লাপিজ লাজুলি পর্ব – প্রথম

লাপিজ লাজুলি
সুনেত্রা সাধু
সঙ্গম ঘাটের তে-কোণা চাতালটায় দাঁড়ালে দুটো নদীর রঙের ফারাকটা বেশ স্পস্ট বোঝা যায়। উৎসা বেশ কিছুক্ষণ ধরে সেই দিকেই তাকিয়ে আছে। জল-দৃশ্যে আবছা হয়ে আসছে চারপাশ। অলকানন্দার শান্ত সবুজ জলের সঙ্গে মিশছে উচ্ছল, বেগবান ভাগীরথীর ঘোলাটে জল। ঘাটে আসা মানুষজনের গলার স্বর ছাপিয়ে কানে আসছে একটানা কলকল-ঝমঝম শব্দ। ঘোর ঘোর ভাবটা খুব বেশিক্ষণ স্থায়ী হল না। অনেকটা উপরে রামমন্দির, সেখান থেকে ভেসে আসছে ঘন্টা ধ্বনি। উপরের শহর থেকে আঁকাবাঁকা সিঁড়ি পথ নেমে এসেছে নদীর পাথুরে খাদে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘাটে পূণ্যার্থীদের ভিড় বাড়ছে। পাশেই একটা ছোট্ট গুহা, খানকয়েক দেবদেবীর মূর্তি সাজিয়ে সাধুগোছের কিছু মানুষ বসে আছে। সস্তার ধূপ জ্বলছে, সেই গন্ধ নাকে আসছে। অনেকক্ষণ তাকিয়ে আছে বলেই হয়তো উৎসার চোখটা জলে ভরে এসেছে, যা কিনা সদ্য বিধবা মেয়ের পক্ষে বেশ মানানসই। লেস বসানো চিকনকারির কাজ করা রুমালটা হাতেই ছিল, সেটা দিয়ে চেপে চেপে চোখটা মুছে নিল উৎসা। আজকাল চোখে কাজল থাকে না, নির্দ্বিধায় সাদা রুমাল ব্যবহার করা যায়। যদিও কাজল বিহীন চোখ ওর একেবারেই না পসন্দ। গতকালই ঠোঁটে লাল লিপস্টিক ঘষতে ঘষতে শ্রমণাদি বলেছিল
হালকা করে কাজল পরতে পারিস তো ! কেমন যেন খালি খালি দেখায়। এই দেবপ্রয়াগে আমরা কজন ছাড়া তোকে কেই বা চেনে! কলকাতা তো আর নয়…
হালকা হেসেছিল উৎসা। বৈধব্য উদযাপনের জন্য ওকে নতুন করে ওয়ার্ড্রোব সাজাতে হয়েছে। কেউ বাধ্য করেনি ঠিকই কিন্তু লোকজনের মুখ বন্ধ আছে তেমনটাও নয়। কিছু প্যাস্টেল শেডের শাড়ি, সালোয়ার কামিজ কিনেছে, সঙ্গে মানানসই ব্র্যান্ডেড কোলাপুরী চপ্পল। সুগন্ধীর কোনো রং হয় না, সেগুলো রেখে বাকী দামী কসমেটিক্স পারুলদির মেয়েকে দিয়ে দিয়েছে। তাদের মধ্যে ঠিক এই রকমই লাল শেডের একটা লিপস্টিক ছিল। শেডের নামটা উৎসা এখনো ভুলে যায়নি, সেটা ঝালিয়ে নিতেই শ্রমণাকে জিজ্ঞেস করেছিল,
তোমার লিপস্টিকটা ম্যাকের ‘রুবী উ’ শেড না? মাস তিনেক আগে কিনেছিলাম জানো, কয়েকবার মাত্র লাগিয়েছি…
কি করবি বল, সবই কপাল। নইলে আটত্রিশ বছরের একটা জলজ্যান্ত মানুষ দুম করে মরে যাবে কেউ ভেবেছিল! কত শখ সাধ বাকী ছিল বলতো! হ্যাঁ রে, তোর আলমারি ভর্তি উজ্জ্বল রঙের সব শাড়ি, কী করবি ওসব?
