হৃদকমল

হৃদকমল

সাবিনা ইয়াসমিন রিংকু

দিয়া ক্যাফেতে ঢুকে দেখল তখনও পবন আসেনি। বেরোনর সময় ওদের ফ্ল্যাটের দিকে অভ্যেসবশত তাকিয়ে দেখেছিল ফ্ল্যাটের দরজা বন্ধ। বাইরের কোলাপসিবল্ গেটটাও টানা।  ভেবেছিল তার বেরোনর আগেই বেরিয়ে গেছে। মাড়োয়ারিদের সন্বন্ধে তার নিজের এবং তার পরিবারের ধারণা কোনোদিনও ভালো ছিল না। বাঙালিকে পছন্দ করে না,কঞ্জুস, গুটখা খায়, দামী বাইকে চ’ড়ে মেয়ে দেখে বেড়ায়…এসব ধারণা ভুল প্রমাণ করে দিয়েছে পবন। যদিও ওর পিতাজি খুবই ঝামেলাবাজ মানুষ। আবাসনের জলের পাইপ ঠিক করানোর সামান্য টাকা খরচ করতেও জান বেরিয়ে যায় তাঁর। অথচ প্রতি মাসে ফ্ল্যাটে পার্টি লেগেই থাকে। পকৌড়া, সামোসা,জিলাবি,গুলাবজামুন আর মদ। সঙ্গে হিন্দি গান ওহ্ হো হো হো/ওহ্ হো হো হো/ইশক্ তেরা তাড়পাভে…. অসহ্য!  ছ’তলার নিচের ফ্ল্যাটটাই দিয়াদের। অপিস থেকে ফেরার সময় প্রায়ই দেখা হত পবনের সঙ্গে। পবন ওই সময় জিম থেকে ফিরত। ঠিক ওই সময়টাতেই। একবারে ঘড়ি ধরে। দিয়া লিফ্টে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে লালটুকটুকে গালে আরো এক রাশ লালিমা লাগিয়ে পবন বলত.. “আমিও যাব।”  লিফ্টটা তো কারো বাপের সম্পত্তি নয়,আবাসনের সবাই চড়তে পারে। পবনের গা থেকে বেরোন ঝাঁজালো পারফিউমের গন্ধে মাথা ধরে যেত দিয়ার। লিফ্টে তেমন কোন কথা হত না। তবে দিয়া ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় দিয়ে অনুভব করতে পারত.. পবন তাকে দেখছে।
করোনার সময় দিয়ার অফিস যাওয়া বন্ধ হল। পবনের জিমে যাওয়া তারও কিছুদিন পর বন্ধ হল। ওয়ার্ক ফ্রম হোম শুরু হল। পবনের পিতাজির তপসিয়ার কারখানাতেও তালা পড়ল। বাজারঘাট, লেক,মল,পার্ক,ময়দানে যাওয়া মানা। অগত্যা ছাদই সেই দুঃসময়ে চরম সাথ দিল। আশি বছরের বৃদ্ধ কানোরিয়া,মধ্যবয়সী আহমেদ আংকেল এবং উনত্রিশ বছরের তরুণী দিয়ার বিকেলের ডেসটিনেশন হল ছাদ। ‘
হৃদকমল’ আবাসনের ভেতরে চারটে কমপ্লেক্স।   সুইগি, ক্যুরিয়ার সার্ভিসের লোকজনের সুবিধার জন্য এ,বি,সি,ডি হিসেবে ভাগ করা। দিয়া’রা হৃদকমলের এ-ব্লকের পাঁচতলার বাসিন্দা। আর পবন খেড়িয়া থাকে ছ’তলার ফ্ল্যাটে। পিতাজি,মাতাজি, দাদাজি আর দাদিজির সঙ্গে। পবনের একটা ছোটি বহিনও  আছে। জয়পুরিয়া কলেজে পড়ে।
