ব্ল্যাকহোলের বাইরে
ঋতা বসু
শীতের সকাল, বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে রুমানি । আজ নার্সিংহোম থেকে ছুটি নিয়েছে, কাল রবিবার এমনিতেই ওর ডে-অফ্ ।
এই কমলা রঙের মিঠে রোদটার উষ্ণতা গায়ে মাখতে বেশ লাগছে, কিন্তু উপায় নেই কামারহাটি যেতে হবে, দুটো দিন ওখানেই কাটাবে ।
মনটা তাই ফুরফুরে আজ, এ দুটো দিন সনকাদি ছাড়াও রমা থাকবে মা-বাবার দেখভালের জন্য । তাই বেশ নিশ্চিন্ত লাগছে ।
বালিগঞ্জ সার্কুলার রোড ধরে ছুটে চলেছে রুমানির নীল স্যান্ট্রো । স্নান সেরে ব্রেকফাস্ট খেয়ে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়েছে,
ন’ টার মধ্যেই চৌরঙ্গীর ভিড়টা পেরিয়ে যেতে হবে । ক্যামাক স্ট্রীট ক্রস করেই বাঁ দিকে যেন একটা কিসের জটলা!
ভিড় করা মানুষের ফাঁক দিয়েই রুমানি দেখলো… একটা মানুষ রাস্তায় শোয়া । কি হলো! রুমানির ডাক্তার সত্তা জেগে উঠতেই,
একটা গলির মধ্যে গাড়ি পার্ক করে, হাতে গ্লাভসটা গলিয়ে রুমানি নেমে পড়লো ।
— দেখি, একটু সরে যাবেন?
— ঠেলাঠেলি করবেন না দিদি, দেখছেন তো…
— আমি ডাক্তার, তাই ভাবছিলাম
— আচ্ছা ম্যাডাম, আসুন আসুন…
ভিড় সরে গিয়ে জায়গা করে দেয় । আরে!! একজন নয়, দুজন মানুষ রাস্তায় শোয়া । একজন নর্দমা ঘেঁষে, অন্যজন ফুটপাতে ।
রাস্তায় একটা ম্যানহোল খোলা পাশেই জঞ্জালের স্তুপ । রুমানির বুঝতে বাকি থাকে না, এই ম্যানহোল পরিষ্কার করতে গিয়েই বিপত্তি ।
একজন ট্র্যাফিক পুলিশ ব্যাস্ত হয়ে ওয়াকি-টকিতে কথা বলছেন, তাকে জিজ্ঞাসা করে রুমানি…
— আমি কি একটু পালস্ টা দেখবো এদের?
আমি ডাক্তার ।
মাথা নেড়ে সম্মতি দেন পুলিশ বাবু । ম্যানহোলের পাশে শোওয়া শ্রমিকটির মাথায় সস্তাদামের একটা হেলমেট ছাড়া আর কোনো
রক্ষাকবচ নেই । নাড়ি চলছে তবে খুব ক্ষীণ । রুমানি পুলিশ বাবুর দিকে তাকিয়ে বলে,
— পালস্ পাচ্ছি এখনো আশা আছে, এ্যম্বুলেন্স…
পুলিশটি মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলেন
— খবর দিয়েছি, আসছে…
অন্য জনের নাড়ি দেখতে গিয়ে রুমানির ভুরু কুঁচকে যায় ।
— একি! এনার তো পালস্ পাচ্ছি না!!
কর্পোরেশনের কমলা জ্যাকেট পরা একজন বলে ওঠেন
— ও, ঠিকেদারের লোক আমাদের নয় ।
রুমানি একটু রেগেই উত্তর দেয়
— তাতে কি? ঠিকা শ্রমিক বলে ওনার প্রাণের দাম নেই?
— তা বলিনি ম্যাডাম, ওনার দায়িত্ব আমাদের নয়, মানে কর্পোরেশনের নয় ।
—- তাহলে কি ওনার ট্রিটমেন্ট হবে না?
পুলিশ বাবু আস্বস্ত করেন ।
— এ্যম্বুলেন্স আসছে দুজনকেই সরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হবে ।
কর্পোরেশনের লোকটি আবার বলে ওঠে
— ওনার চিকিৎসার দায়িত্ব কিন্তু কর্পোরেশন নেবে না ।
কথাবার্তার মাঝখানেই প্যাঁ পোঁ সাইরেন বাজিয়ে এ্যম্বুলেন্স এসে গেল । রুমানি একটু বিরক্ত মেজাজে গাড়িতে ফিরে আসে ।
হাত স্যানিটাইজ করে আবার গাড়িতে স্টার্ট দেয় । মাথায় চিন্তা কিন্তু ঘুরতেই থাকে । দ্বিতীয় লোকটির প্রাণের আশা কম ।
নর্দমার বিষাক্ত গ্যাস, অথচ নিরাপত্তা ছাড়াই কাজ করছেন এরা । গ্যাস মাস্ক নেই, উপযুক্ত পোশাক নেই, এটা কি আইনসঙ্গত?
এদের জীবনের দাম কে দেবে? ঘরে হয়ত বৌ-বাচ্চা আছে, কিংবা বুড়ো মা-বাপ । ভাবতেই নিজের বয়স্ক মা-বাবার কথা মনে পড়ে গেল রুমানির,
যাঁরা এখন শিশুর মতো ওর ওপরেই নির্ভর । ইস্! মনে মনে শিউরে উঠলো রুমানি । গাড়ি ছুটে চলছে সেন্ট্রাল এ্যভেনিউ দিয়ে ।
ডানলপ ব্রিজ পেরিয়ে অনন্য অপেক্ষা করবে রুমানির জন্য তাড়াতাড়ি পৌঁছতে হবে ।
বছর দুয়েক হলো অনন্যর সাথে আলাপ রুমানির । ওদের দুজনের ভাবনা-চিন্তার এতো মিল যে খুব অল্প সময়েই ওরা দুজন কাছাকাছি এসে গেছে ।
ভবিষ্যত নিয়ে অনেক স্বপ্ন ওদের মনে । ডানলপ ব্রিজ পেরিয়েই রুমানির চোখ খুঁজতে থাকে দোহারা চেহারার ছ’ ফুট লম্বা মানুষটাকে ।
পিঠে রুকস্যাক, চোখে সানগ্লাস অনন্য এসে বসে রুমানির পাশের সিটে । গাড়ি আবার স্টার্ট নেয় । রুমানি চুপচাপ, কথা নেই মুখে । ভাবছে অনন্যর
ব্যাগটার ভেতর নিশ্চয়ই ওর প্রিয় ক্যানন ক্যামেরাটা রয়েছে । অনন্য সাংবাদিক কিন্তু ওর নেশা ছবি তোলা আর অসহায় মানুষের পাশে থাকা ।
“সাথী” বলে ওর একটা এন. জি. ও. আছে ।
— কি ম্যাডাম! এতো চুপচাপ কেন?
— ভাবছি, ভাবছি মানুষের জীবনের কোনো দাম নেই ।
— হঠাৎ, ডাক্তার ম্যাডামের মুখে এমন কথা?
— ঘটনা মশাই ঘটনা । এতো বড় রাষ্ট্রে শ্রমিক আর কৃষকেরা এতো বঞ্চিত! মন খারাপ করে দেয় ।
— সবই রাজনীতির খেলা, রু… ব্যাক্তি-স্বার্থ কেন্দ্রিক, বড়জোর দলতন্ত্র ।
— হুম! দেখলাম তো, লকডাউনের সময় অন্য রাজ্যে কাজ করতে যাওয়া শ্রমিকদের কেমন নাস্তানাবুদ হতে হলো । কতো প্রাণ চলে গেল!
— রু, সাংবাদিকরা চুপ করে বসে নেই। ভাবছি আমিও একটা জবরদস্ত ফিচার লিখবো ।
— হাঁ অনি, প্রতিবাদ হোক, মিটিং-মিছিল হোক, সরকারের কাছে একটা আবেদন রাখতেই হবে ।
— রু, ঘুঁটি সহজে নড়বে না কিন্তু,তবুও চেষ্টা চালিয়ে যেতেই হবে । বেশ চালাও পানসি বেলঘরিয়া । দুজনেই জোরে হেসে ওঠে ।
কামারহাটিতে গঙ্গার ধারের যে বিশাল বাগানবাড়িতে অনন্য আর রুমানি “শিশু-আশ্রম” আর প্রাইমারি স্কুল খুলেছে ঐ বাড়িটা দান করেছেন
আবর্তক চটকলের মালিক সূর্য নারায়ন সাহা ।এমনিতেই চটকল ধুঁকতে ধুঁকতে চলছিল, প্যান্ডামিক আর লকডাউনে পুরো তালা পড়ে গেলো।
প্রায় সাড়ে তিন শ’ শ্রমিক একেবারে পথে বসলো । টিচার্স কলোনি পেরিয়েই চটকল কর্মীদের বস্তি । খুব দুর্দশায় কাটছিল ওদের দিন ।
“সাথী” এন.জি.ও থেকে কমিউনিটি কিচেন বানিয়ে ডাল, ভাত, সবজি রেঁধে খাইয়েছে ওদের । সপ্তাহে একদিন ডিম-ভাত হতো, শুধু বাচ্চারা নয়
বড়দের চোখগুলো ও চকচক করে উঠতো । ওদের সুখ-দুঃখের সাথে জড়িয়ে গেছিল অনন্যরা । চটকল কর্মীদের স্বার্থে, ওদের কথা বলতেই
অনন্যরা গিয়েছিল সূর্য নারায়ন বাবুর বাড়ি । গিয়ে দেখলো, কি অসহায় অসুস্থ অবস্থায় দিন কাটছে ওনার । বিপত্নীক সূর্য বাবু খুব যত্ন করে মানুষ
করেছিলেন একমাত্র ছেলে বিক্রমকে । ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে বিক্রম আমেরিকা গেছিল মাস্টার ডিগ্ৰি নিতে, ওখানেই করোনা প্রাণ কেড়ে নেয় বিক্রমের ।
নিঃসঙ্গ সূর্যনারায়ন অবসাদে ডুবে যান । এ্যকিউট এ্যজমায় আক্রান্ত সূর্যনারায়নকে যথাযথ চিকিৎসা করিয়ে মোটামুটি সুস্থ করে তোলে অনন্যরা ।
তারপর অনন্যদের সাথে আলোচনা করে চটকল কর্মীদের কিছু কিছু মূলধন দিয়ে নতুন রোজগারের পথ খুঁজে নিতে বলেন। সূর্যনারায়ন তার বিশাল বাগান
সমেত তিনতলা বাড়িটা দান করেন চটকলকর্মীদের শিশুদের জন্য । যেসব বাচ্চারা তাদের মা বাবা দুজনকেই হারিয়েছে, সেসব বাচ্চারা জায়গা পেয়েছে বাড়ির দোতালায় ।
একতলায় খোলা হয়েছে বাচ্চাদের জন্য প্রাইমারি স্কুল । রুমানি আর অনন্যর চোখে এখন অনেক স্বপ্ন । বাচ্চাগুলোকে মানুষ করতে হবে যথাযথ ভাবে ।
পড়াশোনার সাথে সাথেই খেলাধূলো করবে, ছবি আঁকবে, গান শিখবে হাতের কাজ শিখবে, একটা পরিপূর্ণ মানুষ হয়ে উঠবে এই শিশু-আশ্রমের শিশুরা ।
তাই অনেক ভেবে রুমানি ও অনন্য এই আশ্রমের নাম রেখেছে “সূর্যোদয়” । তিনতলা থেকে রঙিন জামা পরা বাচ্চাগুলোকে যখন সবুজ মাঠে খেলে
বেড়াতে দেখেন সূর্যবাবু, তখন তাদের প্রত্যেকের মুখেই তিনি বিক্রমের আদল খুঁজেপান । তার বিক্রম যেন এক থেকে একশ’ জনের মাঝে ছড়িয়ে গেছে,
বড় তৃপ্তি লাগে মনে।
রুমানির গাড়ি ঢুকছে সূর্যোদয়ের গেট দিয়ে । গঙ্গার ঠান্ডা হাওয়ার সাথে ভেসে আসছে কচি গলার প্রার্থণা সঙ্গীত আসন্ন-প্রসবা মায়ের মতো রুমানির ব্যথাতুর
চোখদুটো মায়ায় ভরে ওঠে । প্রশান্তি ছুঁয়ে যায় মনে। এই শিশুগুলো তাদের নিজের আলোয়ে আলোকিত হবে একদিন । হয়তো বা কেউ কেউ বাতিস্তম্ভ হবে ।
ওরা নিজেদের আলোয়ে সমাজের কালো গহ্বরগুলোকে আলোকিত করবে … পারবে না? ঠিক পারবে রুমানি নিশ্চিত জানে, দেখে নেবেন আপনারা ।

ঋতা বসু
বাহ খুব সুন্দর লাগলো পড়ে
ধন্যবাদ ।
এমন লেখা উদ্বুদ্ধ করে অন্যদের
খুব ভালো লাগল
খুব ভালো লাগল
রূমানিরা আরও বেশী করে এগিয়ে আসুক সমাজের জন্য ।
ভাল লাগল গল্পের অন্তর্গত মেসেজ।
দারুণ লাগলো। এই পৃথিবীতে লক্ষ লক্ষ রুমানী র আশা এভাবেই যেন পুর্নতা পায়।
দারুণ লাগলো। এই পৃথিবীতে লক্ষ লক্ষ রুমানি র আশা এভাবেই যেন পুর্নতা পায়।
সহমর্মিতার গল্প মন ছুঁয়ে যায়
Besh valo
Khub vslo laglo.asha vora.
খুব ভালো লাগলো।আশা জাগালো।
আশার গল্প….
ভালো লাগলো।
খুব ভালো লাগল পড়ে।