কাছের মানুষ

কাছের মানুষ

         ব্রততী সেন দাস

 

টিফিনের ঘন্টা পড়তে দুই বন্ধু দেবিকা আর অদিতি স্কুলবাড়ির পিছনের ভাঙা দেওয়ালটার ওপর পা ঝুলিয়ে বসল।ওদের আর এক জন,অনুশ্রী আজ অনুপস্থিত।ওদের তিনজনকে এক সঙ্গে  টাউনে  ‘তিনমূর্তিবাথ্রি মাস্কেটিয়ার্স নামে চেনে সবাই।দেবিকা জিজ্ঞেস করল,”আই অনু কবে আসবে রে?

কাল,আজ ওর বড়দিভাই চলে যাবে

আহারে,বেচারি“,বলে দেবিকা হেসে অদিতির দিকে চাইল।

সত্যি রে,দিদি তো আমারও আছে কিন্তু দিদি জামাই বাবু এসেছে বলে এক সপ্তাহ স্কুলকোচিন কামাই একটু বাড়াবাড়ি নয়?”

দেবিকা রুটি আলুভাজা চিবোতে চিবোতে বলল,”তুই কী বুঝবি রে এর মহিমা, যে অরিজিৎদার জন্য ফিদা।

হুম,তা হওয়ার মতই বটে।আমাদের তল্লাটে অরিজিৎদার মত জামাই আর একজনও দেখা দিকি।দেবশ্রীদির কপালটা খুব ভাল রে,স্যানাল বাড়ির উপযুক্ত জামাই বটে অরিজিৎদা।

একদমআমাদের পাড়ার সবাই বলে সে কথা।উফফকী ভাল দেখতে বল!যেমন লম্বা চওড়া,তেমনি হ্যান্ডসাম।আমার জামাইবাবুটাকে দেখ,কেমন একটা ঝিমটানো মত,সারাক্ষণ সিগারেট খাচ্ছে আর খক খক করে কাশছেকিছু বলতে গেলেই শুধু জ্ঞান।দিদির জীবনটা হেল হয়ে গেল।

অদিতিও বিরক্তির সঙ্গে বলল,” আমার জামাইবাবু মিলনদাও একই গোত্রেরবছরের অর্ধেক সময় তো দিদিকে বাপের বাড়িতেই ফেলে রাখে।আর কী যে করে কে জানে,তার টানাটানি আর শেষ হয় না।সবার কাছ থেকে সারা বছর টাকা ধার করে যাচ্ছে।দিদি কান্নাকাটি করে, বলে আর শ্বশুরবাড়ি ফিরে যাবে না।এ সব দেখলে না আর বিয়ে করতে ইচ্ছে করে না।

আর আমাদের অনুর জামাইবাবুকে দেখ!যেমন রূপ,তেমনি ব্যবহার।পাড়ার প্রত্যেকে সে কথা বলাবলি করে।ওত বড় একজন ডাক্তার,কত বড় বংশের ছেলে অথচ সবার সঙ্গে ব্যবহার দেখ,সব্বাই প্রশংসা করে।

গোয়ালপাড়ার ননিপিসি,চায়ের দোকানের ফটিককাকা থেকে নরেনজ্যাঠা সবার সঙ্গে কী অমায়িক ব্যবহার,পাড়া্র ছুঁড়ি বুড়ি,ছেলে বুড়ো সবাই জিৎজামাইবাবু বলতে অজ্ঞান!”

দেবিকা হেসে বলল,”তাহলে আর অনুর কী দোষ?”

অদিতিও হেসে বলল,”ঠিক,” দুই বন্ধু পাড়ার জামাইবাবুকে নিয়ে অলোচনায় ব্যস্ত আর তখন অনুশ্রীর বাড়িতে মেয়ে বিদায়ের বিষণ্ণতা।স্যানাল বাড়ির বড় মেয়েজামাই দ্বিরাগমন সেরে আজ বিদায় নিচ্ছে।সেই উপলক্ষে স্যানাল বাড়ি আজ বিষাদাক্রান্ত।নারী পুরুষ সবাই অশ্রুসজল চোখে উঠোনে ভিড় করে দাঁড়িয়েছে।মেয়েরা ঘন ঘন শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছছে।পুরুষরা গম্ভীর কিন্তু সবার চোখে মুখে নির্বিঘ্নে  দায়িত্ব পালনের সন্তুষ্টি।স্যানাল বাড়ির বড় ছেলে অমলেন্দু স্যানাল ,তাঁর বৃদ্ধ বাবা গজেন্দ্রনাথ স্যানাল উঠোনে দাঁড়িয়ে আছেন।দেবশ্রী গিয়ে দাদুকে গিয়ে প্রণাম করতেই কান্নায় ভেঙে পড়ল।মা কাকিমারা এতক্ষণ কান্নায় একটু বিরতি দিয়েছিলেন,দেবশ্রীর কান্নার শব্দে তাঁরা আবার নতুন করে চোখে আঁচল গুঁজলেন।দেবশ্রী পাড়ার মেয়ে তাই ওর বিদায়ক্ষণে শুধু স্যানাল বাড়ি নয় সারা পাড়া জুড়ে একটা বিষাদ মগ্নতা।উঠোনে কনে জামাইকে ঘিরে,আত্মীয়, বন্ধুবান্ধব আর পাড়ার মেয়ে বউরা ভিড় জমিয়েছে।। অরিজিৎ ডাক্তার,বিখ্যাত হাসপাতালের কন্সাল্টিং নিউরোলজিস্ট।দিল্লীতে থাকে।দেবশ্রীর দুই পিসি ।একজন দিল্লীতে থাকেন আর একজন ইউ এস তে।দিল্লীর বেলি পিসিই এই সম্বন্ধটা এনে দিয়েছেন।এ তল্লাটে স্যানাল বাড়ির খ্যাতি সুবিদিত, এঁদের বিরাট চাব্যবসা।যদিও গজেন্দ্রনাথের চার সন্তানের সবাই যে ব্যবসার সঙ্গে জড়িত তা নয়।শুধু বড় ছেলে অমলেন্দু গজেন্দ্রনাথের পর এসবের দেখাশোনা করছেন।বাকিরাও জীবনে সু প্রতিষ্ঠিত।চার ভাই এর সাত মেয়ে আর এক ছেলে।এ বাড়ির ছেলেমেয়েরাও রূপে গুণে, স্বভাবচরিত্রে বিশিষ্ট আর সেই বাড়ির উপযুক্ত জামাই অরিজিৎ।

 