দিয়া মা বাবার একমাত্র সন্তান। তবে তার বাড়িতে আরও একজন মেম্বার আছে। সাদা রঙের মেনি লালি। সংসারে তার খাতির দেখবার মতো। দেশি গার্ল লালি বিশ্বাস ফ্যামিলির মেম্বারদের সঙ্গে ভেটকি, পমফ্রেট খায় আর সারাদিন ধ’রে ল্যাদ খায়। বেলার দিকে ছাদে গিয়ে রোদ্দুরে বসে বসে চড়াই পাখির খুঁটে খাওয়া দ্যাখে। ল্যাজ নাড়ে। কোনোদিনও নিরামিষখেকো ছ’তলার ফ্ল্যাটের দিকে ঘুরেও তাকায় না। মাছে যতটা ভক্তি,দুধ ঘিতে ততোটাই বিরক্তি।
তা যাই হোক করোনাকালে ছাদেই প্রেমের শুরুটা হল।  আর পাঁচটা প্রেমের শুরুয়াত যেভাবে হয়,ঠিক সেভাবেই।
“তুমি মদ খাও?”
“নেহি নেহি।  স্রিফ অকেশনে।  তাও জাদা না।”
পশ্চিমবঙ্গে বসবাসকারী মাড়োয়ারিরা ভালোই বাংলা বলে। মাঝেেমাঝে বাঙালিদের থেকেও ভালো। পবনও ইচ্ছে করলেই গড় গড় করে বাংলায় কথা বলতে পারে।  দিয়ার সামনে তেমনটাই চেষ্টা করে। এই চেষ্টাটাই কিউট লাগে দিয়ার। ভীষণ ফর্সা পবন। দিয়ার চাইতেও। দিয়ার কোনোকালেই এমন দুধেআলতা ছেলে পছন্দ ছিল না। কিন্তু অদ্ভুত একটা ছেলেমানুষী আছে পবনের চোখেমুখে… ওটা দিয়ার ভালো লাগে। পিতাজির সঙ্গে ব্যবসা করে পবন। মুখের আদলে ছেলেমানুষী থাকলেও বুদ্ধিটা পাকা।  কোথায় কী বলতে হয় এবং কীভাবে বলতে হয় পবন সেটা জানে। ওই ছাদেই ট্যাঁ ট্যাঁ করে টিয়াপাখির উড়ে যাওয়া দেখতে দেখতে সন্ধের মুখে পবন বলেছিল কঠোর নিরামিষাশী তাদের পরিবার মছলি, চিকেন,মাটন খাওয়া মেয়েকে ঘরের বউ করতে পছন্দ করবে না। তবে ভবানিপুরের ওদিকে একটা ফ্ল্যাট নেওয়ার চেষ্টা করছে পবন।   বিয়ের পরে আলাদা থাকলে দিয়ার সেরকম তকলিফ হবে না। প্যার দিয়ে সে দিয়ার মনপ্রাণ ভরিয়ে দেবে।
নিরামিষাশী পবনের কথা শুনে চরম বিরিয়ানিপ্রেমী দিয়া দ্বন্দ্বে পড়ে গেছিল। ওদিকে বিশ্বাস বাবুর সঙ্গে আবার মিস্টার খেড়িয়ার একেবারেই বনিবনা নেই।
বেশ কিছুদিন পর লকডাউন উঠে গেল। আস্তে আস্তে বাজার হাট স্বাভাবিক হল। মাস্কহীন মুখের সংখ্যা বেড়ে গেল রাস্তায়।  দিয়ার অফিস খুলল। পবনদের কারখানাও। লকডাউনের সময় যে লোকসান হয়েছিল সেটা পূরণ করার জন্য পবনের ব্যস্ততাও বেড়ে গেল। ফোনে কথা হয়। হোয়াটস্ অ্যাপে চ্যাট।  ব্যাস! একদিন ঠিক হল কোন একটা রেস্তরাঁয় বসবে দু’জন। দিয়াকে একটা সারপ্রাইজ দিতে চায় পবন। ছাদে অসুবিধে আছে। ট্র্যাংগুলার পার্কের ওদিকে একটা সাউথ ইন্ডিয়ান রেস্তরাঁ আছে,ওটার কথা পবন বলেছিল। দিয়া নস্যাৎ করে দিয়েছে। ইডলি দোসা খাবে না ও। পবন বলেছিল ওখানে রাজ-কচৌরিও পাওয়া যায়। দিয়া রাজী হয়নি। তার থেকে ক্যাফেই ভালো। গড়িয়াহাটের কাছে একটা ক্যাফে আছে। সেখানে ফিশ অ্যান্ড চিপস্ পাওয়া যায়। কিন্তু পবনের সামনে বসে ফিশ খাওয়াটা কী ঠিক হবে! ওর থেকে কেক বা কুকিস খাওয়া বেটার। এসব ভাবতে ভাবতে ক্যাফের সামনে এসে দেখল পবন তখনও আসেনি। মনে মনে বিরক্ত হল দিয়া। পবন তার জন্য ক্যাফের সামনে অপেক্ষা করবে এমনই একটা চাওয়া ছিল দিয়ার।  চাওয়াটা মিলল না ব’লে মন খারাপ হল।
