মেয়েলি ভাষায় জবাব

মেয়েলি ভাষায় জবাব

 

সুমিত্র বন্দ্যোপাধ্যায়

 

-পাবদা না ,ইলিশ। সরষে ইলিশ। বড়দা, সর্ষে ইলিশটাই পছন্দ ছিল আপনার ভাইয়ের।

চক্রবর্তী বাড়ির কেউ ভ্রু কুঁচকে, কেউ চোখ বড় করে, কেউ আবার ঠোঁট উল্টিয়ে দেখছিল মেজো বউ দীপ্তিকে।বলা ভালো মাপতে চাইছিলো। বড় ভাসুর, মেজ ননদ, একমাত্র ভাগ্নে, ছোট জা এবং আরো অনেক নিকট আত্মীয়স্বজন।

-মাথাটা একেবারেই গেছে।
-মেজদার চলে যাওয়াটা এখনো নিতে পারছে না।
-সময় লাগবে, এতদিনের সংসার।
-তাই বলে বরের শ্রাদ্ধ আর নিয়মভঙ্গের মেনু ঠিক করবে সদ্য বিধবা!
-গত দেড় বছরের ধকলটা দেখ।

 

এইসব টুকটাক ফিসফাস চলছিল চক্রবর্তী বাড়ির আত্মীয়দের মধ্যে। তিন ভাইয়ের মধ্যে মেজ ছিল মনুজেন্দ্র।বড় ভাই ও বড়দি আদর করে ডাকতেন মনু। মনুর পার্থিব দেহ,সৎকারের দু’দিন পরে,বিকেলবেলা পরিবারের সবাইকে মনুর বাড়িতেই ডেকেছিলেন সবিতেন্দ্র। উদ্দেশ্য ছিল,মেজ ভাইয়ের পারোলৌকিক কাজকর্মের আয়োজন করা ও তাই নিয়ে পরিবারের সকলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা।

-মেজ বউমা, আমাকে একটু চা করে খাওয়াতে পারো?
বড় ভাই অনুরোধের সুরে বললেন মেজো বৌমা দীপ্তিকে।আসলে এই সুযোগে, বাড়ির মেজ বউ কে তিনি নিয়মভঙ্গের মেনু ঠিক করার আলোচনা থেকে সরাতে চাইছিলেন।উপস্থিত সকলে সেটা বুঝতে পারলো, দীপ্তি ও। মুখে অখুশি হওয়ার অভিব্যক্তি থাকলেও মনে -মনে আনন্দই পেয়েছিল দীপ্তি। বলেছিল,
-আমি? আচ্ছা বেশ,চা করে আনছি। তারপরে কিন্তু মিষ্টি কী কী হবে ফাইনাল করবেন।

-কি বলছিস কী মেজো?
একমুখ বিরক্তি নিয়ে ধুমকে উঠেছিল বড় ননদ, মানে মনুর বড়দি ।
শ্বশুর বাড়ির সব নিকটজনের চোখেমুখে বিরক্তি উষ্মার প্রতিফলন দেখতে পেয়ে মনে- মনে একটু তৃপ্তির স্বাদ পেল দীপ্তি। রান্নাঘরে চায়ের জল বসিয়ে পাশের জানালা দিয়ে বাইরেটা দেখছিল দীপ্তি। প্রতিদিনের মত একটা পাখি সামনের কার্নিশে বসে আপন মনে নিজের ভাষায় দিকে যাচ্ছে। কি স্বাধীন সে ডাক! মনুজেন্দ্রর মৃত্যুর খবরটা সব আত্মীয়দের মধ্যে শোক বার্তা হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই স্বাধীনতা শব্দটা মুছে যাচ্ছিল দীপ্তির জীবন থেকে।

-এই কটা দিন সাদা শাড়ি পর মেজ। রাতেও ম্যাক্সি -ট্যাক্সি নয়।
-বৌদি তুমি কি হবিষ্যি পাটকাঠি জ্বেলে করবে না গ্যাসেই…
-এই ক’দিন না হয় টিভি নাইবা খুললে, মেজদি ।

