ঘরে বাইরে পা

ঘরে বাইরে পা

অজন্তা সিনহা

 

আমাদের মেয়েদের নারীজীবন দেখাটা অধিকাংশ ক্ষেত্রে শুরু হয় বাড়িতে মা-ঠাকুমার জীবনযাপনকে কেন্দ্র করে। মেয়েদের ঘরে-বাইরে যাপন বিষয়ে লিখতে গিয়ে আমারও প্রথমে আমার মায়ের কথাই মনে পড়লো। আমার মা পেশায় ছিলেন একজন প্রাথমিক স্কুল শিক্ষিকা। বাবাও একই পেশায় ছিলেন। সেটা এমন এক সময়, যখন প্রাথমিক স্কুল শিক্ষকদের বেতনের হার এমন ছিল না, যাতে বাড়িতে পরিচারিকা রাখা সম্ভব ! অত্যন্ত কম তো বটেই, অনিয়মিতও ছিল। 

মাকে দেখতাম স্কুল থেকে ফিরেই প্রথমে উনুন ধরাচ্ছেন। কয়লার উনুন ধরতে সময় লাগবে, সেই সময়ের মধ্যে বাইরের জামাকাপড় ছেড়ে, হাত-পা ধুয়ে ঘরের অন্যান্য কাজ শুরু করতেন। আমার বাবাও মাকে সংসারের কাজে সাহায্য করতেন। সবজি কাটা থেকে কয়লার গুঁড়োর গুল দেওয়া, সবই পারতেন তিনি। একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। কিন্তু, এহেন গৃহকর্মে কোনও লজ্জা বা দ্বিধা ছিল না বাবার। বলতেন, আমার স্ত্রী সংসারের অর্থনৈতিক দায়িত্ব ভাগ করে নিচ্ছেন, আমি তাঁর সঙ্গে সংসারের কাজ ভাগ করে নেব না ? 

মার্জনা করবেন পাঠক, শুরুতে কিছুটা ব্যক্তিগত চর্চা হয়ে গেল। আদতে সেই প্রথম দাম্পত্য দেখা, যা আমার চোখে মাধুর্যময় হয়ে উঠেছিল দুই সংসার যোদ্ধার পারস্পরিক বোঝাপড়া ও সহমর্মিতায়। এটা থাকলে উভয়েরই কষ্ট কিছুটা লাঘব হয়। ঘরে-বাইরে মেয়েদের যে যুদ্ধ, তা তার একার নয়। সমাজেরও এখানে সমান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। সেকাল থেকে একাল, বিষয়টা কিন্তু একই রয়েছে। আমাদের ঘর ও পরিবার নিয়ন্ত্রণ করে আর্থসামাজিক পরিস্থিতি। সেখানে নারী-পুরুষ উভয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে না চললে জীবনের স্বাভাবিক ছন্দটাই যায় নষ্ট হয়ে।  

এখানে যাঁরা তথাকথিত ভাবে নিছক  ‘হাউসওয়াইফ’ বলে চিহ্নিত, তাঁদের কথাও বিশেষভাবে বলা জরুরি। তাঁরা সংসার বা সমাজে যে অবদানটা রাখেন, সেটাও কিন্তু সংসারে পরোক্ষভাবে অর্থনৈতিক ভারসাম্য রাখতে সাহায্য করে। আমাদের ছোটবেলায়, আমরা সকলেই এমন নারীদের ঘরে ঘরে দেখেছি। তাঁরা আজও আছেন। স্তম্ভের মতো ধরে থাকেন সংসারকে। তা সত্ত্বেও পেশাদারী কাজকর্মের জন্য যে মহিলারা বাইরে যান, তাঁদের সঙ্গে গৃহবধূদের অবস্থান নিয়ে একটা অহেতুক চাপানউতোর চলে ! যিনি উপার্জন করেন আর যিনি করেন না, দুই পক্ষের মধ্যে একটা গুণগত পার্থক্য সৃষ্টির চেষ্টাও চিরন্তন ! আর এই জায়গাটাতেই আমার চরম আপত্তি। লড়াইটা সকলেই করছেন। শুধু যাপনের পরিকাঠামোটা পৃথক। 