অনুশ্রী ভিড় থেকে একটু দূরে,উঠোনের কোণে পেয়ারা গাছের নীচে দাঁড়িয়ে ছল ছল চোখে তাকিয়ে আছে দেবশ্রীর দিকে।।এই মানুষটাকে ছেড়ে থাকবে কী করে! ওর যে সব কিছুতেই বড়দিভাইকে লাগে।প্রতিদিন স্কুলে যাওয়ার সময় চুল বেঁধে দেওয়া,শাড়ি পড়িয়ে দেওয়া এমন কি ভাত খেয়ে যাওয়াও যে বড়দিভাই এর হাতে।ওর আদরআবদারআহ্লাদ সব কিছুই দেবশ্রীর  কাছে।ছোটবেলা পুতুলের বিয়ে দেওয়া,সাইকেল চালানো শেখা,বড়বেলায় সরস্বতী পুজোয় শাড়ি পড়া বা বিয়ে বাড়িতে যাওয়ার সময় সাজগোজ করার সময় অনুর বড়দিভাই ছাড়া আর কাউকে পছন্দই হয় না।এই ছোট্ট টাউনে বড়দিভাইয়ের মত  আর দ্বিতীয় কাউকে খুঁজেই পায়  না ।রূপেগুণেব্যবহারে দেবশ্রীকে নিয়ে ওর গর্বের শেষ নেই।সেই দিদি এই ছোট্ট টাউনের মায়া কাটিয়ে কোন দূর দেশে চলে যাবে,মন হলে কি আর দিদিকে কাছে পাবে?ভাবতেই অনুর দু চোখ উপছে জলের ধারা টপ টপ করে ঝরে পড়ল।ওর ডুকরে কেঁদে ওঠা দেখে সবাই ওর দিকে ফিরে চাইল।নতুন জামাই বিচ্ছেদের এই করুণ পরিবেশে খুব বিব্রত হয়ে পড়ল।অনুশ্রী অরিজিৎকে জামাইবাবু বলে ডাকে।এই রূপবান মানুষটি ওর সবচেয়ে প্রিয় মানুষটিকেকে অজানা কোন দূর দেশে নিয়ে যাবে ভাবতেই ওর খুব রাগ হল।মনে হল কিছুতেই দিদির হাত ছাড়বে না,জোর করে ওদের পথ আটকে দাঁড়াবে।কথা নেই বার্তা নেই,হঠাৎ উড়ে এসে জুড়ে বসা! কিন্তু জামাইবাবুর দিকে চোখ পড়তে ওর সব রাগ জল হয়ে গেল।এ মানুষটা যেন স্বপ্নপুরের সওদাগর,রাগ অভিমান নয়,এর দিকে শুধু মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতে হয়

বিয়ের আগে অরিজিতের ছবি দেখেছিল কিন্তু বিয়ের আসরে চাক্ষুস দেখা।ধাক্কাপাড়ের ধুতি,গারদের পাঞ্জাবি পরিহিত।হাতে সোনার রিস্ট ওয়াচ,গলায় চিক চিক করা সোনার চেন,পাঞ্জাবীতে হীরের বোতাম লাগানো। বিয়ের আসরে পাশাপাশি হর পার্বতীর মত জুটি দেখে উপস্থিত অভ্যাগত অতিথিদের চোখ সার্থক হয়ে গেছিল!

আর অনুশ্রী সেই দিন থেকে নতুন জামাই এর অনুগত।শান্ত,অন্তর্মুখী,শ্যামলা শ্যালিকাটি সব সময় অরিজিতের কাছাকাছি।যদিও কলহাস্যরত,রসিকা শ্যালিকাবৃত্তের দ্বারা পরিবৃত অরিজিৎ এই নিতান্ত সাধারণ দর্শনা এবং বয়সে অনেকটা ছোট অনুশ্রীকে অতটা নজর করেনি সে ভাবে।তাই শ্যালিকাবৃত্তে ওর আসন সর্বদা বাইরের দিকে,তুতো ভাই বোনেরা যখন নতুন জামাইবাবুকে ঘিরে ধরে হই হই করছে তখন নিবিষ্টে চিত্তে খোঁজ রাখছে জামাইবাবুর কখন কী দরকার।কখন জল চাই,কখন শরবৎ খাবে,জলখাবার দেওয়া হয়েছে কিনা।রান্নায় তেল ঝাল কম দাও,জামাইবাবু ঝাল খেতে পারে না,গেঞ্জি কই,চটি কই,তোয়ালে কই।সবদিকে অনুশ্রীর পুঙ্খাণুপুঙ্খ নজর!শেষে মা কাকিমারাও অরিজিতের জন্য কিছু করতে গেলে অনুর কাছে জিজ্ঞেস না করে করতেন না।ভিড়ের কোলাহলে অরিজিতের সঙ্গে দুটো দরকারি কথার বেশি কিছু হয়েছে কিনা সন্দেহ কিন্তু মনে মনে  ওর প্রিয়তম দিদির পাশে এই সুন্দর মানুষটাকে স্থান দিয়েছে।কিন্তু রাত পোহালে ওরা দুজনেই একসঙ্গে কত দূরে চলে যাবে ভাবতেই অনুশ্রীর বুকের মধ্যেটায় টন টন করে উঠল।

০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০

এর পর কেটে গেছে কতগুলো বছর।সেদিনের ক্লাস নাইনের অনু আজ দ্বাদশ শ্রেণীর পরীক্ষা দেবে।মাধ্যমিকে ভাল রেজাল্ট করে যখন ফিজিক্স,কেমিস্ট্রি,বায়োলজিতে ভর্তি হল তখন কাঁঠালপাড়ার অনির্বাণ ওকে বলেছিল,”কি রে তুই যে বলেছিলি কমার্স নিয়ে পড়বি কী হল?হঠাৎ সায়েন্সে চলে গেলি যে বড়?”

দূর,জীবনে অ্যাকাউন্টেন্ট হয়ে কী হবে,লাভ ক্ষতির হিসেব কষতে কষতে তো জীবন বরবাদ হয়ে যাবে!”

হু,তাতো বুঝলাম কিন্তুমাইন্ড ট্রি কোচিন সেন্টারের কী হবে?একজন যে তো তোর পথ চেয়ে বসে ছিল।

অনির্বাণের দাদা দীপঙ্কর সি (কস্ট একাউটেন্সি) পাশ করে একটা কোচিন সেন্টার খোলেমাইন্ড ট্রি।এ অঞ্চলের কমার্সের স্টুডেন্টদের খুব ভিড় সেখানে।দীপঙ্করের মত মেধাবী ছাত্র গতানুগতিক রাস্তায় না চলে এমন একটা স্বাধীন পেশায় যুক্ত হওয়ায় অনুশ্রী খুব অনুপ্রাণিত হয়। ঠিক করে নিজেও রকম একটা  স্বাধীন পেশায় যুক্ত হবে।তার আগেমাইন্ড ট্রিতে যোগ দেবে দীপঙ্করকে কথাও দেয়।অনুশ্রীকে পাশে নিয়ে চলবে এই স্বপ্ন চোখে নিয়ে দীপঙ্কর ওর আশায় দিন গুনতে থাকে।কিন্তু মাধ্যমিকে ভাল রেজাল্ট হতে অনুশ্রী ভাবনাটাকে পালটে ফেলে।ঠিক করে কমার্স নিয়ে নয়, বিজ্ঞান নিয়ে পড়বে।জয়েন্ট এন্ট্রান্স দিয়ে ডাক্তার হবে তারপর কোন একদিন সফল ডাক্তারের মত নিজস্ব চেম্বার খুলে বসবে।ওর স্বপ্নগুলো এখন আর মফস্বলের ঝোপে ঝাড়ে আটকে নেই।তারা এখন সব কিছু ছাপিয়ে দূর আকাশের তারাদের কাছে পৌঁছতে চায়।ভাবতে অসুবিধে কী কোনদিন হয়ত দেশের রাজধানী বা দেশের বাইরে অন্য কোথাও পড়তে বা পড়াতে চলে যেতে পারে,যেমন জামাইবাবু যায়!তারপর একদিন বিয়ে করে দূর কোন দেশে নীড় বাঁধবে।মাঝে মাঝে আসবে।সবাই বলবে আমাদের ছুটকি কেমন অচেনা দেশের সৌরভ বয়ে নিয়ে আসে।ছুটির দিনে দুপুর বেলায় বাড়ির পুকুর ঘাটের পৈঠায় বসে বা ছাদের কার্ণিশের ছায়ায় বসে তেঁতুলের আচার চাটতে চাটতে অনুশ্রী কত কী না ভাবে।এই ছোট্ট পাড়া,ছোট টাউনের ছোট ছোট চাওয়া পাওয়া।ছোট ইচ্ছে, কামনা বাসনা ছাড়িয়ে অনেক দূরের মেয়ে হয়ে যায়।ওর কবিতার খাতার পাতাগুলো ওর সই হয়ে মনের কথা ধরে রাখে।