দীপ্তির মনে হচ্ছিল সহানুভূতি ও সান্ত্বনার নিগড়ে সে যেন আটকে পড়ছি। গত দেড় বছরে তিলে -তিলে, ধীরে -ধীরে গড়ে ওঠা তাঁর নিজের স্বাধীন পৃথিবীটা যেন হারিয়ে যাচ্ছে। দেড় বছর আগে,বিবাহিত জীবনের প্রথম সাড়ে তেত্রিশ বছর যখন মনুর সঙ্গে তালে -তাল মেলাতে গিয়ে থরথর করে কেঁপেছে, চোখের জলে, নাকের জলে একাকার হয়েছে দিনের পর দিন,তখন শ্বশুরবাড়ি, বাপের বাড়ির নিকট আত্মীয়রা জপো মন্ত্রের মতো কানের কাছে শুধু বলে গেছে- ‘অ্যাডজাস্ট, অ্যাডজাস্ট করো ‘ ।

দেড় বছর আগে জটিল স্নায়ু রোগ ও পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হয়ে প্রায় ভেজিটেবিল হয়ে গেল মনু। সেই পর্যন্ত, ষাট ছুঁই-ছুঁই দীপ্তির জীবন ছিল শুধু ‘অ্যাডজাস্ট’ ভরা। গত কয়েকদিনে সেই অভ্যেস ফিরে ফিরে আসছে দেখে নিজের উপরই রাগ হচ্ছিল দীপ্তির। সবচেয়ে রাগ হয়েছিল, মনুর সৎকারের পরদিন সকালে যখন বড় জা ফতোয়া দিয়ে বললেন,
-এই ক’দিন সালমাকে ছুটি দিয়ে দাও। কাজ মিটলে বাড়িতে ঢুকিও।

সিদ্ধান্তটা মেনে নিলেও মন থেকে মানতে পারেননি দীপ্তি।আজকের ঘরোয়া সভাটা তাই তাঁর কাছে ছিল নিজের গলার স্বর, মুখের ভাষা ফিরে পাওয়ার লড়াই।মনে মনে সংকল্প করেছিল কারুর ধ্বনির-প্রতিধ্বনি হবে না সে।গত দু’ ঘণ্টা সেই চেষ্টাই করে গেছে এবং মোটামুটি সফল হয়েছে। চায়ের জল ফোটাতে- ফোটাতে একটা তৃপ্তি অনুভব করছিল দীপ্তি,মুক্ত হওয়ার তৃপ্তি।উল্টোদিকের বাড়ির কার্নিশে বসা ছোট্ট পাখিটার মতো নিজের আওয়াজ ছড়িয়ে দেওয়ার যে স্বাধীনতা তার তৃপ্তি , ইচ্ছেমত আকাশের দিকে উড়ে যাওয়ার যে মুক্তি তার অনুভব। এই মুক্তির স্বাদ,দীপ্তি প্রথমবার অনুভব করেছিল অসুস্থ হয়ে ঘরে বন্দী হয়ে যাওয়ার তিন মাস পরে। সেদিন সে, হাতা কাটা ব্লাউজ পরে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে ছিল, জীবনে প্রথমবার।

বিয়ের পরে সাড়ে তেত্রিশ বছর একা একা খুব বেশি বাড়ির বাইরে যায়নি দীপ্তি বা বলা ভাল যাবার অনুমতি ছিল না। সঙ্গে সব সময় মনু থাকত এবং বলে দিত কেমন হবে পোশাক-পরিচ্ছদ ও কথাবার্তার ধরন- ধারণ। হাতাকাটা ব্লাউজে বউ রাস্তায় বেরোলে দুনিয়ার লোকের ‘খারাপ নজর’ পড়বে বলেই ধারণা ছিল মনুর। অসুস্থতার পরে, চলাফেরার শক্তি, কথা বলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিল মনু। বেশি রাগ বা ক্ষোভ হলে, আগের মতো হাত চালানোর শক্তি ছিল না। গোঁ-গোঁ আওয়াজ করতো আর মুখ দিয়ে থুতু ছুঁড়ত দীপ্তিকে উদ্দেশ্য করে।

দীপ্তি উপভোগ করত সেই থুতু ছোঁড়া।চলচ্ছক্তিহীন মনুকে মুখে কিছু না বলে কোন একটা কাজের মধ্যে দিয়ে জবাব দিত। একদিন বাজার দোকান সেরে বাড়ি ফিরতে একটু বেশি দেরি হওয়ায়, ঘরে ঢুকে কাছে যেতেই, থুথু ছুঁড়েছিল মনু। দীপ্তি কোনো প্রতিবাদ না করে; নিঃশব্দে বাথরুমে গিয়ে স্নান সেরে নেয় আর তখনই ভেবে নেয় কীভাবে দেবে এই থুতুর জবাব।

