কুয়ো দর্শন পর্ব – ২

সঙ্ঘমিত্রা রায়চৌধুরী দাশগুপ্ত
পরীক্ষা এলেই তেড়েফুঁড়ে জ্বর আসতো আমার। প্রত্যেকবার। হাফ-ইয়ার্লি হত ভরা গ্রীষ্মে, গর্মি লেগে যেত। সর্দি-কাশি-জ্বর। একবার ফাউ পেলাম হাম, একবার পক্স। পুজোর ছুটির পর অ্যানুয়াল, সিজন চেঞ্জের দিন। হাঁচতে হাঁচতে, নাক টানতে টানতে, তুমুল জ্বর। এমন নয় যে জ্বর এলে খুব দুঃখ হত আমার, বরং বেশ সুখী-সুখী হত মনটা। মা-কে একটু বেশি সময় কাছে পেতাম। জলপট্টি দিয়ে দিত কপালে, মাথা ধুয়ে দিত বিছানায় অয়েল-ক্লথ পেতে, কুসুম-গরম জলে দু-ফোঁটা ওডিকোলন ফেলে গা মুছিয়ে দিত দরজা-জানলা বন্ধ করে। এমনিতে গামছা ব্যবহার করলেও জ্বরজারি হলে গা-স্পাঞ্জ করানোর সময়ে ন্যাপথলিনের গন্ধমাখা একটা নরম গোলাপী তোয়ালে বের করতো মা আলমারি থেকে।তখন জ্বরে ভাত খাওয়া বারণ ছিল। বিস্কুটের মত কুড়মুড়ে টোস্ট করে পাউরুটি খাইয়ে দিত শিঙিমাছের ঝোলে ডুবিয়ে। রোব্বার-টোব্বার হলে মেটের ঝোল। আমাদের ছেলেবেলাতেও মাংস মানে পাঁঠা-ই ছিল। তা যা বলছিলুম, পাউরুটি দিয়ে শিঙিমাছের মত বিটকেল বিদঘুটে কম্বিনেশনও খেয়ে নিতাম সোনামুখ করে, মা খাওয়াতো বলে। মা ব্যস্ত থাকলে ঠাম্মা, পিসি কেউ না কেউ থাকতোই পাশে। গল্প করতো, চুলে বিলি কেটে দিতো, লোডশেডিং হলে হাতপাখা দিয়ে হাওয়া করতো। ওই ক’দিন দাদুর কাছে নিয়ম-বাঁধা পড়াশোনার বালাই ছিল না। এদিকে পরীক্ষা সামনে! মা কিম্বা পিসি পাশে বসে বই খুলে পড়ে যেতেন, আমি খানিক শুনতাম, বাকি সময়ে চোখ বুজে আকাশকুসুম ভাবতাম। ভিআইপি ট্রিটমেন্ট পাচ্ছি মনে হত, সেটা উপভোগও করতাম চুটিয়ে।
এত জ্বর কেন যে আসতো কে জানে!পরীক্ষার ভয়ে? ব্যর্থতার ভয়ে?এখনো মাঝেমাঝেই স্বপ্ন দেখি কাল পরীক্ষা, অথচ আমি কিছু পড়িনি, কিচ্ছু জানি না। ভূগোল আর ক্যালকুলাস নিয়ে এসব অলুক্ষুণে স্বপ্ন বেশি আসে। পেরেন্টাল প্রেশার, পিয়ার প্রেশার.. গালভারি যে সব শব্দ তৈরি হয়েছে অনেক পরে, সেসব শুনিনি আমার ছেলেবেলায়। হ্যাঁ, দাদু চাইতেন বটে, নাতনী বিদুষী হোক, কিন্তু নাতনীর অমন উচ্চাকাঙ্খা কদাপি ছিল না। আসলে প্রেশার বাইরে থেকে আসে না সবসময়ে, নিজের ভেতরেও তৈরি হয়।’ তোর আর চিন্তা কী!’ ‘ ক’টা লেটার পাবি সেটা বল’ ‘স্টার পাওয়া কোনো ব্যাপার নাকি তোর কাছে?’ আলগোছে ছুঁড়ে দেওয়া এসব কমপ্লিমেন্ট যে কী সব্বোনেশে তা হাড়ে হাড়ে জানি আমি। ছেলেবেলায় কক্ষনো গোল্লা পাইনি, ফেল করিনি, টুকিনি, গড়গড়িয়ে এক ক্লাস থেকে পরের ক্লাসে উঠেছি। শুনলে মনে হয় বটে কৃতিত্ব, আসলে কিন্তু অসম্পূর্ণতা। আজ বুঝি। আসলে গোল্লাই পেয়েছি, পড়াশোনা বাদ দিয়ে সব কিছুতে, বুঝতে পারিনি সেটা সময়মতো। আপাত-তুচ্ছ কিছু অনুষঙ্গ আছে জীবনের,যা না থাকলে জীবনটাকে ষোলো আনা না হোক, অন্তত আনা আষ্টেক ফাঁকি বলেই মনে হয়। বাঁচাটা খানিক আলুনি ঠেকে। ব্যর্থতার স্বাদ না পেলে ব্যর্থতার ভয় যায় না।আর ব্যর্থতাকে ভয় পেলে সাফল্যও আসে না জীবনে।