গেল মাসে দেবশ্রীর ছেলে মিমোর এক বছর পূর্ণ হয়েছে।বড়দিভাই এখন পুরোপুরি সংসারী,অনুশ্রীর শুধু কষ্ট হয় যখন ভাবে দিদি পড়াশোনা নিয়ে আর এগোল না কেন।বিয়ের দু বছরের মাথায় মিমো হল,তারপর থেকে ওর দেখা শোনা আর মানুষ করাই ওর জীবন হয়ে দাঁড়াল।জামাইবাবু কিছু না বললেও মাজ্যাঠিমারা খুব খুশি হলেন।দেবশ্রী আর অরিজিত এই বছরে দু বার এসে ঘুরে গেছে।ওরা এলে শুধু স্যানাল বাড়ি নয় সারা পলাশডাঙা মেতে ওঠে।কারণ অরিজিৎ যেমন হাসিখুশি তেমনি মিশুকে,ওর মধুর ব্যবহারের  আকর্ষণ কেউ কাটাতে পারে না।দেবশ্রীর বন্ধুরা,ওর ভাই বোনদের বন্ধুরা সবাই স্যানালবাড়িতে রাত দিনের জন্য আটকা পড়ে যায়।সারাদিন হৈ হৈ করে আড্ডাগানবাজনা আর খাওয়া দাওয়া চলে।আর এই সব কিছুর মধ্যমণি হল অরিজিৎ।

সেবার শী্তের সময় দেবশ্রীরা চারদিনের জন্য এলো,প্ল্যান ছিল বাপের বাড়ি থেকে সবাই মিলে ভূটান যাবে।যথারীতি বন্ধুদের আনাগোনা শুরু হয়ে গেল,সবার সঙ্গে দেবশ্রীর ছোট বোন তনুশ্রীর বন্ধু সাহানা আর তুহিনা এসে ভিড় জমাল বাড়িতে।সাহানাতুহিনা যমজ বোন,ওদের দুজনকে নিয়ে এই ছোট্ট টাউনে অনেক রটনা।পাড়ার আনাচে কানাচে ওদেরকে ঘিরে নানা রসালো গল্প ঘুরে বেড়ায়।লোকে কানাকানি করে,মুখ টিপে হাসে।ওদের বাবা গোপাল সরকার একটা শাড়ির দোকানের কর্মচারী,বাড়িতে সাতটা পেট, অনটন যেন থাবা গেঁড়ে বসে আছে।পয়সার অভাবে ওদের দু বোনের পড়াশোনা মাধ্যমিকের বেশি আর এগোয়নি কিন্তু ওদেরকে দেখে বোঝার উপায় নেই।রূপ আর শরীরি আবেদনে দুজনেই লাস্যময়ী,সাজ পোষাকও তার সঙ্গে মিলিয়েই করে।ব্লাউজের ডিপ গলার ফাঁক দিয়ে ক্লিভেজ আর শাড়ির আড়ালে গভীর নাভিকুন্ডের আহবানে উদ্বেল হয়ে ওঠে সব বয়সী পুরুষ চিত্ত।প্রকাশ্যে কেউ ওদের সাথে কথা বলতে চায় না বদনামের ভয়ে,কিন্তু ইশারা ইঙ্গিতে অনেক কথা হয়ে যায়।চায়ের দোকানের বেঞ্চিতে ছেলে ছোকরাদের মধ্যে ওদের নিয়ে চোখ টেপাটেপি চলে,রাত নেমে এলে ধুবড়ির মাঠে  কিংবা রেল ঘুমটির অন্ধকারে অনেকেই ওদের ঝোপের আড়ালে ডাকে ।মেয়ে মহলে ওদের ঢলানি স্বভাবের জন্য ওরা সবার চক্ষুশূল।শুধু স্যানাল বাড়িতে বড়মার জন্য ওদের অবারিত দ্বার।বড়মা বলেন মানুষকে কখনও ঘৃণা করো না,তার পাপকে করো। সাহানা একদিন অনুশ্রীকে ছাদের একান্তে গিয়ে বলল,”অনু একটা কথা বলব ,কিছু মনে করবি না তো?”

অনুশ্রী ছাতে কাপড় মেলতে এসেছিল,বলল,”কী গো সাহানাদি,বল না।

“…তোকে বলব,জানি না বিশ্বাস করবি কি না।তনুকে বলতে পারতাম কিন্তু যদি ঝগড়া করে তাই বলতে ভয় লাগে।

অনুশ্রী সাহানার এত কুণ্ঠিত ভাব দেখে হকচকিয়ে গেল,চোখ গোল গোল করে বলল,”কী হয়েছে গোবল না।

শোন,সেদিন সন্ধ্যেবেলায় অরিজিৎদা ছাতে সিগারেট খেতে উঠেছিল।আমাকে বড়মা চা দিয়ে বলল যা ছাতে গিয়ে দিয়ে আয়।আমি আসতেই অন্ধকারে অরিজিৎদা আমাকে জড়িয়ে ধরেছিল জানিসবিশ্বাস কর,মা কালীর দিব্যি।আর এই খানে,ঠিক এই বুকের ওপর হাত দিয়েছিল…”

অনুশ্রী অস্ফুট শব্দ করে দু পা পিছিয়ে বিস্ফারিত চোখে চাইল।সাহানা বলতে লাগল,”অরিজিৎদা আরও কিছু করার আগে আমি জোর করে নিজেকে ছাড়িয়ে নীচে নেমে যাই…”

সাহানা আর কিছু বলার আগে অনুশ্রী হিস হিস করে বলে উঠল,”আমাকে বলেছ ব্যস!আর এই নিয়ে আর কোন টুঁ শব্দ শুনতে চাই না।আর তোমরা দু বোন কোন দিন আমাদের বাড়িতে পা দেবে নাবলে দিলাম।তোমার লজ্জা করে না,নিজেদের তো কোন কিছুর ঠিক ঠিকানা নেই আবার আমাদের বাড়ির জামাইদের নিয়ে কুৎসা করতে চাইছ,ছিঃ!এই মুহূর্তে তোমরা বেরিয়ে যাও আমি বলছি।

এই বলে অনুশ্রী সড় সড় করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে শোবার ঘরে গিয়ে দড়াম করে কপাট বন্ধ করে দিল তারপর একলা বসে ভাবতে লাগল কি সত্যি?জামাইবাবুর মত সৌম্য সুন্দর মানুষ এমন ন্যাক্কারজনক কাজ করতে পারে?কিছুতেই না।নিশ্চয়ই সাহানার বিকারগ্রস্থ মনের অসুস্থ চিন্তাধারার প্রকাশ।এরা দুই বোনেরই এমন নোংরা ঘাটার অভ্যেস আছে!না,না ছিঃ! ওর দেবতুল্য জামাইবাবুকে নিয়ে এমন ধরনের কথা ভাবতেই পারে না।