নতুন হাতা কাটা ব্লাউজ পরে, মনুর কাছাকাছি যায়নি, দূর থেকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। দেখেছে, রাগে থর -থর করে কাঁপছে মনু,এক জায়গায় বসে যতদূর সম্ভব থুথু ছুঁড়ছে । ঘর্ঘরে গলায় গর্জে যাচ্ছে।

সুপার মার্কেটের একটা -একটা করে সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠতে উঠতে সেদিন দীপ্তির মনে হয়েছিল সে যেন পাখি হয়ে আকাশের দিকে উঠে যাচ্ছে। ব্লাউজের কাটা হাতায়, দুটো ডানা যেন কেউ জুড়ে দিয়েছে। অনভ্যাসের জন্য অস্বস্তিও হচ্ছিল প্রথমে। মনে হচ্ছিল হয়তো মনুর কথাই ঠিক,দুনিয়ার লোক তাকে দেখছে।তারপরে যখন চারপাশে ঘুরে বেড়ানো আঠেরো-উনিশের মেয়েদের লক্ষ্য করেছে। একটা সুতোর মতো অবলম্বনে আটকে থাকা টপ জামা পরে, ঘুরছে তারা, পিঠ খোলা অথচ কি স্বাভাবিক, কি স্বতঃস্ফূর্ত! তখন সমস্ত অস্বস্তি উধাও হয়ে গেছে । সুপার মার্কেট, মল, বাজার, জামা কাপড়ের দোকান চষে বেরিয়েছে বেশ কয়েক ঘন্টা। বেশি হাঁটাহাঁটি করার, সেদিন একটা সময় কোমরের নীচ থেকে প্রাচীন ব্যথাগুলো জেগে উঠে জানান দিতে শুরু করেছিল।পূর্ণ যৌবনে, মনুর ক্ষোভ, রাগ, সন্দেহ অথবা ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ হতো দীপ্তির কোমরের নীচে কখনো শরীর দিয়ে আবার কখনো বেল্ট, লাঠি, রড, স্কেল কিম্বা অন্যকিছু দিয়ে । বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে, সেইসব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গেরা, সামান্য অনিয়ম বা অতিরিক্ত পরিশ্রম হলেই দীপ্তিকে জানান দেয় ফেলে আসা দিনগুলোর কথা।

সেদিন, দীপ্তি ঠিক করেছিল বাড়ি ফিরে সালমাকে দিয়ে পা- কোমর মালিশ করার।সালমা, বাড়িতে কাজে যোগ দিয়েছিল শ্যামা হয়ে।একদিন সালমা, নতুন নম্বরে ফোন করায় ট্রু কলারে ওঠে আসল নাম। বকাঝকা করতে গিয়েও, শেষ পর্যন্ত করেনি দীপ্তি। মেয়েটার অসহায়তা অনুভব করেছিল। হয়তো নিজের অসহায়তাও।রান্না ঘরের খুন্তি বাটি থেকে ছাদে ফুলের টবের মাটি,সব বিষয়ে দীপ্তির একমাত্র অবলম্বন সালমা। অসুস্থ মনুকে হাতে পায়ে ভালো করে তেল মাখিয়ে,মালিশ করে চান করিয়ে দেয় সালমা। সেই সময় বেশ চনমনে লাগে মনুজেন্দ্রকে।

-তুই কি মাসাজ পার্লারের কাজ করতিস?
-কেন বৌদি?
-এত পাকা হাতে মালিশ করিস দেখি, তাই…
-কি যে বল বৌদি!

