বুকের মাঝে বিশ্বনিখিল

বুকের মাঝে বিশ্বনিখিল

মৌমিতা ঘোষ

রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, মেয়েরা হল “সীমাস্বর্গের ইন্দ্রাণী”(লিপিকা)।তারা শত বঞ্চনা ভোলেন বাসনকোসন,টেবিল ল্যাম্প,টানটান করা বিছানার চাদর, সোফার কভার , এমনকি ঘরের ন্যাতাটিতেও।প্রবল দুঃখে কড়াইয়ের গরম তেলে ছাড়া পাঁচ ফোড়নের সুবাসে তার ঘামের বিন্দুটি হীরের নাকছাবির মতো ঝলমলিয়ে ওঠে,সে দীর্ঘ একটা শ্বাস টেনে নেয়,জীবনের আঘ্রাণ।বেড়াতে গিয়ে সে ঘুরে ঘুরে ননদের মেয়ের জন্য চুলের ক্লিপ কেনে,মামী শাশুড়ির জন্য ঝিনুক বসানো সিঁদুর কৌটো।সে যেখানে যায় সংসারটিকে মাথায় নিয়ে যায়।সে ঢেউয়ের উপর মুক্তোবিন্দুটিতে দেখে সন্ততির ভাবী স্বপ্নটিকে। সে প্রতিদিন ভোরের সূর্যের প্রথম রশ্মিটি নিয়ে চুমো আঁকে সন্তানের কপালে, দুহাত দিয়ে আগলে রাখে সন্ধ্যার দীপশিখাটি। সংসারের মঙ্গল কামনায় সে বছরে বারোটা উপোস করে। সে ভাবে আমি না করলে কে আর ধরবে এই সংসারের হাল? সে কোথাও বেড়াতে গেলে সাতদিন আগে থেকে ফ্রিজে জমাতে থাকে খাবার, সবার যাতে খাবারের জোগান থাকে, শাশুড়ির ইনজেকশন দেওয়ার লোক থেকে, শ্বশুরের ড্রেসিং পাল্টে দেওয়ার লোক সব ঠিক করে রেখে ,তবে সে তিনদিনের জন্য বোনঝির বিয়েতে যায়। গাছগুলো তে জল দেওয়ার কথা পই পই করে বলে যায় ছেলেকে।বোনের বাড়ি গিয়ে হতাশা লুকিয়ে সে বলে,কর্তার আমার খুব কাজের চাপ,বস ছাড়েই না,বলে,”মিস্টার মিত্র আপনাকে ছাড়া অফিস অচল”; ছেলের আমার দুদিন পরেই assessment, আমিই বারণ করলাম। “
শত মিনতি অগ্রাহ্য করে সে তিন দিনের দিন ই ফিরে আসে,তার বাড়িতে সে যে অপরিহার্য! এমনটা সে যতদিন ঘানি টানে,সে ভালোবেসে বিশ্বাস করে।যখন সে চলে যায় হুট করে, নিজের নিয়মে চলতে থাকে সংসার। আমার এক বান্ধবী বন্ধুদের কোন গেট টুগেদারে আসতো না, ও না থাকলে শ্বশুরমশাই কে ওষুধ দেবে কে, শাশুড়িকে কে দেবে ইনসুলিন? ছেলের হোম ওয়ার্ক কে করাবে? বরের ট্যুরে যাওয়ার স্যুটকেস কে গুছিয়ে দেবে? কোভিডে দু দিনে সে চলে গেলো। তার স্বামীর সঙ্গে গড়িয়াহাটে দেখা। ক্লাব থেকে ফিরছেন, আজকাল টেনিস ও খেলছেন জানালেন। “বাড়িতে তো খুব অসুবিধা হচ্ছে” জিজ্ঞেস করতেই বললেন,” না, মা-বাবার জন্য চব্বিশ ঘন্টার আয়া রেখে দিয়েছি, এছাড়া দুটো কাজের লোক,আর ছেলে তো টিউটরের কাছে পড়ছেই, সামলে নিয়েছি , আফটার অল, আমার তো থামলে চলবে না,বলুন?” আমি বললাম, ” অবশ্যই।” সারাজীবন