ময়না তদন্ত

এবারের চলচ্চিত্রের ময়নাতদন্তে রইলো সিনেমা ‘তাসের ঘর’, কাটা -ছেঁড়া করলেন সুনেত্রা সাধু তাঁর নিজস্ব ভঙ্গিতে। পুকুরঘাট ময়নাতদন্তের রিপোর্ট পেশ করলো আপনাদের সকলের কাছে।
সিনেমা-তাসেরঘর
পরিচালক- সুদীপ্ত রায়
প্রযোজক=চিলেকোঠা ফিল্মস
অভিনয়ে-স্বস্তিকা মুখার্জি-যুধাজিত সরকার
প্রতিটা জিনিসের একটা নিজস্ব গন্ধ থাকে, এমনকি মরে যাওয়া সম্পর্ক বা একাকীত্বেরও…
সেই গন্ধকে চিনতে শিখলে সাধারণ জীবনটাও বিশেষ হয়ে ওঠে। এই গন্ধ বিলাসিতা বা গন্ধ কাতরতা জুড়ে রয়েছে “তাসের ঘর” সিনেমাটির পরতে পরতে। “তাসের ঘরে”র মালকিন সুজাতা এক সাধারণ উচ্চ মধ্যবিত্ত গৃহবধু। দৃশ্য এবং অদৃশ্য সমস্ত জিনিসকে যে রঙ আর বিচিত্র গন্ধ দিয়ে বিচার করে। মধ্য তিরিশের সেই গৃহবধু সারা সিনেমা জুড়ে দর্শকদের গল্প শুনিয়েছেন, তার নিজের গল্প। সেই গল্পে এসেছে তার অতীত , সে কি ভাবে বিয়ে করে একটা সুন্দর সংসার গড়তে চেয়েছিল, বিয়ের খবরে সে ঠিক কতটা খুশি হয়েছিল অথবা তার আগের বাড়িতে সাজানো গাছ গুলো ঠিক কেমন ছিল…
গল্পচ্ছলে নিজের কথা বলতে গিয়ে একটু একটু করে লোক দেখানো সুখের চাদর খুলতে শুরু করে সুজাতা। গল্প বলার মুহূর্ত গুলোতে তার মুখে ফুটে ওঠে এক নীরব দীর্ঘশ্বাস, ক্ষীণ হতাশা। যে ক্ষোভ হতাশা এবং যন্ত্রণা সে সুক্ষ স্যাটায়ারের মোড়কে যত্ন করে ঢেকে রাখে। তাসের ঘর সিনেমার এই গল্প বলার ধরন গড়পড়তা বাংলা সিনেমার থেকে একেবারেই আলাদা।
লকডাউন চলাকালীন একটি দিনের গল্প আমাদের শোনায় সুজাতা। যেখানে আমরা তাকে তার দৈনন্দিন পারিবারিক কাজ করতে দেখি। সে রান্না করে, ঘর গোছায় বরের ফাইফরমাস খাটে, কেক বেক করে, গাছে জল দেয় আর অনর্গল গল্প বলে যায়। তার গল্প বলার ভঙ্গীটি বড় মজার, আবার কখনো কখনো সেটাই হয়ে ওঠে রহস্যময়। আটপৌরে সুজাতার আড়ালে ঝলকে ওঠে এক অন্য নারী।
লকডাউনে সুজাতা তার স্বামীর সঙ্গে গৃহবন্দী। দুজন একসঙ্গে থেকেও একাকীত্বকে গভীর ভাবে উপলব্ধি করে সে, ক্রমে ক্রমে একটা নির্জন জগতের বাসিন্দা হয়ে যায়। কারণ সংসার শুধুমাত্র দুটো মানুষকে নিয়ে গড়ে ওঠে না, সেই সম্পর্কে উষ্ণতা থাকা জরুরি। সুজাতার জীবনে তার বড়ই অভাব।দুটো নির্লিপ্ত মনের সহাবস্থান সংসার হতে পারে না। তাই সুজাতা শুধুমাত্র তার নিজের সঙ্গ উপভোগ করে। তার চারপাশের জড় বস্তুরা হয়ে ওঠে তার একান্ত আপন। তাদের সঙ্গে কথা বলে সময় কাটে তার। গাছেরা মাতৃত্বহীন সুজাতার সন্তান হয়ে ওঠে। পরম যত্ন আর মমতা দিয়ে তাদের বড় করে সে। একাকীত্বকেই গভীর ভাবে ভালোবেসে ফেলে সুজাতা। চার দেয়ালের সংসারটুকুই তার জীবন তার বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন, আবার এই সংসারই তার নিজের রাজত্ব, কারো দখলদারি সে মেনে নিতে পারে না, গুটি কয়েক কাল্পনিক ইঁদুরকে সে শাসন করে, ভয় দেখায়। উৎপাতহীন নিটোল সংসার চায় সে। কিন্তু এই ঘর এই সংসার যে আদতে “তাসের ঘর” তা সুজাতা দিব্যি টের পায়। তবু সে জড়িয়ে থাকতে চায় মশলার কৌটোর সাথে, সবজি কাটার ছুরির সাথে কেকের ব্যাটারের সাথে। এক সাধারণ আটপৌরে সংসার আর কয়টা পোষা গাছ নিয়ে আবর্তিত হয় তার জীবন। বদমেজাজি স্বামী তাকে পাগল বলে দাগিয়ে দেয়। শর্মি নামের এক তৃতীয় ব্যক্তির অস্তিত্ব টের পায় সুজাতা। দরজা