এখানে একটা মজার গল্প বলি। কয়েকদিন আগে পরিচিত এক মহিলার সঙ্গে আমাদের এই ঘরে-বাইরের বিষয় নিয়েই কথা বলছি। পৃথিবীর সব মানুষকে সবকিছু সমান আকর্ষণে টানে না। আমি নিজেই যেমন যতটুকু প্রয়োজন গৃহকর্ম করি। কিন্তু খুব একটা বাড়তি পর্যায়ে আগ্রহী নই। বরং নানা জাতীয় সৃজনশীল কাজেই আমার বিশেষ উৎসাহ। এই মেয়েটিও তাই। সে একজন স্কুল শিক্ষিকা। অত্যন্ত গুণী একজন বাচিকশিল্পী। তাঁর কথায়, “এই গৃহকর্মে পারঙ্গম না হওয়ায় বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি এসে খুব বিপদে পড়েছিলাম। অন্যান্য কাজ যেমন-তেমন, রান্নাটা একেবারেই পারতাম না। যতটুকু না করলে নয় করে, বই পড়তাম। আমার শাশুড়ি মা ছিলেন এককথায় গৃহকর্ম নিপুণ। রান্না করতেন চমৎকার। আমার ওই সুযোগ পেলেই বই নিয়ে বসে পড়া দেখে তিনি একদিন বলেছিলেন, আচ্ছা লেখাপড়া করে কী হয়?” 

শাশুড়ি মহাশয়ার এই বক্তব্যের সার হলো, মেয়েদের জন্য ঘরের কাজ জানাটা অধিক জরুরি। লেখাপড়া করে কী হয় ? উনি যে খুব বেশি প্রাচীনকালের তা কিন্তু নয় ! এমনকী আজও অনেকেই এভাবেই দেখেন বিষয়টিকে। আমি এটাই বলতে চাইছি, এই যে দৃষ্টিভঙ্গি, সেটা কিন্তু আসলে ওই মহিলার নয়। সামগ্রিকভাবে সমাজের। ঘরের মেয়েরা যখন থেকে পেশাদারিভাবে শিক্ষিত হয়ে বাইরের জগতে পা রাখলো, তখনই গৃহবধূ ও চাকরিজীবী মেয়েদের মধ্যে বিভেদরেখাটা স্পষ্ট হতে শুরু করলো। আদতে, দু’ক্ষেত্রেই মহিলারাই কিন্তু সেই অস্তিত্বরক্ষার লড়াইটা করছেন। যিনি চাকরি করেন না, তাঁকেও শ্রম দিতে হয়, যিনি করেন, তাঁকে তো হয়ই। তাহলে বিভেদ কেন ? উন্নত দেশগুলিতে এই বিভেদ বা তুলনামূলক মূল্যায়নের জটিলতা নেই। সেখানে প্রায় সব মহিলাকেই অর্থনৈতিক ভাবে স্বনির্ভর হতে হয়। 

এই যে গৃহবধূ ও চাকরিজীবী মহিলাদের প্রসঙ্গটি এই প্রতিবেদনে আনা, এর একটা বড় কারণ, বহু পরিবারে এটি একটি জ্বলন্ত অধ্যায়। আমার শ্বশুর মশাই বিয়ের পর আমার পড়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন এই যুক্তিতেই, “তুমি কলেজে পড়তে যাবে আর তোমার জা ঘরের সব কাজ একা করবে ?” ফলে আমার লেখাপড়া ডিগ্রিগত ভাবে আর খুব একটা এগোতে পারলো না। যা কিছু শেখা নিজের চেষ্টায় ও কাজকর্মের সূত্রে। মোদ্দা কথা, পরিবারের একটি মেয়ে বা মহিলা পড়ার জন্য অথবা চাকরি করতে বাইরে বের হলে―বাকিদের কোথাও একটা হীনমন্যতা তৈরি হয়। এর পিছনে যে মনস্তত্ব কাজ করে, সেটা সম্ভবত ওই খোলা জানালা পেয়ে যাওয়ার ব্যাপার। যে প্রতিদিন ঘরের বাইরে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে, প্রেক্ষিত যা-ই হোক, সে সুবিধাভোগী শ্রেণীভুক্ত। যে সারাদিন ঘরেই থাকে মূলত, সে এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত ! 