সালমার মালিশবিদ্যা রপ্ত হওয়ার পেছনে প্রকৃত রহস্য অন্তরালেই ছিল বহুদিন । তবে, মুচকি -মুচকি হাসিতে সালমা বুঝিয়েছিল ভেতরে অন্য গল্প আছে। অন্তত , সেরকমই মনে হয়েছিল দীপ্তির।

সালমার বিয়ে হয়েছিল আব্দুল এর সঙ্গে। পরপর মেয়ে হচ্ছিল বলে হতাশা বাড়ছিল আব্দুলের,সঙ্গে নেশা ও নানারকম অন্য চক্কর। মেয়েদের লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করবেই পন করেছে সালমা। স্কুলের হোস্টেলে রেখে এসেছে তাঁদের। বাড়ি বাড়িঅ দীপ্তি কাজ করে মেয়েদের পড়ার খরচ চালাতে। দীপ্তির কাছে আসার পরে অবশ্য এক বাড়িতেই সারা দিন কেটে যায়।

বাড়ির সামনে,গলির ভেতর নিজের সাইকেল ভ্যানে পাশ ফিরে শুয়েছিল আব্দুল । হাতাকাটা ব্লাউজে প্রথমদিন পাখি হয়ে দোকানে বাজারে ঘুরে ঘুরে বাড়ি ফেরার পথে, অসময়ে আব্দুলকে দেখে অবাক হয়েছিল দীপ্তি। আব্দুল তড়িঘরি করে উঠে বসে বলেছিল ,
– বৌদি, ভালো আছেন?
-হ্যাঁ, তুমি এই সময়?

সাধারণত সন্ধ্যেবেলার দিকে এসে সালমাকে সাইকেল ভ্যানে চাপিয়ে নিয়ে যায় আব্দুল। ভরদুপুরে তাঁকে দেখে কিছুটা অবাকই হয়েছিল দীপ্তি। আব্দুল জানিয়েছিল,

-সালমা, এনায়েত মিয়াঁর রক্ত পরীক্ষা করতে দিয়েছে। পরীক্ষার কাগজ নিয়ে বাড়ি ফিরবে, তাই।

আর কথা না বাড়িয়ে চলে গিয়েছিল বাড়ির ভেতরে। আশ্চর্য বৈপরীত্যে ভরা এই আব্দুল, যত দেখে ততই অবাক হয়। সালমার সব বিষয়ে প্রচুর খেয়াল রাখে। আবার ছেলে হচ্ছিল না বলে একদিন কথা কাটাকাটির সময়, তালাক দিয়ে দেয় সালমাকে। কয়েকদিন পরেই আবার,তালাক দেওয়া স্ত্রীকে ঘরে ফিরিয়ে আনার কি বিধান ব্যবস্থা আছে ধর্মে আইনে, তার খোঁজ খবর নেওয়া শুরু করে আব্দুল। সেই উদ্দেশ্যেই বৃদ্ধ এনায়েতের সঙ্গে ‘হিল্লা’ বিয়ে করিয়েছে সালমার। এই বিয়েতে, মুখে মুখে চুক্তি ছিল,বৃদ্ধ এনায়েত সালমাকে বিয়ে করেই তালাক দেবে এবং আব্দুল আবার বিয়ে করবে তার প্রাক্তন বিবিকে। এদিকে সালমা মুগ্ধ বৃদ্ধ এনায়েত মিয়া এখন বেঁকে বসেছে। তালাক দিতে চায় না। আব্দুল খুন করার ভয় দেখালেও ভয় পায় না। সালমাকে পেয়ে আপাতত মৃত্যুচিন্তা মুছে গেছে এনায়েতের জীবন থেকে। সালমাও আপ্রাণ চেষ্টা করছে, এনায়েতের বেঁচে থাকার মেয়াদটা,সেবা-শুশ্রূষা ও ভালোবাসায় যতটা সম্ভব বাড়ানোর। আব্দুল এর কাছে ফিরে যাওয়াটাও যতটা সম্ভব বিলম্বিত করা যায়। যত বিলম্ব হবে, আব্দুলও সালমার প্রেমে গদগদ হয়ে থাকবে। ফিরে গেলে আবার যে কে সেই!

বাড়ি ফিরে দীপ্তি সেদিন দেখেছিল মনু খেয়ে দেয়ে ঘুমোচ্ছে। সালমা ব্যাগ পত্র গুছিয়ে তৈরি হচ্ছে চলে যাবে বলে। এক মুখ কালো মেঘ নিয়ে সালমা বলেছিল,

-বৌদি সামনের সপ্তাহে আমার ক’দিন ছুটি চাই। দিন দশেক আসা হবে না।
-কেন রে?
-ওনাকে মনে হচ্ছে হাসপাতলে ভর্তি করাতে হবে।
-কেন? কি হয়েছে এনায়েত ভাইয়ের?