বন্ধ করে তার স্বামী কাল্পনিক যৌনতা উপভোগ করে শর্মির সাথে, সুজাতা আড়ি পেতে শোনে। শর্মির প্রতি তার মায়া হয়, আহা রে স্বামীটা প্রেমিকাকেও শাসায়! হাত কাটা নাইটি পরে শর্মি নাকি তার স্বামীকে সিডিউস করছে! এই অপরাধ! হাসি পায় ভীষণ হাসি পায় সুজাতার আসলে স্বামীর অবদমিত যৌনতার শিকার তো সে নিজে, প্রতি রাতে ভালোবাসাহীন এক কামুক মানুষের হাতে তাকে ধর্ষিত হতে হয়। মানুষটা তার স্বামী তাই সাত খুন মাফ। সমস্ত সুখ উজাড় করে দিয়েও সুজাতা পদে পদে অবহেলিত হয় স্বামীর কাছে। মুখের হাসি দিয়ে সে চাপা দেয় ক্ষোভ রাগ দুঃখ হতাশা। ধীরে ধীরে একাকীত্বের অন্ধকার গ্রাস করে তার জীবন। আসলে এই পৃথিবীতে আমরা সবাই একলা, জুড়ে থাকার ভান করি শুধু। সাজানো সোফাসেট, বাহারি পর্দা আর গোছানো খাবারের ট্রে আমাদের সুখের ছবি দেখায়। পরিচালক সুদীপ্ত রায় দ্বারা পরিচালিত “তাসের ঘর” সিনেমাটি ছেচল্লিশ মিনিটে আপাত সুখের ভিতর অসুখের কাঁটা খুঁজতে শেখায়, আর শেখায় গন্ধ বিচার। মাছের আঁশ, পুঁজ-রক্ত, মলম, মাড়ির গন্ধ সুজাতার মনে বিতৃষ্ণার জন্ম দেয় এই গন্ধ থেকে মুক্তির উপায় খোঁজে সুজাতা।
সুজাতা দর্শকদের গল্প বলে, তার জীবনের খুঁটিনাটি টুকরো টুকরো ঘটনা শুনে আমরা তার অসহায়ত্ব মাপি কখনো বা তার চোখে ঝলকে ওঠে প্রতিশোধ স্পৃহার আগুন। সে সামলে নেয়, সংযত হয়। যতক্ষণ সিনেমাটি চলতে থাকে ততক্ষণ মনে হয় এ তো আমাদেরই কথা, কিন্তু ছবির শেষে বুঝি সবাই সুজাতা হয়ে উঠতে পারে না।
সুজাতার চরিত্রে অভিনয় করেছেন স্বস্তিকা মুখার্জি। তাঁর স্বামীর চরিত্রে অভিনয় করেছেন যুধাজিৎ সরকার। স্বস্তিকা একজন প্রতিভাধর অভিনেত্রী। সম্প্রতি আমরা তাঁকে বিভিন্ন রকম চরিত্র নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে দেখেছি। তবে সুজাতার চরিত্রটি পরিচালক সুদীপ্ত রায় বড় যত্ন করে বুনেছেন। গল্পের প্রেক্ষাপট বহুতলের একটি অংশ, যেখানে দুটি ঘর একটা রান্নাঘর আর একটা ছাদ নিয়ে তৈরী হয় সিনেমার সেট। চরিত্র বলতে দুইটি। সুজাতা ও তার স্বামী। মৃত শাশুড়ী ক্ষণিকের জন্য ফ্ল্যাশ ব্যাকে আসে, বাকী সব চরিত্র কাল্পনিক হয়েও দিব্যি ধরা দেয় মননে। আমরা তাদের না দেখতে পেয়েও উপস্থিতি টের পাই। এইখানেই পরিচালকের মুন্সিয়ানা।
তাসের ঘর সিনেমাটি দেখতে গিয়ে মনে হবে সুজাতাকে আমরা খুব কাছ থেকে চিনি, যেসব নারী প্রতিনিয়ত শারীরিক ও মানসিক ভাবে নির্যাতিত, যারা বৈবাহিক ধর্ষণের স্বীকার, যারা সবটুকু অত্যাচার হাসি মুখে মেনে নিয়ে সংসার করে তাদের মধ্যে আমরা সুজাতাকে খুঁজে পাব। তবে সুজাতা কি সত্যি শেষ অবধি অত্যাচার সয়ে বাঁচবে? জানতে হলে দেখুন হৈ চৈ এর ওটিটি প্ল্যাটফর্মে প্রকাশিত সিনেমা “তাসের ঘর”। সুদীপ্ত রায় পরিচালিত ‘তাসের ঘর’ সিনেমাটি জায়গা করে নিয়েছে মেলবোর্ন চলচিত্র উৎসবে। সাহানা দত্তের লেখা গল্প, সুদীপ্ত রায়ের পরিচালনা ও স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়ের দূর্দান্ত অভিনয় আপনাকে বাংলা সিনেমা নিয়ে সদর্থক ভাবনা ভাবতে বাধ্য করবেই….
সুনেত্রা সাধু
সুনেত্রা’র রিভিউ তার লেখা মৌলিক গল্পের মতোই আকর্ষণীয় যা শব্দের ছায়া অনুসরণ করে সুজাতা’র গেরস্থালি তে উঁকি দিতে আগ্রহ জাগায়।
চমৎকার লাগলো। ❤️❤️খুবই দক্ষ বিশ্লেষণ ।