এই প্রসঙ্গে বিপরীত কথা বলার লোকের অভাব নেই। বিতর্ক সৃষ্টি করতেও অনেকেই আগ্রহী হবেন হয়তো। আমার উদ্দেশ্য সেটা নয়। আমি খুঁজতে চাইছি এই জটিলতার উৎস। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই সারা বিশ্বের বহু দেশের মতো ভারতেও অর্থনৈতিক কারণে সামাজিক পরিকাঠামোয় বিপুল পরিমাণে ধাক্কা লাগে। একান্নবর্তী পরিবারগুলি ভেঙে যায়। তখন থেকেই মূলত ব্যাপকহারে, পরিবারের ভরণপোষণের জন্য মহিলাদেরও পেশাদারী পথে যেতে হয়। আর্থ সামাজিক প্রেক্ষিত এবং যুগের পরিবর্তন, দুটো সমান্তরালে বদলে দেয় পরিবার ও সমাজের চালচিত্র। 

এই যে মেয়েদের পেশাদারী ক্ষেত্রে এগিয়ে আসা, এটাও কিন্তু সব পরিবারে সমান মানসিক প্রস্তুতির প্রেক্ষিতে আসেনি। নারীর স্বাতন্ত্র, তার শিক্ষা ও স্বনির্ভর হওয়ার অধিকার তার প্রাপ্য। সেই অবলম্বন নিয়ে সে সংসারের স্তম্ভ হয়ে উঠবে কিনা, সেটা আর একটা দিক। এই দুইয়ের মধ্যে মেলাতে গিয়েই যত জটিলতা। সংসারকে দেখার ব্যাপারটা অর্থনৈতিক স্বনির্ভর হয়ে একরকম, আবার না হয়েও সেটা করেন বহু মহিলা। দুজনেরই সমান স্বীকৃতি ও সম্মান প্রাপ্য। যেহেতু সমস্যাটা মানসিকতার, সেখান থেকেই ওই ‘হাউসওয়াইফ’ ও ‘ওয়ার্কিং উইমেন’–দুটি পৃথক শ্রেণী বানিয়ে ফেলে অহেতুক জটিলতা টেনে আনা। তার থেকেই সাস-বহু চিত্রনাট্য ও সিরিয়ালের রমরমা। 

শুরুর দিকে প্রধানত শিক্ষকতাকেই অধিক বেছে নিতেন মহিলারা। ছুটিছাটা বেশি, পরিবেশও অনুকূল বা নিরাপদ ( তখন এমনটাই ভাবা হতো)। ছুটি বেশি হওয়ায় তাঁরা ঘরে-বাইরে সামঞ্জস্য রাখতে সক্ষম হতেন সহজে। তারপর এল নার্সিং পেশা। এটার মধ্যেও বেশ একটা তথাকথিত নারীসুলভ, বলা ভালো সেবিকা ইমেজের ব্যাপার ছিল। এই যে মহিলাদের ‘উপযুক্ত’ কিছু পেশাকে একেবারে নির্ধারিত করে দেওয়া, বলা বাহুল্য এই সবই পারিবারিক ও সামাজিক ধ্যানধারণা প্রসূত কিছু অলিখিত রীতি বা চিন্তাভাবনা। পরবর্তীকালে বাস্তব কারণেই এইসব যাবতীয় ভাবনা ও রীতি বদলে গেল। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, কর্পোরেট থেকে পাইলট―আজকের মেয়েরা কী না করছেন ? 