আমাদের এক দিদিমণি একবার মা-কে ডেকে পাঠালেন আমার ব্যাপারে কী সব আলোচনা করবেন বলে। আমার তো ঢিপঢিপানি শুরু হল বুক জুড়ে। তবে কি অঙ্ক ক্লাসটেস্টের দিন যে খাতাটা এমনভাবে ধরে লিখছিলাম যাতে বর্ণালী দেখতে পায়, তা বুঝে গেলেন আন্টি? নাকি, সেদিন ফিজিক্স ক্লাসে যখন ‘আলো’ চ্যাপ্টারটা পড়ানো হচ্ছিল আমি কিস্যু না শুনে জানলা দিয়ে বাইরে গুলমোহর গাছটার দিকে তাকিয়ে “আলো আমার আলো ওগো” গাইছিলাম মনে মনে, শুনে ফেলেছিলেন নাকি? ক্লাস টেন সি-র ওই খাড়া খাড়া চুলওয়ালা ছেলেটা যে মাঝেমাঝে টেরিয়ে টেরিয়ে চায়, একদিন একগাল হেসেছিল, আমিও সে হাসি ফেরত দিয়েছিলাম, সেটা দেখে ফেলেছেন নির্ঘাৎ! এইসব ভাবতে ভাবতে মা ফিরলো, শুনলাম আমি নাকি কিছুদিন যাবৎ পর্ণার সঙ্গে একটু বেশি মিশছি, সেটাই দিদিমণিদের উদ্বেগের কারণ। বুঝুন কাণ্ড! তা মিশছিলাম বটে পর্ণার সঙ্গে একটু বেশি বেশি, একটা অন্য পৃথিবী, অন্য জীবনের গন্ধ পেতাম আমি ওর চারপাশে। বিবাহবিচ্ছিন্ন মা-বাবা, অঢেল স্বাধীনতা, গলায় অপূর্ব সুর। আমাদের বাড়ির সাঙ্গীতিক রুচি ও অভ্যেস, তখনো অবধি ছিল কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত। বড়কাকুদাদুর দ্বারা। অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্ত, দ্বিজেন্দ্রলাল ছাড়া এক রবি ঠাকুরের প্রবেশাধিকার ছিল সে চৌহদ্দির ভেতর, তবে আংশিক। ওঁর গানে আবার প্রেম-পূজা আলাদা করা যায় না কিনা, তাই !রেডিওতে তারস্বরে হিন্দি ফিল্মী গান বাজতো গলির মোড়ে লক্ষণকাকুর পান-বিড়ির দোকানে, ওদিকের জানলাটা পার্মানেন্টলি বন্ধ রাখা হত দাদুর নির্দেশে, ওসব কানে এলে আমাদের চরিত্তির নষ্ট হয়ে যায় পাছে! হ্যারি বেলাফন্ট, বব ডিলান, এলভিস প্রিসলে, বিলি জোয়েল এঁদের নাম আমি প্রথম শুনি পর্ণার কাছে। এঁদের গানও। পড়াশোনা করতে ভালোবাসতোও না, করতোও না তেমন। একবার ফেল করেই আমাদের ক্লাসে এসেছিল। সারস্বত দুনিয়া নয়, ও ছিল গন্ধর্বলোকের মানুষ। ওর সঙ্গে আমার মেলামেশা নিয়ে দিদিমণিদের আপত্তির একটা কারণ ছিল বটে ওর অ্যাকাডেমিক রেকর্ড, কিন্তু আসল কারণটা ছিল…ও প্রেম করতো। আমাদেরই এক দিদিমণির ছেলের সঙ্গে । এবং তা নিয়ে ওর কোনো দ্বিধা লজ্জা লুকোচুরি ছিল না। এতটা হজম হয়, বলুন? আমার চরিত্ররক্ষার জন্য সবার যে কী উৎকণ্ঠা ছিল! ওদিকে দাদু বিবিধভারতী শুনতে দেন না, এদিকে দিদিমণি মা-কে ডেকে বলেন মেয়ে যেন না মেশে পর্ণার সঙ্গে। চরিত্র বস্তুটাই সাধারণভাবে ভঙ্গুর, নাকি আমার চরিত্রটাই কেবল অমন পলকা, বুঝে উঠতে পারতুম না তখন। তারপর তো তসলিমা নাসরিন সমস্তটা বুঝিয়েই দিলেন পরিষ্কার করে!
ওই শিক্ষিকার প্রতি ক্ষোভ নেই আমার। উনি ওঁর মত করে আমার হিতাকাঙখা করেছেন। তাই তো করি আমরা সবাই, আমার কাছে যা শুভ আর মঙ্গল বলে মনে হয় তা চাপিয়ে দিই আমার সন্তান, ছাত্র, সন্তানসম প্রিয়জনদের ওপর।স্নেহ আর সংবেদনের দাঁড়িপাল্লা সমান-সমান হয় না তো সবসময়ে! ক্ষমতার অসাম্য থাকে, তাই মেনে নিতে হয় এতেই ভালো হবে। আজ ভালো না লাগুক, এইসব ডিসিপ্লিন-টিন, উচিত-অনুচিতের তালিকা ছুঁড়ে ফেলে দিতে মন চাক, পর্ণাকে বলে দিতে ইচ্ছে হোক, “আন্টি না তোর পাশে বসতে, টিফিন-টাইমে তোর সঙ্গে টিফিন খেতে না করে দিয়েছে”, লক্ষ্মণকাকুর রেডিও-র সঙ্গে গলা মিলিয়ে যতই গাইতে ইচ্ছে করুক ” ছুঁ কর মেরে মন কো কিয়া তু নে ক্যায়া ইশারা”, তারস্বরে, তবু, মুখ গোমড়া করে, ছলোছলো চোখে কিম্বা গজগজ করতে করতে নিজেকে বলতে হয়, ভালো হবে, ভালোই হবে নিশ্চয়, কোন সুদূর ভবিষ্যতে তা নাই বা জানা গেল!
আর তখনই বোধহয় জ্বর আসে হাড় কাঁপিয়ে, জ্বরের তীব্রতায় মেনে নেওয়ার গ্লানি, ব্যর্থতার আতঙ্ক সব ফিকে হয়ে যায়। জ্বর যার এলো সে তবু বেঁচে গেল, কিন্তু অভিযোজন আয়ত্তে আনায় সবাই তো আর সমান দড় হয় না!তাই হয়তো আইএসসি পরীক্ষার প্রথমদিনই বাড়ি ফিরে নিজেকে শেষ করে দেয় মৈত্রেয়। উজ্জ্বল চোখের শান্ত ছেলেটি!! তুপলের সহপাঠী। ‘ছিল, নেই, মাত্র এই’। ডেস্কে সাঁটা ওর নাম-লেখা কাগজটা বাঁ-হাত দিয়ে ছিঁড়ে দিয়ে যান মিস! প্রেয়ার হয়,পরীক্ষা হয়,তোলা হয় গ্রুপ ছবিও। ওর নাম উচ্চারিত হয় না একবারও। বন্ধুরা কাঁদে, রাগে ফেটে পড়ে অকারণে! আর আমরা, বাপ-মায়েরা কেউ হাহুতাশ করি, কেউ বিস্মিত হই, জল্পনাকল্পনা করি, ‘ কী স্বার্থপর! বাবা-মা’র কথা ভাবলি না একটুও!!’ বলে দাগিয়ে দিই। খাদের কোন কিনারে পৌঁছে গেলে তরতাজা তরুণ নিজেকে নিঃশব্দে সরিয়ে নেয়, তা বোঝার ক্ষমতা হারিয়েছি বহুদিন!
এমন লিলিপুট হয়েছি আমরা, জুতোগুলোও অ্যায়সা টাইট হয়ে পা আঁকড়েছে, খুলে যে পাশের মানুষটার জুতোয় পা গলিয়ে দু-দণ্ড দাঁড়াবো নিঃশব্দে, সে সাধ্যিই বা কই আর?
সঙ্ঘমিত্রা রায়চৌধুরী দাশগুপ্ত
কুয়োর জলে ছোটবেলার ছায়াছবি দেখতে পাচ্ছি।। খুব ভালো লাগছে।
বড় ভালো লিখেছো।
তোমার লেখায় অন্য এক জীবন দর্শন চিত্রিত হয়। আমি ছোটবেলাটা এভাবে ভাবিনি এখনো ভাবি না হয়তো কারণ আমার চোখে তো সকলই বিমল সম ব্যাপার। কিন্তু এই লেখা পড়তে গিয়ে মনে হয় এভাবেই হয়তো ভাবা উচিত। তাই ভীষন ভালো লাগে এই লেখা।
বেশ ভালো লাগছে, চলুক।