মেয়েদের গল্পটা বলা হোক মেয়েলি ভাষায়

শ্রীজাতা গুপ্ত
কোন ভাষা নারীসুলভ, কোন ভাষা পুরুষালি এ নিয়ে একটা অনলাইন ফোরামে বক্তব্য রাখছেন দেশ বিদেশের মানুষ। কেউ বলছেন ফরাসি বা মালায়ালাম মেয়েলি, রাশিয়ান বা আফ্রিকান ক্লিক-ভাষা তুলনামূলক পুরুষালি। এদের কারো বক্তব্যই ভাষাতত্ত্ব থেকে উঠে আসছে না কারণ মূল প্রশ্নটি ভাষাতত্ত্বের নিরিখে অপ্রাসঙ্গিক। ক্রিয়াপদ বিশেষ্য বা বিশেষণের লিঙ্গনির্মাণ সম্ভব হলেও গোটা একটি ভাষার মেয়েলি বা পুরুষালি হয়ে ওঠার কোনও দায় থাকেনা। প্রধানত শুনতে কেমন লাগছে তার উপর দাঁড়িয়ে ছিল আলোচনাটা। যে ভাষা শুনতে ‘মিষ্টি’ বা ‘নম্রমধুর’ শোনায়, তা’ নারীসুলভ; কানে ‘কর্কশ’ ঠেকলে পুরুষালি। নারীস্বভাবে নীচুস্বর কমনীয়তা কাম্য, পুরুষের রুক্ষ ইমেজ : এই স্টিরিওটিপিক প্রত্যাশা ছায়া ফেলছে ভাষা চরিত্রায়নে।
আমার সদ্য প্রকাশিত প্রথম বই হাতে নিয়ে দু’পাতা উলটে এক পাঠক মন্তব্য করেছিলেন “লেখা পড়ে মনে হচ্ছেনা কোনও মেয়েছেলের লেখা।” কারণ জিজ্ঞাসা করায় বলেছিলেন, ‘কোনও ন্যাকামি দেখছিনা, “আমায়-বাঁচাও-আমায়-বাঁচাও’ হাবভাব নেই।”শব্দ নির্বাচনের ক্ষেত্রেও এই ভাগাভাগি বিচার চলে। এমন কিছু শব্দ আছে যা মেয়েদের মুখে শুনলে ছিছিকার পড়ে যায়, আবার কিছু শব্দ কেবল মেয়েরাই বলবে এমনটাই রীতি। বাংলায় ‘মিনসে’ ‘অনাছিষ্টি’ ‘ধিঙ্গি’ ‘সোহাগ’ এসবের মেয়েদের মুখেই মানায়। এর উপর অবশ্যই চেপে বসে জাত ধর্ম আর্থসামাজিক অবস্থানের পরত, অতএব, সব মেয়েলি শব্দ সব মেয়েদের মুখে মানানসই নয়। বিধান দিচ্ছে কে? পুরুষতন্ত্র। বাঙালি মেয়েদের কথ্য ভাষা নাকি এতখানি আলাদা যে সেইসব শব্দ একজাগায় করে গোটা একটি অভিধান বানালেন সুকুমার সেন Women’s Dialect in Bengali নামে। মূল কোনও ভাষা থেকে বিছিন্ন হয়ে নিজস্ব পরিবর্তিত রূপে কোনও ভাষা ব্যবহার হলেই টেক্নিক্যালি তাকে ‘Dialect’ বলা হয়। মেয়েলি বাংলা ভাষা কার থেকে আলাদা হল? পুরুষের ভাষার থেকে। অর্থাৎ মূল বাংলা ভাষা হল যে ভাষায় বাঙালি পুরুষ কথা বলে, মেয়েদের ভাষা ব্যবহার তার ব্যতিক্রম, অতএব, নতুন ডায়ালেক্ট বলে আলাদা লিস্টি করতে হচ্ছে।
সাংস্কৃতিক ভৌগোলিক, এমনকি, সাময়িকভাবে একই ভাষার অংশীদার হয়েও পুরুষ মহিলা আলাদা কথা বলছে কেন? ডঃ সেন বলেছেন, এর কারণ মেয়েলি ভাষা (১) সাধারণত রক্ষণশীল, (২) তীব্রভাবে অনুভুতি প্রকাশে সক্ষম, বিস্ময় হোক বা নিন্দা, (৩) শ্রুতিকটূ শব্দের বদলে প্রতীকী নরম শব্দে ভরা, (৪) নানা কুসংস্কার প্রভাবিত, (৫) শব্দসংখ্যায় পুরুষের ভাষার চেয়ে দীনতর, (৬) ঠাট্টা বিদ্রূপ শ্লেষ উপহাসে পরিপূর্ণ। মেয়েদের স্বভাব এবং জগৎ আলাদা, তাদের চিন্তার পরিসর ক্ষুদ্র, বহির্জগতের সঙ্গে তাদের ওঠাবসা নেই, তাই মেয়েলি ভাষা পুরুষের ভাষা থেকে ভিন্ন হওয়াই স্বাভাবিক, এই অনুমান কে ধ্রুবসত্য ধরে নিয়ে ডঃ সেন এর মত অনেক ভাষাবিদ ভাষাচর্চা করেছেন, এবং এড়িয়ে গিয়েছেন এর পিছনের সামাজিক বৈষম্যের অস্বাভাবিক অন্যায়। ভাষার মতই পরোক্ষে এঁরা চাইছেন মেয়েদের জায়গাটা পুরুষদের থেকে আলাদা রাখাই বাঞ্চনীয়। সুকুমার সেন বইয়ের মুখবন্ধে খানিক দুঃখসহকারে লিখছেন, শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতি ভাষায় এই লিঙ্গবিভেদ ঘুচিয়ে দিচ্ছে অনেকখানিযার ফলে পুরনো অনেক মেয়েলি শব্দ আর শোনা যাচ্ছেনা। তারা পুরুষদের ভাষায় কথা বলছে। এর প্রায় অর্ধশতক পার করে Language and Woman’s Place শীর্ষক একটি প্রবন্ধ লিখবেন রবিন ল্যাকফ, যা প্রথমবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেবে পুরুষতান্ত্রিক পরিকাঠামোয় মেয়েদের ভূমিকা এবং অবস্থান সীমাবদ্ধ করার ফলে মেয়েলি ভাষাব্যবহার ভিন্ন হয়েছে।
প্রাণীজগতে নানা প্রজাতির পুরুষ এবং মহিলা সদস্যদের যোগাযোগের মাধ্যমে বিস্তর ফারাক দেখা যায়। পুরুষ প্রজাপতি, পাখি বা মাছের শরীরে ঝলমলে রঙ, উলটোদিকে তাদের মহিলারা নেহাৎই সাদামাটা। ছেলে পাখিরা গান গাইতে পারে, বাহারি বাসা বাঁধতে পারে, মেয়েরা সেসব দেখে শুনে পছন্দ করে সবচেয়ে রঙিন, সর্বাধিক সুরেলা পুরুষটিকে পছন্দ করে। ছানাপোনার জন্ম হয়। জিনগুলি এগিয়ে চলে। প্রকৃতির নিয়মে একদলের জিন এমনভাবে তৈরী হয়েছে যাতে অন্য পক্ষের জিন সেই ভাষা চিনতে সক্ষম হয়। ব্যাস! এইটুকুই প্রয়োজন। এরজন্য দুপক্ষেরই কষ্ট করে রংচং মেখে ঘুরেবেড়ানো নিষ্প্রয়োজন। এমন নয়, যে মেয়ে-ময়ূরের নীল পেখম থাকা সত্ত্বেও তাকে ছোট থেকে শেখানো হচ্ছে, তুমি যেন কোনওদিন পাখা মেলো না। গান গাইতে বারণ করা হচ্ছেনা মেয়ে-গিবনদের। মানুষের মেয়ে-পুরুষের ভাষাগত পার্থক্য কিন্তু এরকম কোনও প্রাকৃতিক নিয়মের ফলাফল নয়। সামাজিক বিধিনিষেধ দিয়ে একপক্ষের ইচ্ছা-অনিচ্ছার তোয়াক্কা না করে তাদের নিয়ন্ত্রণ করার ষড়।
ভাষা প্রয়োগের উপর বিধিনিষধ শৈশব থেকে ছেলে মেয়ে উভয়ের ক্ষেত্রেই থাকে, তবে মেয়েদের বাধা তর্কাতীতভাবে অনেক বেশি। ছোট থেকেই আমাদের প্রবণতা থাকে রাস্তাঘাটে শোনা গালিগালাজ রপ্ত করব। এ অবস্থায় একটি ছেলেকে শেখানো হয়, খারাপ কথা বলতে নেই, মেয়েদের শেখানো হয়, মেয়েরা এসব কথা বলেনা। এই শুরু অসমতা। মেয়ে হিসেবে আলাদা করে আচরণের নিয়মাবলি বলে দেয় যে শুধুমাত্র মেয়ে পরিচয়টুকুর জন্যই মনে যা আছে তা সবসময়ে প্রকাশ করার স্বাধীনতা আমার নেই। এই Talk like a Lady প্রশিক্ষণের ঠেলায় আজীবন মেয়েলি ভাষা খর্ব, অনেক কিছু বলার জন্য নরমসরম প্রতীকী শব্দের আড়াল নিতে হয়, এমনকি নিজের শরীর সম্পর্কেও খোলাখুলি কথা বলা ছাড়পত্র নেই। ‘শরীর খারাপ’ একটি মেয়ের মুখে যে অর্থ বহন করে ছেলেদের বেলায় সম্পূর্ণ আলাদা। ইংল্যান্ডে এখনও বাথরুম পেলে মহিলারা বলেন ‘I shall return shortly having powdered my nose’. এই যে ‘হিসি হাগু পেলে’ না লিখে ‘বাথরুম যাওয়া’ লিখলাম, এর কারণ আমার আশৈশব লালিত ভাষাব্যবহার শিক্ষা, যার সম্পর্কে জানার পরেও এর হাত থেকে নিস্তার নেই।
মেয়েলি ভাষার প্রত্যাশা হল, মেয়েরা হালকা বিষয়ে কথা বলবে, পর্দার রঙ, আকাশের রঙ, গাড়ির রঙ। ছেলেরা বলবে মুদ্রাস্ফীতি, নিম্নচাপের কারণ বা মাইলেজ। এই হিসেবনিকেশের বাইরে গিয়ে কোনও পুরুষ যদি জামদানির সূক্ষ্ম বুনোট নিয়ে মন্তব্য করেন বা কথায় কথায় প্রকাশ করেন গভীর আবেগ, তার দিকে সচরাচর বাঁকা চোখেই তাকায় সমাজ। ফেমিনিস্ট ভাষাবিদরা বলছেন সমাজব্যবস্থার উচ্চস্তরে পৌঁছোতে মেয়েদের পথের অন্যতম বাধা ভাষ্যে। ক্ষমতার ভাষা স্বতঃস্ফূর্তভাবেব্যবহার করতে কুন্ঠায় ভুগছেন মেয়েরা, যার ফলে অনেক ক্ষেত্রেই তাদের কথা গুরুত্ব পাচ্ছে না। শোনাই যাচ্ছেনা তাদের স্বর। কারণ আমরা ভাষাকে যতখানি ব্যবহার করি, ভাষা আমাদেরকেও ততখানিই ব্যবহার করে। ল্যাকফ বলছেন,
The marginality and powerlessness of women is reflected in both the ways women are expected to speak, and the ways women are spoken of. অর্থাৎ মেয়েদেরমুখের ভাষা নয়, ভাষায় মেয়েদের কোথায় স্থান দেওয়া হছহে তার দিকেও তাকানো জরুরি। গবেষণা বলছে, মেয়েদের স্বতন্ত্র পরিচয়ের বদলে অমুকের মেয়ে বোন স্ত্রী বা মা হিসেবে মহিলাদের পরিচয় দেওয়া হয়, সে তার পেশাগত অবস্থান যাই হোক। ওরা কী করবে, কী পরবে, চালচলন কেমন হবে, পুরুষের অধীনে থাকবে, কেন থাকবে,আবহমানকাল ধরে ভাষাকে অস্ত্র করেএইসব নির্মাণ করা হয়েছে প্রবাদপ্রবচনের মাধ্যমে, যেগুলিকে প্রতিপদে মনে।করিয়ে দেওয়া হয়। ২৪৫টি বিভিন্ন ভাষা-সংস্কৃতি থেকে পনেরো হাজার সাতশ’ পঁয়ত্রিশটি এমন উদাহরণ সংগ্রহ করেছেন মাইনেকে শিপ্পার Never Marry a Woman with Big Feet বইয়ে।
ল্যাকফ এর পর এই পথে কাজ এগিয়েছে, Language and Gender Studies নামে গবেষণার নতুন শাখা উঠে এসেছে, যার মূল লক্ষ্য হয়ে উঠেছে ভাষাকে বদলে আরও লিঙ্গ-নিরপেক্ষ করে তোলা। পরীক্ষানিরীক্ষা আজও চলছে, কিন্তু প্রশ্ন অন্য। ভাষাবদল করে কি লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য দূর করা সম্ভব? প্রথাগতভাবে কিছু নতুন নিয়ম শিখে ‘he’ বা ‘she’ না লিখে inclusive pronoun ‘they’ ব্যবহার করে কেবল পলিটিক্যালি কারেক্ট থাকতে শিখছি, এর বেশি কিছু কি পাওয়া গেল? প্রবন্ধের শেষ পর্যায় গিয়ে ল্যাকফের সঙ্গে অনেক বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করলেও একটি বিষয়ে আমি দ্বিধাহীনভাবে একমত- খামোখা ভাষা বদলে সমতা প্রতিষ্ঠিত করা যাবেনা। আলোচ্য সমস্যা সামাজিক মনস্ত্বত্বের এতখানি গভীরে প্রোথিত যে সামাজিক বদল না আনতে পারলে ভাষায় মেয়েদের জায়গা কখনওই বদলাবেনা। বসন্তরোগে গায়ের গুটিগুলির উপর মলম লাগিয়ে কি আর ভেতরের ভাইরাসটিকে হারানো যায়!
মোদ্দা কথা, যে শ্লেষাত্মক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ‘মেয়েলি ভাষা’ শব্দবন্ধ ব্যবহার করা হয় তাকে একটি ইতিবাচক মোড় দেওয়া জরুরি মেয়েলি ভাষ্যকে অস্ত্র করেই যা একমাত্র সম্ভব। যেভাবে ‘ব্ল্যাক’ বা ‘ক্যুইয়ার’ বলে কৃষ্ণাঙ্গী বা এলজিবিটি সম্প্রদায়ের মানুষদের বিদ্রূপ করার হাত থেকে এই বিশেষণগুলিকে মুক্তি দিয়েছে দীর্ঘকালের প্রতিবাদ। মেয়েদের ভাষা নথিভূক্ত করুক মেয়েরা।মেয়েরা বলুক কীভাবে তারা দেখছে প্রেম বা যুদ্ধ, আশেপাসে কীভাবে বাঁচছে তাদের আত্মীয়ারা? ইতিহাস সমাজ সাহিত্য শীল্প নতুন করে পাঠ করুক মেয়েলি দৃষ্টি। এলেনা ফেরন্ত যেভাবে বিকল্প মাতৃত্বের গল্প বলেছেন তার উপন্যাসে, ম্যাগি জিলেনহল যার রূপ দিলেন The Lost Daughter ছবিতে। সমাজে প্রতিষ্ঠিত সংজ্ঞায় অন্ধ বিশ্বাস রেখে নিজেদের নানারঙের অভিজ্ঞতা থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখলে মেয়েলি যাপনের বহুস্বর ধরে রাখবে কে? পক্ষ বিপক্ষ যখন তৈরী হয়েই রয়েছে তখন মেয়েদের গল্পটা বলা হোক মেয়েলি ভাষায়।

শ্রীজাতা গুপ্ত
অসাধারণ।
অসাধারণ লেখা। ভাবতে শেখায়
খুব যুক্তিযুক্ত লেখা। ধন্যবাদ লেখিকাকে। আশেপাশে ও শিল্প বানানটি ঠিক করে নিলে ভালো লাগবে।
Vasar o je gender achhe eai lekha pore bujhlam,etodin to jantam je Vasa marjito r oshlil hoy..aj bujhlam vasa purus o stree o hoy.. dhonyobad apnake
ভাবাচ্ছে লেখাটি।
ভাবনা সমৃদ্ধ লেখা। প্রথাগত দৃষ্টিভঙ্গিকে ভাঙতে মেয়েদের কলম হয়ে উঠুক বহুমাত্রিক, বলিষ্ঠ। বহির্বিশ্বের স্বাদ নিতে নিতে মন খুলে কথা বলুক তারা । তবেই এই দূরত্ব কমবে।
সুন্দর সুচিন্তিত লেখা । প্রসঙ্গত শর্মিলা বসু দত্তর ‘বাংলায় মেয়েদের ভাষা’ বইটির কথা উল্লেখ করলে ভালো লাগত।
সুন্দর, সুচিন্তিত লেখা। প্রসঙ্গত শর্মিলা বসু দত্তর ‘বাংলায় মেয়েদের ভাষা’ বইটির উল্লেখ করলে ভালো লাগত।