অরিজিৎ আসে,দু চার দিন হৈ হৈ করে চলে যায়।সবার ছোট শ্যালিকাটি তার সে ভাবে চোখে পড়ে না।উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ,রোগা,দু বিনুনি করা,মোটা ফ্রেমের চশমা পড়া শান্ত,অন্তরমুখী মেয়েটিকে তার সুন্দরী উচ্ছ্বল রসিকা শ্যালিকাদের ভিড়ে হারিয়ে ফেলে।অনুশ্রীর খুব ইচ্ছে করে জামাইবাবুর কাছে বসে গল্প করতে,খাওয়ার বেড়ে দিতে বা দু চারটে এমন কিছু কাজ করে দেখাতে যাতে জামাইবাবুর তাক লেগে যায়।মনে মনে তারিফ করে, বাব্বাহ বোঝা যায়নি তো অনুর এত গুণ!কিন্তু হায়! অনুর যে কোন গুণই নেই,বাড়ির সবার ছোট বলেই এতদিন সবার এমনিই আদর পেয়ে এসেছে।

অনুশ্রীর একটা কবিতার খাতা আছে।লুকনো খাতা।তাতে নিজেকে দেখে।বর্ষার দুপুরে আকাশে মেঘ করলে,শীতের দুপুরে বাগানের ঝোপ থেকে যখন ঘু ঘু পাখি বিষণ্ণ স্বরে ডাকে বা বসন্তের বিকেলে পুকুর পাড় থেকে বাতাস উঠোনের চাঁপা ফুলের গাছটা থেকে ফুলের সৌরভ নিয়ে ঘরে ঢোকে তখন অনুশ্রী খাতাখানি মেলে ধরে।কত কথা ভিড় করে আসে মনের কোণে,কত আবেগ মনকে চঞ্চল করে।স্বপ্নের আবেশে যখন চোখ বুজে আসে তখন অনুশ্রী ছন্দের সূত্রে কথাগুলো গেঁথে তোলে।খাতার পাতা ভরে ওঠে অনুশ্রীর কবিতায়।এই খাতাটা ওর একেবারে নিজস্ব,কাউকে কখনও দেখায়নি,অনির্বাণকেও না।কিন্তু ওর ইচ্ছে করে কোন এক নির্জন দুপুরে ছাতের ঘরে বসে একা জামাইবাবুকে পড়ে শোনায় কবিতাগুলো।শুধু জামাইবাবু শুনবে আর তারপর বলবে,”বাঃ অনুতুমি যে এত রোমান্টিক জানতাম না তো।এত আবেগ নিজের মধ্যে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছো?আরো লেখ,তোমার লেখার হাতখানি ভারি চমৎকার।জামাইবাবুর মুখ থেকে এই কথাগুলো শোনার জন্য অনুশ্রী নিজের ভবিষ্যৎ বাজি রাখতে পারে

 

জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষার পর অনুশ্রী দিল্লীতে দিদির বাড়ি ঘুরতে গেল।বহুদিন ধরেই দেবশ্রী বলে যাচ্ছিল ছুটকি একবার ঘুরে যা এসে।কিন্তু পরীক্ষা আর পড়াশোনা থেকে ফুরসৎ কই?অবশেষে সুসংবাদ এলো যে দেবশ্রী দ্বিতীয়বার সন্তান সম্ভবা,মাস চলছে।অতএব দিদির সঙ্গে দেখাও হবে ,দিদির পাশে থাকাও হবে    আর দিল্লীও ঘোরা হবে ভেবে অনুশ্রী উৎসাহে উৎগ্রীব হয়ে উঠল।স্টেশনে ওর দুই বন্ধু অদিতি আর দেবিকা এসেছিল বিদায় জানাতে।অদিতি অনুশ্রীর হাতটা ধরে বলল,”কী রে তোর নাড়ি দেখছি দ্রুত গতিতে চলছে!”

দেবিকা বলল,”তা হবে না? এতদিন অনু মানসভ্রমণ করেছিল এবার সত্যিকারের স্বপ্নপূরণ হবে যেরাজধানী আর রাজদর্শন!”

যাঃ বাজে বকিস না!”বলে অনুশ্রী মুখ টিপে হাসল।

দেবিকা আর অদিতি কলকলস্বরে বলে উঠল,”আরে লজ্জা পাচ্ছিস কেন?তোর প্রিয় জামাইবাবুর সঙ্গে দেখা হবে,কত ঘুরবি,গল্প করবি ভাবতে পারছিস?সব ডিটেলে বর্ণনা দিয়ে আমাদের চিঠি লিখবি।

হ্যাঁ,তোরাও চিঠির উত্তর দিবি কিন্তু।

স্টেশনে অরিজিৎ নিতে এসেছিল।শীতের দিল্লীর ভোরের কুয়াশা তখনও কাটেনি।দূর থেকে দীর্ঘদেহী মানুষটা যখন হেঁটে আসছিল তখন স্টেশনটা আলো আলো হয়ে উঠল।পরনে ইট রঙা কলার দেওয়া টিশার্ট আর ডেনিম জিন্স,টিকোল নাক আর ধারালো চিবুক,সুগভীর দুটো হাসিমাখা চোখ আর টান টান পুরুষালি দেহসব মিলিয়ে আভিজাত্যে মাখামাখি।কাছে আসতে অনুশ্রী নীচু হয়ে পায়ে হাত ছুঁইয়ে প্রণাম করল।অরিজিৎ ওর কাঁধ স্পর্শ করে বলল,” কেমন আছো।অনেক বড় হয়ে গেছ দেখছি।এতদিন জামাইবাবু অনুশ্রীকেতুইবলেই সম্বোধন করত,আজ হঠাৎ তুই থেকে তুমিতে উত্তরণ অনুশ্রীকে অনেকটা বড়  তুলল।

অনুশ্রীর দিনগুলি রঙিন প্রজাপতির মত ফুরফুরিয়ে উড়তে লাগল।অরিজিতের বাবাও মস্ত বড় কার্ডিওলজিস্ট ছিলেন।আর মা দিল্লীর মিলিটারি স্কুলের হেড মিস্ট্রেস।দুজনেই রিটায়ার করেছেন।বসন্তকুঞ্জে ওঁদের বেশ ছড়ানো বাড়ি।বাড়ির পেছনে কয়েকটা গাছ আছেজ্যাকোরান্ডা,আম,তেঁতুল,ফুলের গাছ।সামনে ঘাসের কার্পেট বিছানো এক টুকরো লন ।গেটের কাছে আছে কৃষ্ণচূড়া গাছ,পাম গাছ।একদিকে গ্যারেজ আর আউট হাউস।ওখানে থাকে বাহাদুর আর তার মেয়ে রেশমি।সেই ভূটান থেকে বাহাদুর এসেছে, বাড়ির মালি কাম কেয়ার টেকার আর ওর মেয়ে রেশমি ঘরের কাজ কর্ম,ঝাড়ুসাফাইবর্তন ধোওয়া সব করে।দিদিদের বাড়ির ব্যস্ততায় ভরা জীবন আর অনুশ্রীর ছুটির আবকাশ সমান্তরাল পাশাপাশি চলতে লাগল।

দুপুরে যখন সবাই যে যার কাজে ব্যস্ত থাকে বা বিশ্রাম নেয়,শীতের শিরশিরে বাতাস দু হাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরতে চায় তখন অনুশ্রী নিজের ঘরে বসে কবিতার খাতার পাতা ওল্টায়।আধখানা ভর্তি খাতাটা রিক্ততার অভিমানে স্যুটকেসের এক কোণে পড়ে আছে।অনুশ্রী খাতা খুলে ভাবতে থাকে।কৃষ্ণচূড়া গাছ পেরিয়ে দূরের দেবদারু গাছের সারি।তার পারে রয়েছে উন্মুক্ত প্রান্তর।বড় বড় ঘাসের জঙ্গলে ফার্ণ আর নানা বুনোজ গাছের ঝোপ পা জড়িয়ে ধরতে চায়,কোন এক অজানা লতায় ফুটে রয়েছে বিন্দু বিন্দু তারার মত অজস্র নীল বুনো ফুল।ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধ বেরোয়।বহু দূর পাহাড়ের ওপরে ধোঁয়ার কুন্ডুলি পাক খেয়ে উঠছে আর সেখান থেকে একটা খয়েরি ঘোড়ায় চেপে দীর্ঘকায় যোদ্ধা এক যুবা পুরুষ এসে দাঁড়ায় খয়ের গাছের নীচে।দৃপ্ত উন্নত তার ভঙ্গিমা,দৃঢ় মুখ,তীক্ষ্ণ দৃষ্টি।কুচকুচে ঘন চুল পথশ্রমে এলোমেলো,ঘর্মাক্ত উজ্জ্বল বর্ণ মুখমন্ডলে জয় লাভের দীপ্তি।দু চোখের নীল সায়রে স্বপ্ন আঁকা আছে।সেই স্বপ্নে আধখানা হয়ে উঁকি মারছে তার প্রেয়সীর মুখ।কোন এক দুর্গম পাহাড়ি প্রদেশে,কোন এক দুর্ধর্ষ আদিবাসী রাজার এক মাত্র কন্যার সঙ্গে যুবাপুরুষের সাথে দেখা হয়েছিল পাহাড়ি সুড়িপথের নিরিবিলিতে।দোঁহে হাত ধরাধরি করে হৃদয় বিনিময় করেছিল নির্জনে।তারই গীতিকথা লিখতে চায় অনুশ্রী।বাদামী ত্বকের সুন্দরী আদিবাসী রাজকন্যা অনুশ্রীর অচেনা হলেও যুবাপুরুষ কিন্তু বড়ই চেনা।

রাতে অরিজিৎ চেম্বার থেকে ফিরে ফ্রেশ হয়ে দোতলার আরাম ঘরে বসে একটু রিল্যাক্স করে।দু চার পেগ ড্রিঙ্কস নেয়,মিউজিক সিস্টেমে বাজতে থাকে রবিশঙ্করের সেতার বা আমজাদ আলি খাঁর সরোদ অথবা কখন চৌরাশিয়ার বাঁশি।অনুশ্রী সোয়েটার ,চাদর জড়িয়ে গুটিসুটি মেরে বসে আরাম কেদারায়।আর দেবশ্রী ডিভানে  পা ছড়িয়ে বসে উল বোনে।দু বোনের মধ্যে টুকটাক কথা চলে।সেদিন অরিজিৎ জিজ্ঞাসা করল,”অনু তোমার দিল্লী কেমন লাগছে?ঠান্ডা কেমন?”

ভাল,তবে এখানকার ঠান্ডায় শুকনো হাওয়া বয় ।আমাদের ওখানে ঠান্ডা হাড় কাঁপানো,বল দিদি।খেয়ে উঠে হাত ধুতে গেলে ঠক ঠক করে কাঁপতাম।

“…তোমাদের ওখানে সবই ভাল বুঝলে অনুশ্রী কিন্তু বেশিদিন থাকা চলে না।ওদিককার মানুষগুলোর মধ্যে কোন প্রসারতা নেই।ভিষণ সংকীর্ণ,কনজারভেটিভ।

দেবশ্রী বুনতে বুনতে বলল,”মানে?”

মানে তোমাদের ওখানকার ছেলেমেয়েদের কথা বলছি,ওরা যেন কুয়ো বন্দী ব্যাঙের মত।এখন পৃথিবী কত পালটে গেছে,একটা বোতাম টিপলেই সারা দুনিয়ার খবর তোমার হাতের নাগালে।এখনও শুধু দশটা পাঁচটা চাকরি,প্রেম,বিয়ে,সন্তান,রাজনীতি আর আই পি এল ছাড়াও যে কিছু আছে তার খবরই রাখে না।ওখানকার লোকেরা কি সিলি জিনিস নিয়ে হাসাহাসি ,কানাকানি করে!প্রতিবার গিয়ে একই কথা শুনিঅরুণকাকার পাগল বউ,শচীনের বড়দার সঙ্গে পাশের বাড়ির রমাবৌদির প্রেম,নবীনের আত্মহত্যা নয়তো সাহানাতুহিনা কার সাথে শুলডিসগাস্টিং!”

অনুশ্রী অবাক হয়ে জামাইবাবুর দিকে চেয়ে রইল।শ্বশুরবাড়ির দেশের মানুষজন সম্পর্কে এমন হীন ভাবনা অরিজিৎদার!

দেবশ্রী ছোট বোনের সামনে স্বামীর অভব্যতায় বিরক্ত হল।বলল,”পেটে মদ পড়লে তুমি কী বল তোমার ধারনা আছে?ছোট জায়গায় অমন শোনা যায়।কোথায় পলাশডাঙা আর কোথায় দিল্লী!”

তা ঠিকএখানকার ছেলে মেয়েরা অনেক প্রগ্রেসিভ…”

কাকে যে তোমাদের প্রগ্রেসিভনেস বলে কে জানে?এখানে তো বয়ফ্রেন্ড,গার্লফ্রেন্ড পাল্টাতে এক সেকেন্ডও সময় লাগে না,লীভ ইন রিলেশনশীপ,ডিভোর্স,অ্যাবর্শন,ফ্রেন্ডস উইথ বেনিফিট তো জল ভাত।এসবের নাম তো অর্ধেক শোনেইনি ছুটকিরা।কী রে ছুটকি শুনেছিস?”

অনুশ্রী বিস্মিত হয়ে বলল,”ফ্রেন্ডস উইথ বেনিফিটমানে?”

অরিজিত জড়ানো গলায় বলল,”আমি বলছিএর মানে।

দেবশ্রী কড়া গলায় বলল,”তোমায় বোঝাতে হবে নাছুটকি,তুই ডিনার করে শুয়ে পড়।অনেক রাত হয়েছে।

