বিন্দুর পত্র
গৌরী মৃণাল
আমি বিন্দু। তোমার,তোমাদের সেই বিন্দু। চিনতে পারো আমাকে? সেই কবে যেন তোমার কলম আলতো ছুঁয়েছিল বাঙালি ঘরের এই কালো কুচ্ছিত মেয়েটাকে। হোক সে খুড়তুতো ভাইদের অনাথা বোন, হোক সে বড়দিদির এজমালি সংসারে এক বিষম বালাই, এক অনাবশ্যক আবর্জনা,- তবু তুমি তাকে জুটিয়ে দিয়েছিলে এক আশ্চর্য আশ্রয়,- সে আমার মেজদিদি। আমার মৃণালদিদি। তুমি মহদাশয় বটে। সেই সাতাশ নম্বর মাখন বড়ালের গলির ওই বাড়িতে একটা গাবগাছ ছিল উত্তর দিকের পাঁচিলের গায়ে নর্দমার ধারে। নতুন পাতাগুলি যখন রাঙা টকটকে হয়ে উঠত, আমার মেজদিদির মুখখানিতে সেদিন বাসন্তী আলোর রোশনাই। সে বুঝি শুধু আমিই দেখতে পেতুম। এই অভাগা দীনহীন মেয়েটার হৃদয় পেয়েছিল এক কমলহীরে। সেও তোমার পরম দাক্ষিণ্য। তারপর? তারপর তোমার শাণিত কলম নামিয়ে দিল এক নিকষ কালো পর্দা, নিয়ে এল এক ঝোড়ো অন্ধকার। আমার সে সুখটুকু তোমার সইল না। আরও একবার আমাকে ঘরছাড়া করলে তুমি। ঘরে বাইরে শরীরে মনে আকাশে বাতাসে উথালপাথাল ধেয়ে এল অন্ধকারের ঢেউ, আগুনের ঢেউ ... পালাতে পালাতে জ্বলতে জ্বলতে পালাতে পালাতে, শেষবারের মত .... - বিন্দু!! আমি মরলুম। মরে বাঁচলুম। তুমি লিখলে,- মরেছে বৈ তো না,বেঁচে থাকলে কী না হতে পারত! বলো তো কেন? কেন? কেন মরতেই হল আমাকে? এই সংসারের অন্দরমহল থেকে, অতি তুচ্ছ ইঁটকাঠের আড়াল থেকে, তার সমস্ত বাঁধা নিয়ম, বাঁধা অভ্যাস, বাঁধা বুলি,বাঁধা মার এর হাত থেকে কেন বেরোতে দিলে না? কেন সেই দীনতার নাগপাশ- বন্ধনের জয় হল তোমার কলমে? হার হল তোমার নিজের সৃষ্টি ঐ আনন্দলোকের! তোমাকে দোহাই দিই। এক নতুন বিন্দুকে গড়ে তোল তুমি নতুন করে, আর একবার। তুমি তো নিষ্ঠুর নও ভাগ্যের মত। আর একবার শ্রীক্ষেত্রের গাড়িতে আমাকে তুলে দিয়ে আসুক শরৎ, আর একবার নীল সমুদ্র আর আষাঢ়ের মেঘপুঞ্জ ঘিরে আসুক চারিদিক, আর একবার অন্ধ আবরণখানা ছিন্ন করে বাইরে এসে দাঁড়াই, সেই সুন্দরের পায়ে জীবনের জয়পতাকা উড়িয়ে দিয়ে বলি ,- যো তুম তোড়ো পিয়া ম্যায় নাহি তোড়ু রে! আমিও বাঁচব, আমি বাঁচলুম।গৌরী মৃণাল
অসাধারণ। লক্ষ্মী মেয়ের নতুন পরিচয়ে নতুন দিগন্তের সূচনা।