সাংসারিক জটিলতার পর্ব ছেড়ে আজকের নিউক্লিয়ার পরিবারের মহিলা, যাঁরা দশভুজা হয়ে ঘর ও বাইরের দায়িত্ব সামলাচ্ছেন, তাঁদের কথায় আসি। এই বিষয়টি ছাড়া এই প্রতিবেদন অসম্পূর্ণ। সংসার, অফিস, বাচ্চার স্কুল এবং সর্বোপরি গৃহকর্মে সাহায্যকারী এক বা একাধিক ব্যক্তিকে চালনা করা তাঁদের জন্য নিত্য রুটিন। বলা ভালো, এই সাহায্যকারী বা কারিনীর ওপর সংসার বা বৃহত্তর অর্থে নিত্যযাপনের ছন্দ অনেকটাই নির্ভরশীল। এরই সঙ্গে নিজের শরীর ও মনের যত্ন। প্রসাধন, মেকআপ, মেকওভার। এই শেষোক্ত বিষয়গুলি আগে এত প্রয়োজন পড়েনি। চাকরি জগৎ বা পেশাদারী দুনিয়া যত জটিল হয়েছে তত মেয়েদের লড়াইটাও বেড়েছে। সঙ্গে জটিলতা এবং প্রত্যাশা। 

এখন কাজের মাসি না এলে, কড়াই মেজে অফিস যাওয়ার সময়ও প্রায় মডেল দুনিয়ার মতো প্রেজেন্টেবল হয়ে যেতে হয়। মহিলা পাঠককুল সহমত হবেন কিনা, জানি না। কিন্তু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি একথা। এ ব্যাপারে পুরুষকুলের প্রতি সমাজের প্রত্যাশা তুলনামূলক ভাবে কম। মোদ্দা কথা, আক্ষরিক অর্থেই দশভুজা হও, না হলে গেলে। বাড়ির পুরুষরা কতটা স্বাবলম্বী সর্বকাজে, সেটাও একটা ইস্যু। এক গ্লাস জলও গড়িয়ে খেতে পারে না, অফিস যাওয়ার আগে মোজা খুঁজে না দিলে গালে হাত দিয়ে বসে থাকে, এমন পুরুষ আজও নেহাত কম নয়। এই ব্যাপারে চাকরিজীবী মায়েদের ছেলেরা তুলনায় অধিক স্বাবলম্বী সংগত কারণেই। 

এযাবৎ যত কথা বললাম, তার সবটাই শিক্ষিত, উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মহিলাদের কথা। কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে, এটাই মোটামুটি চিত্র। এবার খুব কাছ থেকে দেখা শ্রমজীবী মহিলাদের কথা বলবো। যেখানে উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গ―দুটোই রয়েছে। জেলা শহর বারুইপুরে থাকাকালীন কলকাতায় অফিস করতে আসার জন্য নিত্য যাতায়াত ছিল লোকাল ট্রেনে। টানা পাঁচ বছর এই রুটিন চলেছে। খুব কাছ থেকে দেখেছি বারুইপুর, ডায়মন্ডহারবার, লক্ষিকান্তপুর, ক্যানিং লাইনের বিভিন্ন গ্রামের মেয়েদের। এই পাঁচটি বছর এঁদের সংস্পর্শে আসার অভিজ্ঞতা আমার স্মৃতির সিন্দুকে থেকে যাবে চিরকাল। ওদের যাতায়াতের সময়কালীন বেশিরভাগ ট্রেনের মহিলা কামরা ঝি-কম্পার্টমেন্ট বলে অভিহিত ছিল। ছেলেরা মাছের বাজার বলতো। লেডিসের পাশেই ভেন্ডার―পুরুষকুল সেখানে উঠে, জালের ফাঁক দিয়ে দেখতো ওই ‘কাজের মেয়ে’দের নিত্য নাটক।