অনুশ্রী দিদির শাশুড়ি,শ্বশুর মশাই আর দিদির সঙ্গে টুকটাক এদিক ওদিক ঘুরেছে ।অরিজিৎ কোনরকমে ছুটি জোটাতে পারলে একদিন সবাই মিলে ঘুরতে যাওয়া হল।রেড ফোর্ট,রাষ্ট্রপতি ভবন,ইন্ডিয়া গেট,যনতর মনতর ইত্যাদি নানা জায়গায় সারাদিন ঘুরে ,হৈ হৈ করে বাড়ি ফিরল।দেবশ্রী যেতে চাইছিল না কিন্তু সবার চাপে পড়ে রাজি হল।অনুশ্রী দিদির একটা সিগ্রীন রঙা ক্রেপ শাড়ি পড়েছিল।সাধারণত চুড়িদারকুর্তি বা লং স্কার্ট পড়ে।আর গায়ের রঙ চাপা বলে সাদা,অফ হোয়াইট বা মেরুন রঙ ছাড়া অন্য কিছু বিশেষ পড়েই না।কিন্তু বড়দিভাই বলল বলে সুন্দর শাড়িটা পড়ল।জামাইবাবু দেখেই বলল,” বাঃ অনুশ্রী তোমায় তো দারুণ দেখাচ্ছে!শাড়ি পড়লেই তোমায় সব চেয়ে ভাল লাগে ,অন্য কিছুতে কিন্তু অতটা মানায় না জানো?” সেই মুহূর্তে অনুশ্রীর বুকের মধ্যেকার প্রদীপটা এক ফুঁয়ে নিভে গেল।ইচ্ছে হচ্ছিল এক টানে শাড়িটা খুলে একটা অন্য কিছু পড়ে নিতে।কিন্তু দিদির দিকে চেয়ে তা করল না।ঘুরতে ঘুরতে খেয়াল করল জামাইবাবু সেদিন দিদির দিকে সযত্ন সতর্কতার সঙ্গে দেখাশোনার পাশাপাশি ওর দিকেও একটু অতিরিক্ত ঘনিষ্ঠ নজর দিচ্ছে।ফটো তোলার বা সাইট সিয়িং এর সময় বারে বারে কাঁধে হাত দেওয়া,কোমড়ে স্পর্শ দেওয়া চলতে লাগল।গাড়ি চালাতে চালাতেও অরিজিৎ রিয়ার ভ্যিউ দিয়ে বার বার তাকাচ্ছে ।লাল কেল্লায় ঘুরতে ঘুরতে দেবশ্রী পরিশ্রান্ত হয়ে একটা ছায়ায় বিশ্রাম নিচ্ছিল।অরিজিত ঘোরার ফাঁকে অনুশ্রীর গালের কাছে মুখ নিয়ে এক চোরা চুম্বন দিয়ে ফিসফিস করে বলল,”ইউ আর লুকিং সেক্সি।

অনুশ্রীর গা টা কেমন গুলিয়ে উঠল।অরিজিতের এই সস্তা সানুরাগ প্রশংসা আর চোরা চাহনিগুলো নিতে পারছিল না।বারে বারে মনে হচ্ছিল দিদির কাছে অপরাধী হয়ে যাচ্ছে।জামাইবাবুর প্রগলভতায় অনুশ্রীর ওর প্রতি সেই অনুরাগ মিশ্রিত সম্মানবোধ কোথাও যেন ক্ষুণ্ণ হচ্ছিল আর কিছু বলার সাহসও হচ্ছিল না।

 

দেবশ্রীর ব্লাড প্রেসার খুব ফ্লাকচুয়েট করতে লাগল।এই ভরা মাসে প্রেসার স্টেবল থাকা খুব জরুরি।কিন্তু ডাক্তার ওষুধপত্র দিয়ে কিছুতেই প্রেসার স্টেবল করতে পারছেন না।বলেছেন প্রয়োজন হলে কয়েকদিনের জন্য হাসপাতালে ভর্তি করা যেতে পারে।এ সময় অনুশ্রীরও দায়িত্ব অনেক বেড়ে গেল,ছোট্ট মিমোকে দেখাশোনা করা,মেসোমশাইকে সময়ে সময়ে প্রেসার সুগারের ওষুধ দেওয়া।মাসিমার বাতের ব্যথা,তাকে সংসারের কাজে সহায়তা করা এরকম নানা কাজে অনুশ্রী নিজেকে জড়িয়ে নিল।দিদির জন্য এটুকু করতে পেরে যেন ধন্য হয়ে গেল।সেদিন ভোরে ঘুম ভাঙতে অনুশ্রী নীচে নেমে এলো।এ বাড়িতে এত সকালে কেউ ওঠে না শুধু মাসিমা ছাড়া।শুনতে পেল মাসিমা রান্নাঘর থেকে চাপা অথচ রাগত স্বরে রেশমিকে কিছু বলছেন,”তোদের না পোষালে চলে যাকেউ তোদের পায়ে ধরে থাকতে বলবে না।

রেশমি কান্না বিজড়িত কণ্ঠে বলল,”ম্যাডামজি আপ মুঝে গলত সমঝ রাহি হ্যায়মেরে কো কাম করনা হ্যায়মগর ছোটা সাহাব রোজই হামারা সাথ এইসা করতা হ্যায় হি আপকো বলনা চাহতি হুনেহি বাতানে সে আপ মুঝে হি ডাটেঙ্গেইস লিয়ে।

সুনরাত কো আনা,ম্যায় পয়সা দে দুঙ্গি ঔর মুহ বন্ধ রাখকিসিকো কুছ মাত বাতানামনে রাখবি তোর বাবা ছোট সাহেবের কাছ থেকে যে টাকা ধার করেছে তার এখনও শোধ হয়নি…”

রেশমি ওড়না দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বেরিয়ে আউট হাউসের দিকে চলে গেল।অনুশ্রীর মনটা ভিষণ ভারি হয়ে গেল,চাপ ধরা একটা ব্যথায় ওর নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যেতে লাগল।কী যেন একটা ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে।স্বপ্নে যে ফুলের বাগান দেখেছিল তা যেন ছারখার হয়ে যাচ্ছে

   

অবশেষে আটমাস সাতদিনের দিন দেবশ্রীকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হল।প্রেসার প্রচন্ড বেড়ে গেছে।সিস্টোলিক একশ ষাট আর ডায়াস্টোলিক একশ কুড়ির ওপর হয়ে গেছে।সারা শরীর ফুলে ঢোল আর সে সঙ্গে চলছে খিঁচুনি,চোখেও ঝাপ্সা দেখতে শুরু করলে ডাক্তার ভর্তি হওয়ার পরামর্শ দিলেন।সবার মুখ চুন,দুশ্চিন্তায় খাওয়া দাওয়া বন্ধ হওয়ার যোগাড়।ছোট মিমো মাসিমণিকে আঁকড়ে ধরেছে। মাকে দেখতে না পেয়ে সারাক্ষণ ঘ্যানঘ্যান করে যাচ্ছে।অনুশ্রী ওকে কীভাবে শান্ত করবে ভেবে পাচ্ছে না।বাড়ির তিনতলায় একটা স্টোররুম মত আছে,সেখানে মিমোর যাবতীয় ভাঙা খেলনা ঢাই করে রাখা।মিমো একদিন জেদ ধরল ওই ঘর থেকে ওর পুরনো রিমোট কন্ট্রোল্ড হেলিকপ্টার এনে দিতে হবে।অনুশ্রী ওই ঘরে সেটা খুঁজতে খুঁজতে একটা কাবার্ড থেকে আবিষ্কার করল এক পাঁজা পর্ণগ্রাফি,সচিত্র বইগুলো দেখেই গা ঘিনঘিন করে উঠল।এই সস্তা নোংরা বইগুলো কার সম্পত্তি বুঝতে ওর এক মুহুর্ত সময় লাগল না।ছুটে ওপর থেকে নেমে এলো অনুশ্রী।