নিজেকে অপরিহার্য ভাবা আমার বান্ধবীর অভাব কেউ বুঝতেই পারছেনা বাড়িতে! আর সে তার সারাটা জীবন সখ আহ্লাদ sacrifice করলো। এভাবেই মেয়েরা ঘরে থেকে ছড়িয়ে পড়ে না, নিজেকে সীমাবদ্ধ রেখে ,ভাবে ওই সংসারটার সে নিয়ন্ত্রক। আর পুতুলের মতো নড়ে চড়ে তার জীবন একটাই ছন্দে চলে যায়। সে আসলে মাল্টি ট্যালেন্টেড ,মাল্টি টাস্কার ও। সে ফ্রিজের ভেজিটেবল ট্রে তে পড়ে থাকা উদ্বৃত্ত সবজি দিয়ে বানিয়ে ফেলে চমৎকার পাঁচ মেশালি তরকারি বা এন্ড ইউজার যদি জেন ওয়াই হয়,তবে ওগুলো ই সেদ্ধ করে চটকে ব্রেড ক্রাম্ব দিয়ে বানিয়ে ফেলতে পারেন কাটলেট বা গোল্ডেন কয়েন। কাস্টমার সার্ভিস ও কাস্টমার রিকোয়ারমেন্টে বোঝার জন্য তাকে ম্যানেজমেন্ট পড়তে হয়নি।সে শাশুড়ি সমাবেশে দিব্যি প্রণাম করে বলে, আপনি এলেন ,কী ভাগ্য আমার! মেয়ের বন্ধুদের সামনে গেয়ে দেয় নাথিং গান আ চেঞ্জ মাই লাভ ফর ইউ। নিজের বন্ধুদের সঙ্গে দিব্য তুলে ফেলে পাউট করা সেলফি।স্বামীর বস এলে চমৎকার সেজে, সাজিয়ে ফেলেন টেবিল নানা স্যালাডে। তার ঘরটুকু কি কম বড় পৃথিবী? তাকে পাল্লা দিয়ে শিখতে হয় টেকনোলজি।ছেলে মেয়েকে পড়াতে হবে তো। কখনো সে abacus শিখে ফেলে,কখনো দাদরা তাল। সে ইদানিং বিটিএস ও শুনে নিচ্ছে। এখন ঘর আর বাইরের অবিশ্যি তফাৎ বড় একটা নেই। ঘরে বসে সে ইউটিউব দেখে শিখে ফেলছে বেকিং, বানিয়ে ফেলছে চমৎকার সব কেক, অর্ডার আসছে ইন্স্টাগ্রামে।সে অনলাইন শাড়ি,গয়না, মশলা, মেক ওভার…সব শিখেও নিচ্ছে,বিক্রিও করে ফেলছে।সে জেনে ফেলছে কী করে মিউজিক মিশিয়ে নানা ছবির কোলাজ করে বিজ্ঞাপন করতে হবে তার প্রোডাক্টের।‌তার ছেলে মেয়েরা তাকে সাহায্য করছে। এখন আর একেবারে ঘর বা বাহিরের আগল গেছে ঘুচে।এক দিক থেকে ভালোই হয়েছে। বাড়িতে থেকেও সে একঝলক বহির্বিশ্বকে দেখতে পাচ্ছে।তার থেকে রসদ সংগ্রহ করছে। সে তার ছোট আশিয়ানার আশনাইগুলো নিজেই জোগাড় করে নিচ্ছে। যে মেয়ে কখনো বেরোয় নি, সর্বদা তার আত্মবিশ্বাসের গাছটির গোড়ায় নুন ঢেলে দেওয়া হয়েছে,সেও আজকাল চেষ্টা করে স্বোপার্জিত অন্নের।সেও চেষ্টা করে তার মেক আপ থেকে মশলা নিজে কিনে নিতে। ঘরে ঘরে এখন মহিলারা বেশি রোজগার করেন,তাদের পয়সায় সংসার চলে। তাতে পুরুষ সিংহটির চিরকালীন ইগো আহত হলেও,টাকার সামনে বহু কথা থেমে যায় বৈকি! আগে বয়ফ্রেন্ড রা গার্লফ্রেন্ড কে খাওয়াতো, বেড়াতে নিয়ে যেতো। এখন বান্ধবীরা ট্রিপ প্ল্যান করে বলে ,”বুক করে দিচ্ছি হোটেল,তুই যাবি কিনা বল? “
মেয়েরা এখন আর প্রেমিকের, বরের অপেক্ষা করেনা শখ পূরণের জন্য। সে হীরের আংটির জন্য বয়ফ্রেন্ড ঘাড়ে করে বয়ে বেড়ায় না।‌সে শেয়ারিং চায়, সে ইক্যুয়াল মত বিনিময়ের একটা প্ল্যাটফর্ম চায়। আর সেটা যত ই প্রকাশিত হচ্ছে, ছেলেরা দুকদম এগিয়ে এসে গ্রহণ করতে পারছে না। তারা ” এটাই ঔদ্ধত্য” ভাবছে। আর তা নিয়ে চড়চাপাটি থেকে অ্যাসিড ছোঁড়া, সাইবার বুলিং থেকে রেপ, সবই চলছে। ধর্ষণের মূল কারণ যে যৌনতা নয় ,তা আমরা জানি। ধর্ষণের মূল কারণ আয়ত্তে আনার চেষ্টা, অপমান করা, অসহায় দেখতে পাওয়ার স্যাডিস্ট উল্লাস। আর এখানে ই পুরুষেরা পিছিয়ে পড়ছেন ক্রমাগত। নতুন ভাবনাকে যত ভালোবেসে তারা বুকে না টানবেন,তত তারা পিছিয়ে থাকবেন। এই একবিংশ শতাব্দীতে হাজার হাজার,কোটি কোটি মেয়ে তাদের এতদিনের শিক্ষা,তাদের দক্ষতা, তাদের ভাবনা নিয়ে এক নতুন পৃথিবী গড়তে দাঁড়িয়ে আছেন।তাতে মহাকাশচারী থেকে পরিচারিকা,গবেষক থেকে ক্লের গয়না তৈরি করা শিল্পী সকলে আছেন। এরা সকলেই ড্রীমার। তারা একটি ভিন্ন আইডেন্টিটিতে নিজেদের দেখতে চাইছেন, দেখতে পাচ্ছেন। তারা অমুকের বৌ হিসেবে পরিচয়েও খুশি , আবার নিজের পরিচয়টা নিজের কাজে উজ্জ্বল করে ধরাতে তার হাসিমুখটিতে টোল পড়ে বৈকি। বাইরের কাজে তাকে কেউ আটকাতে পারছেনা। সংসার তাকে অসাধারণ টাইম ম্যানেজমেন্ট শিখিয়েছে।তাকে শিখিয়েছে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে মাথা ঠান্ডা রাখা।শিখিয়েছে ধৈর্য্য, যে কোন সময় রি অ্যাক্ট না করতে। এইসবকিছুই তাকে এগিয়ে দিচ্ছে চাকরিতে,ব্যবসায়। এইসব কিছুই তাকে প্রতিদিন ডিল ক্লোজ করতে সাহায্য করে। তার বেড়ে ওঠায় ইগোর পাহাড় নেই। তাকে ছোট থেকে শেখানো হয়েছে adjust করে নাও।শেখানো হয়েছে সব বিষয়ে কথা বলা উচিৎ নয়, শেখানো হয়েছে জল উঁচু থাকলে তুমি ও উঁচু,নীচু থাকলে তুমি ও নিচু করে রাখবে মাথা, মানে পরিস্থিতি বুঝে প্রতিবাদ করো বা চুপ করে থাকো। তাকে ‘না ‘ শুনতে শেখানো হয়েছে। তাই সে সর্বত্র টিকে যায়, শিখে নেয়,তারপর এগিয়ে যায়। পুরুষ” চরিত্রের দোষ” বলেও আর তাকে আটকাতে পারছেনা,সে ন্যাশনাল হেড হয়ে যাচ্ছে হয়তো। “মেয়েদের আন্ডারে কাজ করবো? “; এই উন্নাসিকতা পুরুষকে আরো খারাপ এমপ্লয়ি করে তোলে কখনো, তাতে নারীটির উন্নতি আটকায় না আর, সুপ্রীম কোর্টের হস্তক্ষেপে হলেও আর্মির পুরুষতান্ত্রিক ভাবনার উপরে যোগ্য মহিলা অফিসারের