বিলিয়ে দেব।
তোর লাল হলুদ ইক্কত আর রাণী কালারের শিফনটা আমাকে দিস। অত দাম দিয়ে শাড়ি কিনতে পারি না। এই বাজারে ছেলে মেয়ের স্কুল কলেজ সামলে নিজের শখ-সাধ পূরণ করা যে কি কঠিন, ছেলেপুলে থাকলে বুঝতিস।
মৈনাক মারা যাবার পর এই ‘ছেলেপুলে থাকলে বুঝতিস’ খোঁটাটা আর তেমন গায়ে লাগে না। সেটা হজম করেই উৎসা বলেছিল,
বেশ তো, একদিন এসো, তোমার যা যা পছন্দ নিয়ে নিও।
উৎসার কথাটা শেষ হলে গলাটা খাদে নামিয়ে শ্রমণা বলেছিল,
এসব কথা মধুরাকে বলিস না। শিক্ষিত হয়েও এত ন্যারো মাইন্ডেড তুই ভাবতে পারবি না। বিধবা মেয়ের শাড়ি পরব শুনলে আর রক্ষা থাকবে না। তোকে তো সব কথা বলতে পারি না, মনে কষ্ট পাবি। দেখলি না, সেদিন পুজোর ডালাটা ছুঁতে দিল না। কাল-অশৌচে শুভ কাজ চলে না। জিজ্ঞেস করছিল তোর দেওর একাদশী করে কিনা, মুখাগ্নি করলে নাকি এসব করতে হয়!
ফিলাডেলফিয়ায় বসে একাদশী করবে এতটা ধর্মপ্রবণ শৌনক নয়। এমনকি আমিও নই, মৈনাকও সম্ভবত ছিল না। বেশ আহত হয়েই কথা গুলো উৎসার মুখ থেকে বেরিয়েছিল।
তাই তো, আমিও ওই একই কথা বলেছিলাম। আসলে মধুরাটা তো মফস্বলের মেয়ে, এসব কুসংস্কার খুব মানে। শ্রমণা অনভ্যস্ত হাতে ক্ষতে প্রলেপ দিয়েছিল।
উৎসা অহেতুক তর্ক এড়িয়ে যেতে ভালোবাসে, তবে সেদিন চুপ করে থাকেনি। গ্রাম-মফস্বল আর শহরের সঙ্গে সংস্কারের ইকুয়েশন টানা যে অত্যন্ত ভুল সেটা প্রমাণ করতে বলেছিল,
অন্বেষাদিও তো মফস্বলের মেয়ে, কই তাকে তো এ বিষয়ে কিছু বলতে শুনি না। আসলে কি জানো তো, গ্রাম-শহর-মফস্বলের মানসিকতা বলে আলাদা কিছু হয় না, মনটা কতটা সংস্কার মুক্ত সেটাই আসল বিষয়।
তুই আর ওই ঢঙুনী অন্বেষার পক্ষ নিয়ে কথা বলিস না। কতটা চিনিস ওকে? সাতে পাঁচে থাকিস না, কাজেই ও যে কী জিনিস বুঝিসও না। লোক দেখানি মেয়েছেলে। হরবখত প্রগতিশীলতা আর নারীমুক্তির বুলি কপচাচ্ছে। কলেজে রাজনীতি করত তো, স্বভাব যাবে কোথা! এদিকে কিছু বলতে গেলেই শাশুড়ীকে ঝেড়ে কাপড় পরিয়ে দিচ্ছে। সেদিন মাসিমার সঙ্গে গড়িয়াহাটে দেখা হল, কি চেহারা হয়েছে ভাবতে পারবি না। খুব কাঁদছিলেন।
তোমার শাশুড়ি ভালো আছেন শ্রমণাদি?