সালমা, গুছিয়ে বলার চেষ্টা করে কিন্তু সুবিধে করতে পারেনা।এনায়েতের ডাক্তারি কাগজপত্র দেখায় দীপ্তিকে। দীপ্তি পড়ে বুঝতে পারে প্রস্টেটের অপারেশন হবে এনায়েতের তাই নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা দিয়েছেন ডাক্তার বাবু। মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে দীপ্তি। যা আগে তাঁর পক্ষে ছিল কল্পনার অতীত।

-একতলার ঘরগুলো খালি আছে। অপারেশনের পরে পুরো সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত এ বাড়িতেই থাকিস তুই আর এনায়েত ভাই।

-কিন্তু বৌদি…
-বললাম তো। যা এখন ভাত বার , আমি স্নান সেরে আসছি।
-আব্দুল যদি রাজি না হয়, মানে কিছু করে।
-কী করবে? পেটাবে?গুন্ডা আনবে? আমি আছি না।

‘আমি আছি না’ শব্দগুলো উচ্চারণের সময় একটা অদ্ভুত আত্মবিশ্বাস অনুভব করেছিল দীপ্তি। কিভাবে এই আত্মবিশ্বাস অর্জন করেছিল তা নিজেও ভালোভাবে জানে না।মনু, আকস্মিক অসুস্থতার মধ্যে না পড়লে এই আত্মবিশ্বাস শব্দটার সঙ্গে কোনদিন পরিচয় হতো কিনা সন্দেহ!

সেদিনই দীপ্তি খেয়াল করেছিল, ড্রয়ারে রাখা সিগারেটের প্যাকেট সিগারেট প্রায় শেষ। হাসপাতলে ভর্তি হওয়ার আগের দিনে তিন -চার প্যাকেট সিগারেট লাগত মনুর। পাইকারি দোকান থেকে একসঙ্গে অনেক প্যাকেট এনে ঘরে রাখা থাকতো। যখন ডাক্তার সিগারেটের সুখটান এর মতো অনেক কিছুই মনুর জীবন থেকে চিরতরে মুছে ফেলার বিধান দিলেন তখন একবার দীপ্তি ভেবেছিল ছোট দেওরকে বলবে বাকি প্যাকেটগুলো নিয়ে যেতে। প্রায় পনেরো প্যাকেট তখনও রয়েছে। কিন্তু অসুস্থ দাদার সাধের জিনিস ভাইকে নিতে বলাটা ঠিক হবে কিনা বুঝতে পারেনি সেদিন । শেষমেষ ভেবেছিল ফেলেই দেবে নয়তো সালমাকে বলবে আব্দুলকে দিয়ে দিতে। তারপর একদিন নিজেই একটা প্যাকেট নিয়ে, তা থেকে সিগারেট বার করে বাথরুমে চলে যায়।ধরাতে গিয়ে কেশে -টেশে অস্থির হয়েছিল সেদিন। একদম ভালো লাগেনি। কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে সেই না ভালো লাগাটাই কয়েক মাসে অভ্যেস হয়ে গেল দীপ্তির। তবে তা বাথরুমেই সীমাবদ্ধ ছিল। সপ্তাহে দু’ তিনবার কখনো সখনো দিনে দু’বার। তারপরে রুম ফ্রেশনার ছড়িয়ে দিতে হতো।

আজকাল মেয়েরা অনেকেই সিগারেট খায় প্রকাশ্যে। তবে দীপ্তির সাহসে কুলোত না বাথরুমের বাইরে এসে সিগারেট ধরানোর। যদি কেউ দেখে ফেলে বা ধোঁয়ার গন্ধ পায়।একদিন কোন একটা তুচ্ছ কারণে মনু খুব থুতু ছুঁড়ছিল। ওষুধ খাওয়ানোর সময় মনুর গায়ে একটু জল পড়ে গিয়েছিলো বোধায়। দীপ্তি, ঠিক করলো একটা কড়া জবাব দিতে হবে। সিগারেট নিয়ে এসে মনুর সামনেই ধরিয়ে ছিল সেদিন। রক্তবর্ণ হয়ে গেছিল মনুর মুখ, দু’চোখ জুড়ে ছিলো বিস্ফোরণ। চোখের পাতা পড়ছিলো না।