অরিজিৎ দুশ্চিন্তায় ছিল কিন্তু একজন ডাক্তার হওয়ার সুবাদে মানবশরীরের গঠনরীতির ওপর সম্যক জ্ঞান ডাক্তারি শাস্ত্রের ওপর বিশ্বাস থাকায় তাকে অতটা ভয়ার্ত করছিল না।দেবশ্রীর ডাক্তারের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগের পাশাপাশি  নিজের হসপিটাল আর ক্লিনিকের কাজকর্ম চালিয়ে যাচ্ছিল।প্রতিদিন তাই ফিরতে বেশ রাত হয়ে যেত।সেদিন অরিজিৎ ফিরে রাতে আরাম ঘরে বসে রবিশঙ্করের সেতার শুনছিল।মিমো তার দাদুঠকুমার সঙ্গে শুয়ে পড়েছে,ওকে সকাল সকাল উঠে স্কুলে যেতে হয়।আরাম ঘরের আলো আঁধারের মায়াবী জগতে সেতারের সুর এক অন্য মূর্চ্ছনা জাগাচ্ছিল।রাত জাগা কোন পাখির করুণ সুরে যেমন হৃদয়ের অন্তর্লীন অনুরাগ ধীরে ধীরে পল্লবিত হয়ে ওঠে তেমনি সেতারের সুর ঝঙ্কার রাতের নিকষ অন্ধকার থেকে গভীর বেদনা চয়ন করে সিক্ত স্নিগ্ধ ফুলমালা গাঁথছিল।অন্ধকারের দীর্ঘশ্বাস পরতে পরতে অনুরণিত হচ্ছিল।শীতের শিশির বাগানের ঘাসের ওপর আলগোছে টুপটাপ ঝরে পড়ছিল।বাইরে হিম হিম কুয়াশা।অরিজিতের সামনে সাজানো স্কচ হুইস্কি আর কাঁচের গ্লাস।।অনুশ্রী সারাদিনের ধকলে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।সকাল সকাল খেয়ে গেস্টরুমে  শুয়ে বই পড়ছিল।ইদানীং জামাইবাবুকে একটু এড়িয়েই চলে।দিদি বাড়ি ফিরলে ফিরে যাবার টিকিট কাটবে ঠিক করেছে।তবে দিদি ওকে ছাড়লে তো! ভাবতে ভাবতে কখন যেন ওর চোখ লেগে এসেছিল হঠাৎ দরজায় ঠক ঠক শব্দে ধড়মড় করে উঠল।

কে?”

আমি অনুআমি,দরজা খোল…”এত রাতে অরিজিতের কণ্ঠস্বর শুনে খুব অবাক হল।অনুশ্রী উঠে দরজার লকটা খুলতেই অরিজিত হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ল,হাতে একটা কাঁচের গ্লাস।একটু টলছে।

অনু ডার্লিং ,দরজা বন্ধ করছ কেন,আমি একা বসে ঘরে আর তুমি এখানে একা শুয়ে আছো?এসোআমার কাছে এসো।বলে অরিজিত অনুশ্রীকে বুকের কাছে টেনে নিল।

অনুশ্রী হতবাক! অরিজিৎকে বুকে একটা জোরে ঠেলা দিল,টাল সামলাতে না পেরে অরিজিৎ বিছানায় পড়ে গেল।হাতের গ্লাসটা মেঝেয় ছিটকে পড়ে ভেঙে চুরমার হয়ে গেল।উঠে দাঁড়িয়ে অরিজিৎ এগিয়ে এলো,”কী হল,তুমি ভয় পাচ্ছো?কাছে এসোআমি তোমায় ডাকছি,ভয় কিসের।আমি তোমাকে ধরতে চাই,তোমায় স্পর্শ করতে চাই।একবার শুধু একবারঅনুশ্রী আস্তে করে বলল,”জামাইবাবু তুমি প্লিজ তোমার ঘরে যাও।

হুমযাব তো।শুধু তুমি একবার হাতটা ধরতে দাওএই বলে অরিজিত আবার এগিয়ে গেল।অনুশ্রী নিজেকে বাঁচানোর জন্য আবার ওকে জোরে একটা ধাক্কা দিলে অরিজিত পড়ে গেল।মদ খেয়ে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারছে না বলে অরিজিতের অসহিষ্ণুতা যেন চরম বেড়ে গেল,ততক্ষণাৎ নিজেকে দাঁড় করিয়ে ঠাস করে এক চড় কষালো অনুশ্রীর গালে,”ইউ সোয়াইনতেজ বেশি বেড়ে গেছে না? আমার সঙ্গে একদম  ঠ্যাঁটাপনা করবে না…”

অনুশ্রী জামাইবাবুর এই রূপ দেখে জ্ঞান হারিয়ে ফেলল।হিসহিস করে বলল,”জামাইবাবু,এই মূহুর্তে তুমি আমার ঘর থেকে বেড়িয়ে যাও।এক্ষুণি,নয়তো আমি চেঁচাব।চিৎকার করে আমি মাসিমাকে ডাকব বলে দিলাম।

 “চেঁচাও,চেঁচাও ।মাসিমাকে ডাকবে?ডাকোঅরিজিত দু পা এগিয়ে এসে বলল,”…মা কিচ্ছু করবে নাআমার বাড়িতে এসে আমার সঙ্গে চোখ গরম করে কথা বলছো?”হঠাৎ অরিজিত হাত মুঠো করে জড়ো করে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল অনুশ্রীর সামনে,ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলল।দয়া করো অনু,দয়া করআমি আর পারছি নাএকবার্,একবার এসো।আমি জানি তুমি আমায় পছন্দ করো,আমায় চাওআমাকে শুধু একবার সুযোগ দাও,প্লিইইজ।

অনুশ্রী ঘরের এক কোণ থেকে বলতে লাগল,”জামাইবাবু এরকমটি করো নাছিঃ ছিঃ।আমি তোমাকে শ্রদ্ধা করিআমি আমার দিদিকেও খুব ভালবাসি,তুমি প্লিজ ঘর থেকে চলে যাও।

অরিজিতের আহত পৌরুষত্ব মরিয়া হয়ে অনুশ্রীর হাত ধরে টানতে লাগল।সমস্ত ঘরে একটা দাপাদাপিকমলবনে মত্ত হস্তির অস্থিরতা।ঠিক সেই সময় দরজা খুলে মাসিমা ঘরে ঢুকলেন।

বাবুকী হচ্ছেএসব কী?”মাকে দেখে জোঁকের মুখে নুন পড়ল,অরিজিৎ নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে আস্তে করে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেল।মণিমালা ওর বেরিয়ে যাওয়া অবধি অপেক্ষা করলেন তারপর অনুশ্রীর দিকে চেয়ে বললেন,”শোন মেয়ে,তুমি জামাকাপড় গুছিয়ে নাও,টিকিট কাটতে দিচ্ছি,হাতে এলে বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে।বুঝেছ?”

অনুশ্রীকে কিছু বলতে না দিয়ে দড়াম করে দরজা বন্ধ করে চলে গেলেন মণিমালা।

 

লাগোয়া বারান্দার ছেঁড়া ছেঁড়া রাতের ফাঁকে ভোরের নরম আলো মায়াকুসুম ছড়াচ্ছে।সারা রাত না ঘুমিয়ে অনুশ্রী ঠায় জেগে, আকাশের দিকে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে ঝড়ের পরে ধরণী শান্ত হয় কিন্তু তার রূপ দেখে বোঝা যায় কোথাও একটা ওলোট পালট হয়ে গেছে।স্যুটকেস হাটকে কবিতার খাতাখানি বার করল ।এক একটা পাতা ধরে ছিঁড়ে কুটি কুটি করে সারা ঘরময় ছড়িয়ে দিতে লাগল।বিশ্বাসভঙ্গের বেদনা ওর সারা শরীরে একটা তীব্র দহনজ্বালা সৃষ্টি করেছিল।কেন এরকম হল,কেন?দুঃস্বপ্নেও তো এর আশঙ্কা করেনি ,তাহলে?বিছানায় উপুড় হয়ে পড়ে অনুশ্রী বাঁধ ভাঙা কান্নায় ভেঙে পড়ল।অন্তরের সমস্ত বিষ যেন এই আকুল করা গোঙানিতে ঢেলে দিতে লাগল।

