এক সুখী পরপুরুষের কাহিনী

এক সুখী পরপুরুষের কাহিনী

মন্দিরা পাল

এক সোনালী চুলের তরুণী রাজকুমারী টিভিতে সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময় ঠোঁটে মৃদু হাসি নিয়ে আফসোস করে বলেছিলেন, “আমাদের বিয়েতে একটু ভিড় হয়ে গেছিল, সেখানে আমরা তিনজন ছিলাম।” বলাই বাহুল্য তিনি নিজে তাঁর স্বামীর প্রণয় পাত্রী ছিলেন না।
স্বামীটি একদিকে উচ্চবংশীয় রাজকুমার, বিলেতের ভাবী সম্রাট। উল্টো দিকে অভিজাত সমাজের  নিয়মকানুনের তোয়াক্কা না করে তিনি বারবার বরপুরুষ থেকে পরপুরুষ, আবার পরপুরুষ থেকে বরপুরুষে রূপান্তরিত হয়েছেন। বরং একটু বিশদেই বলা যাক।
উনিশশো একাশি সালে তিরিশোর্ধ কিন্তু দ্বিধাগ্রস্ত সেই।
রাজকুমার বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলেন অপরূপা লেডি ডায়ানা স্পেনসরের সঙ্গে। পরিবারের চাপ ছিলই, কারণ সিংহাসনের উত্তরাধিকারী পুত্র সন্তান প্রয়োজন। ডায়ানার সোনালী চুলের কথা বলেছি বটে, তবে তার রূপের আলোচনায় না গিয়ে শুধু এটুকুই বলা ভালো যে বিয়ের কিছু বছরের মধ্যেই এই দুনিয়ার সর্বাধিক ফটোগ্রাফিত মহিলা হিসেবে তার খ্যাতি হয়েছিল। এও মনে রাখা দরকার সে মেয়ে সেল্ফি তোলার সুযোগ পায়নি। যাই হোক, বিয়ের সময় তার বয়স ছিল মাত্র সাড়ে উনিশ। বিরাশি ও চুরাশিতে তার পরপর দুটি পুত্র সন্তান। রাজপরিবারের ক্রিস্টমাস কার্ডে বা আনুষ্ঠানিক ব্যাপারে চারজনকে নিয়মিত দেখা যেত দিব্যি একসাথে। অথচ বিয়ের প্রায় এক দশক পার হয়ে জানা গেল, রাজকুমারদের জন্মের পর আফ্রোডাইটের আশীর্বাদধন্য মেয়েটির দিকে তার বরপুরুষ আর ফিরেও চাননি।
পঁচাশিতেই তিনি ক্যামিলার বাহুডোরে নিজেকে পুরোপুরি সঁপে দিয়েছিলেন। তখন তিনি ক্যামিলার পরপুরুষ। উনিশশো একাত্তর থেকেই প্রিন্স চার্লস ও ক্যামিলার বন্ধুত্ব। ঘনিষ্ঠতা এতই বেড়ে গেছিল যে কে বা কারা কলকাঠি নেড়ে রাজকুমারকে কিছু মাসের জন্য সাত সমুদ্র তেরো নদী পার করে পাঠিয়ে দিল ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ। রাজকীয় নেভির হয়ে ডিউটি করতে। ক্যামিলা রাজপ্রাসাদে বউ হিসেবে বেমানান, এটাই ছিল তাদের ভয়। সেই উনিশশো তিয়াত্তরে ক্যামিলা চটপট বিয়ে করে ফেললেন পুরনো এক বন্ধু, এনড্রু পার্কার বোলসকে।।
তবে প্রিন্স অফ ওয়েলস, চার্লস ফিলিপ মাউন্টব্যাটেন, উনআশি/আশি সাল থেকেই বিবাহিত ক্যামিলা পার্কার বোলস-এর সঙ্গে পুরনো প্রেমের প্রদীপ জ্বালিয়ে রেখেছিলেন। তাই ডায়ানার জীবনে চার্লসের প্রবেশ ক্যামিলার হাত ধরে, যেন শ্যানেলের সিগনেচার জোড়া সি-এর মত, একসঙ্গে। অলওয়েস ইনসেপারেবল। আশ্চর্যের ব্যাপার, নভেল উপন্যাসের পাতায় যেমনটা হয়, ঠিক তেমনি, সুন্দরী মেয়েটা হঠাৎ মরে গিয়ে চার্লসের জীবনে স্বচ্ছন্দে সেকেন্ড ইনিংস খেলার সুযোগ করে দিল একদিন। খাতায় কলমে ডিভোর্সটা আগেই হয়ে গেছিল, ছিয়ানব্বই সালে। আরো অদ্ভুত, ক্যামিলাও ডিভোর্স নিয়েছে ওই একই সময়ে। কিন্তু ডায়ানা দুনিয়া থেকে চলে গিয়েও এমন তুমুল ভাবে জনমানসে বেঁচে রইল যে চার্লস তড়িঘড়ি ক্যামিলার বরপুরুষ হতে পারলেন না। তবে প্রেমের গল্পে কি হাল ছাড়া যায়!?
প্রথমে তিনি ছেলেদের নিয়ে ক্যামিলা সহ বেড়াতে গেলেন গ্রীসে। রানী মাকে বাগে পেতে বেশ সময় লাগল, নতুন মিলেনিয়ামে রানী এলিজাবেথ গররাজী হওয়া সত্ত্বেও চার্লস ও ক্যামিলা এক ছাতের নীচে বসবাস শুরু করলেন। শেষ পর্যন্ত দুহাজার পাঁচ সালে চার্লসের খাতায় কলমে ক্যামিলার বরপুরুষে উত্তরণ। এখন আপনারা কেউ চাইলে একে অবতরণ বলতেও পারেন।।
আজকের যুগে এ গল্প নিয়ে কথা বলা নিতান্তই বেমানান মনে হলেও উনিশশো ছত্রিশ সালে এই একই পরিপ্রেক্ষিতে ইংল্যান্ডের রাজা এডওয়ার্ড সিংহাসন ও দেশ থেকে এক প্রকার বিতাড়িত হয়েছিলেন। তৎকালীন বিলেতের পার্লামেন্ট তাঁর প্রেমিকা, ডিভোর্সি আমেরিকান ওয়ালিস সিম্পসনকে রানীর মর্যাদা দিতে অস্বীকার করে, আর ইংল্যান্ডের চার্চ ডিভোর্সি মহিলাকে বিয়ে করায় রাজার মাথায় মুকুট রাখতে। অষ্টম এডওয়ার্ড-এর পাঁচ দশক পরে পৃথিবীতে পদার্পণ করা চার্লসকে তাই বরপুরুষ ও পরপুরুষ হিসেবে সৌভাগ্যবান বলাই শ্রেয়।
মন্দিরা পাল
পুকুরঘাট