সালমা সেদিন দেখে ফেলেছিল। বৌদিকে এভাবে দেখে সামান্য অবাক যে হয়নি তা নয়। দীপ্তি সিগারেটের কাউন্টার এগিয়ে দিয়ে সালমাকে বলেছিল,
-খাবি?
সালমা প্রথমে লজ্জায় অস্বস্তিতে গুটিয়েছিল তবে আজকাল অবশ্য ইচ্ছে করলে নিজেই চেয়ে নেয়। এক সময় মনুর সারাদিন সিগারেট খেয়ে চলাটা ঘোর অপছন্দের হলেও মুখ ফুটে কিছু বলতোনা দীপ্তি, ভয় পেতো। দীপ্তির, এখন যে সিগারেট খুব ভালো লাগে তা নয় কিন্তু মনুকে দেখিয়ে দেখিয়ে সুখ টানটা খুব উপভোগ করে। মনুর প্যাকেটগুলো নিঃশেষিত হলে পাড়ার দোকান থেকে সিগারেট কিনে আনা সম্ভব ছিলনা দীপ্তি কিম্বা সালমার পক্ষে। সালমাই তখন এই কাজে আব্দুলকে ব্যবহারের বুদ্ধিটা বার করে। আব্দুল মনুর গুরুতর অসুখের কথা জানত না।তাই মনুর প্রয়োজনের কথা জানিয়ে সিগারেট আসতে শুরু করে বাড়িতে। তারপর নামিদামি দোকানের যাবতীয় শখ-আহ্লাদের জিনিস, খাবার-দাবার। কৃপণ মনু, সুস্থ থাকার সময়, যে সব সখ-আহ্লাদেরা ছিল কল্পনাতীত।

দীপ্তির জীবনে এই অপ্রত্যাশিত স্বাধীনতা উদযাপন এর একমাত্র নিত্য সঙ্গী হয়ে ওঠে সালমা। মনুর নাম করে,আব্দুলের হাত ঘুরে,এই উদযাপনের অনুষঙ্গ হিসেবে ঠান্ডা বীয়ার -এর বোতলও দু’ তিন দিন বাড়িতে এসেছে। সাড়ে -তেত্রিশ বছর দাম্পত্যে ক্ষতবিক্ষত হওয়ার পরে জীবনটা হঠাৎ রূপকথার মতোই হয়ে উঠেছে দ্বীপ্তির কাছে, গত দেড় বছরে।

প্রথম প্রথম আলগা আলগা, আলতো মালিশ করে দিত সালমা। তারপরে, যত দিন এগিয়েছে, দীপ্তির সর্বাঙ্গ উন্মুক্ত হয়েছে সালমার কাছে। সালমার স্পর্শে তাঁর মনে হয়েছে সে যেন বার্ধক্যের নয়, দাঁড়িয়ে আছে যৌবনের প্রবেশ দ্বারে। সালমার আঙুলের স্পর্শে স্পর্শে প্রেম। এই স্পর্শ সে কীভাবে শিখল তা সঠিকভাবে বলতে না পারলে এর পেছনে যে বৃদ্ধ এনায়েতের অবদান আছে সেকথা জানায় সালমা।

‘হিল্লা’ বিয়ের নিয়ম অনুযায়ী সহবাসের অধিকার আছে এনায়েতের কিন্তু বয়স বড় বালাই। স্নেহ-ভালবাসা, মমতা মাখা স্পর্শেই সে প্রতি রাতে জাগিয়ে তোলে, বাঁচিয়ে রাখে সালমার শরীর আর নিজের যৌবন।

আজকাল দ্বিতীয় অনুভব করে একটা শরীর ছিল আজীবন জেগে ওঠার অপেক্ষায়, স্নেহ ভালবাসার স্পর্শ মাখতে মাখতে। তেল মালিশের দুপুরবেলায়, দীপ্তি ও সালমা দুজনেরই ইচ্ছে হয় আরো নিবিড়ভাবে আলিঙ্গন করতে, আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে পরস্পরকে আঁকড়ে ধরতে কিন্তু শেষ মুহূর্তে দুজনের শ্রেণী ও সমাজ এসে বাঁধা তৈরি করে দুজনের মগজে, মনে ও শরীরে।শরীরে শরীরে স্পর্শে স্পর্শে দুপুরবেলা গুলো একটা ভালোলাগার একটা ভালবাসার পৃথিবী গড়ে উঠেছে ধীরে ধীরে। যা দুই মহিলার একান্ত নিজস্ব জগৎ।