স্থান হয়। কোর্টকে হস্তক্ষেপ করে যখন একজন মহিলার যোগ্যতাকে প্রতিষ্ঠিত করতে হয়, তাতে তার জয় আরো বাড়ে,আর চারদিকের হাহারব তোলা লোকেদের আরো ক্লীব মনে হয়। বহুদিন সন্তানের দোহাই দিয়ে,সন্তান কে মনোযোগ দেওয়ার একছত্র দায়িত্ব ঘাড়ে তুলে দিয়ে তাকে আটকানো হয়েছে। মেয়েরা এখন বাচ্চা কে কাউন্সেলিং করে তাকে একজন পরিচারিকা সঙ্গে নিয়ে উড়ে চলে যাচ্ছে সেমিনারে। পরিচারিকা ও বাচ্চার যাওয়ার খরচ সে ইনসেনটিভ থেকে কামিয়ে নিচ্ছে। একটু বড় হলে সে একা চলে যাচ্ছে চিরকালীন অপরাধবোধ ঝেড়ে ফেলে। তার সন্তানের কাছে তার এখন সম্মান বেড়েছে। তার সন্তান তার সাফল্যের দিকে জুলুজুলু চোখে তাকায়। আগে সন্তানেরা বাবার মতো হয়ে চাইতো বড় হয়ে, এখন মায়ের মতো ও হতে চায় অনেকেই।
ঘর আর বাইরের মাঝখানের দেওয়ালটি এখন খুব দুর্বল। ঘরে বসেও entrepreneur হয়ে যাচ্ছে মেয়েরা। শুধুই ঘরের জন্য রান্না করা গৃহবধূ এখন হয়তো ” গিন্নির রান্নাঘর” নাম দিয়ে স্যুইগির সঙ্গে টাই আপে ব্যবসা করেন।
বাড়ি মানে চারটে দেওয়ালে র মধ্যে থাকা কিছু অতৃপ্ত মানুষ নয়, সংসার মানেই একতরফা আত্মত্যাগের মন্দির নয়, মেয়েরা তা অ্যাকসেপ্ট করতে শিখেছে। সে জিতে যাচ্ছে এখানে ই, দায়িত্ব অস্বীকার করে নয়, পিঠের বোঝাটাকে পাহাড় না করে তোলার প্রতিশ্রতিতে।
যারা এখনো পারেননি,তারা ঠিক শিখে যাবেন অচিরেই। জয় খুব কাছেই। ঘর আমাদের, পথ ও আমাদের, শুধু ঔদ্ধত্য না এলেই জয়ের পথ নিশ্চিত হয়, অসৎ না হলে সাফল্য স্থায়ী হয় একথা যেন আমরা না ভুলি।
মৌমিতা ঘোষ
পুকুরঘাট

পুকুরঘাট

একদিন আমরা মাত্র কয়েকজন সদস্য নিয়ে পুকুরঘাট নামের একটি মেয়েদের ভার্চুয়াল দল খুলে ছিলুম। অচিরেই সে কয়েকটি সদস্যের দল কয়েক হাজার সদস্যের মেয়েদের দল হয় ওঠে। পুকুরঘাট দলের মত এত গুণী মেয়েদের সমাহার বাংলাদেশে খুব কম ভার্চুয়াল দলে আছে। কাজেই সেই দল সেখানেই আটকে থাকবে না বলা বাহুল্য। তাই পুকুরঘাট দলের অন্যতম উদ্যোগ হিসেবে প্রকাশিত হলো পুকুরঘাট পত্রিকা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

5 thoughts on “বুকের মাঝে বিশ্বনিখিল

  1. একশো শতাংশ ঠিক বিশ্লেষণ। চমৎকার লেখা। সম্পূর্ণ সহমত। শেষের সতর্কতা সবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।

  2. আমার কথা… আমাদের কথা… অনেক ভালো লাগা আর ভালোবাসা জানাই…

  3. নতুন যুগের মেয়েদের, নতুন চোখ নিয়ে দেখতে শিখতে হবে সবার। 👍❤️