করোনার আতঙ্ক কাটিয়ে মানুষজন অনেকটাই স্বাভাবিক। রাস্তায় লোক চলাচল দেখে মনে হচ্ছে না পৃথিবীর ওপর দিয়ে কত বড় একটা বিপর্যয় নেমে এসেছিল! সেই হাঁকডাক,গাড়ির হর্নের আওয়াজ, চলতে চলতে মোবাইলে কথা বলা সব একইরকম আছে। কেবল সাবধানী মানুষগুলোর মুখে রঙবেরঙ-এর মাস্ক অতীতের বিকেলগুলো থেকে আলাদা করে দিয়েছে আজকের বিকেলটাকে। দিয়ার আনমনা ভাবটা ছিঁড়ে দিল একজন ঢ্যাঙা মানুষ। মুখে সাদা মাস্ক পরে একজন তার দিকেই তাকিয়ে কিছু একটা ইশারা করল।
দিয়ার পিত্তি জ্বলে গেল। আশ্চর্য!  একা একটা মেয়েকে দেখলেই…..
লোকটা মুখের মাস্কটা নামিয়ে বলল “শুনতে পাচ্ছেন না? কতোক্ষণ ধরে বকেই চলেছি। রাধে আমাকে পাঠিয়েছে।”
দিয়া অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল “রাধে কে? আপনি কী বলছেন কিছু বুঝতে পারছি না। আপনি মনে হয় অন্য কারো সঙ্গে আমাকে গুলিয়ে ফেলেছেন।”
“কিচ্ছু গুলোয়নি। আপনিই তো মিস সুনয়নী বিশ্বাস? ফেসবুকের প্রোফাইলে বিশ্বাস সুনয়নী?”
“হ্যাঁ। আপনি কী করে জানলেন? আমার ফ্রেন্ডলিস্টে আছেন না কি?”
পুরুষমানুষটি হাসল। “অত সৌভাগ্যের অধিকারী আমি নই ম্যাডাম। সামান্য ফলোয়ার আমি।”
মোটা গোঁফের তলা থেকে হাসিটা দেখে মনে মনে মুগ্ধ হল দিয়া। ছেলেটির গজদাঁতদুটো স্পষ্ট দেখতে পেল।
“সে না হয় বুঝলাম। কিন্তু রাধে কে? ও নামে তো আমি কাউকে চিনি না।”
“শালা পবন আপনাকে বলেনি ওর ডাক নাম রাধে!”…..  বলেই দাঁত দিয়ে জিভ কাটল মানুষটি। আবার গজদাঁতদুটো প্রকাশিত হল।
চোখ সরিয়ে নিল দিয়া।
“চলুন ভেতরে গিয়ে কফি খেতে খেতে বাকি কথা বলি।”
“আশ্চর্য ! আপনার সঙ্গে খামোখা কফি খেতে যাব কেন? আপনি কে সেটা তো আগে বলুন!”
“আমি দেবদীপ ব্যানার্জি।  ‘হৃদকমল’-য়েই থাকি। বি-এর পাঁচতলায়। রাধে মানে পবনের বন্ধু আমি।”
দিয়া দ্রুত  মাথা খাটাচ্ছিল। হৃদকমলে থাকে!অথচ গজদন্তকে জীবনেও দ্যাখেনি ! আশ্চর্য!  কতো প্রোগ্রামে কমপ্লেক্সের বাসিন্দারা একসঙ্গে জড়ো হয়েছে,তখনও দ্যাখেনি! বান্টির বিয়েতে, আরিয়ানের জন্মদিনে, মিসেস দত্তগুপ্তের নাতনির অন্নপ্রাশনে এই মুখ, এই হাসি কীভাবে অনুপস্থিত থাকতে পারে একই আবাসনের বাসিন্দা হয়েও!
“অত কী ভাবছেন ম্যাডাম ! চলুন ভেতরে গিয়ে কফি খেতে খেতে কথা বলি। পবন আসতে পারবে না। গোডাউনে মালের হিসেব মেলানোর কাজে ব্যস্ত রয়েছে। আপনার জন্য একটা গিফ্ট পাঠিয়েছে। ও নিজেই গিফ্টটা আপনার হাতে দিয়ে চেয়েছিল। কিন্তু কাজে ফেঁসে গেছে। “
খুব বিরক্ত হল দিয়া। আজ সকালেও পবনের সঙ্গে তার কথা হয়েছে। কিন্তু আসতে পারবে না সেটা যে কেন জানালো না! ছেলেটার হাতে একটা বেশ বড়সড় প্যাকেট। দিয়ার মনে হল প্যাকেটের মধ্যে শাড়ি আছে।
ক্যাফের ভেতর ঢুকে মুখোমুখি বসল ওরা। অনেকেই কফি খাচ্ছে। তবে গল্প করছে বেশি। মানুষ বহুদিন ঘরে আটকে থেকেছে তাই মুক্তির স্বাদ পেয়ে একটু বেশিই উচ্ছ্বল হয়ে উঠেছে।
কফি এল। ফিশ অ্যান্ড চিপসও।
কী যে বলবে দিয়া বুঝতে পারছে না। প্যাকেটটা দেবদীপের কফি মগের পাশেই রাখা।
“আপনি ছবির চেয়েও সুন্দর।” দেবদীপ দিয়ার দিকে তাকিয়ে কথাটা বলল।
 “গতমাসের পাঁচ তারিখে আপনার জন্মদিন ছিল ; তাই না?”
“হ্যাঁ।” দিয়াও সরাসরি তাকাল দেবদীপের দিকে।
“কিন্তু আপনি ওইদিন যে ছবিটা পোস্ট করেছিলেন,সেটা তো জন্মদিনের ছবি ছিল না!”
“ঠিক কী বলতে চাইছেন বুঝতে পারছি না।’ দিয়া সামনে ঝুঁকে পড়া চুলগুলোকে হাত দিয়ে ফুলিয়ে ঠিক করতে করতে বলল।
“বলছি যে ওইদিন আপনি একটা হলুদ রঙের শাড়ি পরেছিলেন,সম্ভবত লাল পাড়। সন্ধেবেলায় কেক কেটে ফুঁ দিয়ে মোমবাতি নেভাচ্ছিলেন। আপনার ফুঁয়ের খুব জোর। আর কাউকে লাগেনি। অতগুলো মোমবাতি আপনি একাই নেভালেন! সেদিন একটা নীল রঙের শাড়ি পরা ছবি পোস্ট করে লিখলেন– জন্মদিন।”
দিয়া না হেসে পারল না। “আপনি এত তথ্য পেলেন কোথায়?”
“আমার ঘরের জানলা দিয়ে আপনাদের বসার ঘরটা খুব স্পষ্ট দেখা যায় কি না!”
“কিন্তু আপনাকে তো কোনোদিন দেখিনি হৃদকমলে!”
“কী করে দেখবেন? পবনের মত টমেটোসুলভ চেহারা নয় যে! আর অত টাকাও নেই।  একটা বেসরকারি ফার্মে চাকরি করি। মাইনে খারাপ নয়। নিজের অবস্থানটাও বেশ ভালো। লকডাউনে চাকরি চলে যায় নি।”
“এসব কথা আমাকে বলছেন কেন? আমি কী শুনতে চেয়েছি?”
“না শুনতে চাননি। তবে মনে হল বলি। পবনের মতো টুকটুকে ফর্সা নই বলে কেউ আমার কথাও শুনতে চায় না ম্যাডাম।”
এবারে শব্দ করে হেসে ফেলল দিয়া।
“আপনাকে গম্ভীর থাকলেই বেশি মানায়।”
নিজের ঝাঁকড়া চুলে বিলি কেটে দেবদীপ দিয়াকে বলল ” আপনি তো বিরিয়ানি খেতে খুব ভালোবাসেন!”
অবাক হয়ে গেল দিয়া। “এটাও জানেন? কী করে জানলেন? বন্ধু বলেছে?”
ফলোয়ারদের কাছে সব খবর থাকে। তা যা বলছিলাম সারাজীবন গাট্টে কি সবজি, মেথি আলু,ব্যাগন ভর্তা,মশালা গোবি,মূলি পরাঠা খেয়ে থাকতে পারবেন? অবশ্য প্রেমে মানুষ কিই না পারে! আর সামান্য মাটন বিরিয়ানি,
কাবাব,মেটে ফ্রাই,চিকেন তেহারি, চিংড়িমাছের মালাইকারি,লটে মাছের ঝুরো, ইলিশ পাতুরি,,কাঁচা টমেটো দিয়ে মৌরলামাছের চচ্চড়ি….ছেড়ে থাকতে পারবেন না!”
বিষম খেল দিয়া। কাশতে কাশতে বলল “কী করছেন বলুন তো! আমার পছন্দের খাবারের নামগুলো শুনতে শুনতে নালেঝোলে একাকার হয়ে গেলাম তো! আপনি যে কী করেন না!” মুর্শিদাবাদ সিল্কের আঁচলটা মুখে চাপা দিল দিয়া।
দেবদীপ দিয়ার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে বলল তবে “লালির যে কি হবে কে জানে!”
“আপনি লালির কথাও জানেন?” চোখ বড় বড় করল দিয়া।
“সুনয়নী নামটা সার্থক কিন্তু।”
“ওসব ছাড়ুন। এবার বলুন লালির কথা আপনাকে কে বলেছে? পবন?”
“হ্যাঁ। আমি নিজের চোখেও দেখেছি। ছাদে আপনার পায়ে পায়ে ঘোরে। তবে ধবধবে সাদা রঙের বিড়ালের নাম লালি এটা মানা যায় না। লালির নামের প্রতি আপনারা সুবিচার করেননি।
আপনার নিজের নামটাও তো নষ্ট হতে চলেছে।”
“মানে!” দিয়া উত্তেজিত হয়ে বেশ জোরে বলে ফেলল কথাটা। ও সাধারণত অত উঁচু গলায় কথা বলে না।
“মানে কদিন পর সুনয়নীর পাশে খেড়িয়া শব্দটা বসবে তো! সুনয়নী খেড়িয়া। ” দেবদীপ কেটে কেটে উচ্চারণ করল নামটা।
অথচ চৌধুরি,মুখার্জি,সেনগুপ্ত,সিনহা, দত্ত,
বন্দ্যোপাধ্যায়, ভৌমিক, বাসু,… কতো সুন্দর সুন্দর টাইটেল ছিল!  তাই না!” ডান হাতের মধ্যমা আর বুড়ো আঙুলটা দিয়ে দেবদীপ তার মোটা গোঁফের ওপর একবার কায়দা করে হাত বুলিয়ে নিল।
“উফ্!  আপনি না একেবারে যা তা… “
দিয়ার কথার উত্তরে আবার সেই মারাত্মক গজদন্ত হাসি।
“তা যা বলেছেন! আমার মাও তাই বলেন। আমি না কি একটা যা তা! তবে আমি পবনের দাদির মত নিষ্ঠুর নই।”
দিয়া মুখটা দেবদীপের দিকে ঝুঁকিয়ে একটু নিচুস্বরে বলল “কেন? দাদিজিনে ক্যায়া কিয়া?”
“তেমন কিছু না। একদিন লালি ভুল করে পবনদের ফ্ল্যাটে ঢুকে পড়েছিল। তখন পবনের দাদি মছলিখোর বোলকে লালিকো এক লাথ মারা।”
“কি! এত বড় কথাটা পবন আমাকে বলেনি!” উত্তেজনায় টান টান হয়ে বসল দিয়া।
“এত সাহস। আমার লালিকে লাথি মারে!”
দেবদীপ টেবিল থেকে স্যানিটাইজারের বোতল থেকে একটু খানি লিক্যুইড নিজের হাতে নেয়,দিয়ার হাতেও ঢেলে দেয়। হাত দুটো ঘষতে ঘষতে বলে “ছাড়ুন না। দাদি মাত্র একবারই তো ভুল করেছেন। আর বিড়াল তো মাছ খাবেই!  তাই না! আপনি না হয় পবনের জন্য আমিষ ছাড়বেন,লালি কী সেটা পারবে!”
চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়াল দেবদীপ।
“এবার আমাকে বেরোতে হবে। একটা কাজ আছে।পবন এসএমএসের পর এসএমএস করেই যাচ্ছে। গিফ্টটা দিয়েছি কি না দশবার জিজ্ঞেস করা হয়ে গেল।”