ওরা ঝগড়া, মারামারি, খিস্তিখেউর করতো। একে অপরের মাথার উকুন বাছতো। স্বামীর পরনারী আসক্তি নিয়ে চিৎকার করে কান্না ও ওই মেয়েটিকে শাপশাপান্ত–―এসবের মধ্য দিয়েই তারা নিজেদের চরম অসহায়তা প্রকাশ করতো। এই উন্মত্ত বেদনা আখ্যানগুলি কোথাও কোথাও খুনখারাবির চেষ্টায় গিয়ে শেষ হতো, এমনও শোনা যায়। বেশিরভাগ স্বামী আক্ষরিক অর্থেই ছিল কিল মারার গোঁসাই। ভাতার হওয়ার তো প্রশ্নই ছিল না। বউ খেটেখুটে রোজগার করে আনবে। তাকে মারধোর করে টাকাপয়সা কেড়ে নিয়ে মদ-জুয়ায় ওড়ানো, এটাই হলো ওইসব পিছিয়ে পড়া অঞ্চলের প্রচলিত জীবনধর্ম। এরমধ্যে আর্থসামাজিকতা এবং তাকে ঘিরে চিরন্তন ধোঁকার রাজনীতি তো আছেই। 

এতকিছুর পরও এই মেয়েদের দলটি দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল আমায়। ওদের কোথাও কোনও ভণ্ডামি ছিল না। আমাদের শিক্ষিত সমাজের বেশিরভাগ মহিলা যাত্রী ওদের এড়িয়ে চলারই চেষ্টা করতো। সেটাই স্বাভাবিক। তাদেরও ঘরে-বাইরে অন্তহীন লড়াই। তার মাঝে চলার পথে বাড়তি ঝঞ্ঝাট কে আর চায় ? এছাড়াও অপরিচ্ছন্নতা, উকুনের ভয়–এসব তো ছিলই। আমার এই এড়িয়ে চলার উপায়টা সবসময় হতো না। এমন এক পেশায় ছিলাম, তাতে ঘড়ি ধরে যাতায়াত সম্ভব ছিল না। আর জেনারেল কম্পার্টমেন্টে যাওয়ার বিড়ম্বনা কী কী, তা নিয়ে আর এখানে বিস্তারে যাচ্ছি না। অতএব ওদের গায়ে গা ঘেষে যাওয়া-আসা। এটাও কিন্তু আক্ষরিক অর্থেই। ওখানে গা বাঁচিয়ে চলতে গেলে, ‘ওরে আমার ভদ্দরনোক রে !!’–এহেন বাক্যবান সহ্য করতে হবে। অর্থাৎ ওরাও আমাদের যথেষ্ট অপছন্দ করতো।  

এইসব বেড়া পার করে ওদের মনের কাছাকাছি পৌঁছতে অনেকটা কসরৎ করতে হলো, বলাই বাহুল্য। তারপর একটা সময় বিশ্বাসযোগ্যতার একটা ভিত্তি তৈরি হলো ওদের সঙ্গে আমার সম্পর্কের। চোখের সামনে দেখতে শুরু করলাম ওদের নিদারুণ লড়াই। এক একজন এক এক পারিবারিক ও সামাজিক জটিলতায় বিপর্যস্ত। তবু, সকলেই সংসারের দায়িত্ব পালন করে চলেছে হাসিমুখে। বহুদূর থেকে আসতো তারা। বেশিরভাগ মেয়েরই বাড়ি স্টেশন থেকে কমপক্ষে ২/৩ ঘন্টার হাঁটা পথ। রাত থাকতে উঠে ঘরের সব কাজ সেরে, বাচ্চাদের খাইয়েদাইয়ে, সারাদিনের খাবার মজুত রেখে বেরুয়ে আসতো ওরা। ফিরতে ফিরতে অনেকেরই গভীর রাত। 

এমন অনেককেই চিনতাম, যারা ঘন্টা দুয়েকও ঘরে থাকার সুযোগ পেতো কিনা সন্দেহ। এরপর ছিল ট্রেনের গন্ডগোল, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইত্যাদি ! দুটি স্টেশনের মাঝে ট্রেন দাঁড়িয়ে। আমরা অধৈর্য হচ্ছি। ওরা ঝুপঝাপ লাইনে নেমে পড়ে হাঁটতে শুরু করলো। বাড়িতে বাচ্চারা পথের দিকে চেয়ে, মা গিয়ে রাঁধলে তারপর খাবে। সেই টেনশনে পাগল হয়ে দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পথ চলতো এই মেয়ের দল। শিক্ষার সুযোগ পায়নি বেশিরভাগই। তবু, ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠাবার চেষ্টা করতো। অনেকের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক রচিত হওয়ায় ওদের অপূর্ব হৃদয়বৃত্তির পরিচয় পেয়েছি, যা কখনও ভোলার নয়। 

শেষ করবো পাহাড়ের মেয়েদের কথায় ! নারী-স্বাধীনতার প্রকৃত স্বরূপটি জীবনের শেষ প্রান্তে পৌঁছে, উত্তরবঙ্গের পাহাড়ী গ্রামগুলিতে এসে দেখলাম। ওরা মূলত কৃষিজীবি। কেউ কেউ মজুরের কাজ করে। নারী-পুরুষ হিসেবে এখানে কাজের কোনও ভেদাভেদ নেই। সবাই সব কাজ করে। প্রত্যেকে অসম্ভব স্বাবলম্বী। মহিলারা তুলনাতীত সম্মান পায়। আমার বাড়ির মেঝে তৈরিতে যে মহিলা রাজমিস্ত্রী তার নিপুণ কুশলতায় মুগ্ধ করেছিল, সে বিমলা। বিমলা আজ আর নেই। সেরিব্রাল এটাকে মাত্র পঞ্চাশ বছর বয়সেই মারা যায় সে। এই বিমলা আমার দেখা প্রথম মহিলা রাজমিস্ত্রী। কলকাতায় আমি মহিলা যোগালি দেখেছি। মিস্ত্রির কাজ পুরুষদের একচেটিয়া। বিমলাকে আশপাশের গ্রাম থেকে ডেকে নিয়ে যেত কাজের জন্য। এখনও প্রসঙ্গক্রমে সবাই তার নাম উচ্চারণ করে শ্রদ্ধার সঙ্গে। 

বিমলা ছাড়াও বহু মহিলার সংস্পর্শে এসেছি আমি। হোমস্টে মালকিন অন্তত তিনজন মহিলাকে চিনি আমি, যাদের সুপরিচালনা রীতিমতো নজর কেড়ে নেয়। এরা প্রত্যেকে স্বাধীন চিন্তার অধিকারী। পাহাড়ের মানুষের জীবনে চূড়ান্ত দারিদ্র রয়েছে। সরকারি স্তরে যুগ যুগ ধরে বঞ্চনা ও অবহেলার শিকারওরা। কিন্তু ঘর ও বাইরের কাজে নারী-পুরুষ একে অপরের যথার্থ পরিপূরক। কর্মস্থলে আমাদের শিক্ষিত সমাজের মেয়েদের যে নিকৃষ্টতম ও অপ্রীতিকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয় প্রায়ই, এখানে সেসব নেই। অফিস থেকে বাড়ি ফিরে কে চা বানাবে, তা নিয়েও কোনও জটিলতা নেই। যে যখন সময় পায়, সে তখন সামনে যে কাজ পড়ে থাকে, তা করে ফেলে। নারী নির্যাতন, ধর্ষণ ইত্যাদি পাহাড়ে ঘটে না বললেই চলে ! এই সমাজকে খুব নিবিড় অভিজ্ঞতায় দেখে বিশ্বাস ফিরে পাই আমি। পথ খুঁজে পাই এই চিত্রাঙ্গদাদের দেখে, আপন সংকটে-সমস্যায়। 

অজন্তা সিনহা

 

পুকুরঘাট

পুকুরঘাট

একদিন আমরা মাত্র কয়েকজন সদস্য নিয়ে পুকুরঘাট নামের একটি মেয়েদের ভার্চুয়াল দল খুলে ছিলুম। অচিরেই সে কয়েকটি সদস্যের দল কয়েক হাজার সদস্যের মেয়েদের দল হয় ওঠে। পুকুরঘাট দলের মত এত গুণী মেয়েদের সমাহার বাংলাদেশে খুব কম ভার্চুয়াল দলে আছে। কাজেই সেই দল সেখানেই আটকে থাকবে না বলা বাহুল্য। তাই পুকুরঘাট দলের অন্যতম উদ্যোগ হিসেবে প্রকাশিত হলো পুকুরঘাট পত্রিকা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *