মেঘদূতম্

মেঘদূতম্

রোহিণী ধর্মপাল

 

জুনের শুরুতেই সেবার বর্ষা ঘন ঘন গর্জন সহ ঢুকে পড়ল বাংলাতে। বৈশাখ-জৈষ্ঠের তীব্র তাপদাহে তখন রাস্তার পিচ গলা গলা। যেসব ছেলে মেয়েগুলিকে সেলসের কাজে ঠিক ওই দুপুরেই বেরোতে হয়, তারা ছাড়া সবাই যেন কেমন নিঝুম। ট্রাফিক কনস্টেবলরা শুধু ভাবছে কখন ডিউটি শেষ হবে। পাড়ার মোড়ে, বাজারে তাল কেটে কেটে কচি শাঁস বার করে প্যাকেটে করে ভরে ভরে কিনছে যারা, অন্য পথচারীরা হিংসে করছে তাদের। যে বুড়ো মুচিটা রোজ এসে ওদের বাড়ির নিচে বসত, সেও কদিন আর আসছে না। মা জানলা দরজা বন্ধ করতে করতে বললে, “এই ভয়ানক রোদে আসবে কি করে বেচারা! মাথা ঘুরেই তো পড়ে যাবে”।

তাদের একটু সেকেলে বাড়ি। ঘরে ঘরে খসখসের পর্দা ঝোলে। মা রোদ চড়ার আগেই সব বন্ধ করে স্প্রে করে জল দিয়ে দেয়। কেমন একটা শীতল সুগন্ধী অন্ধকার নেমে আসে শুদ্ধু ওদের ঘরগুলোতে। বাইরের পৃথিবী তখন পুড়ছে। পুড়ে যেন খাক হয়ে যাচ্ছে।

বাজার থেকে তারাপদদাদা প্রতিদিন কাঁচা আম বা বেল নিয়ে আসে। দিদা যত্ন করে সেই পাকা বেলের শাঁস বার করে ভিজিয়ে ফ্রিজে ঢুকিয়ে রাখে। আম হলে পুড়িয়ে খোসা ছাড়িয়ে রেখে দেয়। কোনদিন সেই বেলের পানা, কোনদিন বা আমপোড়ার সরবত। কী যে স্বাদ। আর পুরো শরীরের ভেতর যেন ঠাণ্ডা করতে করতে নামে। আনন্দ পড়েছে শরদিন্দুর উপন্যাসে। এই সরবতের পুরোনো নাম তক্র। ওর তাই বলতেই ভালো লাগে। ও মায়ের কাছে বিকেল হতে না হতে আবদার করে, “মা, বেলের তক্র দাও না! বিকেল তো হয়ে গেল”। মা ওর চুলটা একটু ঘেঁটে স্নেহের সুরে বলে, “দিচ্ছি বাপু তক্র। এই নিয়ে আর তর্ক নয়”।

