মনের মাঝে যে গান

গৌরী সেন
“গানগুলি মোর শৈবালেরই দল / ওরা বন্যাধারায় পথ যে হারায় উদ্দাম চঞ্চল।”
গান শিখতে শুরু করার প্রথম দিকে, গুরুজীর কাছ থেকে, প্রায় হাতেপায়ে ধরে এই গানটি নিয়েছিলাম। ওই যে কোমল নিষাদ ছুঁয়ে সুর গড়িয়ে আসে গান্ধারে, ‘গানগুলি মোর’, তারপর ছোট্ট এক দুলন্ত লতার কুঁড়ির মতন,”আ… হা….!” সে যেন অজস্র নাম না জানা ফুল ফুটিয়ে যেত এক কিশোরীর মনের বাগানে। কাহারবা তালে এ গানের চলন সত্যিই ভারি মোহময়। গুরুজী বলতেন, দ্যাখো, এই “উদ্দাম চঞ্চল”কে দ্যাখো চ..অ..ন্…চল্ …। একেবারে কেমন ছুটে গিয়ে নিষাদ হয়ে তারার সা কে ছুঁয়ে আসছে, ঠিক ক্রিজে থাকা ব্যাটসম্যানের সিঙ্গল্ রান নেওয়ার মত। তেমনি করে সুরকে ছুট্ করাও, গলায় ওই চঞ্চলতা দোলাও। হ্যাঁ, গুরুজী মস্ত ক্রিকেট অনুরাগী ছিলেন। তারপর সুরের ঢেউএ নাচতে নাচতে সাম্পান বেয়ে চলতো গানের বাণী-
“ওরা কেনই আসে যায় বা চলে,
অকারণের হাওয়ায় দোলে
চিহ্ন কিছুই যায় না রেখে, পায় না কোনো ফল।।”
পরে অনেকবার ভেবেছি, কী আশ্চর্য এ গানের কথা! যিনি নিজের গান সম্পর্কে এডওয়ার্ড টমসনকে এক জায়গায় বলছেন,”If all my poetry is forgotten, my songs will live with my countrymen and have a permanent place”, বলেছেন তাঁর গান হচ্ছে “A parallel growth to my poetry “। তিনিই আবার গানের বাণী রচনা করছেন। “চিহ্ন কিছু যায় না রেখে, পায় না কোন ফল!” ওই কম্প দ্বিধার অধরা মাধুরী মিশিয়েছেন এমন আরও অনেক লাইনে,
“আমার সুরগুলি পায় চরণ, আমি পাই নে তোমারে” লিখেছেন। “আমি কি গান গাব যে ভেবে না পাই” অথবা “হেথা যে গান গাইতে আসা/আমার হয় নি সে গান গাওয়া।” কী বিস্ময়কর না!
কলেজের দিনগুলোতে মাঝে মাঝে মামার বাড়ি ফিরে যেতুম। বারাসাত লোকাল। ফিরতি পথে দুপুরবেলায় ভিড় থাকতো না বললেই চলে। প্রায়ই দেখতাম তাঁকে বহুব্যবহারে অনতিশুভ্র ধুতিটি, হলদেটে ফতুয়া, হাতে একটি খঞ্জনীসদৃশ কিছু। তো একদিন, সেদিন আকাশ ছেয়ে এসেছে একরাশ মধুপিঙ্গল মেঘ, মালকোঁচা মেরেছে উড়নচণ্ডী হাওয়া। দাঁড়িয়ে আছে ট্রেন বিশরপাড়ার কাছে কেন কে জানে। দুপাশের নয়ানজুলিতে কুটিপাটি হচ্ছে কচুরিপানার কিশোরীফুল। উৎকর্ণ হয়ে উঠলাম-
“ওগো কাঙাল আমারে কাঙাল করেছ আরো কী তোমার চাই।”
“প্রতিদিন প্রাতে নব নব ধনে তুষিব তোমারে সাধ ছিল মনে ….
ভোরের ভৈরবী উদাস মধ্যাহ্ণে সবকটি পাপড়ি মেলে ফুটে উঠেছিল সেদিন।
ভিখারি আমার ভিখারি,হায়
পলকে সকলই সঁপেছি চরণে আর তো কিছুই নাই।”
যাত্রীবিরল কামরার দরজার পাশের দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। খোলা গলা। কিন্তু ঈষৎ ধরা ধরা। যাকে বলে হাস্কি। আগেও শুনেছি কখনও “ও দয়াল বিচার করো”, কখনও “বাহারো ফুল বরষাও”। এক মুহূর্তে অনেক জোড়া চোখ ঘুরে যায় ওই সুরের উৎসমুখের দিকে,ওই সুরভিখারির দিকে। কিন্তু সেদিন মেঘভারানত দ্বিপ্রহর যে উন্মুখ হয়ে উঠল। সে কি গানের আকুতিময় কথা, না কি সুরের নিবিড় সমর্পণ ! “আরও যদি চাও মোরে কিছু দাও”, এমন কথা পৃথিবীর আর কোনো গীতিকার কি লিখেছেন কোথাও? “ভিখারি আমার ভিখারি হায় “, দাতাও ভিখারী, গ্রহীতাও তাই। কী অদ্ভুত আর নিখুঁত এই পারস্পরিক সম্পর্ক! সত্যি,আমরাও কি নই তাঁর কাঙাল, বা তিনি আমাদের?
বৈশাখ এলেই তোড়জোড় শুরু হয়ে যেত আমাদের পাড়াতুতো রবীন্দ্রজন্মোৎসব পালনের। রায়দের মস্ত ছাদে শতরঞ্জি বিছিয়ে চৌকি পেতে অস্থায়ী মঞ্চের একপাশে মালাচন্দনসজ্জিত কবির ছবি বসিয়ে, পক্ষব্যাপী সে এক উচ্ছল উন্মাদনা। রিহার্সাল হতো বিকেলে। রুমুদের চিলেকোঠার ঘরে। শাপমোচন হবে সেবছর, তুমুল তার প্রস্তুতি। রুমুদের চিলেকোঠার অন্যদিকে আর একটা ঘর আছে,বাইরে থেকেই বন্ধ করা থাকে। কে যেন বলেছিল…। সেদিন বৈশাখের চোখে নেমেছিল অকালশ্রাবণ। একমাথা বৃষ্টি মাথায় করে ছুটে এসেছি মহলায়, আর কেউ তখনও হাজির হতে পারে নি। জল মুছতে মুছতে জানালার খড়খড়ি খুলে দিতে গেলাম। বৃষ্টিধারা ধেয়ে এল সবেগে ,কিন্ত আমার হাত থেমে গেল সেখানেই। বন্ধ দরজা কেমন করে খুলে গেছে। রুমুর সেজপিসী দাঁড়িয়ে আছেন ছাতের মাঝখানে। জানতাম তিনি মাঝে মাঝেই অপ্রকৃতিস্থ হয়ে পড়েন। সেই কারণে অন্য ঘরটিতে বন্ধ করে রাখতে হয় তাঁকে। কিন্তু সেদিনের প্রমত্ত বর্ষণে কী করে দরজা খুলে গিয়েছিল, মুখখানি আকাশের দিকে তোলা, অবিন্যস্ত আঁচল, বৃষ্টিরেণু মাখতে মাখতে তাঁর রুক্ষ ধূসর একঢাল কেশ দুলে উঠছিল। “কিসেরই পিয়াসে কোথা যে যাবে সে পথ জানে না” শাপমোচনের গান। নির্ভুল সুরে, কণ্ঠতুলিতে আঁকা মীড় যেন আদর করছিল গানের বাণীকে। “সখী আঁধারে একেলা ঘরে মন মানে না ….।” চিত্রার্পিত আমি শুনতে শুনতে দেখতে দেখতে হারিয়ে যাচ্ছিলাম কোথাও। যেন সেজপিসী নয়, যেন শুশ্রূষাকাতর নির্বন্ধু সব মানুষের আর্তি বিন্দু বিন্দু সুরের অশ্রু হয়ে ছড়িয়ে পড়ছিল ব্যথাতুর হাওয়ায় , “পথ জানে না, সখী!” শুধু মনে হচ্ছিল, দেশকালের সীমা ছাড়িয়ে রবীন্দ্রনাথের গান এক অনন্তপ্রবাহ। স্বতঃশ্চল আর চিরউজাগর।

গৌরী সেন
ভালো লেখা আজ ভালো দিনে পড়তে পেয়ে যারপরনাই খুশি❤️
অনুভবের কি অপূর্ব প্রকাশ।
অসাধারণ……অসাধারণ অনুভবের কথামালা দিদি…..”দেশকালের সীমা ছাড়িয়ে রবীন্দ্রনাথের গান এক অনন্তপ্রবাহ”…….আপনার এ অনুভূতির শরিক আমরাও 🙏❤
সুরে ভেসে গেলাম! ❤️
বড়ো ভালো লেখা, খুব ভালো লাগলো
বাহ্..কোথায় গিয়ে যেন এক অনন্য স্পর্শের ছোঁয়া লাগলো..
অসাধারণ লাগলো। আপনার মতো সংবেদনশীল মন খুব কমই আছে। লেখায় আপনার মনের সম্পূর্ণ প্রতিফলন ঘটেছে।
মুগ্ধতা একরাশ গো। সেজপিসির বৃষ্টিধোয়া গানের বেদনা লেখায় রূপ পেল। অপূর্ব…
মগ্ন হয়ে পড়লাম… অনবদ্য লিখেছেন!!
মনের মাঝে যে গান মনে থাকবে অনেক দিন। অনবদ্য।
Gouridi… গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে ❤️
কোথা যে উধাও হলো মন এমন বানী শুনে। কেন যে মন ভোলে আমার মন জানে না
খুব ভালো লাগলো