পুকুরঘাট

একদিন আমরা মাত্র কয়েকজন সদস্য নিয়ে পুকুরঘাট নামের একটি মেয়েদের ভার্চুয়াল দল খুলে ছিলুম। অচিরেই সে কয়েকটি সদস্যের দল কয়েক হাজার সদস্যের মেয়েদের দল হয় ওঠে। পুকুরঘাট দলের মত এত গুণী মেয়েদের সমাহার বাংলাদেশে খুব কম ভার্চুয়াল দলে আছে। কাজেই সেই দল সেখানেই আটকে থাকবে না বলা বাহুল্য। তাই পুকুরঘাট দলের অন্যতম উদ্যোগ হিসেবে প্রকাশিত হলো পুকুরঘাট পত্রিকা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

13 thoughts on “এক সুখী পরপুরুষের কাহিনী

  1. এই কাহিনীতে বর আর পরের সংজ্ঞা উল্টেপাল্টে গিয়েছিল।ডায়ানার কাছে চার্লস পরপুরুষ হয়েই রয়ে গিয়েছিলেন ,কিন্তু তাতে প্রেমের মাধুর্যটুকু ছিল না, আবার বরপুরুষের বিশ্বস্ততাও অনুপস্থিত ছিল। তথাকথিত ভাবে পরপুরুষ মনে হলেও আগেও সবটুকু দিয়েছিলেন ক্যামিলা কে, পরে ক্যামিলার বরপুরুষ হয়ে ওঠেন।

    1. আজকাল বাচ্চারা যেটাকে complicated বলে, সেই আর কি ☺️

      মন্তব্যের জন্য আলাদা করে ভালোবাসা।

  2. বরপুরুষ ইনি ভুল করে হয়েছিলেন স্বর্ণকেশী সুন্দরীর সাথে, পর পুরুষ থেকে বর পুরুষ হয়েছিলেন যাঁর সাথে পরে, সেখানেই হৃদয় মন প্রদান করেছিলেন, অন্যত্র ইতিউতি ঘুরে বেড়ান নি, বোধহয়… তবে তাতে করে যাঁকে প্রথম বিবাহ করে অসম্মান অবজ্ঞা অবহেলা করেছিলেন, তাঁর প্রতি অপরাধ কখনোই কমে না!

    1. ওদের সামাজিক ব্যবস্থা অনেকটাই অন্যরকম। তায় রাজপরিবারের ব্যাপার আরো আলাদা। অভিজাত পরিবারের একটি ভার্জিন ব্লন্ড যোগাড় করে সিংহাসনের উত্তরসূরি প্রস্তুত করা চার্লসের জন্যেও বোধহয় সহজ ছিল না। তাছাড়া বড় হওয়ার সময় তাঁর মায়ের সঙ্গে ছিল অত্যন্ত ক্ষীণ অন্তরঙ্গতা। উল্টোদিকে ডায়না ছিলেন অতিরিক্ত ভালোবাসার কাঙাল। এই সবকিছু মিলিয়ে বোধহয় এমন পরিণতি হওয়া অস্বাভাবিক ছিল না।

  3. ডায়ানার কথা ভাবলে এখনও মন খারাপ হয়। তোমার লেখা সেই মনখারাপটা আরো একবার জাগিয়ে তুলল। অল্প কথায় সবটা লিখে দিলে।

    1. আমাদের প্রজন্মের মেয়েদের ডায়নার প্রতি এক অদ্ভুত আকর্ষণ ছিল, সেটা অযৌক্তিক ছিল কি না তা জানি না।

  4. খুব ভাল লেখা। একই সাথে বরপুরুষ আর পরপুরুষ হিসেবে প্রিন্স চার্লস চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। সাবলীল আর নির্মেদ গদ্য লেখাটির অনন্য সৌন্দর্য।

    1. তোমার মন্তব্য রেখে যাওয়া আমার জন্য এক অসামান্য প্রাপ্তি।