আনন্দ ছোট থেকেই অন্তর্মুখী বড্ড। ওদের বাগবাজারের পুরোনো বাড়িটার বিশাল বিশাল ঘরগুলোর দুটো মিলিয়ে রয়েছে একটা লাইব্রেরি। ওই লাইব্রেরির বয়সও বাড়িটার মতোই। শতাধিক বছরের। ঢুকলেই প্রথমে কেমন একটা প্রাচীন বয়ে যাওয়া নদীর ভাঙা ভাঙা ধার, একটা অশ্বথ গাছের বিবর্ণ হয়ে যাওয়া পাতা, ভারী ভারী সোনার গহনা আর বেনারসী পরা সুন্দরী কিন্তু বিষণ্ন এক রমণীকে যেন এক ঝলক দেখতে পায় আনন্দ। শুধু ওই পায়। যদিও ও কখনও আর কাউকে জিজ্ঞেস করেনি। এমনকী পুজোর সময় যখন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বসাক বাড়ির সব আত্মীয়স্বজন আসে, সঙ্গে সমবয়সী সব ভাইবোনেদের দল, তখনও ও কাউকে এসব জিজ্ঞেস করেনি। বলেওনি। ওদের সবার হাতে মোবাইল ফোন। এখানে এসেই ছাদে দৌড়ে চলে যায়। বা পুরোনো ঘন্টাঘরটায়। ওইসব জায়গায় ছবি তুলে পোস্ট করলে নাকি লাইক আর কমেন্টের বন্যা বয়ে যায়। আনন্দ বোঝে, ওরা ওর কথা বুঝবেই না। বরং হাসাহাসি করবে। আসলে পুরোনোকে ওরা মোটেই ভালোবাসে না। ছবি ভালো ওঠে বলে ভালোবাসে। পুজোর ক’দিনের খাওয়ার ক্ষেত্রেও তাই। পিৎজা আর বিরিয়ানি খাওয়া মুখে চুইঝাল দিয়ে রাঁধা মাংস আর হিমকণার পায়েস যখন পড়ে, সব কোলাহল করে ওঠে। “ও কাকীমা” “ও বৌদি” “ও দিদুন” এগুলোর রেসিপি দাও”।
“এইসব রান্না করলে পরের পার্টিটা জমে যাবে পুরো, কী বলো পার্থ”? আনন্দর কাকী স্বামীকে বলেন।
“জমে যাবে মানে? জমে পুরো ক্ষীর”।
“ক্ষীর কিগো! হিমকণা বলো”! ঠিক ঠিক হি হি হি র হুল্লোড় ওঠে। কিন্তু এও আনন্দ ঠিক জানে এমন রান্নার পরিশ্রম ওরা করবেই না। ওদের পার্টি মানেই হোটেল। এমনকী আনন্দরাও কখনও সখনও যখন মামা বা কাকাদের বাড়ি গিয়ে থেকেছে, তখন রোজ রোজ ওই বাইরে খাওয়া। আনন্দ চাইনিজ বা মোগলাই ভালোবাসে না, তা নয় কিন্তু। তাই বলে রোজ? দুবেলা? আর এই একটা সময় ওর গুরুগম্ভীর বাবাকে ওর খুব ভাল লাগে। আত্মীয়দের বাড়ি থাকতে গেলে তিনি সুচন্দ্রাকে কক্ষণো রান্নাঘরে পা মাড়াতে দেন না।
আনন্দের মাঝে মাঝে মনে হয় ওদের আত্মীয়রা ওদের ডাকেই বোধ হয় এইজন্য। মাকে দিয়ে নানারকম রান্না করিয়ে সবাইকে খাওয়াবে। কিন্তু বাবাকে সবাই এমন ভয় পায়, যে সাহস পায় না বলতে। বাবা সত্যি কেন যে এত গম্ভীর! অথচ মা কী শান্ত আর হাসিমুখের মানুষটি। আনন্দ অনেকবার মাকে জিজ্ঞেস করেছে, “বলো না মাগো, বাবা এমন কেন”?
“আরে, আন্দুল, বড়দের কত কী ভাবতে হয়! এতবড় বাড়ি রক্ষা করা, তোমার পড়াশোনার খরচ, এই যে লাইব্রেরি ঘরে সারাদিন প্রায় পড়ে থাকিস, এই সব বই সংরক্ষণ করা, এসব কিছুর জন্য প্রচুর পয়সা লাগে রে। বচ্ছরকার পুজোটাও তো প্রায় তোর বাবা পুরোটাই সামলায়। দিদুন মাঝে মধ্যেই অসুস্থ হন। এসব কে করবে বল্! এই সব করতে গিয়ে বাবা এমন হয়ে গেছেন”!
“কই, তুমিও তো কত্ত কাজ করো মা। সকাল থেকে মাঝ রাত পর্যন্ত। আমি সব লক্ষ্য করি। তুমি শীতের দিনে কেমন ডাল বেটে ফেনিয়ে ফেনিয়ে বড়ি দাও। তাতে কখনো কুমড়ো কখনো বাঁধাকপি কখনো হিং মিশিয়ে দাও। তোমার ঝোলের কী স্বাদ হয়! গরম কালে কত আচার বানাও। সেইসব আচার ছাদের ঘরে কড়ির বড় বয়ামে রেখে রেখে দাও। কত রকম রান্না করো। ঘর সাজাও। বাগান করো। মালীদাদুর পেছন পেছন তুমিও তো ঘুরতে থাকো বড় কালো কাঁচিটা হাতে। দিদুনের অসুখ বাড়লে সবসময় তুমিই তো পাশে থেকে গল্প করো। গায়ে হাত বুলিয়ে দাও। আমার বাংলা পড়া, ইতিহাস পড়া জলের মতো করে তুমিই তো বুঝিয়ে দাও। অঙ্ক করাও ধাঁধার মতো মজা করে। পুজোর সময় দেখি না বুঝি, কার খাটনি সবচেয়ে বেশি! তবু তো তোমার মুখে সবসময়ই হাসি”।
ছেলের কথা শুনতে শুনতে সুচন্দ্রার চোখের কোণ ভিজে আসে! এইভাবে তাকে লক্ষ্য করে আনন্দ! তিনি খুব করে কন্যাসন্তান চেয়েছিলেন। ছেলে হওয়াতে মন খারাপ হয়ে গেছিল। এখন সে কথা ভাবলে লজ্জা করে। সন্তান তো সন্তানই। আর যদি সে এমন হয়! মায়ের এমন খেয়াল রাখা ছেলে! তিনি তো মনে মনে জানেন তাঁর দিবাকর, যাকে তিনি দি ডাকতেন আর দিবাকর ডাকতেন সু বলে, সেই দি এমনটা ছিল না। কত লোকের কত জায়গায় প্রেম শুরু হয়। স্কুলে, কলেজে, কোচিংএ, অফিসে, অনুষ্ঠানে। তাঁদের প্রেম হয়েছিল এক হঠাৎ বর্ষার দিনে। একটা আধভাঙা বাড়ির তলায় অনেকের সঙ্গে তাঁরাও আশ্রয় নিয়েছিলেন। বৃষ্টির অল্প অল্প ছাঁট আসছিলোই এলোমেলো হাওয়ার সঙ্গে। আর তাঁর এত ভালো লাগছিল যে নিজেকে আটকাতে না পেরে গুণগুণ সুর ধরে ফেলেছিলেন, হৃদয় মন্দ্রিল ডমরু গুরু গুরু… আর তাঁকে অবাক করে দিয়ে পাশে দাঁড়ান যুবকটি একেবারে গলা ছেড়ে দিয়েছিল তাঁর দিকে তাকিয়ে….দুলিল চঞ্চল বক্ষোহিন্দোলে মিলন স্বপ্নে …. । দুজনে কারুর দিকে তাকাননি। গান শেষ হতে সুচন্দ্রা শুরু করেছিলেন মেঘদূতের
শ্লোক…

বর্ষার বল্লভ এনেছ অপরূপ
কল্পদুর্লভ সুহৃদমেঘ
যক্ষের বক্ষের বেদনা সুগভীর
ক্ষুব্ধ মর্মের বিপুল বেগ
যৌবন স্বপ্নের মোহন মদিরায়
মত্ত উচ্ছল নিখিল প্রাণ
বিশ্বের বিস্ময় অতুল রূপময়
শিল্পী সুন্দর তোমারো দান!

ওই শুরু। রবিবাবুর বর্ষার গান, কালিদাসের মেঘদূতম্, একটা আধ ভাঙা বাড়ির ছাদ-বারান্দার তলায় আধো ভেজা প্রেমের শুরু।তারপর যেমন আকাশ থেকে বর্ষা ভেঙে পড়ে মাটির ওপর, শুষে নেয় সমস্ত তাপিত অভিমান, তেমন করেই দুজনের প্রেম এসেছিল সে কী মহাসমারোহে। যখন দেখা করার পালা সাঙ্গ হত, ফিরতে হত বাড়িতে, সুচন্দ্রা বলে উঠতেন মৃদু স্বরে, “হেরিয়া শ্যামল ঘন নীল গগনে এই সজল কাজল আঁখি পড়িবে মনে”।। তাঁর দি বাকিটা পূরণ করে দিতেন, “অধর করুণা-মাখা মিনতি-বেদনা-আঁকা নীরবে চাহিয়া থাকা বিদায়-ক্ষণে”!!

তারপর দুই বাড়ি জানল। বিয়ের কথাবার্তা এগোল। একদিন, বিয়েও হয়ে গেল। সেদিনও বৃষ্টি পড়েছিল। তবে জলের ধারা যত না নামছিল, বজ্রের গমক আর বিদ্যুতের চমক ছিল বেশি। সুচন্দ্রার কেমন একটা অস্থির লাগছিল। তিনি এখনও জানেন না, তাঁর কেন যেন মনে হচ্ছিল বর্ষার ধারা যেমন কমে এসেছে, তাঁদের জীবনেও সেই প্রেম আর থাকবে না। বরং বজ্রপাতের গুরুগুরুটাই বাজবে বেশি করে।

এমনটা কিন্তু নয় যে বিয়ের পরে তাঁদের মতের অমিল হতে শুরু করল। বা এতদিনের পছন্দটা হঠাৎই পাল্টে গেল। একেবারেই তা নয়। কিন্তু তাঁর দি দিবাকর হয়ে গেল। একথাটা তিনি কাউকেই বোঝাতে পারবেন না। কারণ অন্য বন্ধুদের, আত্মীয় দিদিদের বরেদের সম্পর্কে, বিশেষ করে বিয়ের পর তাদের ব্যবহারের পরিবর্তন সম্পর্কে যা শুনেছেন, তেমন কিছুই কিন্তু হয় নি। শুধু দুজনেই কেমন ব্যস্ত হয়ে গেলেন সংসার নিয়ে। একটার পর একটা দায়িত্ব, আনন্দের জন্ম, পারিবারিক ঐতিহ্য বজায় রাখার দায়িত্ব, সুচন্দ্রার মা বাবার বয়স হচ্ছিল– তাঁদের দেখাশোনারও দায়িত্ব; ফলে আরও টাকার প্রয়োজন, সেই রোজগারের দায়িত্ব– কেমন যেন ভারে ডুবে গেলেন দুজনে। প্রেমের বদলে দায়িত্বের ভার। বর্ষার আনন্দের বদলে
বৃষ্টি শুরু হলে ধড়মড়িয়ে আগে ছাদে ছুটতেন। আধ শুকনো কাপড়গুলো গেল বোধহয় ভিজে। ললিতার সঙ্গে সব জানলা বন্ধ করতে হত। বৃষ্টির ছাঁট ঢুকে সব ঘরের মেঝে পেছল হয়ে যাবে। বাড়ির পেছনের বাগানটায় কার্বলিক অ্যাসিড ছড়াতে হতো। সাপের ভয়ে। বর্ষার আনন্দ চলে যেতে বেশি সময় লাগল না। কিন্তু তাঁর মনে হয় আনন্দের মধ্যে বোধ হয় তাঁদের সেই যৌবনের বীজটা রয়ে গেছে। বৃষ্টি শুরু হলে আনন্দের ঘরের জানলা বন্ধ করা যায় না। “থাক না মা! একটু না হয় আসুক ছাঁট। আকাশের নদী ঘরের বুকে একটু না হয় বয়ে যাক। হয়ত ওরও ইচ্ছে করে আমাদের লাল মেঝেতে জল দিয়ে আঁকিবুঁকি আলপনা কাটতে”। ছেলের মুখে এমন কথা শুনে থমকে যান সুচন্দ্রা। কিছু না বলে বেরিয়ে আসেন। একটু অন্যমনস্ক হয়ে যান। মনে পড়ে যায় পুরোনো কিছু কিছু কথা। অশ্রুভরা বেদনা দিকে দিকে জাগে….গানের সুরটা মনের মধ্যে জেগে ওঠে। তারপরেই মনে হয় ললিতা শাশুড়িকে ওষুধটা খাইয়েছে তো? আনন্দ মায়ের এই অন্যমনস্কতাকে লক্ষ্য করে। বোঝে, ওর এইসব কথা মায়ের মনের কোনও পুরোনো স্মৃতি বা ক্ষতকে কিছুক্ষণের জন্য জাগিয়ে দেয়। তাই মাকেও খুব বেশি কিছু বলে না। জানলার শিকে মুখ রেখে আধোভেজা হতে থাকে।

একদিন লাইব্রেরির একটা তাকের পেছনে একটা বেশ পুরোনো বই আর একটা ফাইল খুঁজে পেল ও। বইটা সংস্কৃত। দেবনাগরী অক্ষরে লেখা। মেঘদূতম্।

ক্লাস সেভেন এইটে সংস্কৃত ছিল বলে নামটা পড়তে ওর অসুবিধা হল না। কিন্তু ভেতরের শ্লোকগুলো খানিক খানিক পড়তে পারলেও মানে বুঝতে পারছিল না। বই আর ফাইলটা নিয়ে ও নিজের ঘরে বিছানায় উপুড় হয়ে পড়ল। দেখল, ফাইলের মধ্যে ওই শ্লোকগুলিরই বাংলা করা। সঙ্গে মাঝে মাঝে গান। কিছুক্ষণের মধ্যেই আনন্দ যেন ডুবে গেল রসের সাগরে। ছোট থেকেই কোনও বই পড়াতে বাধা ছিল না বলে অনেক ছোট বয়সেই ও বঙ্কিম শরৎ পড়ে ফেলেছে। গল্পগুচ্ছও। তাই প্রেম কী, তা বোঝে ও। এখন ষোল হয়েছে বলে আরও বোঝে। সুন্দর কোনও মেয়ে, সুন্দর কোনও দৃশ্য দেখলে ওর বুকের ভেতর কেমন একটা শিরশিরানি জেগে ওঠে। মাঝে মাঝে কল্পনা করে যেন ও ওর ক্লাসের শবনমকে বুকের মধ্যে জাপটে ধরেছে। আর শবনম তিরতির করে কাঁপছে ছোট্ট চড়ুইপাখির মতো। শবনমের চুলে কী আশ্চর্য একটা সৌরভ। কী যেন একটা আতর মেখে আসে রোজ। আর সেই গন্ধ রাতে ঘুমের মধ্যেও আনন্দ নিঃশ্বাসে পেতে থাকে। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে বসে থাকে। ভেতরটা যেন উথালপাথাল করতে থাকে। তাই প্রেম তার কাছে ততটা বিস্ময় নয়। বরং মেঘদূতের শ্লোক আর রবিগানগুলি পড়তে পড়তে আনন্দ যেন খানিকটা নিজেকে মেলাতে পারল। কেন মাঝে মাঝে অকারণ মন খারাপ হয় ওর। কেন ও নিজেকে হারিয়ে ফেলে আজকাল। শবনম একদিন না এলে মনে হয় স্কুলে যাওয়াটাই বৃথা হল ওর। এই তো বিরহ। যা প্রেমেরই ভাষা। একদিন শবনমকে না দেখলে মনে ওর বিষাদ ছড়িয়ে পড়ে, সেখানে একককক বছরের অদর্শন! আর এই যক্ষও তো দেখি তার মতোই কল্পনাপ্রবণ। এতটাই সে ভালোবাসে তার প্রিয়াকে, যে তার থেকে দূরে থেকে এতটাই বিচলিত হয়ে পড়েছে যে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে। এক খণ্ড আষাঢ়ের মেঘকে দেখে ভাবছে,
প্রত্যাসন্ন। শ্রাবণে প্রিয়া তার। কেমনে ধরবে। পরাণ–তাই।
শঙ্কায়, যক্ষ। কুশল সংবাদ। ভাবলে, মেঘকে। দিয়ে পাঠাই।
আর কেমন সেই মেঘ? আষাঢ় মাসের প্রথম দিনের মেঘ।
আস্তে আস্তে সংস্কৃতটা পড়ল সে। আষাঢ়স্য। প্রথমদিবসে। মেঘমাশ্লিষ্টসানুং। বপ্রক্রীড়া। পরিণতগজ। প্রেক্ষনীয়ং দদর্শ।
ছন্দটা, শব্দগুলির ঝঙ্কার আনন্দের এত ভালো লাগল, যে ও বারবার পড়তে লাগল। তারপর তার বাংলা মানেটাও। এল আষাঢ়ের প্রথম দিন। যক্ষ দেখলে, পাহাড়ের চূড়া জড়িয়ে এক খণ্ড মেঘ। ঠিক যেন একটি হাতি নিচু হয়ে দাঁত দিয়ে মাটি খোঁড়ার খেলা খেলছে।

আহা! বিরহ এত সুন্দর! আনন্দের মনে হতে লাগল প্রেমের থেকেও যেন বিরহ আরও সুন্দর। আরও মধুময়। এই বিরহের সঙ্গে মিলিয়ে ফাইলে লেখা গান চালিয়ে দেয় ইউ টিউবে। একেবারে আস্তে করে…অশ্রুভরা বেদনা দিকে দিকে জাগে। আজি শ্যামল মেঘের মাঝে বাজে কার কামনা।। ওর ঘরের এক কোণে রাখা পুরোনো ইজিচেয়ারে গা এলিয়ে বুঁদ হয়ে যায়। একেকদিন ওখানেই ঘুমিয়ে পড়ে।

সোম থেকে শনি স্কুল, পড়াশোনা নিয়ে আজকাল এত ব্যস্ত থাকতে হয় যে লাইব্রেরি ঘরে রবিবারটাই এখন ওর দিন। যে রবিবার ফাইলটা খুঁজে পেল ও, তার পরের সপ্তাহটা প্রায় ছটফট করে কাটাল। পরের শনিবার রাতেই আবার ও খুলে বসল ফাইলখানা। সেদিন খুব এলোমেলো হাওয়া দিচ্ছিল। জানলা একেবারে হাট করে খুলে, ভারী পর্দাখানি সরিয়ে খাটে এসে আনন্দ দেখল কাগজপত্র খানিক হাওয়ায় এলোমেলো হয়ে গেছে। গুছিয়ে নিতে গিয়ে দেখল পাতাগুলির শেষে নীল রঙের অনেকগুলি কাগজ। যেমন সেই ইনল্যান্ড লেটার হত। অসম্ভব কৌতূহলে সেই তাড়াটা বার করল ও। চিঠিই। এক গোছা চিঠি।
প্রথম চিঠিটা খুলেই চোখ আটকে গেল তার। কী সুন্দর হাতের লেখা! আর কালির কলমে লেখা। ঝর্ণা কলমে! “আমার দি”, এই দিয়ে চিঠি শুরু। তারপরে কত কথা! কত ছোট ছোট বিষয়। কিন্তু কী মধুরসে ডুবিয়ে তুলে আনা যেন! আর মাঝে মাঝে গানের দুই একটি করে লাইন ঢুকিয়ে দেওয়া। ঠিক যেন আপন মনে কেউ তার প্রেমিকের কানে ফিসফিস করে বলে যাচ্ছে কথা আর গুণগুণ সুরে গেয়ে উঠছে গান। উত্তেজিত আনন্দ দেখল তলায় লেখা, তোমার সু। এতো ওর বাবা মায়ের প্রেমপত্র! এত কথা বলত দুজনে! আর এমন ভাবে! উত্তেজিত আনন্দ একটার পর একটা চিঠি দেখতে লাগল খুলে। একটা চিঠি খুলে চমকে গেল ও। বাবা মাকে লিখছেন “আমার যক্ষপ্রিয়া, এই নীল ইনল্যণ্ড কাগজটিকেই ধরে নাও না সেই এক খণ্ড মেঘ বলে! আজ না আষাঢ়ের প্রথম দিনটি! আর তুমিই তো আমার সেই তণ্বী শ্যামা শিখরদশনা পক্ববিম্ব যেন অধর।
মধ্যে ক্ষীণা। চকিতহরিণী। নয়না, নাভি গভীরতর্”….. মায়ের উত্তর খুঁজে পেল না। সব চিঠি তো পরপর সাজানো নেই! কিন্তু তার মানে এখন যে বাবা আর মাকে খালি কেজো কথা বলতে শোনে, বাবা যেন কতই গম্ভীর, ভারী গলায় ডাকেন, “সুচন্দ্রা, একটু শুনে যাও”! বা কখনও ওকেই বলেন, “আনন্দ, তোমার মাকে এই খামটা একটু দিয়ে এস তো”! মাও তো কখনও ভুলেও আর দি বলে ডাকে না! কেন? এই বর্ষার জলধারার মত মুখরিত প্রেম কোথায় হারিয়ে গেল? তবে কি প্রতিদিনের দায়িত্ব পালনের ফাঁকে, রোজ মানুষ একটু একটু করে পরস্পরের কাছে পুরোনো হয়ে যায়, ফুরিয়ে যায়? ও কি মাকে বলবে এই চিঠিগুলি পাওয়ার কথা? পড়ার কথা? মা তো ওর বন্ধুর মতো। কখনোই বকবে বলে মনে হয় না। অথচ ওকে তো বুঝতে হবে যে বিরহবেদনাই যদি প্রেমকে বাঁচিয়ে রাখে, রোজকার মিলন যদি তার তীব্রতাকে শীতল করে দেয়, তবে? তবে কি শবনমের প্রতি তার যে এই আসঙ্গলিপ্সার আবেগ শেষ হয়ে যাবে? এতো সে কল্পনাও করতে পারে না! পায় নি বলেই কি কামনা এত সুগভীর? পেলেই কি শেষ? এ প্রশ্নের উত্তর তো তাকে পেতেই হবে। আর মা ছাড়া কেই দেবে এই উত্তর!
আনন্দ ঠিক করল মাকে সে কালকেই জিজ্ঞেস করবে। বাবা বাইরে গেছে ব্যবসার কাজে। এইসময়টাই ভালো।

পর দিন, রবিবার, সন্ধ্যাবেলা, খানিক আগেই এক ঝলক বৃষ্টি হয়ে গেছে, জানলা দিয়ে একটু ঠাণ্ডা হাওয়া আসছে। সাধারণত এই সময় আনন্দ মায়ের সঙ্গে ছাদে যায়। অনেকক্ষণ আসছে না দেখে সুচন্দ্রাই এল ছেলের ঘরে, “কী রে আজ যাবি না ছাদে? শরীর ভালো নেই নাকি? আর আজকাল বুঝি রাত জাগছিস বেশি? কার কথা ভাবিস? শবনম”? মায়ের মুখে আলতো হাসি।
“সু কে মা? তুমি? আর দি তো বাবা? তাই না”?
ছেলের মুখে আচমকা যেন বহুযুগের ওপার হতে দু খানি ভালোবাসার নাম ভেসে এল। থমকে গেলেন সুচন্দ্রা!
“তুই কি করে জানলি? কোথায় পেলি এই নাম”? বলতে বলতে এগিয়ে এলেন তিনি। খাটের কাছে এসে দেখলেন ছড়ানো নীল নীল কাগজ।

সুচন্দ্রা খাটের উপর বসে পড়ে আস্তে আস্তে সেগুলোর উপর হাত বুলোতে লাগলেন। ছেলের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “কোথায় পেলি এসব? সব পড়েছিস বুঝি”? আনন্দ মাকে জড়িয়ে ধরে বলল,” সব না। কিন্তু কিছু কিছু পড়েছি। তুমি কি রাগ করেছো? আমার যে তোমাকে প্রশ্ন করার আছে? তুমি রাগ করলে কি করে করব”?
“আমি বুঝেছি আনন্দ, তুই কী প্রশ্ন করবি”। ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে সুচন্দ্রা বলল।
” তুমি জানো? আমিতো কিছুই বলিনি মা। তুমি কি করে জানলে”?
” তোকে তো জানি বাবা। তাই বুঝতেই পারছি তুই কি প্রশ্ন করবি। তুই নিশ্চয়ই জানতে চাস আমার আর তোর বাবার এই প্রেম কি করে হারিয়ে গেল? আমরা তো আর এভাবে কথা বলি না। এই সব চিঠির ভাষায় যে আকুলতা আছে, তার ছিটেফোঁটাও তুই আর দেখতে পাস না। তাহলে কি তোরও তাই হবে? যাকে ভালোবাসছিস, তাকে পাওয়ার পর ভালোবাসা ফুরিয়ে যাবে? কি? এই তো তোর প্রশ্ন”?

“শোন। আমার উপলব্ধিটুকু তোর সঙ্গে শেয়ার করি। প্রেম এক একজনের কাছে এক এক রকম। কারুর কাছে প্রেম মানে দায়িত্ব, কর্তব্য। কারুর কাছে প্রেম মানে শরীরী আকর্ষণ। কারুর কারুর বিশ্বাস দেহাতীত প্রেমই আসল। কেউ বা বলে বিরহের মাধুর্য্যই প্রেম। কেউ মনে করে প্রেম বলে কিছু হয় না। ওটা মোহের একটা রূপমাত্র। আসলে প্রেমকে কোনও একটা বোধে, কোনও একটা অনুভব দিয়ে বলা যায় না। প্রেম মানে তাতে কাম থাকবে, ঈর্ষা থাকবে, বিরহও থাকবে, শ্রদ্ধাও থাকবে। তবে পারস্পরিক। আর সবচেয়ে বেশি করে থাকবে বন্ধুত্ব। তখনই কিন্তু বিরহও মধুর মনে হবে। তা না হলে প্রেম একটা অভ্যাসে পরিণত হবে। বিরহ বরং হবে তখন একটা মুক্তি, যেন বাঁচা গেল! তখনই প্রেমের মৃত্যু। আমি আর দিবাকর পরস্পরকে ভালোবেসেছিলাম। সেটা মিথ্যা ছিল না। পারস্পরিক আকর্ষণ তৈরি হয়েছিল। মোহ তৈরি হয়েছিল। দু তিন দিন দেখা না হলেই মন খারাপও হত। কিন্তু এখন বুঝি আমাদের মধ্যে বন্ধুত্ব তৈরি হয় নি। তাই তুই জন্মাবার পর পর সেই যে খানিক দূরত্ব, সাংসারিক কাজ দুজনেরই বেড়ে গেল, তা বেড়েই চলল, সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ল দূরত্ব। আর অধিকাংশ পুরুষ মনে করে স্ত্রীর প্রতি কর্তব্য করা অর্থাৎ গিফট কিনে দেওয়া, কখনও সখনও খানিক সময় কাটানো, বছরে দু একবার ঘুরতে যাওয়াই যথেষ্ট। প্রেমকেও যে লালন করতে হয়, তা অনেকেই বোঝেই না। তোর বাবাও তার বাইরে নয় রে। তাই একটা সময় আমার ভেতরের প্রেমটাও কবে যে শুকিয়ে গেল, আমি খেয়াল পর্যন্ত করিনি। তাই কিছু মনেও হয় নি। আজ, এতদিন পর, তুই বললি বলে খেয়াল হল”।

আনন্দ চুপ করে মায়ের কোলে মাথা রেখে শুনছিল। সুচন্দ্রা ছেলের মাথায় হাত রেখে বলল, “নিজের মনকে ভালো করে বুঝিস আগে। তাকে বুঝতে দিস। তারপর বন্ধুত্ব গড়ে উঠবে। সেই বন্ধুত্ব যখন গভীর হবে, মনে হবে একে হারালে জগত অন্ধকার হয়ে যাবে, তখন বুঝবি ভালোবেসেছিস। ভালোবাসা কী এত সহজ রে! তোমায় নতুন করে পাব বলে হারাই ক্ষণে ক্ষণ…” সারা ঘরে সুচন্দ্রার গলা ছড়িয়ে পড়ল।

বাইরে আবার ঝেঁপে বৃষ্টি এল।।

রোহিণী ধর্মপাল

 

 

Nila Banerjee

পুকুরঘাট

একদিন আমরা মাত্র কয়েকজন সদস্য নিয়ে পুকুরঘাট নামের একটি মেয়েদের ভার্চুয়াল দল খুলে ছিলুম। অচিরেই সে কয়েকটি সদস্যের দল কয়েক হাজার সদস্যের মেয়েদের দল হয় ওঠে। পুকুরঘাট দলের মত এত গুণী মেয়েদের সমাহার বাংলাদেশে খুব কম ভার্চুয়াল দলে আছে। কাজেই সেই দল সেখানেই আটকে থাকবে না বলা বাহুল্য। তাই পুকুরঘাট দলের অন্যতম উদ্যোগ হিসেবে প্রকাশিত হলো পুকুরঘাট পত্রিকা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *