বইমেলার বোল

শুভঙ্কর দে
আঙ্কেল, কেমন আছো?
–আমার বন্ধু শুনে বললো, এই আঙ্কেল কাকে বলছে?
–আমায় বলছে।
আমরা আঙ্কেল হয়ে গেলাম! একরাশ বিস্ময় বন্ধুর মুখে।
বাংলায় কাকু, জেঠু হয়। দাদার পরে কাকু চলে কিন্তু এক লাফে যদি জেঠু হয়ে যাই কেমন কেমন একটা লাগে না! আঙ্কেলে কাকু না জেঠু কিছুই বোঝা যায় না।
বন্ধুকে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, দেখ আঙ্কেল বলেছে, জেঠু তো বলেনি। বন্ধু রেগে বললো , তুই কী করে জানলি যে এই আঙ্কেলের মধ্যে জেঠু নেই।
–কোথাও তো আর পুরোপুরি কাঁচা নেই। সব জায়গাতেই তো পাক ধরেছে। কপাল। কপালের নিচে ডানদিকের ভ্রুতে দেখ দুটো পাকা। সপ্তাহে একবার করে ছাঁটাই, শালা দুটো আবার ফুটে বেরোয়।
এই হলো শব্দের বিড়ম্বনা। অশ্লীল শব্দ ব্যবহার না করলেও বাক্যটা অশ্লীল। “শালা” শব্দটা গালাগাল হলেও বউয়ের ভাইকে শালা ডাকেই আনন্দ। সে শালা যতই রাগ করুক।
বইমেলায় ঘটে যাওয়া ক্ষনিকের মুহূর্ত। যেখানে এক পড়ুয়ার চোখে বইমেলায় স্টাইল মেরে ঘুরে বেড়ানো অপুর প্রৌঢ়ত্বের বিড়ম্বনা।
বারো দিনের বইমেলায় অজান্তেই ঘটে যায় এমন কত শব্দের বিভ্রাট। বইমেলায় লেখক, পাঠক, প্রকাশক ও স্টলের কর্মীদের মধ্যে যে সব কথোপকথন হয় তাতে শব্দের বিভ্রাট তো থেকেই যায়। আমার দেখা ও শোনায় সেই কথোপকথনগুলোই বরং এখানে সাজিয়ে দিই।
নতুন কর্মী নারায়ণ সান্যালের বইয়ের তাকের সামনে দাঁড়িয়ে। ভিড় ঠেলে এগিয়ে আসে ভক্ত পাঠক।
–রাস্কেল…দাদা বইটা দিন।
দাদার নামটাই কেমন রাস্কেল হয়ে গেল। সারা দিন ধরে নতুনদা শুনে গেলেন,
–রাস্কেল দাদা।
–দাদা বিশ্বাসঘাতক।
–না মানুষ দাদা।
–দাদা প্রবঞ্চক।
কলেজ পড়ুয়া অপু যখন নারায়ণ সান্যালের বই বিক্রি করতো তখন কতবার শুনতে হয়েছে “দাদা কালো”। নারায়ণবাবুর একটা বই ছিল “কালো কালো”। কখনো বলতো
–দাদা কালো।
আবার
–কালো কালো দাদা।
ছুটতে ছুটতে হাঁপিয়ে পড়ে চিত্র সাংবাদিক গোপাল। খুব দ্রুত জিজ্ঞাসা করে কোনো লেখক বাউন্সার নিয়ে বইমেলা ঘুরছে?
–কিছুক্ষণ হকচকিয়ে গিয়েছিলাম। “বাউন্সার” শব্দের সঙ্গে আমার পরিচয় ক্রিকেট মাঠে। ইন্ডিয়া অস্ট্রেলিয়া টেস্ট ম্যাচে ইডেনের মাঠে স্পিনার শেন ওয়ার্ন তিনিও বাউন্সার করেছিলন। এর বাইরে যে এই শব্দের আরও বৃহৎ মানে আছে তা মূর্খ অপুর জানা ছিল না। আপ্তসহায়ক বা বডি গার্ড এদের একটা গোষ্ঠীকে নাকি বলা হয় বাউন্সার। নেতা মন্ত্রী থেকে লেখকও এখন সঙ্গে বাউন্সার রাখছেন, পাঠকেরা যাতে হামলে না পড়েন।
–ওই দেখ, শংকর!
–শংকর কে?
–আরে তুই চৌরঙ্গী পড়িসনি?
–সৃজিতের সিনেমাটা। কী যেন নাম দিয়েছিল, বল না!
–হোটেল রিজেন্সি।
–ওরে শালা গা… তুই শংকরের লেখা পড়িসনি! সিনেমা দেখেছিস! তাও আবার সৃজিতের!
–তোকে আজই একটা বই কিনে দিচ্ছি নিয়ে গিয়ে পড়।
–আমি যখন বইটা সই করাবো তুই তখন একটা ছবি তুলে দিবি?
–যাবি কী করে তাঁর পাশে! দেখ না দুপাশে দুজন দাঁড়িয়ে।
–এঁরাও কি বাউন্সার নাকি! কিন্তু বাউন্সারদের এরকম ল্যাৎপেতে চেহারা হয় নাকি! ওই দেখ ক্যাশমেমো করছে। শোন ওকে কালু বলে ডাকছে। বাউন্সারদের নাম কালু হয় নাকি!!
–দাদা দেব নাকি?
–দেখি, তারপর বলছি।
দেখার পরে ক্রেতা বলেন দিন। তারপরে বলেন, কোথায় দেব?
কেমন যেন শোনালেও, স্টলে ভিড়ের মাঝে এমনটাই কথোপকথন চলে ক্রেতা আর বিক্রেতার মাঝে।
–হিসেব মিটিয়ে যখন ডেলিভারিতে পৌঁছয়, ডেলিভারি বয় চিৎকার করে বলতে থাকে,
–সমরেশ বসুর কামনাটা পাঠা, (বইয়ের নাম কামনা বাসনা)।
–ওই শংকরের সংসার পাঠা, (সোনার সংসার)
–এক এক সময় এই ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর শব্দের মধ্যে বিচিত্র আবহ তৈরি হয়। সংসার থেকে স্নানঘর হয়ে কখন যেন বিয়ের মণ্ডপে পৌঁছে যায় টুকরো টুকরো শব্দের মধ্যে দিয়ে।
দুপুর বারোটা থেকে রাত্রি ন’টা পর্যন্ত যত মানুষ বইমেলায় আসেন তার সত্তর শতাংশ মানুষ ছবি তোলেন। একটা দুটো নয়। পাশে কম করে একটা শূন্য তো বটেই। এই বছর বইমেলায় কুড়ি লক্ষ মানুষ এসেছেন। ধরে নিচ্ছি তার অর্ধেক মানুষ ছবি তুলেছেন, এবং তিনি কম করেও ২০ থেকে ৩০ টি ছবি তুলেছেন। এত কোটি ছবি কোথায় গেল!
আমাদের স্টলের পাশে শংকরের নতুন বই “সত্যজিৎ শতাব্দী”র বড় করে ছবি দেওয়া। এক তরুণীকে দেখেছিলাম ওই বইয়ে সত্যজিতের ছবিতে সত্যজিতের গালে গাল রেখে ছবি তুলতে। দেখে মনে হয়েছিল মরেও শান্তি, ছবিতেও স্পর্শসুখ।
–লেখকের ফোন, অপু আজ তো রবিবার হয়ে গেল। আমার বই আজও আসবে না?
–আজ নিয়ে যাবো।
–বাইন্ডার্স থেকে বই আসবে। রবিবারের ভূরিভোজ করে উঠোনে পায়চারি। বই এলেই বইমেলা ছুট।
–উঠোন আর বাইরে হতে হতে হঠাৎ দেখি সুসজ্জিত নারীপুরুষ সঙ্গে আরও কয়েকজন, দেখে প্রথমে মনে হয়েছিল সিনেমার শুটিং হবে বুঝি। ক্যামেরাম্যান, ছাতা ধরার ছেলে আরও জনা দুই।
পাশ থেকে আমার অবিবাহিত ভাই বলে উঠলো প্রিওয়েডিং শুট হচ্ছে।
এই ব্যাপারে আমার জ্ঞান নেই। আমার দৌড় আশীর্বাদ পর্যন্ত। বিয়ের আগে এটাই হয় বলে জানি। প্রিওয়েডিং ব্যাপারটা আমার জানা ছিল না। আমার এক বন্ধুর আশীর্বাদে চার বন্ধু মিলে গোটা ষাটেক চিংড়ি খেয়েছিলাম মনে আছে। কিন্তু এই জনা ছয় তরুণ তরুণী সুসজ্জিত হয়ে রবিবারের ভর দুপুরে বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিট ঘুরে বেড়াচ্ছে। মাঝে মাঝেই বন্ধ দোকানের সামনে, কফি হাউসের পাশের গলি মানে শ্যামাচারণ দে স্ট্রিটে প্রেমিকের কোলে প্রেমের ভার আর সামনে ক্যামেরার খচাত খচ।
বাঁধাইখানা থেকে বই এসে গেল। আমি মশগুল প্রিওয়েডিং শুটে। এমন দৃশ্য আগে কখনো দেখিনি। সুসজ্জিত প্রেমিকা রিকশাচালককে সরিয়ে দিয়ে হাতে তুলে নেয় রিকশার হাতল, আর সওয়ারির আসনে বসে প্রেমিক। আমার মনে হলো আহা এমন কেন হলো না। বাইন্ডার্স থেকে আসা বই গাড়ির পেছনে না দিয়ে যদি রিকশায় তুলে আমিও চড়তে পারতাম।
ঘড়িতে ন’টা বাজতে তখনও কিছুটা সময় বাকি। সাংবাদিকের প্রশ্ন এক সুন্দরী তরুণীকে।
–আজ তো বইমেলা শেষ। কেমন লাগছে?
–তরুণীর ঝটপট উত্তর। খুব ভাল লেগেছে।
বিগ বেনের ঘন্টা বেজে ওঠে মাইকে…
লিখেছে শুভঙ্কর দে,ছবি দিয়েছেন অপুর।ব্যাপার স্যাপার বোঝা দায়!তবে লেখাটি জম্পেস!শীত চলে গেলেও জমে গেছে।
তবে আমার দুঃখ,অনেক দিন হয়ে গেলেও ‘অপু দে’ বলতে পারলাম না।সেই দাও- তেই রয়ে গেলাম।
সুন্দর সুপ্রভাত, অপু-বৌমা। কন্যার জন্যে স্নেহাশীষ।
______
* সকালের নাস্তা -পানি পাইনি এখনো। তাই নিয়ে দুঃখ নেই বিশেষ। তোর লেখাটি প্রথমে পেট পরে পূর্ণ করল মন।
* তুই গ্রন্থ, নির্মাণ, বিপণন জগৎ নিয়ে ভালো লিখে চলেছিস, ভবিষ্যতে আরো ভালো লিখবি—এ আমার কাছে নতুন কিছু না। তাই তোর সব লেখা পড়তে পড়তে খুঁজি, নতুন কী এলো অপুর হাত থেকে। এবারের লেখায়, নতুন নতুন শব্দাবলী— যা আমার বিশেষ আগ্রহের।
* গ্রন্থজগতে ব্যবহৃত বিশেষ শব্দাবলী উপহার পেয়ে, পালটি শব্দ উপহার দু-চার “বাণী” তোর করতলে দিই, এই সাড়ে সাত সকালে।
______
* সময়কাল : সাঁঝ-পিদীম বেলা। সংবাদপত্রের গমগমে নিউজ রুম। খিস্তি-খেউড়ের বন্যা চলে। পূতি গন্ধময়। তখন ওখানে কে কার বাপ-ভাই-বোন!
______
* সিনিযার সাব, আপন ভাই , জুনিয়র সাব এডিটরকে বলছে, ” শালা, রেপটা কতক্ষণে করবি? ভালো করে কর। হাত খুলে কর। আজকে ওটাই সেকেন্ড লিড়।” ( মানে, গণ ধর্ষণের অতি গুরুত্বপূর্ণ খবর এসেছে।)
______
* এক্সিকিউটিভ এডিটর ( ডিফ্যাকটো এডিটর) বলছেন নাইট শিফটের দায়িত্বে থাকা মহিলা ইনচার্জ কে, ” আরে বাঁ… এটা পারছিস না! দু’টো লেগের মাঝে ছ’ইন্চি গুটিয়ে দে। বক্স আইটেম কর, বোল্ড টাটপ নে। লেট নাইটে দু’টো লেগ সরিয়ে, পুরো ঢুকিয়ে নিস।”
[ ডেইলি পেপারের এক একটা কলম= একটা লেগ। প্রথম পাতায় সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ খবর ফার্স্ট লিড, এরপর সেকেন্ড লিড …
* মাঝরাতে হঠাৎ ঘটা নাশন্যাল নিউজ। তাই দুটি কলমের মাঝে নমো নমো করে পাঠকপুজো। লেট নাইট, শেষ শহর সংস্করণে, (**, *** প্রভৃতি চিহ্ন থাকে) নতুন পাতা তৈরি করতে হয়। তখন বিস্তৃত সমাচার।
* মনে রাখা দরকার, সময় কারোর পৈতৃক গোয়ালের বাঁধা গোরু নয়। কাগজ দেরি হলে মেচেদা লোকাল, লালগোলা, তারকেশ্বর লোকাল, দমদম এয়ারপোর্টে যম ছাড়া কেউ থাকবে না। পরদিন মিটিং-এ বাপান্তি চলবে। পাঠক পরিষেবা তেত্রিশ কোটি দেবতার অধিক, জানিবেন মহানগর, মহাশয়।
______
* আমি শতাব্দী প্রাচীন একটি বাংলা দৈনিকের ছাপুড়ে, ছাপাখানার পেত্নীর দোজবর। প্রসেস বিভাগের প্রাক্তনী। নিউজরুমে এডিটোরিয়ালের তৈরি পাতা আনতে গিয়ে এই সব অমৃত বচনের কিয়দংশ নিজের দু’কানে এবং অবরে-সবরে পাঁচকান থেকে শোনা।
দারুণ অপু!
যথারীতি ফাটাফাটি
শুভঙ্কর বাবু নিয়মিত লিখুন। সামান্য পাঠক হিসেবে এই কামনা বাসনা।
অসাধারণ লেখা! ❤️
মুগ্ধ হয়ে পড়লাম!
ভালো। প্রতিবেদন? পর্যবেক্ষণ?
পড়ে বেশ আনন্দ পেলাম। প্রকাশকের সরস দৃষ্টিকোণ।
ভালো লাগলো অপুদা।
তোর গ্রামের ভাষাটা আমার কাছে আরও কাজের হত। পবিত্র জেঠু।
খুব ভাল লাগল। অনবদ্য