০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০

ট্রেন ধীরে ধীরে স্টেশনে ঢুকছে।অনুশ্রী কম্পার্টমেন্টের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে।চেয়ে চেয়ে দেখছে দিল্লী কত পাল্টেছে।প্রায় দশ বছর পরে অনুশ্রী আবার দিল্লী এলো,সঙ্গে স্বামী দীপঙ্কর আর মেয়ে জোনাকি।কত ঘিঞ্জি হয়ে গেছে ।লোক বেড়েছে,চারদিকে গাড়ি,ঘোড়া,অটোতে ছড়াছড়ি।অনুশ্রীরা স্টেশনের কাছে একটা মোটামুটি পরিচ্ছন্ন হোটেল ভাড়া নিয়েছে।গতবার গেছিল রাজস্থান ঘুরতে।এবার দিল্লী আর আশপাশের জায়গা ঘোরার ইচ্ছে।শেষবার যখন এসেছিল তখন দিদি দেবশ্রীর বাড়িতে উঠেছিল,সেই স্মৃতি ওকে ওলোট পালোট করে দিচ্ছে।বড়দিভাই কেমন আছে,মিমোপম্মি কত বড় হলো?ওদের জন্য বড্ড মন কেমন করছিল ওর।এত কাছে এসে বড়দিভাই এর সঙ্গে দেখা হবে না!অনুশ্রীর মন মানতে চাইছে না।কিন্তু শেষ বারের ভাঙা চোরা মন নিয়ে যে ফিরে গেছিল সেই দুঃস্মৃতি আজও ভুলতে পারে না।সেবার বাড়ি ফিরে কাউকে কিচ্ছু বলেনি কিন্তু একদিন সন্ধ্যেবেলায় ছাদে দাঁড়িয়ে অনুশ্রী যখন কাঁদছিল তখন বড়মা এসে পাশে দাঁড়ান।অনুশ্রী বড়মার বুকে মুখ গুঁজে কাঁদতে কাঁদতে সব বলে ফেলে,বড়মা ওর মাথায় অনেকক্ষণ হাত দিয়ে বসে থাকলেন।তারপর আঁচল দিয়ে চোখ মুছে বললেন,”আমি নিজের হাতে নিজের মেয়ের বিসর্জন দিয়েছি,মা হয়ে মেয়ের সর্বনাশ করেছি।দেবি যা মনে করবে করুক।আমি ওর পাশে থাকব।” 

জানে না বড়মা দিদিভাইএর মধ্যে কী কথা হয়েছে। শুধু অনুশ্রীর মনে হতো বড়দিভাই আর ওর মধ্যে যোজন যোজন মাইল দূরত্ব সৃষ্টি হয়ে গেছে যা আর কোন দিনই মেটবার নয়।এই দুঃখের মধ্য দিয়েই ওর আর দীপঙ্করের মধ্যেকার ফাঁকটা যে কখন ভরে গেল,কখন যে দুজনে কাছাকাছি চলে এলো টের পেল না।একদিন দীপঙ্করের বুকে মাথা রেখে চোখের জলে ভেসে যেতে যেতে সব কিছু খুলে বলে।দীপঙ্কর বলে,”হয়ত বড়দিভাই সব জানেন,কিন্তু লজ্জা, দুঃখ আর অপমানে তোমার সাথে যোগাযোগ করছেন না।তোমার উচিৎ নিজে থেকে যোগাযোগ করা।সে আর এত বছরে হয়ে ওঠেনি।কী যেন একটা বাধা দলা বেঁধে উঠেছিল।ইতিমধ্যে স্কুলে চাকরি পেয়ে অনুশ্রী নিজের কাজের জগতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে,জয়েন্টে ভাল ফল করতে না পেরে ওর আর ডাক্তার হওয়া হয়ে ওঠেনি।দীপঙ্করের সঙ্গে বিয়ের প্রস্তাব প্রথমে অনুশ্রীর বাড়ির কেউই মেনে নিতে পারেনি কারণ বিত্ত,কৌলিন্য আভিজাত্যে নিরিখে সান্যাল পরিবার দীপঙ্করদের ধরাছোঁয়ার বাইরে।কিন্তু একমাত্র বড়মা এর সমর্থন যুগিয়েছিলেন।অর্থ আর আভিজাত্যের ভাঁজে ভাঁজে নিকষ কালো  অন্ধকার থাকে, বাইরে থেকে অর্থের আলোক বিচ্ছুরণে চোখ ধাঁধিয়ে যায় তাই সেই কৃষ্ণগহবরগুলো চোখে পড়ে না।বড়মা চান না দেবশ্রীর মত আর কেউ সেই গর্তে পড়ে অসম্মানের অনলে জ্বলে পুড়ে মরুক বরং যাকে বিয়ে করে সুখী হতে চায় তাকেই বিয়ে করুক।সান্যাল বাড়িতে বড়মার কথাই সব,বড়মা দাঁড়িয়ে থেকে অনুশ্রী আর দীপঙ্করের বিয়ে দিয়েছিলেন।

দিল্লীর আশপাশের সব দর্শনীয় স্থানই ঘুরে দেখা হল।কিন্তু কোথাও অনুশ্রী বুকের মধ্যে এক দীর্ঘশ্বাস চেপে রেখেছিল।দীপঙ্কর ওর মুখ দেখে উপলব্ধি করতে পারছিল কোথায় বেদনা বাজছে।লোদী গার্ডেন ঘুরতে ঘুরতে দীপঙ্কর জিজ্ঞাসা করল,”তোমার কাছে বড়দিভাই এর বাড়ির ঠিকানা আছে?”

না,কেন?”

ফোন নং?”

হু

আমায় দাও তোআমি বড়দিভাইকে ফোন করব।
কেন?”

দরকার আছেযদি সম্ভব হয় আমি তোমাকে নিয়ে বড়দিভাই এর সঙ্গে দেখা করতে চাই।

অনুশ্রী চোখ লোকজনের বাঁধা মানল না,ভ্রমণার্থীদের ভিড়ে দাঁড়িয়ে ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলল।কত বছরের বুভুক্ষু হৃদয় আজ সজল বারিস্নানে স্নিগ্ধ,শান্ত হল।দিল্লী ভ্রমণের এমন সুখ মুহূর্ত আর আসেনি।ব্যাগ হাটকে দিদির নম্বরটা খুঁজে দিল অনুশ্রী আর তারপর থেকে ওর সমস্ত শ্রবণ আর অন্তরাত্মা অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা করে থাকল বড়দিভাই এর মুখেছুটকিডাকটার জন্য।

 

Nila Banerjee

পুকুরঘাট

একদিন আমরা মাত্র কয়েকজন সদস্য নিয়ে পুকুরঘাট নামের একটি মেয়েদের ভার্চুয়াল দল খুলে ছিলুম। অচিরেই সে কয়েকটি সদস্যের দল কয়েক হাজার সদস্যের মেয়েদের দল হয় ওঠে। পুকুরঘাট দলের মত এত গুণী মেয়েদের সমাহার বাংলাদেশে খুব কম ভার্চুয়াল দলে আছে। কাজেই সেই দল সেখানেই আটকে থাকবে না বলা বাহুল্য। তাই পুকুরঘাট দলের অন্যতম উদ্যোগ হিসেবে প্রকাশিত হলো পুকুরঘাট পত্রিকা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Others Episodes