হ্যাঁ গ্রামের বাড়িতে থাকে, ভালোই থাকবে। সময় মতো টাকাপয়সা পাঠিয়ে দিই, বয়স্ক মানুষের আর কী লাগে বল …
যে’কটা বছর একসঙ্গে ছিলাম জ্বালিয়ে খেয়েছে, তোকে তো এসবের কিছুই ভোগ করতে হয়নি। আমার মতো একটা শাশুড়ি ওই অন্বেষার কপালে জুটলে বুঝত। কাল রাতে কী বলছিল জানিস! তোর নাকি আবার বিয়ে করা উচিত। বললেই দুম করে এত বছরের বিবাহিত জীবনের স্মৃতি ভুলে বিয়ে করা যায়! বল না, তুই পারবি? ও নিজে রিপোর্টার হয়েছে , কাগজে লেখা বেরোচ্ছে , এর ওর সঙ্গে শুয়ে পড়ছে বলে সবাই যেন ওর মতো শোবার জন্য হেদিয়ে মরে যাচ্ছে। চুয়াল্লিশ বছর বয়স হল, এদিকে বেলেল্লাপনার শেষ নেই। কাজের নাম করে সব সময় পুরুষ মানুষ বগলে নিয়ে ঘুরছে। সব খবরই রাখি বুঝলি! পোস্টাল ডিপার্টমেন্টে দশটা পাঁচটার চাকরি করি বলে খবর পাব না তাতো নয়। আমার কলিগ অতসীদির ভাই একই কাগজের অপিসে চাকরি করে। কার ঘাড়ে, কার মাথায় পা দিয়ে অন্বেষা উপরে উঠছে জানিনা ভেবেছিস?
ছাড়ো ওসব কথা।
এই তুই বলেই বলছি। নইলে মনের কথা বিশ্বাস করে কাকেই বা বলবো বল? তোদের বিয়ের কথা খুব মনে পড়ে জানিস, খুব হৈ হৈ হয়েছিল। প্রথম দিনের আলাপেই তোকে আপন মনে হয়েছিল। সেদিন থেকে তোকে ছোট বোন হিসেবে দেখেছি। কেমন যেন সব উল্টে-পাল্টে গেল। আচ্ছা তোদের তো অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ, কুষ্ঠি মেলানো হয়েছিল? কুষ্ঠিতে বৈধব্য যোগ লেখা থাকে জানিস তো? তোর ছিল?
গতকালের কথোপকথন মনে করে এবার সত্যি সত্যি কান্না পেল উৎসার। শ্রমণাদির বলা কথাগুলো হবহু মনে আছে দেখে একটু হতাশই হল। আসলে বেশ কয়েকদিন ধরেই মৈনাকের সঙ্গে হওয়া শেষ গল্প গুলো মনে করতে চাইছে উৎসা, পারছে কই! তাহলে কি তাদের মধ্যে বহুকাল কোনো গল্পই হয়নি? নাকি নিতান্ত সাধারণ কথাবার্তা হয়েছে যা মনে রাখার কোনো দায় মস্তিস্ক নেয়নি? আগে যদি জানতো মৈনাক মারা যাবে তাহলে কথাগুলো রেকর্ড করে রাখা যেত। হতাশা ঝেড়ে চোখ মুছে ঘাটের সিঁড়িতে বসল উৎসা। তেষ্টা পাচ্ছে, বেরোনোর সময় জলের বোতল আনার কথা মনে ছিল না। সঙ্গে টাকা আছে কিন্তু এখানে কোনো দোকান নেই। আঁজলা ভরে গঙ্গার জল তুলে মুখে দিতে গিয়েও পারল না উৎসা। গঙ্গার পবিত্রতার প্রতি সে সন্দিহান অথচ তার মরনাপন্ন স্বামীর শেষ ইচ্ছে ছিল দেবপ্রয়াগে অলকানন্দা আর ভাগীরথীর সঙ্গমে অস্থি বিসর্জন! নিজের কানকে সেদিন বিশ্বাস হয়নি। মৈনাককে বরাবর নাস্তিক হিসেবেই জেনে এসেছে উৎসা। ওদের ফ্ল্যাটে একটা সরস্বতীর মূর্তি ছাড়া আর কোনো দেবদেবীর মূর্তি ছিল না। পুজোপাঠ বলতে দূর্গাপুজো আর সরস্বতী পুজোতে অঞ্জলি, তাও মৈনাক কোনো না কোনো ভাবে ঠিক এড়িয়ে যেত। আসলে মানুষের মন বড় বিচিত্র। কোন কুঠুরীতে যে কোন আশা-আকাঙ্খা লুকিয়ে থাকে, তা কে জানে!
