হাসি! ভাবুন তো শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড়ে শাড়ি পরিহিতা গিন্নীকে নিয়ে পুজোর বাজার করতে গেছেন। এমন সময় পাতাল ফুরে হাওয়ার তোড়ে শাড়িটি উর্দ্ধগামী আপনার মুখটি কেমন দেখাবে?আদৌ জীবনে আর মুখটি দেখানো যাবে? এ রসিকতা করার এবং সওয়ার ধক থাকতি হবে চাঁদু!সুগন্ধির গলি পেরিয়ে হনহনিয়ে অপেরা হাউসের পানে ধাইতেই ‘কোথা থেকে কি হইয়া গেল’আমার চুল শেরওয়ানী সোয়েটার সব আমায় ছেড়ে দে উড়াল! ভাগ্যিস থার্মাল আর জিনস দাঁতে দাঁত লাগিয়ে পা দুটো কামড়ে ধরে ছিল তাই এ যাত্রা মান সম্মান নিয়ে ফিরতে পারা গেল। ধন্যি প্যারিস! সুগন্ধি আর হাওয়ার জোড়া ধাক্কা সামলে এলিয়ে পরলাম অপেরা হাউসের বিস্তৃত চাতালে।সেখানে গান ধরেছে এক যুবক আর তাকে ঘিরে কয়েকশো নারী পুরুষ। কী অপূর্ব সে দৃশ্য! চারিদিকে অজস্র গাড়ি,অফিস ফেরত মানুষজন,জগৎবিখ্যাত সব ব্রান্ডেড দোকান দোকানী, ক্রেতা, কফিশপ, চেয়ার টেবিল, খাওয়া দাওয়া সব চলছে এমন নিঃশব্দে যেন মিউট বাটন টিপে দিয়েছে কেউ। রাস্তা পরিষ্কার করার গাড়িটিও একধারে সরে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো যতক্ষণ গান চললো।গায়ক আর শ্রোতার মধ্যে তিরতির করে বয়ে চলেছে এক মুগ্ধ নীরবতা।
অপেরা হাউসের চাতাল
হাঁটছি – বসছি, এগোচ্ছি – দেখছি একটা দোকানের সামনে এসে বেশ ফিলগুড অনুভূতি হলো আমাদের। আইফেল টাওয়ার থেকে নোতরদাম সব পাওয়া যাচ্ছে।্এখন যে কোনও সংখ্যা কে নব্বই দিয়ে চোখের পলকে গুন করে ফেলছি,হিসেব কষে দেখলাম দুচারটে আইফেল টাওয়ার – লুক্সর ওবেলিস্কওলা চাবির রিঙ- ফ্রিজ ম্যাগনেট কেনাই যায় ।বাদামী দোকানদার হাসিহাসি মুখে কুতকুতে চোখে আমাদের নব্বই ঘরের নামতা শুনছেন আর না বুঝে সবজান্তার হাসি হাসছেন আমি চৈতীকে ফিসফিসিয়ে বললাম – ‘কী আতাক্যালানে লোক দ্যাখ বলদের মতো আমাদের কথা শুনে হেসেই যাচ্ছে – কি বুঝছে?’ তাক ঝেড়ে সবচেয়ে কমা মাল খুঁজে পেতে বের করে লোকটার সামনে দিয়ে বেশ কায়দা করে জিজ্ঞাসা করলাম – How much I have to pay?সেই গা জ্বলানো হাসিটা হেসে লোকটা বললো – ‘ফালতু ইংরাজি কইয়া চিবুকে ব্যথা করোনে কাম কি আপা?বাংলায় কয়েন আমার বাড়ি কুমিল্লা আপনে তো ইন্ডিয়ার আপনেরগো থনে বেশি নিমু না’!
আমি আর চৈতী ফরাসি সুগন্ধের দোকানের সামনে
সুজাতা রায়
লেখার রঙ গাঢ় হচ্ছে, নেশা বাড়ছে, ডুবছি। অজ্ঞান হবার আগে শানেল ফাইভটা একবার শুঁকে এসেছিলে তো!
হাহা, শেষ টা দারুন! প্রায় গোটা ইউরোপ, বাংলা থুড়ি বাঙাল বলে চালিয়ে দেওয়া যায়। দারুন লাগছে পড়তে।
কী যে ভালো লিখেছো কি বলবো।হাসতে হাসতে ভালোবাসছি ,তোমার সাবলীল গদ্য কে,সুগন্ধে আর হওয়াতে ভেসে যাচ্ছি।চমৎকার। পরবর্তী পর্বের অপেক্ষায় থাকলাম