পুনে থেকে মেয়ে জামাই এলে, কয়েকদিন থেকে আবার চলে যাওয়ার সময় দীপ্তির অভিমান হতো। আরো দু-চারটে দিন বেশি থাকলো না কেন ওরা এই কথা ভেবে কষ্ট হচ্ছে খুব। কিন্তু কয়েক মাস আগে যখন ওরা মনু কে দেখতে এসেছিল তখন নিজের স্বাধীন জীবন কে বিসর্জন দিয়ে আদর্শ মা’র চরিত্রে অভিনয় করে যেতে দম বন্ধ লাগছিলো দীপ্তির। কিন্তু তাঁর পাল্টে যাওয়া নতুন জীবনযাত্রাকে মেয়ে-জামাই বুঝতে পারবেনা হয়ত -এই ভেবে প্রকাশও করতে পারছিল না তাঁদের সামনে । মনে মনে প্রার্থনা করছিল, যেন দীর্ঘায়িত না হয় মেয়ে-জামাইয়ের ছুটি। আবার, এই প্রার্থনা করছে ভেবে কষ্টও পেয়েছিল।

দীপ্তি বুঝতে পারছিল,মনু আকারে ইঙ্গিতে ইশারায় দীপ্তি ও সালমা কে দেখিয়ে মেয়ে জামাইয়ের কাছে অনেক অভিযোগ, অনুযোগ করতে চাইছে কিন্তু মেয়ে জামাই কিছুই বুঝতে পারছে না। মনে মনে ঠিক করল দীপ্তি, মনুকে একটা জুতসই জবাব দিতে হবে। মেয়ের সামনে কাঁদো কাঁদো গলায় দীপ্তি বলেছিল,
-তোর বাবা আসলে নিজের শ্রাদ্ধের  নিয়মভঙ্গের মেনু নিয়ে কথা বলতে চাইছি।
-মানে?
-যখন একটু আধটু বলতে পারছিল তখন আমাদের বলেছিল তোদের বুঝিয়ে দিতে।
-কী বোঝাবে?

-ওর খুব ইচ্ছে নিজের শেষ কাজটা যেন ঘটা করে হয়। লোক খাওয়ানোর মেনু সব ঠিক করেছে নিজে।

মনু মেয়ের সামনে গোঙাতে গোঙাতে রক্তবর্ণ হয়ে গেছিল প্রথমে। তারপরে একসঙ্গে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠেছিল বাবা আর মেয়ে ।

মনুর শ্রাদ্ধের পর নিয়মভঙ্গের খাওয়া দাওয়ার দিন আব্দুলকেও নিমন্ত্রণ করেছিল দীপ্তি। বাড়ির সবার মতামত কে উপেক্ষা করে, আমন্ত্রিতদের সঙ্গে প্যান্ডেলে, চেয়ার -টেবিলে খেতে বসেছিল দীপ্তি। বড় ভাসুর আপত্তি করায় দীপ্তি উত্তর দেয়

-আপনার মেজ ভাইয়ের শেষ ইচ্ছে ছিল দাদা, বলেছিল নিয়মভঙ্গে আমি খেলে ওঁর আত্মা শান্তি পাবে।

এরপর পাতে রাখা তিন নম্বর ইলিশের পিসের দিকে মন দিয়েছিল দীপ্তি। আব্দুল খেতে বসেছিল একটা টেবিল ছেড়ে। সামান্য দূরে। মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা দীপ্তির ননদ ও জায়েরা মনুকে নিয়ে আলোচনা করছিল।
-কি জানি বাপু, দেড় বছর তো ছোড়দা প্রায় বিছানাতেই ছিল?
-শুধু গলা ভাত খেত না?
-হ্যাঁ, কথাও বলতে পারতো না।
-তাহলে এইসব মেনু ঠিক করলো কী করে?
-লিখেছিলো বোধহয়।
-মেজ বৌদিকে সাইকিয়াট্রিস্ট দেখানো দরকার।

দীপ্তিদের পরিবারের লোকজনদের কথাগুলো আব্দুল ও সালমা দু’জনের কানেই যাচ্ছিল। দেড় বছর দাদাবাবু শুধু গলা ভাত খেত শুনে আব্দুলের নিজের গলায় সেইসময় ইলিশ মাছের কাঁটা আটকে গেল। সালমা এসব দেখেও দেখলা না। দীপ্তি, কেটারারের পরিবেশনকারী কে বলল,
-আর এক পিস ইলিশ দেখি ভাই!

সুমিত্র বন্দ্যোপাধ্যায়

পুকুরঘাট

পুকুরঘাট

একদিন আমরা মাত্র কয়েকজন সদস্য নিয়ে পুকুরঘাট নামের একটি মেয়েদের ভার্চুয়াল দল খুলে ছিলুম। অচিরেই সে কয়েকটি সদস্যের দল কয়েক হাজার সদস্যের মেয়েদের দল হয় ওঠে। পুকুরঘাট দলের মত এত গুণী মেয়েদের সমাহার বাংলাদেশে খুব কম ভার্চুয়াল দলে আছে। কাজেই সেই দল সেখানেই আটকে থাকবে না বলা বাহুল্য। তাই পুকুরঘাট দলের অন্যতম উদ্যোগ হিসেবে প্রকাশিত হলো পুকুরঘাট পত্রিকা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

17 thoughts on “মেয়েলি ভাষায় জবাব

  1. যে ছবি অদেখা থাকে গল্প সেই ছবি দেখালো। দূর্দান্ত। এ গল্প ছবি হোক….

  2. অবদমিত নারী চরিত্রটির বিবর্তন বড় বাস্তব রূপ নিয়েছে আপনার কলমে। আর তাঁর চারপাশের সমাজকেও আপনি বিলকুল ঠিক চিনেছেন।।

  3. খুব ভালো লাগলো। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে এভাবেই ঘুরে দাঁড়ায় মানুষ।

  4. মেয়েদের কথা বা ভাবনা প্রকাশ চমৎকার তবে অনেক বানান ভুল চোখে পড়ল।

  5. খুব ভালো লিখেছেন । অবদমিত আকাঙ্ক্ষা ও প্রতিশোধ স্পৃহার চমৎকার প্রকাশ ঘটেছে ।

  6. দুর্দান্ত !!! যখন একজন পুরুষের লেখায় এত সুন্দর একটা মেয়ে র ছবি উঠে আসে, তখন আরো ভালো লাগে

  7. অদ্ভুত সুন্দর একটি গল্প পড়লাম। এই কলমকে কুর্নিশ জানাই। এমন এক একটি লেখার জন্য অপেক্ষা করে থাকি।

  8. খুব ভালো লাগলো, মেয়েদের স্বাধীনতা বা ইচ্ছে গুলো কে যে পুরুষ একটু হলেও প্রশ্রয় দেয়। তাকে সম্মান দিতে ই হয়।

  9. খুব ভালো গল্প। একটানে শেষ করলাম।

  10. অবদমন, উৎসার, উচ্ছ্বাস সব মিলেমিশে একাকার দীপ্তি আর সালমার চরিত্রে। দুই নারী, পরস্পরের সান্নিধ্যে আনন্দ খুঁজে পাচ্ছে, যতখানি লাঞ্ছনা সহ্য করেছে এতদিন, অনেকটাই ফিরিয়ে দিতে পেরে শ্বাস নিচ্ছে স্বাধীন যাপনে। দুর্দান্ত গল্প।

  11. দুর্দান্ত ! শব্দের নিটোল বুনোটে মুগ্ধতার ছোঁয়া পেয়ে খুব ভাল লাগল।

  12. কি কঠিন প্রতিবাদ অথচ কতো শান্ত স্বরে!! অসামান্য লেখা।

  13. প্রতিবাদের ধরন বেশ অভিনব। জ্বলিয়ে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট।

  14. দৃঢ় অথচ শান্ত প্রতিবাদ অনেক বেশি জোরালো হয়, গভীরে তার শিকড় প্রোথিত থাকে। লেখাটিও তেমন। অনুচ্চকিত আর বলিষ্ঠ।