এই যে একটু দূরে অল্পবয়সী একটা ছেলে শ্রাদ্ধের কাজ সারছে, এরা কি দেবপ্রয়াগের বাসিন্দা? নাকি পিতৃ ইচ্ছা পূরণ করতে এখানে এসেছে? ছেলেটার মা সাদা থান গায়ে দিয়ে পাশেই বসে আছে। টানা টানা সুরে গাওয়া মন্ত্রের সঙ্গে তাল রেখে দুলে দুলে কাঁদছে। উৎসা মৈনাকের জন্য আর কাঁদতে পারে না। ভবিষ্যতের জন্য ওর কোনো দুশ্চিন্তা নেই। ঈর্ষনীয় ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স, ঘরে পর্যাপ্ত খাবার আর আরামের আয়োজন শোকটাকে দীর্ঘস্থায়ী হতে দেয়নি। উৎসা শোক যাপনের চেষ্টা করেছিল, পারেনি। এখন চোখে যেটুকু জল আসে তা সবই নিজের না পাওয়াটুকু কেন্দ্র করে, বাইরের লোক সেটাকে মৃত মৈনাকের প্রতি ভালবাসা বলে ভুল করে। সমবেদনা জানায়। নিজেকে তখন অপরাধী মনে হয় উৎসার।
কী রে! একলা একলা এখানে বসে আছিস! একবার বলে আসবি তো? ফোনটাও সঙ্গে আনিসনি। আমরা গোটা রিসর্ট খুঁজে মরছি, শেষে সিকিউরিটির ছেলেটা বলল “ম্যাডামজি ঘাট পর হ্যায়।” ভারী শরীর নিয়ে অতগুলো সিঁড়ি ভেঙে এসেছে শ্রমণা, হাঁফাতে হাঁফাতে কথাগুলো কোনরকমে বলল।
ভোর বেলায় এসেছি শ্রমণাদি, তোমরা তখন ঘুমোচ্ছিলে। আর বিরক্ত করিনি। ফোনটা চার্জে বসিয়ে এসেছি। তোমাদের শুধু শুধু দুশ্চিন্তায় ফেললাম, খারাপ লাগছে। ভেবেছিলাম রিসেপশনের বলে আসব, দেখলাম মেয়েটা ডেস্কে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে। মায়া হল, জাগাইনি। ভাগ্যিস সিকিউরিটির ছেলেটা দেখেছিল।
উৎসা মুখার্জি চোখের সামনে দিয়ে পেরিয়ে যাবে আর লোকজন খেয়াল করবে না, তা কি হয়? কত মুনি ঋষির ধ্যান ভঙ্গ হল! ওরা তো সাধারণ মানুষ…
সিকিউরিটির ছেলেটা না জানলেও রিসর্ট থেকে ঘাট পর্যন্ত সবাই জানে তুই এখানে……
আজকাল এই জাতীয় কথা শুনতে আর ভালো লাগে না। মৈনাক বেঁচে থাকতে এই নিয়ে প্রছন্ন একটা অহঙ্কারবোধ ছিল বৈকি! এখন সেটা অপরাধবোধের পর্যায়ে পৌঁছেছে। মৈনাকের শ্রাদ্ধের দিন দুই মাসতুতো জা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছিল,
দেখিস, কত ছেলের মাথা চিবিয়ে খাবে! শাসন করার মতো মাথার উপর কেউ তো রইল না, উড়ে উড়ে বেড়াবে। পেটটা দ্যাখ পুরো ফ্ল্যাট!
বাঁজা মেয়েমানুষদের অমনি হয়। এদের কত সুবিধা ভেবে দেখেছ? বলেই আদিরসাত্মক রসিকতায় গা টেপাটিপি করে দুজনে খুব হেসেছিল।
শৌনক কথাগুলো শুনেছিল কিনা জানে না উৎসা, তবে তাকে কাঁদতে দেখে মাথায় হাত রেখে বলেছিল,
মন খারাপ কোরো না বৌমণি। জীবনটা তোমার, কেমন ভাবে বাঁচবে সেটা তোমার ডিসিশন। আমি যদিও দূরে থাকি তবু জেনো রইলাম।
শৌনককে সেদিন ঠিক বাবার মতো মনে হয়েছিল উৎসার, কান্নার দমকটা বেড়েছিল……
এইসব খারাপ লাগা দৃশ্যগুলো চাইলেও ভুলতে পারা যায় না। লুপ ভিডিওর মতো ফিরে ফিরে মগজে আসে। বিধবা হবার পর এতকরম কথা শুনতে হচ্ছে যে মৈনাকের সঙ্গে কাটানো জীবনটা যেন ক্রমেই আবছা হয়ে আসছে। এই ভাবেই কি কাটবে? সাত পাঁচ ভাবনাতে চড়াই পথ শেষ হল, রিসর্টে এসে পৌঁছল দুজনে। গোটা রাস্তা অনর্গল কথা বলেছে শ্রমণা, কিন্তু কোনো কথাই উৎসার মন- মগজ স্পর্শ করতে পারেনি। আজকাল নিজেকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন মানুষ বলে মনে হয়। সমবেদনা, অনুকম্পায় ভরে যাচ্ছে জীবন। সত্যিই কি এসব জানানোর খুব প্রয়োজন থাকে? সেই আগের জীবনটা আর ফিরে পাওয়া যাবে না তাই না? নিজেকে প্রশ্ন করেও কোনো সদুত্তর পায় না উৎসা…
রামকুন্ড রিসর্টটা ভারী সুন্দর। বারান্দা, লাউঞ্জ, ইয়ার্ড যেখানেই দাঁড়াও না কেন অলকানন্দা আর ভাগীরথীর মিলন দেখা যায়। জলের আবছা শব্দও কানে আসে, রাত বাড়লে সেটা আরো তীব্র হয়ে ওঠে। গেটে ঢুকেই একটা টানা রাস্তা পোর্টিকো অবধি এসে শেষ হয়েছে, যার দুপাশে সবুজ লন আর সাজানো বাগান। এপ্রিল মাস বলেই হয়তো পুরো বাগানটা ফুলে ফুলে ভরা। কিনার ঘেঁষে কয়েকটা বড় গাছও আছে। তাতে কিচমিচ করছে অসংখ্য নাম না জানা পাখি। বাগানেই টেবিল সাজিয়ে ব্রেকফাস্টের আয়োজন। সকালের মিঠে রোদ অবকাশ যাপনের সেই আয়োজনকে সম্পূর্ণ করেছে। টেবিল জুড়ে নানা পদ, গন্ধে ক্ষিধে পেয়ে গেল উৎসার। এখানে অবশ্য সবটাই নিরামিষ। মধুরাদির বর শুভঙ্করদা মাছ ছাড়া একেবারেই ভাত খেতে পারেন না। অসুবিধা হলেও উৎসার মুখ চেয়ে মানিয়ে নিচ্ছেন। অন্বেষাদির বর ঋদ্ধিদা আর শ্রমণাদির বর অজয়দার কোনো কিছুতেই তেমন অসুবিধা নেই, তবে রাত্রে বোতল পর্ব সারতে না পারলে বিমর্ষ হয়ে পড়েন। এরা কেউই মৈনাকের সমবয়সী বন্ধু নন, অফিস কলিগ। মৈনাক বেঁচে থাকতে বার কয়েক ঘুরতে যাওয়া হয়েছিল, সেই সূত্রেই আলাপ গাঢ় হয়। মৈনাকের শেষ ইচ্ছের কথা এরা জানতো, উৎসাই জানিয়েছিল। তারপর উৎসাহ নিয়ে ওরাই দেবপ্রয়াগ আসার ব্যবস্থা করে। যাওয়া আসার খরচটা উৎসা জোর করেই দিয়েছে, বাকি খরচ নিজের নিজের। ওদের ছেলেমেয়েরা বড় হয়েছে, সঙ্গে আসেনি। উৎসাকে সবাই মিলে আগলে রেখেছে, এতটা বাড়াবাড়ি ওর নিজেরই পছন্দ হচ্ছে না। একলা হতে মন চাইছে। তবু মুখে কিছু বলা যায় না।
পুরো দলটাকেই ব্রেকফাস্ট টেবিলে পাওয়া গেল। শ্রমণা আর উৎসার চেয়ার দুটো ফাঁকা ছিল, ওরা বসল। ঢক ঢক করে দু গ্লাস জল খেয়েও উৎসার তেষ্টা মিটল না। তৃষ্ণা কি শুধুই জলের? কে জানে….
কালো কলাইয়ের ডালের স্টাফ দেওয়া ঘি মাখানো পরোটাটা উৎসার খুব পছন্দ হয়েছে, রায়তা আর চাটনি দিয়ে ওটাই দুটো নিল। স্বর্গীয় স্বাদ। স্থানীয় মানুষেরা এটাকে ‘গেইথ কি পরাঠা’ বলে। স্বাদের প্রসংশা করতে গিয়েও থেমে গেল, ভুলে গিয়েছিল সে সদ্য বিধবা। বিধবাদের নোলা থাকতে নেই। বাঁচার জন্য যেটুকু প্রয়োজন সেটুকু গলাধঃকরণ করার মধ্যেই মহত্ব। যখন মৈনাক বেঁচে ছিল, তখন উৎসা ভাবত সমাজটা অনেকটা এগিয়ে গেছে। মানসিকতা বদলেছে। মধ্যযুগীয় চিন্তাধারা এখন অতীত। সে ভুল ভেঙেছে। নিয়ম মানতে বাধ্য করার ব্যাপারটা হয়তো এখন নেই, তবে প্রতি মুহুর্তে ‘তুমি বিধবা’ সেটা মনে করিয়ে দিতে কেউ ভুলছে না।
সাতজন যাওয়া মানে তো দুটো গাড়ি করতে হবে। নীরবতা ভেঙে অন্বেষা বলল।
হ্যাঁ তা করতে হবে। তোরা মেয়েরা একটা গাড়িতে যাবি, আর আমরা অন্যটায়। অজয়ের কথা শুনে হাঁ হাঁ করে উঠল মধুরা। আমি শুভঙ্করকে ছাড়া উঠব না। কলকাতাতেও স্বামীকে কাছে পাব না, এখানে এসেও পাব না; ওটি হচ্ছে না। শ্রমণা “ন্যাকা” বলতে গিয়েও থেমে গেল, মধুরার যা মুখ।
কোথায় যাওয়া হচ্ছে? উৎসা প্রশ্ন করল ,কারণ বিষয়টা ওর অজানা।
এত কাছে এসেছি ভাবছি কেদার-বদ্রী দর্শন করে যাই। আবার কবে আসা হবে কে জানে! আজকাল তো কেদারে হাঁটতে হয় না। হেলিকপ্টার হয়েছে। ঋদ্ধির কে নাকি চেনা আছে, সেই বুকিং করে দেবে। এখন ভালই ভালই কেদারনাথ টানলে হয়। হাতটা এঁটো না হলে কথার শেষে কপালে একবার ছুঁইয়ে নিত শ্রমণা, সেটা হল না।
আমি যাব না শ্রমণাদি, তোমরা ঘুরে এসো। এদিক দিয়েই তো ফিরবে। না হলে বোলো আমি হরিদ্বার চলে যাব। ওখানে তো তোমরা আসছই।
সেই ভালো। তোর যদি একা থাকতে মন হয় তুই এখানে থাক। অন্বেষা বলে।
অজয়, ঋদ্ধি আর শুভঙ্কর তিনজনেই না না করে উঠল। -একা থাকবে মানে! বিদেশ বিঁভুয়ে এমনি করে ফেলে রাখা যায়! আমাদের একটা দায়িত্ব নেই!
আপনারা ভাববেন না, আমি ঠিক থাকতে পারব। ইমম্যাচিওর তো নই। উৎসা আশ্বাস দেয়।
না পারার কি আছে! তোর দেওরের বিয়ের পর তুই একা একা ফিলাডেলফিয়া থেকে ফিরেছিলি না? মৈনাক বোধহয় আগেই ফিরেছিল প্রজেক্টের কাজ ছিল। অন্বেষা মনে করিয়ে দেয়।
শেষ পর্যন্ত ঠিক হল ওরা ছ জন যাবে। উৎসা এই রিসর্টেই থাকবে। ফেরার পথে ওরা তুলে নিয়ে যাবে অথবা উৎসা নিজেই হরিদ্বার পৌঁছে যাবে। খাওয়া শেষ হলে দলটা উঠে গেল, তৈরী হয়েই বেরিয়ে পড়বে। উৎসা এসে বসল গেটের পাশের দোলনাটায়। ‘এই কয়েকটা দিন অচেনা জায়গায় একলা কাটাবে’ সেই ভাবনাটা ওকে অদ্ভুত সুখ দিচ্ছিল। মাথাটা অনেকদিন পর এক লহমায় নির্ভার হয়ে গেল। বৈধব্যের খোলসটা অলকানন্দার জলে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে সে মৃদু মৃদু দোল খেতে লাগলো। সিকিউরিটির ছেলেটা একবার আড়চোখে তাকিয়ে নিল, গত দুদিনে ম্যাডামজিকে বোধহয় এতটা স্বচ্ছন্দ হতে দ্যাখেনি।
খুব হালকা একটা হাওয়া দিচ্ছে, তবে ঠান্ডা একেবারেই নেই। পাশের নিচু পাঁচিলে কটা রঙিন পাখি বসেছিল, একটা গাড়িকে ঢুকতে দেখে ঝটপটিয়ে উড়ে গেল। গাড়িটা থামলে তিনজন পুরুষ ও দু’জন বিদেশি মহিলাকে নামতে দেখল উৎসা । ওদের লাগেজ বলতে একটা করে ব্যাকপ্যাক। এত কম লাগেজে বিদেশ ভ্রমণ করা যায়! দেওরের বিয়েতে যাবার সময় দুটো ডাউস সুটকেস আর একটা ব্যাগ নিয়ে গিয়েছিল। যাওয়া আসা দুবারই লাগেজের জন্য উৎসাকে বাড়তি মাশুল গুনতে হয়েছিল। ঠিক করল এবার থেকে ওই রকম ব্যাকপ্যাক নিয়েই ঘুরবে, হাত দুটো খালি থাকলে চলতে ফিরতে সুবিধা হয়। কিন্তু ঘুরবে কোথায়?
বিদেশি মেয়ে দুটো ‘ওয়াও! সুইং!!!’ বলে এগিয়ে এলে দোলনা ছেড়ে একপাশে সরে দাঁড়ালো উৎসা। দুটো ছেলে রিসেপশনের দিকে এগিয়ে গেল আর একজন ড্রাইভারের সঙ্গে কথা বলছিল। গাড়িটা আড়াল হওয়াতে ওকে দেখা যাচ্ছিল না, শুধু হিন্দি কথোপকথন কানে আসছিল। উৎসা একটু অবাকই হল। এর আগে কোনো বিদেশিকে এতটা পরিস্কার হিন্দি বলতে শোনেনি। কৌতুহল বাড়ছিল আর ঠিক তখনি “ডু ইউ হ্যাভ চেঞ্জ?” বলে আড়ালে থাকা ছেলেটি পাঁচশো টাকার একটা নোট উৎসার দিকে বাড়িয়ে দিল। উৎসা থতমত খেয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে পাঁচটা একশো টাকার নোট পার্স থেকে বার করল। ধন্যবাদ জানিয়ে ভাড়া মিটিয়ে আবার উৎসার সামনে এসে দাঁড়ালো সেই অনিন্দ্যকান্তি পুরুষ। উৎসা ভয়ানক অস্বস্তি নিয়েই ছেলেটার চোখের দিকে তাকিয়ে হাসল, মণির রঙটা অদ্ভুত রকমের নীল…
ঠিক সেই মুহুর্তে ‘লাপিজ লাজুলি’ শব্দটা হঠাৎ করেই উৎসার মনে এল……
সুনেত্রা সাধু
তোমার লেখার ভক্ত। যেমন অপূর্ব ভাষা, তেমনি ঝরঝরে বিশ্লেষণ। তরতর করে এগোয়, নদীর মতোই, আর শেষ লাইনে এসে মনে হয়-যাহ! শেষ! আবার অপেক্ষা পরের কিস্তির…
পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।
তড়বড় করে পড়তে শুরু করেই দেখি যাহ, আজকের পর্ব শেষ… পরের মঙ্গলবার জলদি আসুক।
সুনেত্রীয় লেখা, পড়ি কম ছবি দেখতে পাই বেশি। খুব ভালো লাগে..
Valo laglo…. Poret porbor jonno agroho roilo
লাপিজ লাজুলি,,পড়া শুরু করলাম।
অপেক্ষায় থাকলাম। প্রকৃতি এবং উৎসা আকর্ষণ করল।
ভাল লাগল লাপিজ লাজুলি। মনের ঢাকনা খুলে দেখা। পরেরটির অপেক্ষায় থাকলাম।