বিলেতে দেহাতি
শুরু হলো সুজাতা রায়ের ভ্রমণ ধারাবাহিক ‘বিলেতে দেহাতি’,
কয়েক পর্বের এই লেখার এবার প্রথম কিস্তি।
সুজাতা রায়
আমি গাছের মতো,আরে না না সহ্য ক্ষমতা-ছায়া-ফল-ফুল-ছাল-বাকল এসবের কথা মোটেও বলছি না বলছিলাম শেকড়ের কথা।যেখানে জন্মেছি এই শেষ পঞ্চাশে এসেও সেখানেই আছি -এমন শেকড় চাড়িয়েছি।এই শহর ছেড়ে আমি একটানা বেশিদিন কোথাও থাকতে পারি না।খাটের কোন,বারান্দার রেলিঙ,ছাদের আলসে,সিড়ির ধাপ,ফোড়নের ডালা,বাথরুমের আয়না,পাড়াভর্তি কুকুর বেড়াল,বাগান ভর্তি পাখি গাছ ফুল,উঠোনের কোনে কুঁয়ো -কুয়োঁর ভেতর উঁকি মারা আরেকটা আমি – সব্বাইকে নিয়ে জড়াজড়ি করে এই জীবনটাই আমি-আমার বেঁচে থাকা।তবে ঐ যে নতুন করে পাবো বলে মাঝেমধ্যে হারানোর ছুতোতেই বৎসরান্তে এক আধবার বেড়ানো।এরম বেদম ঘরসোহাগী আমি যে কেমনকরে একবারে জেলা -রাজ্য -দেশের বেড়া টপকে বিদেশ পৌঁছে গেলাম সে বড়ো আশ্চজ্জি।বছর পনেরো আগে করা পাসপোর্ট রিনিউ করানোর সময় হতেই হুঁশ হলো এতো কাণ্ড করে পাসপোর্ট করানোর মানে কি এতদিনেও একটা দেশের ছাপই যদি না পড়লো?বাঙালের ‘চেইত্যা ওঠা’ যাকে বলে! – অনেক হলো রান্নাবাটি খেলা এবার কিন্তু বিদেশ যাবার পালা!ব্যাঙ্কক -পাট্টায়ার বুড়ি ছোঁয়ানোর ধান্দা হতেই লাফিয়ে উঠলাম – ‘মারি তো গণ্ডার, লুঠি তো ভাণ্ডার ‘! যাবো তো ইওরোপ ই যাবো!ভদ্রলোক বুঝলেন ব্যাঙ্ক ব্যালেন্সের থেকে শান্তির প্রয়োজন অনেক বেশি! অতঃপর -চালাও পানসি মাঝ দরিয়া।
শুরু হলো খবরের কাগজের বিজ্ঞাপন দেখে পাত্র-পাত্রী নির্বাচন এর মতো ট্রাভেল এজেন্সির খোঁজ ।এ ভালো না সে!মাঝ আকাশে প্লেন থামিয়ে টাকা চাইবে না তো?বিদেশে বিভুঁয়ে ফেলে পালিয়ে আসবে না তো?আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধবদের মধ্যে কারা গেছে কাদের সঙ্গে গেছে,কোন এজেন্সি আধপেটা খাইয়ে রেখেছে,পাঁচতারা বলে দু তারা হোটেলেও রাখেনি, দিস্তা দিস্তা ফিরিস্তির ঝাড়াই বাছাইয়ের পর্ব সাঙ্গ হতেই পঁয়তাল্লিশ বছরের বন্ধু চৈতীকে ফোন ‘ চল ইওরোপ ঘুরে আসি!’তার দশা হলো – ‘পাগলা খাবি? না আঁচাবো কোথায়!’
২০২০-র ১২মে ইওরোপ বেড়ানোর দিন ঠিক হতে ২০১৯-এর ২৩ অক্টোবর ট্রাভেল এজেন্সির ব্যাংক একাউন্ট এ টাকা জমা দিয়ে আসা হলো আর ঠিক সেদিনই বিকেলে আমার মা এর হার্ট অ্যাটাক হলো।বাবা,দুই দিদির মৃত্যুর পর মা এর আমি ছাড়া কেউ নেই।চারিদিক আঁধার হয়ে এলো। চুলোয় যাক বিদেশ ভ্রমণ,শুরু হলো মা কে নিয়ে এক হাসপাতাল থেকে আর এক হাসপাতাল দৌড়াদৌড়ি।আই.সি.সি.ইউ ও বিস্তর ওষুধ পত্তরান্তে মা সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে না ফিরতেই ২০২০-র ফেব্রুয়ারির এক রাতে একদম আমার হাতে মাথা রেখেই মা তারার দেশে পাড়ি দিল।তার ঠিক এক মাসের মাথায় করোনার কারণে পৃথিবী স্তব্ধ হয়ে গেল।ট্রাভেল এজেন্সিও জানান দিল তারা একপয়সাও ফেরত দেবে না। সব স্বাভাবিক হওয়া অবধি অপেক্ষা ছাড়া কিছু করার নেই।মা কে হারিয়ে বিপর্যস্ত মানসিক অবস্থায় এই সময়টুকু আমার ও খুব দরকার ছিল।
একুশের অগাস্ট পড়তে না পড়তেই ট্রাভেল এজেন্সির ফোন এলো অক্টোবরে ইওরোপের অনেক দেশ পর্যটনের দরজা খুলে দিচ্ছে এবং আমাদের মূলতুবি হয়ে যাওয়া ভ্রমণ এবার সেরে নেওয়াই দস্তুর কেননা দুবছর ধরে টাকা দেওয়া হয়ে আছে। ঈষৎ ব্যথিত চিত্তে আমরা প্রস্তুতি শুরু করলাম কেননা যে চারটি দেশ বেড়ানোর লিষ্টে ছিল তার মধ্যে আমার সবচেয়ে আগ্রহের দেশটি বাদ গেল -ইউ কে কেননা তখনও তারা পর্যটক ঢুকতে দিচ্ছেনা।ভিসা -ইউরো আর টি পি সি আর-এর ঝামেলা চুকিয়ে অবশেষে অক্টোবর এর বাইশ তারিখ দিল্লীর প্লেনে চেপে বসলাম।কাতার এয়ারলাইন্সের টিকিট।রাত সাড়ে দশটায় দিল্লী পৌঁছে পাঁচঘন্টা অপেক্ষার পর রাত সাড়ে তিনটেয় দোহার ফ্লাইট।দিল্লী এয়ারপোর্টের অসহযোগিতা, ইমিগ্রেশন কাউন্টারের অব্যবস্থার কথা লিখে শেষ করা যাবে না সে আর এক গল্প।অবশেষে আমরা দোহাগামী ফ্লাইট এ চেপে বসলাম।সারাদিনের ক্লান্তি আর উদ্বেগের অবসানে শরীর যেন ছেড়ে দিল – চোখ জড়িয়ে এসেছে ঘুমে এমন সময় কানের কাছে মিহিন সুরে ডাক পাড়ছে কে রে? কোনও রকমে চোখ খুলতেই দেখি -আবছা আবছা আলোর মাঝে ফুটফুটে এক মেয়ে নীল দুখানি চক্ষু মেলে আমার পানে চেয়ে কি যেন সব বলেই যাচ্ছে মাথায় ঢুকছে না।ভাবছি আমি এই তো শুলাম স্বপ্ন দেখছি নাকি,বিদেশ যেতে না যেতেই বিদেশিনীর স্বপ্ন! মাগো! স্বপ্ন তে কি সাহেব সুবোর কম পড়লো নাকি!এমন সময় পাশের জনের রামধাক্কা খেয়ে ঘুম ভাঙতেই সামনে দেখি বিমানবালা হাজির ভোরপাঁচটায় ট্রে ভর্তি খাবারদাবার নিয়ে।না বলতে গিয়েও দেখি সবাই তো বেশ নিচ্ছে – খাই না খাই দেখতে ক্ষতি কী?নিরামিষ এর ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হয়ে হাত বাড়ালাম।জীবনে প্রথম ভোররাত্তিরে পোলাও -পনির-হ্যানো ত্যানো অমুক তমুক সাত সতেরো(নাম জানি না যে) খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।ঘুম ভাঙতেই দোহা ‘হামাদ ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট ‘।
কলকাতা নেতাজী সুভাস বিমানবন্দরে লেখিকা। পায়ে কিন্তু কালো জুতো।
দোহার এয়ারপোর্ট এ প্রচুর হাঁটতে হবে বলে আগেই চৈতী আর আমার বরের হুইলচেয়ার বলাই ছিল ওদের হুইল চেয়ারে রওনা করিয়ে আমরা বাকী তিনজন আমি,নীরেনদা( চৈতীর বর )আর আমার বেয়ান হাঁটা পথে রওনা দেব বলে দাঁড়িয়ে আছি এমন সময় লিফ্টম্যান আমাকে ডেকে বললেন -‘আপনার জুতোর সোল খুলে পড়ে আছে’।পাগলা বলে কি!বিদেশ যাবো বলে পাটভাঙা জুতো পরেছি আর বলে কিনা!হেসে বললাম ‘ঠিক করে দেখুন আপনার জুতোর নয় তো?’পিছন ফিরে দেখলাম একটা ফুটফুটে সাদা শুকতলা হামাদ এয়ারপোর্টের মাটিতে বীচসুন্দরীর মতো শুয়ে সানবাথ নিচ্ছে। আর আমি এগোতে গিয়েই টের পেলাম ডানপা টা কেমন নিচু নিচু ঠেকছে! ওমা একি!আমার জুতো র তলা কই!লিফ্টের আফ্রিকান ভদ্দর লোক চোখমটকে তার পা দেখিয়ে বুড়ো আঙুল তুলতেই আমি দাঁত চিপে মনে মনে তাঁকে ‘সম্বন্ধীর পো’ বলে খোঁড়াতে খোঁড়াতে এয়ারপোর্ট এ মুচির খোঁজে রওনা দিলাম।নতুন জুতো কি করে এমন হয়,সল্টলেক সিটিসেন্টারএর সেরার সেরা দোকান থেকে মাত্র দুবছর আগে কেনা। তারপর থেকে বাক্সবন্দী,করোনায় বেরিয়েছি যে পরবো?গজগজ করতে করতে একে তাকে জিজ্ঞাসা করেও মুচির খোঁজ না পেয়ে শেষে এয়ারপোর্ট এ জুতোর দোকানের শরণাপন্ন হলাম।একদিকে ইমিগ্রেশনের ঝামেলা তখনও বাকি অন্যদিকে প্যারিসের ফ্লাইট এর টাইম হয়ে আসছে,সময় নেই সময় নেই রব।জুতোর দোকানের লোকেদের মুখ দেখে মনে হলো জুতো যে সাড়ানো যায় এটাই তারা প্রথম শুনছে।এ জুতো পরে আমি প্যারিস যাবো কি করে!অগত্যা কেনো নতুন।কি করে কিনবো আমার কাছে তো কাতার এর রিয়াল নেই।ভারতীয় টাকা নেবে না একমাত্র ইউরো নেবে।সবচেয়ে কমদামী জুতোর দাম 306ইউরো।আমি বাবারে মারে বলে লাফাতেই নীরেনদা বলে উঠলো – ‘সুজাতা এমনকি দাম! আমার জুতোটাই তো এর চেয়ে বেশি দিয়ে দেশেই কিনেছি,সময় নেই একদম নিয়ে নাও। কর্তাও সঙ্গে নেই,আমাদের দেরি দেখে ওরাও ছটফট করছে,আমিই কি হিসেবে ভুল করছি?হতে পারে অঙ্কে গোল্লা পাওয়া আমি,নীরেনদা অতোবড় ডাক্তার……’। 306 ইউরো দিয়ে নতুন জুতো কিনে পুরোনো (মাত্র একদিন পরা)জুতো ঐ দোকানের ডাস্টবিনে গুঁজে ছুটতে ছুটতে এসে কোনও রকমে ইমিগ্রেশন টপকে হাঁফাতে হাঁফাতে ফ্লাইট এ উঠে কর্তাকে সব বলতেই মিচকি হেসে বললেন -‘বাড়ি ফিরে একটা কাচের বাক্স বানিয়ে জুতোটা সাজিয়ে রেখো।’আমি রে রে করে উঠলাম ‘কি এমন দাম’! কর্তা আরো আস্তে বললেন-‘306×90করলে 27540/- হয়।’আমার মাথাটা কেমন টলমল করে উঠলো – পা এর দিকে তাকাতে গেলাম চোখে কেমন ঘোর লেগে গেল। হা ভগবান নীরেনদা যে বললো2700/!জীবনে প্রথম অঙ্ক ঠিক করেছিলাম,ডাক্তারবাবুর কথায় বিশ্বাস করে সেটাও ভুল করে ফেললাম!নীরেনদাকে তেড়েফুড়ে বলতেই বললেন -‘প্লেনটা মিস করলে কি বেশি ক্ষতি হতো না?নাকি এই ঠাণ্ডায় তুমি খালি পায়ে প্যারিসে পা রাখতে?’চুলোয় গেল বেড়ানোর আনন্দ,বাকি সারাটা রাস্তা দোহা থেকে প্যারিস আমি আক্ষরিক অর্থে মৃতবৎ হয়ে রইলাম। অপ্সরা নিন্দিত বিমান বালা -বচ্চন নিন্দিত সহযাত্রী ঘন্টায় ঘন্টায় দেবভোগ্য খাদ্যসম্ভার সব চোখের সামনে দিয়ে বয়ে গেল যেন,শুরু হলো উৎকন্ঠার ভ্রমণ।সীমিত অর্থ আর অসীম খরচের টানাপোড়েন।
( চলবে)
প্যারিসের বিমানবন্দরে লেখিকা নামলেন সাদা জুতো পায়
সুজাতা রায়
সুজাতা, বিলেতে দেহাতি ভালো লাগল। আমার সাহেব সুবোর দেশে লেখা মনে পড়ল…
দিদি আপনি পড়েছেন – অশেষ ধন্যবাদ।
Chomotkar opekkhyae roilam
মজা পেলাম। অপেক্ষায় রইলাম।
বেশ লাগল কিন্তু
আমি তোমার টেনশনটা খানিক উপলব্ধি করার চেষ্টা করলাম। কেমন যেন ঢেউয়ের ধাক্কায় বালি সরে যাবার মতো অনুভূতি হলো। কি ভালো লাগছে পড়তে❤️❤️
সুজাতার লেখা লা-জবাব!
সাব টাইটেল গুলোতে অনেক টাইপো চোখে পড়ছে। এখানে যেমন নেতাজি সুভাস, তৃতীয় কিস্তিতে দেখলাম লভোনীয়।
আর একটা কথা। আলাদা করে বলার অপেক্ষা রাখে। সেটা অলংকরণ। অপূর্ব সুন্দর।
পুকুর ঘাটের এ-ই পত্রিকা দিনে দিনে তিলোত্তমা হয়ে উঠছে।
Chomotkar laglo