দাঁড়িয়ে থাকা দেবদীপকে এখন আর তেমন ঢ্যাঙা লাগছে না। বরং তার দাঁড়ানোর মধ্যে একটা আত্মপ্রত্যয়ের ছাপ ফুটে উঠেছে। দেবদীপ প্যাকেটটা দিয়ার দিকে বাড়িয়ে দিল।
বলল “পবন বলেছিল বাঙালি মেয়েরা কি ধরনের গিফ্ট পছন্দ করে সে ব্যাপারে কোন আইডিয়া নেই তার। দেবদীপ যেন সাহায্য করে দেয়। পবনের টাকা,আমার পছন্দ।”
হাত বাড়িয়ে প্যাকেটটা নেয় দিয়া।  দেবদীপের আঙুলে দিয়ার আঙুলের স্পর্শ লাগে।
“অনেক ধন্যবাদ। “
“এখন নয়। গিফ্টটা খুলে দেখে তারপর আমায় ফোনে ধন্যবাদ জানাবেন।”
“কিন্তু ফোন নম্বর তো……”
“আপনারটা আমার কাছে আছে। পবন দিয়েছে।
আজকে আপনার সঙ্গে যোগাযোগের সুবিধার জন্য। আমি আপনাকে এসএমএস করে পাঠিয়ে দিচ্ছি আমার নম্বরটা।” দরজার দিকে এগোল দেবদীপ। দরজা না ঠেলে আবার ফিরে এল। বলল “আজকে কফির বিল আপনিই মিটিয়ে দিন। পরেরবারটা আমার।” সেই খুনখারাপি হাসিটা হেসে ক্যাফে থেকে বেরিয়ে গেল দেবদীপ।
দিয়া কাছের মার্কেটে ঢুকে টুকটাক কিছু দরকারি জিনিস কিনে সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরলো।
রাতে খাওয়াদাওয়ার পর ফোন চেক করতে গিয়ে পবনের মেসেজ দেখতে পেল। “গিফ্ট পছন্দ হয়েছে?”
গিফ্টের প্যাকেট খুলে একটা সাদা রঙের ঢাকাই শাড়ি পেল দিয়া। সঙ্গে একটা চিরকুট।
চিরকুটে মাত্র তিনটে বাক্য।
আপনার কাছে দুটো অপশন।
আন্ডা ,মছলি,মটন,
নেহি তো শাকাহারি বেচারা পবন।
দিয়া হাসতে শুরু করলো। হাসির আওয়াজ শুনে দিয়ার মা দরজার পর্দা সরিয়ে মেয়েকে একবার দেখে গেলেন।  দেবদীপের হোয়াটস অ্যাপে একটা মেসেজ করলো দিয়া। …ধন্যবাদ ভাই দেবদীপ। আপনি খুব মজার মানুষ। আপনাকে বেশ পছন্দ হয়েছে আমার।  পবনের দেওয়া গিফ্টটাও ভালো লেগেছে। তবে লাল আমার প্রিয় রঙ। পবন জানে। আপনাকে বলে দিলে ভালো করতো।
দেবদীপকে মেসেজটা পাঠিয়ে দিয়ে এবার পবনকে ফোনে ধরলো দিয়া….
“এই যে মিস্টার রাধে! নিজেকে খুব চালাক ভাবো তাই না! বেঙ্গলে এসে করে কম্মে খাচ্ছো তাতেও হচ্ছে না! বাঙালি মেয়ের সঙ্গে চালাকি করছো! আমি তোমাকে সত্যিই পছন্দ করি কিনা , বিয়ে করবো কিনা… এটা সরাসরি জিজ্ঞেস করলেই বলে দিতাম! দেবদীপবাবুকে মাঝখানে গুঁজে দিলে কেন?
মেয়েদের মনের ভাষা বোঝো না?
ওদিক থেকে জবাব এলো.. “বুঝি।  সারা জীবনের কাহানি আছে তো তাই ভালো করে যাচাই করিয়ে নিলাম।”
“যাচাই!!! বাহ্! বহুত বড়িয়া বাত বলেছো।  দশ মিনিটের মধ্যে ছাদে এসো একবার। কঠিন শাস্তি দেব।”
সাবিনা ইয়াসমিন রিংকু
পুকুরঘাট

পুকুরঘাট

একদিন আমরা মাত্র কয়েকজন সদস্য নিয়ে পুকুরঘাট নামের একটি মেয়েদের ভার্চুয়াল দল খুলে ছিলুম। অচিরেই সে কয়েকটি সদস্যের দল কয়েক হাজার সদস্যের মেয়েদের দল হয় ওঠে। পুকুরঘাট দলের মত এত গুণী মেয়েদের সমাহার বাংলাদেশে খুব কম ভার্চুয়াল দলে আছে। কাজেই সেই দল সেখানেই আটকে থাকবে না বলা বাহুল্য। তাই পুকুরঘাট দলের অন্যতম উদ্যোগ হিসেবে প্রকাশিত হলো পুকুরঘাট পত্রিকা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

26 thoughts on “হৃদকমল

  1. সাবিনা আমিষপ্রীতিকে প্রেমের বিরূদ্ধে জিতিয়ে দিলে মানতেই পারতাম না। শেষে এসে ধূম লেগে গেল হৃদকমলে।

    1. গল্পটা কি শেষ হয়ে গেল? আরো জানতে ইচ্ছে করছে যে!

  2. কি মিষ্টি গল্প! আমার প্রেম পাচ্ছে….

    1. কি যে ভালো লেখা… প্রেমে টৈ টম্বুর… ভাংচি তে প্রেমটা বুঝি কেঁচেই গেলো
      ভাবছি যখন, তখনই শেষটায় ভরিয়ে দিলে মনটা ❤️

  3. আমি হলে বলতাম দেবদীপকে গুঁজে দিয়েছো ঠিক আছে, কিন্তু চিকেন আমি খাবোই, তুমি ভালোবাসার খাতিরে এটার সঙ্গে adjust করে নাও।

    সাবিনাদেবী প্রেমকেই ভুবন বলিয়া জানিয়াছেন,আর কী করা?

  4. রান্নার গল্পের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত নয়, তবু খাওয়া দাওয়ার একটা ব্যাপার আছেই… কিন্তু তার ও উপরে আছে অমর প্রেম… যুগ যুগ জিও!

  5. যদি Deer লটারি টা লেগে যায় একবার, তাহলে এই কাহানী লেকে ম্যায় জরুর এক ফিলিম বানাউঙ্গী, একদম পাক্কা 👍 👍 👍
    কাস্টিং এ মুকুজ্জে গিন্নি র কন্যা টি তো লালীর রোলে থাকবে ই, আর দেবদীপ পেয়ে গেছি। খালি টমেটোর মত রাঙাটুকটুকে পবন কোথায় পাই তা ই ভেবে মরছি???? 🤔
    সুনয়না কে নিয়ে চিন্তা নেই, এখন কার মেক আপ আর্টিস্ট রা যা কে তা কে সুনয়না করে তুলতে পারে, এ বিশ্বাস আমার আছে 😂

  6. একদম সাবিনাদিদির মতোই মিঠে দখিনা বাতাসের মতো একটা গল্প।

  7. অমন সব খাবার দাবারের লিস্টি সাথে প্রেম আর কি চাই

  8. এতো ভালো লাগলো এত সুন্দর একটা প্রেমের গল্প তোমার শৈলীতে!! দুর্দান্ত🥰🥰

  9. কি যে বলি!দুরু দুরু বুকে ভাবছিলাম কি হয় কি হয়!
    যা হলো তা দারুণ

  10. ভাগ্যিস শেষটা ছিল….! নাহলে যে বড্ড বিশ্বাসঘাতকতা করা হত। নামকরণের সার্থকতা এখানেই, সঙ্গে তোমারও

  11. দুর্দান্ত গল্প। যেমন চলন তেমন বাঁক আর তেমনই শেষটা। খুন্তি আর কলমের প্রেম অক্ষয় হোক।💞💞💞

  12. উফফ কি লিখেছে সাবিনা দি! একদম ফাটাফাটি, চুমু😘

  13. মিষ্টি প্রেমের গল্প ৷ ভালো লাগল ৷

  14. বেশ গল্প। মিষ্টি টুইস্ট। মিলেমিশে মাখন টেক্সচার।

  15. আমাকেও তো ফলোয়ার করে রেখেছো। ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট টা কবে গ্রহণ করবে?

  16. মিষ্টি প্রেমের গল্প। লক ডাউন প্রেম জমে গেছে বেশ☺️