এক পা ঘরে এক পা বাইরে

এক পা ঘরে এক পা বাইরে

সুপ্তশ্রী সোম

শুরু  করবো সেই মেয়েটার গল্প দিয়ে।  আকাশবাণী র ইঞ্জিনিয়ার  সেই  যুবতী। উত্তরবঙ্গে পোস্টেড।  বিয়ে করেছিল তার ই সহপাঠী আরেক ইঞ্জিনিয়ার কে। কিন্তু সে কাজ করে অন্য সংস্থায়।থাকে কলকাতায়। দুজনে তো সংসার পাতলো কিন্তু থাকে দুজন দুজয়গায়।বিয়ের বছর দুয়েকের মাথায় মেয়েটি কনসিভ করলো। ছুটি ছাটায় যায় আসে। যথা সময়ে সে সদ্যোজাত সন্তানের মা হলো। এবং একদিন শেষ হলো তার মাতৃত্বকালীন ছুটির মেয়াদ। বাচ্চার বয়স মোটে চারমাস। মেয়েটির তেমন কেউ নেই যে তার বাচ্চাকে দেখবে টানা। ফলে কাজের লোক ভরসা। যখনকার এ কাহিনী তখন উত্তরবঙ্গের সেই জায়গায় আয়া পাওয়া যেতনা । মেয়েটির কাজের লোক আসে দশটা নাগাদ। ফলে সকলের দিকে মেয়েটিকে দেখতে হয়। মেয়েটির মর্নিং ডিউটি থাকলে এর কাছে ওর কাছে , এমনকি পড়শী দের কাছেও রেখে সে যেত ডিউটি করতে। একদিন সে কোন ব্যবস্থাই করতে পারেনি। এদিকে  ভোর পাঁচটায় উঠে তাকে ট্রান্সমিটার এ তবে শুরু হবে আকাশবাণী র প্রথম অনুষ্ঠান। সেদিন অঝোরে বৃষ্টি হচ্ছে। সদ্য সে কাজে যোগ দিয়েছে। লম্বা ছুটির পর। এমতাবস্থায় তার ছুটি নেই । সে থাকে অফিসের পাশের কোয়ার্টারে। গাড়ির ব্যবস্থা নেই তার। অগত্যা সে রেনকোটের ভিতর বাচ্চাকে পুরে নিয়ে সেই অঝোর বৃষ্টিতে গিয়ে পৌঁছল অফিসে। ঘুমন্ত বাচ্চাকে সোফায় শুইয়ে শুইয়ে সে মরনিং ডিউটি করলো সেদিন। এর পর  থেকে  সব মর্নিং ডিউটি তেই সে নিয়ে যেত বাচ্চা টিকে। দিনের পর দিন। অফিসে বাচ্চা নিয়ে আসা কে কেন্দ্র করে সে সম্মুখীন হয়েছে প্রচুর সমালোচনার। কিন্তু কি করবে সে। এই ভাবে বছর তিনেকের মাথায় সে কলকাতায় বদলি নিতে পারে। মেয়েটির এই লড়াই তাকে কি দিয়েছে। সে পেয়েছে যোগ্যতার মূল্য , আর্থিক নিরাপত্তা , কাজের আনন্দ আর আত্মবিশ্বাস। বদলে সে করেছে অমানুষিক পরিশ্রম ।। লজ্জা ঘেন্না ভয়ের উর্দ্ধে উঠে উড়িয়ে দিয়েছে যত সমালোচনার বন্যা কে। চাকরি ছেড়ে দাও ইত্যাদি উপদেশ। শিক্ষা কে কাজে লাগিয়ে ঘরের বাইরে পা যেমন সে বাড়িয়েছে তেমনি সে হয়েছে সাহসী।  যদিও বাচ্চাকে মানুষ করা নিয়ে তার পাহাড় প্রমান অপরাধ বোধ তাকে কষ্ট দিয়েছে।  মায়ের মমতা তাকে প্রতিনিয়ত তুলাদন্ড তে তুলেছে। বলেছে তুমি পারোনি পারছনা। কিন্তু বদলির কাগজ হাতে নিয়ে সে যখন আবার ফিরে গেছে নিজের সংসারে সে বুঝেছে যে সে পেরেছে। সে একটা লড়াই জিতেছে।
  এই হচ্ছে সত্যি কারের ছবি এই এক পা ঘরে আর এক পা বাইরে রাখার। এক আদ্যন্ত লড়াই।  অনেকটা দু নৌকোয় পা দিয়ে চলার মতোই।  যে কোন মুহূর্তে পপাত হবার ভয়। এক লড়াই । ঘর ও ৰাইরের মধ্যে সমতা বজায় রাখার এক প্রাণান্তকর দুরূহ প্রচেষ্টা। তবে এই লড়াই অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিজের সাথে নিজের। প্রতি মুহূর্তে নিজেকে ভেঙে নেওয়া কিংবা নিজের প্রতিটি সত্তা কে ছাপিয়ে যাওয়ার দুঃসাহস দেখানো । এ যুদ্ধ প্রতিটি কর্মরতা মেয়ে স্বাবলম্বী মেয়ে করে। পেশা ও  ঘরের নেশা ,সংসার করার অদম্য ইচ্ছে কে পোষ মানিয়ে। ভালো লাগে তাদের যুদ্ধে জিততে। এই লড়াইয়ের বাই প্রোডাক্ট হলো কখনো কর্মক্ষেত্রের সাফল্যের আস্বাদ উপভোগ তো কখনো ভালো করে ঘর করতে না পারার দুরন্ত অপরাধবোধ। এই বাই প্রোডাক্ট রা অবশ্যই জায়গা বদল করে। কিন্তু তবু দাঁতে  দাঁত চেপে লড়াই চালিয়ে যায় প্রতিটি কর্মরতা মেয়ে। এক চুম্বক আকর্ষন। যে এর স্বাদ পেয়েছে সেই জানে দু ক্ষেত্রেই সাফল্য কি আনন্দ টাই না দেয়। অসীম আত্মবিশ্বাস , ভালো লাগা নিজেকে ছাপিয়ে যাওয়ার আনন্দ যে বড় উপভোগ্য। নিজেকে ভেঙে ভেঙে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করা এক আশ্চর্য উত্তরণ। কন্যা জায়া জননী। তিন তিনটে রূপে নিজেকে খাপে খাপে সাজিয়ে নেওয়ার পরে বাইরে কাজের জগতে এক অনির্বচনীয় কর্মী সত্তার উন্মোচন। যে মেয়ে ব্যবসা করে বা পেশাদার কোন কাজের সাথে যুক্ত সে হয়তো একটু সময় টাকে নিজের হাতে রাখতে পারে তবে টানাপোড়েন আছে সবেতেই। ঘরের বাইরে পা বাড়াবার সঙ্গে সঙ্গে সেই ব্যালেন্সের খেলা। সার্কাসের মেয়েদের মত এই মেয়েরাও ঠিক পারে লড়াকু হয়ে অবস্থাটা সামলে নিতে।
আমার জীবনের এক লম্বা সময় কেটেছে ফুলটাইম অফিস করে। কেন্দ্রীয় সরকারি চাকরি করতে করতে আমার দুটো বাচ্চা মানুষ করতে হয়েছে। বাড়িতে কেউ নেই যে দেখে বাচ্চা কে। অফিস স্পেসে ক্রেস থাকতে হবে এসব কেতাবি আইন আছে প্রতিটি অফিসের জন্য। কিন্তু আমার অফিসে ছিলোনা। ফলে মেটার্নীতি ছুটির পরে অফিসে জয়েন করে কি লড়াই টা না করতে হয়েছে। প্রথম আপোষ করলাম কাজের সাথে। মেটার্নীটি  লিভের পর অফিসে গিয়ে দেখি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা থেকে বদলি করে দেওয়া হল অতি জঘন্য যায়গায় । । সেখানে বাজেকাজ।। কারণ জানতে চাইলে আমাকে বলা হলো তুমি তো এখন খালি ছুটি নেবে। মেনে নিলাম এবং চ্যালেঞ্জ নিলাম। পরে সেখানের ওই বাজে কাজের মধ্যেও ছন্দ আনলাম। পরে যখন আবার ভালো জায়গায় গেলাম তখন দেখলাম ওই বাজে কাজের জায়গার অভিজ্ঞতা আমাকে কিছু শিখিয়েছে। অন্য রাও আমাকে চিনেছেন যে আমি লড়াকু। নাকে না কেঁদে নিজের পায়ের তলার মাটি নিজেই শক্ত করতে পারি। এই জেতা হারার অনুভূতি, নিজেকে কাটা ছেঁড়া করে প্রতি মুহূর্তে তৈরি করা ঘরের বাইরে পা না রাখলে হয় না।
একটি মেয়ে যতদিন অবিবাহিত ততদিন সে এক পা বাইরে রেখে বাইরের আনন্দ এবং বাইরের লড়াই তাই লড়ে। যেই মুহূর্তে সে ঘরনি হলো যুক্ত হলো ঘরের দায়িত্ব । প্রতিটি রূপ সময় দাবি করে। আমি আমার দীর্ঘ কর্ম জীবনে দেখেছি অফিসে এসেও মেয়েদের গৃহস্থালী কি পরিমাণ টানে । কি খুঁটিনাটি তার নজরে পড়ে। ঘর থাকবে সুন্দর সাজানো। দেখে মনে হবে সে ঘরের জন্যই বেঁচে আছে। এক নিপুণ গৃহবধূর প্রতিটি দায়িত্ব পালন করার দিকে তার প্রচন্ড উৎসাহ। এবার তাকে বলো যে তুমি কাজ ছেড়ে দাও। ঘাড়ের রোম ফুলিয়ে ঝগরুটে বেড়ালের মত সে বলবে কেন? কক্ষনো নয়। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা র স্বাদ বড়ই মধুর। দুই ভূমিকায় তাঁতের মাকুর মত যাওয়া আসা করতে করতে সে ততদিনে দিব্যি সাবলীল। এই লড়াই করতে চাই সৈনিকের সম্মান। বাড়ির লোকের পরিপূর্ণ সহযোগিতা।
ঘরে ও বাইরে একই সাথে পা রাখলে সব চেয়ে যন্ত্রণা এবং ভালোলাগা একই সাথে জাঁতা কলে পিস্ট করে কখন ? উত্তর জানা । যেই না কোলজুড়ে এলেন তিনি। সেই নরম ছানাটি। মাতৃত্ব কালীন ছুটি শেষে হবার আগে আগে শুরু হয় বুকদূরদুর করা। পারবে তো থাকতে ওই ছোট্ট নরম আমার ছানা টা বিকল্প ব্যবস্থায় মানিয়ে নিতে। বুকের ওমে মায়ের বুকের ঢিবঢিবআওয়াজ শুনতে শুনতে যে চুকচুক করে দুধ খায় আর ঘুমিয়ে পড়ে । পারবে আয়ার কাছে বোতলে দুধ খেতে ? কাঁদবে না তো? আয়া পারবে তো দেখতে ? কিংবা মা বা শাশুড়ি।শুরু হয়ে যায় বেরোবার আগে যত টা বেশি বাচ্চার  কাজ করে যাওয়া যায় তার প্রতিযোগিতা। অবশ্যই মাতৃসত্তা আর আমার নিজের সাথে। চুলে চিরুনি পড়লো কি পড়লোনা , সাজ হলো কি না দূর হয়ে যাক বেরোবার আগে বাচ্চাকে শেষ ফিড দিয়ে নিই।কিংবা ব্রেস্টপাম্প দিয়ে বুকের দুধ ধরে রাখা।  সব চেয়ে কষ্ট হয় বেরোবার সময় বাচ্চা কাঁদলে। সে যে শুধু মা কে চায়। কত দিন লুকিয়ে বেরিয়ে যেতে হয় চোখের জল চেপে। শেষ মুহূর্তে বাজে ড্রেস পরে অফিসে যেতে হয়। সেখানে পা দিয়ে নিজে তুমি কর্মী। তখন আর বাহানা নয়। সেও তো নিজেকে ফাঁকি দেওয়া হবে। তাই সেখানে নিজেকে প্রমান করার গুরু দায়িত্ব ও একই সাথে তোমার কাজ যার জন্য মাস গেলে তোমার পকেট ভরে সে দিক টাও দেখতে হয়। অফিস ছেড়ে দেয় না। সেই সময়ের জন্য তুমি তোমার অফিসের।  এরই মাঝে  খোঁজ নেওয়া। ফোন করা। এক অদ্ভুত শৃঙ্খলা বদ্ধ ভাবে তুমি একবার ঘরের দিকে দেখছো একবার বাইরে। কত অসংখ্য মুহূর্ত। না পারার দুঃখ, ত্যাগ আর অপরাধ বোধ  প্রতিটা  মুহূর্তে জ্বালিয়ে মারে। কর্মক্ষেত্রের আনন্দ তো ত্যাগ করা যায়না। একবার এক ক্লায়েন্টের বহু পুরোনো ক্লেম আমি খেটে খুটে সেটল করে দেবার পর এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক আমাকে বলেছিলেন , “গড ব্লেস ইউ”.। কি যে ছিল তাঁর গলায়। এখনো তাঁর সেই কন্ঠ আমি নিজের দুর্বল মুহূর্তে স্মরণ করি। সে রকম অনেক পেয়েছি। কত অন্য রাজ্য থেকে হেড কোয়ার্টার এ এলে লোকে নিজে থেকে এসে দেখা করে গেছেন। সে সব আনন্দ আমার সন্তানের এপ্লাস পাওয়া রিপোর্ট কার্ডের থেকে কম আকর্ষণীয় নয়।  এই যে অফিস কেটে একদিন সুন্দর বাচ্চার শপিং করলে, বাইরে খেলে কিম্বা বিউটি পার্লারে গিয়ে চুরি করে কেড়ে নিলে একটি ঘন্টার সময়। সেই অর্থনৈতিক স্বাধীনতা কে দেবে তোমায়।কারুর কাছে হাত পাততে হলোনা। যতই সম্মানের সাথে দেওয়া হোক না কেন নিজের রোজগারের টাকা নিজের টাকাই।  নিজের রোজগারের টাকা থেকে প্রিয়জনের দামি শার্ট যে কিনলে। গাড়ি বাড়ি কিনতে গেলে প্রভিডেন্ড ফান্ড থেকে টাকা দিলে সেই পরিপূর্ণতার আশ্বাস তোমাকে কে দেবে ? তোমার রুজি ছাড়া।বাবা মার শখ পূরণ বা চিকিৎসা সবই করা যায় নিজের পয়সায়। সে আনন্দ আলাদা।  নিজের চেয়ারে বসে যখন টিম লিডার হয়ে বড় টার্গেট মিট করলে। প্রমোশন হলো। আবার নতুন দায়িত্ব নেওয়ার দিন ই দেখা গেলো ছেলের হাত ভেঙেছে অথচ তুমি পৌঁছলে সবার পরে। রাতে বাড়ি ফিরে দেখলে সেই দুর্ভাবনার মুহূর্ত কেটে গেছে। চিকিৎসা সম্পূর্ণ ।ছেলে  একহাত দিয়ে দিব্যি বল খেলছে কিন্তু বুকের মধ্যে একটু যন্ত্রণা হুল ঠিক ফোটাচ্ছে। তুমি ছিলেনা।  শিখতে হয়।  ওই যন্ত্রণা কে নিয়েই চলতে শিখতে হয়। বাচ্চারা বোঝে। বড় হলে জলের মতোই বোঝে। মা কেন স্কুলের  পিটিএম যেতে পারতোনা সে অফিস যেত বলেই। তাদের সেই কষ্ট টা বাচ্চাটি ভুলে তো যায় ই। দিব্যি বলে ঠিক ই তো করেছ মা ।
আমার দীর্ঘ দিন কাজ করার অভিজ্ঞতা বলে যে এই যে জাগলিং এর খেলা এ কিন্তু দিব্যি ঘষে মেজে তৈরি করে দেয় । এক আনাড়ি নারী কে চটপটে নারী তে বদলে দিতে পারে সহজেই। খুব জোর প্ল্যানিং , প্রেসেন্স অব মাইন্ড তৈরি হয়ে যায়। সময় কে নিজের হাতে নিয়ে তার সওয়ার হতে কখন যে তুমি শিখে নেবে বুঝতেই পারবেনা। বাচ্চারা স্বাবলম্বী হয় তাড়াতাড়ি। আমার দুই মেয়েরই ক্লাশ টু থেকেই সবার শেষে বাড়ি থেকে বেরোতো বলে দরজায় চাবি লাগিয়ে একলা স্কুলবাসে চড়তে হতো। মোটে সাত বছর বয়স। দিন রাতের সহকারিণী নেই। পেতাম না। খুব তাড়াতাড়ি দায়িত্ব দিয়েছিলাম। গুরু দায়িত্ব। একদিন ও চাবি হারায়নি। একটু বড় হলে স্কুল ফি ওদের হাতে দিয়ে দিতাম। ঠিক ঠাক দিয়েছে। যতদিন স্কুলে টাকা জমা হতো। একলা ছেড়ে দিয়েছি। স্কুলের এন্যুয়াল প্রোগ্রামে রিহার্সালে কেউ দিয়ে আসার লোক নেই বলে মেয়েকেই জিজ্ঞাসা করেছি  আসতে পারবো কিন্তু নিতে তো পারবো না। মাত্র এগারো বছর বয়স তার। ভালো নাচতো। সুযোগ পেয়েছে। শুধু আমি বাড়ি থাকিনা বলে যাবেনা। ছেড়ে দিয়েছি । নিজে ই বাসে চেপে ফিরেছে।তবে অফিসে বসে আমি কিছুতেই মন বসাতে পারিনি। কি ভয় করেছে। হাজার আশঙ্কা কুরে কুরে খেয়েছে। কিন্তু সে পেরেছে। অল্প বয়সে ই হাতে টাকা দিয়েছি। মোবাইল আসার পর তাও। শুধু ভালো করে বুঝিয়ে দিতাম ভালো মন্দ গুলো। ফলে একটু আধটু ভুল করলেও শিখে নিতে দেখেছি ওদের। দায়িত্ব নিতে শেখা।
স্বামীর মৃত্যুর পর সহানুভূতি র চাকরি পাওয়া মেয়েদের দেখে অবাক হয়েছি। কি শক্তি হয় তাদের। ওই চাকরি করে তার স্বামী হয়তো পিপে পিপে মদ গিলে মারা গেছে অকালে। সে কিন্তু সেই একই চাকরি করে ছেলেমেয়েদের মানুষ করেছে, বাড়ি বানিয়েছে। মেয়ের বিয়ে দিয়েছে। ঘরের বাইরে সে বাধ্য হয়ে বেরিয়েছিল কিন্তু নিজেকে পরিপূর্ণ বিকশিত করতে সে হাল ছাড়েনি। ঘর তার সুন্দর হয়েছে আরও কিন্তু বাইরে টাকে অন্তরে প্রতিষ্ঠা করে সে আত্মবিশ্বাসের ডানা পেয়েছে ।
এ নিয়ে লিখতে গেলে মহাভারত হয়ে যাবে।  আমরা মেয়েরা দিব্যি পারি এই এক পা ঘরে আর এক পা বাইরে রেখে চলতে। ঘর কে ভালোবাসতে গেলে বাইরে কেও যে ভালো বাসতে হয়। অফিসে গিয়ে নিজের কিউবিকলে বসে আমি একদম আলাদা হয়ে যেতাম। বাড়ির জানলা তখন বন্ধ করে বাইরের দরজা খুলে দিয়েছি সযত্নে। আমার চেয়ার আর আমি একাকার হয়ে যেতাম। তবে  বাচ্চার কচি বয়সে খুব কষ্ট দেয় অপরাধবোধ। দুগ্ধ পোষ্য শিশু সে যে বোঝেনা কিন্তু আমার অভিজ্ঞতা বলে বুঝতে শিখে যায়। সময় মনে রাখে ওরা। মায়ের ফেরার সময়। দেরি হলে ছটফট করে। এই কিছুদিন বড় কষ্ট হয়। কিন্তু ঠিক হয়ে যায় পরে। ওর সাথে কোয়ালিটি সময় কাটাতে হবে। বোঝাতে হবে তোমার ভালোবাসা। আর একটু বড় হলে একটু একটু করে ওকে দায়িত্ব নিতে শেখানো। আমরা মায়েরা তো চিরদিন থাকবোনা। দুনিয়া ওদের ছেড়ে দেবেনা । সব কিছু উসুল করে নেয় এই প্রতিযোগিতার পৃথিবী। একটু একটু করে না শেখালে ও পারবে কি করে। ছোট বয়স থেকেই বাচ্চাদের নিজের নিজের বয়স অনুযায়ী দায়িত্ব নিতে শেখানো টা খুব জরুরি।
বাইরে পা রাখা মেয়েরা কিন্তু বাচ্চা মানুষ করা ছাড়া প্রচুর দায়িত্ব নেয়। নেয় মা বাবার দায়িত্ব। শ্বশুর শাশুড়ির মেডিকেল ইন্সুরেন্স করানো থেকে শুরু করে অপেরাশন করানো অব্দি আমি করতে দেখেছি অনেক কেই। বর অন্য রাজ্যে থাকে কর্মসূত্রে ননদের বিয়ের সর্ব খুঁটিনাটি করে দিতে দেখেছি কর্মরতা বৌদি কে।  এরকম ভুরি ভুরি উদাহরণ আছে। তবে ব্যতিক্রম যে একে বারে নেই তা নয়। আছে অনেক সময় এক্সপ্লয়টেড ও হতে হয় । কিন্তু ব্যতিক্রম ব্যতিক্রম ই। সব চেয়ে বড় অন্যায়ের প্রতিবাদ করার সাহস ও মানিয়ে নিতে না পারলে বেরিয়ে যাওয়ার সাহস দেখবার জোর তো কাজ ই দেয়।
এক পা ঘরে রেখে অন্য পা বাইরে রেখে এই যে দড়ির উপর হাঁটার খেলা এ  মেয়েদের  চালিয়ে যাওয়াই উচিত। নিজেকে টান টান ধনুকের ছিলার মত রেখে দিব্যি অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ভোগ করতে এর বিকল্প  তো হয়না।  মাল্টি টাস্কিং করতে করতে নিজের বুদ্ধির ঝকঝকে ধার টা অনুভব করতে শেখা কিন্তু বাইরে পা রাখলেই পাওয়া যায়।  নিজেকে সাবাস কেউ বলুক বা না বলুক দিনের শেষে নিজের পিঠে বেশ কয়েকটা সাবাস চাপড়  যেন সে নিজেই  দিতে পারে। ছেলে মেয়েরা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে , বর বিরাট পোস্টে কাজ করলে , সময় দিতে না পারলে থোড়াই কেয়ার।  নিজেই নিজের জীবন সাজিয়ে নেওয়া আর কি । মেনোপজের কষ্ট কে লাগাম পরাতে বাইরের কাজের জুড়ি নেই। এই সময়ে বাড়ির মেয়েদের যে শূন্যতা দখল করে , সেই মধ্য দুপুরের নির্জনতা কাটাতে বাড়ির বাইরে পা দেওয়া টা খুব জরুরী। ব্যস্ততা মনের ফাঁকা জায়গা গুলো ভরিয়ে রাখে। নিজেকে চিনতে শেখায়। আমরা মেয়েরা যে যা চাই সব করতে পারি। পারি পারি পারি । আমরা  দশভুজা নারী। ঘর পারি বাইরেও পারি। এই ভাবনাই মনে থাকুক। কোন অবস্থাতেই কাজ ছাড়া উচিত নয়। আজকের অসুবিধে কালকের সুরাহা হবে।  জীবনকে পোষ মানিয়ে এগিয়ে চলাই তো ভালো।
এক পা ঘরে আর একপা বাইরে রাখার অন্য নাম ই তো জীবন। নারী জীবন। লড়াই আর জয়ের জীবন। কে কে সেই জীবনের পক্ষে ভোট দেবে হাত তোলো বন্ধুরা।
সুপ্তশ্রী সোম
পুকুরঘাট

পুকুরঘাট

একদিন আমরা মাত্র কয়েকজন সদস্য নিয়ে পুকুরঘাট নামের একটি মেয়েদের ভার্চুয়াল দল খুলে ছিলুম। অচিরেই সে কয়েকটি সদস্যের দল কয়েক হাজার সদস্যের মেয়েদের দল হয় ওঠে। পুকুরঘাট দলের মত এত গুণী মেয়েদের সমাহার বাংলাদেশে খুব কম ভার্চুয়াল দলে আছে। কাজেই সেই দল সেখানেই আটকে থাকবে না বলা বাহুল্য। তাই পুকুরঘাট দলের অন্যতম উদ্যোগ হিসেবে প্রকাশিত হলো পুকুরঘাট পত্রিকা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

10 thoughts on “এক পা ঘরে এক পা বাইরে

  1. খুব ভালো লাগলো গো, বিশেষ করে শিশুদের স্বাবলম্বী হয়ে যাওয়ার বিষয় টা খুব মন কাড়ল।

    1. খুব ভালো লাগলো তোমার ভালো লেগেছে জেনে। ভালো থেকো।

  2. সুপ্তশ্রী খুব সুন্দর লিখেছ তোমার নিজের মনের কথা এবং নিজের মত আরও কত এক পা ঘরে ও এক পা বাইরে মায়েদের কথা। তোমার আবেগ, অনুভূতি, নিজেকে ছাড়িয়ে যেতে পারার আনন্দ আবার নতুন করে নিজের জীবনের পুরোনো দিনগুলো কে মনে পড়িয়ে দিল। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ছাড়া কোন স্বাধীনতা সম্ভব নয়। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা দাম্ভিকতা শেখায় না, বরং নিজের আত্মমর্যাদা বাড়ায় এবং শ্রমের মূল্য শেখায়।
    তোমার সাথে একমত। আরও লিখো।

    1. অনুপ্রেরণা পেলাম ইন্দ্রাণী দি। নিশ্চয়ই লেখার চেষ্টা করবো।

  3. সুপ্তশ্রীদি, খুব ভালো লাগলো গো, তোমার ভাবনার সাথে রিলেট করতে পারলাম অনেকটাই।

  4. আমাদের সবার কথা তোমার লেখনীর গুণে অনন্য হল।

  5. Khub sundor likhechhe no, ekdom i bastob… tobe ami nije bigoto 15 bochhor ek paa ghore aar ek paa baire diye bujhechhi, Doshobhuja howar chesta na kora i bhalo. For few years it can give immense satisfaction that I am the best at whatever I am doing, but I will definitely fail to notice that people have started taking this efficiency for granted. And when you will finally notice that, it will be too late. It is okay to relax some time and let some tasks be done by others, let the mediclaim of in-laws be taken care by their son. I have nothing to prove by doing so, a journey is beautiful when travelled in peace and not in exhaustion. Off course it is my personal opinion from my experience.

    1. অনেক দিন পরে দেখলাম । কোন কোন ক্ষেত্রে অবশ্যই কেউ কেউ সুযোগ নেয়। তবে এই বাইরের আনন্দ অনেকের দরকার হয়। নিজেকে চেনার জন্য। আমি কিন্তু এই অফিসে কাজের আনন্দ পেয়েছি , উপভোগ করেছি স্বাবলম্বী হবার আনন্দ। আর দায়িত্ব ভাগ করে দিতেই হয়, নইলে হয়না। একা সব পারা যায়না। বাড়ির লোকেদের সহযোগিতা ছাড়া অসম্ভব। সে যত টুকুই হোক না কেন।

  6. খুব ভালো লাগলো সুপ্তশ্রী । আমি ও একজন ঘরে ও বাইরে পা রেখে চলা সংসারী নারী ।তোমার লেখার প্রতিটি অংশের মধ্যে নিজেকে দেখতে পেয়েছি। স্কুলের মেটার্নিটি লিভার তখনকার নিয়মে ছিল ডেলিভারির আগে দেড় মাস ,আর পরে দেড় মাস ,বলা হতো তিনমাস ছুটি । তাই বাচ্চার চারমাস নয় দেড়মাস পর্যন্ত ছুটি পেয়েছিলাম ।কুড়িয়ে বাড়িয়ে আর দশ দিন মেডিকেল লিভ নিয়ে স্কুলে জয়েন করেছিলাম ,একা নতুন মা , নতুন লোকের কাছে বাচ্চাকে রেখে ।… সেই যুদ্ধে সহযোদ্ধা ছিলেন স্বামী,তিনি নিজেই দুটি সন্তান কে বড় করে তোলার আগেই চলে গেলেন সব ফেলে রেখে । চাকরি করতাম বলে দুটো ছেলেকে মানুষ করতে পেরেছি ,ঘরে ও বাইরে আমার ভূমিকা আমি অব্যর্থ ভাবে পালন করতে পেরেছি , কারুর করুণার পাত্রী হইনি ।ছেলেরা মায়ের স্ট্রাগল ছোট থেকে দেখে নিজেরাও আত্মনির্ভর ,সংগ্রামী ও আত্মবিশ্বাসী হয়েছে । সেটা আলাদা করে শেখাতে হয়নি । বাইরে পা দেবার জন্যে ই কাজ ও অভিজ্ঞতা আমাকে সব কঠিন পরিস্হিতি সামলানোর শক্তি ,সাহস ও আত্মবিশ্বাস দিয়েছে আমি লড়তে পেরেছি ।
    তোমার বিশ্লেষণ আমার জীবন দিয়ে সমর্থন করলাম ।

    1. খুব ভালো লাগলো আপনি নিজেকে খুঁজে পেয়েছেন বলে। আমি জানি কষ্ট করতে হয় কিন্তু এর আনন্দ ও কিছু কম নয়। আপনার ক্ষেত্রে আরো অনেক কষ্ট করতে হয়েছে জানি। একলা বড়ো করেছেন বাচ্চাদের। তবু এই যে করুণার পাত্রী হলেন না এর চেয়ে বড় জোরের জায়গা হয়না। ভালো লাগলো খুব। ভালো থাকবেন।