নারীর ভাষা নারীর লেখা নারীর রাজনীতি

যশোধরা রায়চৌধুরী
নারিকেলের শস্য, স্ত্রীলোকের বুদ্ধি। করকচি বেলায় বড় থাকে না; ডাবের অবস্থায় বড় সুমিষ্ট, বড় কোমল; ঝুনোর বেলায় বড় কঠিন, দন্তস্ফুট করে কার সাধ্য? তখন ইহাকে গৃহিণীপনা বলে। গৃহিণীপনা রসাল বটে, কিন্তু দাঁত বসে না। …
তার পরে মালা—এটি স্ত্রীলোকের বিদ্যা—কখন আধখানা বৈ পূরা দেখিতে পাইলাম না। নারিকেলের মালা বড় কাজে লাগে না; স্ত্রীলোকের বিদ্যাও বড় নয়। মেরি সমরবিল্ বিজ্ঞান লিখিয়াছেন, জেন অষ্টেন্ উপন্যাস লিখিয়াছেন—মন্দ হয় নাই, কিন্তু দুই মালার মাপে।
-বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কমলাকান্তের দপ্তর, মনুষ্যফল
ভাষা নিয়ে আলাদা করে কোন রাজনীতি হয়না, ভাষাই ত রাজনীতি আসলে। তবু এই ভাষা নামক বস্তুটি ব্যবহারের জিনিস, তাই বদল ঘটে এর, ক্রমাগত ঘষামাজা হয়ে ওঠে, ক্রমাগত একের পর এক পরিবর্তন , নতুন উপাদানের আত্তীকরণ, সবটাই চলে। বন্ধ করে রেখে দেওয়া যায়না ঘরে। নদীর মত বইতে থাকে ভাষা। পালটাতে থাকে।
কখনো কখনো এই ভাষাই হয়ে ওঠে শস্ত্র। রাজনৈতিক অস্ত্র। যেমন, ভাষার ভেতরে রাজনীতি দেখতে “চাইনি” বলেই আমরা দেখিনি, যে জীবনানন্দকে বরিশাল থেকে কলকাতায় প্রতিষ্ঠা পেতে এসে কী পরিমাণ যুদ্ধ করতে হয়। কেন উপন্যাসের পর উপন্যাস ট্রাংক বন্দি থাকে। অথচ, জীবনানন্দের লেখা কতটাই রাজনীতিসচতন তা আমরা একটু তলিয়ে দেখলেই বুঝব। তাঁর গদ্য ও কবিতা খুঁটিয়ে পড়তে গিয়ে কতরকমের রাজনীতির গন্ধ যে পেয়েছি তা সব লিখে ওঠার পক্ষে এই লেখা বড় ছোট। বাংলার মানসে জীবনানন্দ কী করে জীবনানন্দ হয়ে উঠেছেন, আর জসীমউদ্দীন কেন সেভাবে ‘আধুনিক’ বিবেচিত হলেন না, এ বিষয়ে আমানো মন্তব্য আমরা অন্য এক লেখায় রেখেছি। হিন্দু এলিট জীবনানন্দ বরিশাল থেকে কলকাতায় এসে যে কালচার শক-এর কথা তাঁর ছত্রে ছত্রে লিখেছেন, যেভাবে নিজেকে কলকাতার উপযোগী করে তুলেছেন অতি বেদনায় তাও আর এক গবেষণার বিষয়। এ জন্যে আমাদের তাঁর লেখা কবিতাগুলিকে পড়তে পড়তে বারবার ‘reading between the lines’ করার জন্য তাঁর কালপরিমাণ গদ্যের শরণাপন্ন হতে হবে। জীবনানন্দকে কেন ‘করেচ’ ‘খেয়েচি’ করে অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তকে চিঠি লিখতে হতো, রবীন্দ্রনাথকে চিঠি লেখবার সময়ে নিজের ইংরেজি সাহিত্যের জ্ঞান আওড়াতে হতো, কেনই বা তিনি লিখেছিলেন “পৃথিবীতে নেই কোনো বিশুদ্ধ চাকরি”? এসবকিছু দেখলে মনে হয়, কেমন যেন ‘চেনা চেনা। আবার অন্যদিকে, রূপসী বাংলা-র জনপ্রিয়তার তুঙ্গে ওঠার সময়টা রূপসী বাংলা লেখার সময়ের থেকে এত দূরবর্তী কেন? ১৯৩২-৩৩ খ্রিস্টাব্দে, বরিশালে, দিনের পর দিন এক ঘোরের মধ্যে বসে লিখে যাওয়া এই একগুচ্ছ সনেটধর্মী লেখা ছাপবার জন্য উপযুক্ত সময় কেন তখনই পাননি মুখচোরা ও বাঙাল এই কবি। আর যে বাঙালিকে রূপসী বাংলা বিপুলভাবে মথিত করে নিজেই এক মিথ হয়ে উঠল ১৯৫২-র দিকে, সে-বাঙালি কি মূলত পূর্ববঙ্গ থেকে উৎপাটিত, স্বদেশ হারানোর শোক ও নস্ট্যালজিয়াবিধুর হিন্দু শিক্ষিত বাঙালি নয়? রূপসী বাংলা-র শব্দসংকলনের চূড়ান্ত হিন্দু অনুষঙ্গগুলির গ্রহণযোগ্যতা কি এঁদের কাছে যথেষ্টই অমোঘ ছিল না? এসব বিষয়ে আরও পড়াশুনার প্রয়োজন ছিল, আছে। অথচ এক লেখায় সুবোধ সরকার লিখেছিলেন, লেখায় তিনি বলেছেন— “কবিতা শুধু নাইটিঙ্গেলের গান বনলতা সেনের চুল নয়।” বলেছেন, “বাংলা কবিতা শুধু প্রেম আসেনি, শুধু ধানসিঁড়ি লিখে আসেনি।”
ঠিক কোন মুহূর্তে, সাধারণ অর্থে, আমরা একটি লেখাকে প্রতিবাদী বলি, রাজনৈতিক বলি? কখন ভাষা হয়ে ওঠে রাজনৈতিক?
কথার ভেতরে জ্বালাময়ী বক্তব্য থাকতে হবে, নাকি বক্তা বা লেখককে কোন রাজনৈতিক পার্টির সদস্য হতে হবে? নাকি তাঁর সঙ্গে থাকতে হবে কোন এক বিপন্ন সময়ের নাড়ীর যোগ? কোন না কোনভাবে কি বক্তা বা লেখক চাইবেন সেই অনুভূতিগুলিকে শব্দে তুলে আনতে, যেগুলির ভেতর কোন না কোনভাবে রয়ে গেছে তাঁর চারপাশের বিক্ষত, বিধ্বস্ত অবস্থার প্রতি প্রতিক্রিয়া? সহজ করে বললে, মানুষকে স্পর্শ করছে এমন কিছু, যা অশুভ, যা অন্যায়… এবং তাঁর লেখায়, বা বাচনে সেই ব্যক্তি , সেই কথাটা কোনভাবে তুলে আনছেন।
যখন আমরা প্রথম বর্ষের ছাত্রী, আমাদের ইউনিয়নের বামপন্থী দাদাদের কাছে প্রথম রাজনীতির পাঠ, হাতেখড়ি চলছে, তখন একটা কথা শুনেছিলাম। এখনো কানে লেগে আছে। এবং এখনো বেদবাক্যের মতই সত্য।
“সবকিছুর মধ্যেই, বুঝলি, রাজনীতি আছে। এই যে তুই একটা জামা পরেছিস, এই যে তুই একটা বই ফেলে অন্য একটা বই কিনলি, এই যে তুই বাসে না উঠে ট্যাক্সিতে উঠলি, এগুলো প্রতিটি একটা করে রাজনৈতিক স্টেটমেন্ট। আজ যে বিষয়ে একটা প্রশ্ন উঠবে, সেখানে যদি দুজন কথা বলে আর তিনজন চুপ করে থাকে, এই চুপ করে থাকাটা দিয়ে সেই তিনজন কিন্তু রাজনীতির বাইরে থাকতে পারল না। সেও কিন্তু তার নীরবতা দিয়ে একটা রাজনৈতিক স্টেটমেন্ট দিচ্ছে মনে রাখিস। কোনও কিছু রাজনীতির বাইরে নয়।“
এই কথার পিঠোপিঠি আরও অনেকগুলো কথা উঠে আসে। এক, অবস্থানহীনতাও একধরণের অবস্থান। দুই , যে কোন মূল্যবোধই আসলে রাজনৈতিক , যে কোন সচেতনতাই আসলে রাজনৈতিক।
এই রাজনীতির সঙ্গে আজকের দিনের মারকুটে প্রশ্নসংকুল রাজনীতির যোগ নেই। আবার একইসঙ্গে, এর পরে, বহু বছর ধরে আমাদের জীবনযাপনে , পড়তে পড়তে লিখতে লিখতে যাকিছু দেখেছি , শিখেছি, জেনেছি, সবেতেই বার বার প্রমাণিত, ব্যক্তিগতই আসলে রাজনৈতিক। প্রতিটি মুহূর্তের বেচে থাকায় আমাকে অবস্থান নিতেই হয়েছে, আর আমাদের চারপাশেও , যেভাবে কথা বলা হয়, লেখা লেখা হয়, ভাবা হয়, পড়া হয়, তাও পালটে গেছে।
আর এখানেই আমার কাছে সবচেয়ে মূল্যবান হয়ে উঠেছে এই কথাটি – দ্য পার্সোনাল ইজ পলিটিক্যাল। সম্ভবত শুলামিথ ফায়ারস্টোনের কথা এটি। নারীবাদী দর্শনের অন্যতম প্রস্থানবিন্দু।
২
মেয়েদের লেখাকে নারীবাদীরা বিশেষ করেই বলেছেন রাজনৈতিক। সে অর্থে, যাঁরা সজোরে, সোচ্চারে প্রতিবাদী কবিতা লেখেননি কখনো, সেই মহিলাটি, রান্না করার আর শিশুপালনের ফাঁকে ফাঁকে প্রথম যেদিন একটা গোপন খাতায় কবিতা লিখছিলেন, তিনি আসলে বিপ্লবী। কেননা তাঁর সমাজ, তাঁর পরিপার্শ্ব, সবচেয়ে বড় কথা তাঁর পরিবার তাঁকে সে লেখায় উৎসাহ দেয়নি বা দেবেনা কখনো। অথবা , ওপরে ওপরে উৎসাহ দেখালেও, সে উৎসাহের পর পরই তাঁর ওপরে আসবে এমন সব দাবি, তাঁর সময়ের ওপরে আসবে এমন সব চাহিদা, যে লেখার ব্যাপারটাই হয়ে দাঁড়াবে এক লড়াই। একইসঙ্গে, তাঁর লেখার বিষয় যা-ই হোক, অন্তরে, অন্তরালে কোথাও তাঁর ওপর একটা শাসনের, নিষেধের বেড়াজাল আছেই, সেটাকে অস্বীকার করতে পারার ওপরেই নির্ভর করছেন তিনি আদৌ কিছু লিখে উঠতে পারবেন কিনা। একইসঙ্গে, লেখার পরবর্তী যে প্রক্রিয়া, ছাপার, প্রকাশিত হবার যে প্রক্রিয়া, তাও এক রাজনীতি বৈকি। এই সবকিছুর মধ্য দিয়েই এক নারীর লেখক হয়ে উঠতে পারা।
একটি মেয়ে যেই মুহূর্তে কাগজে কলমটি ঠেকাচ্ছেন আর একটি “লেখা” লিখে ফেলছেন, সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হচ্ছে পুরুষতন্ত্রের সঙ্গে তাঁর বোঝাপড়া। আজন্মকালের সামাজিক শিখে ওঠা তাঁদের বলে দেয়, মেয়েরা নিজেরা হবেনা , হতেই পারবে না লেখক। কারণ সে ত লেখক পুরুষের মিউজ হবার জন্য বলিপ্রদত্ত । নারীর রূপবর্ণনা করবেন কবি, নারী হল পুরুষের সৃষ্টিকর্মের প্রেরিকা বা প্রেরণা। শুধু লেখা কেন, আমাদের বিশ্বধারণাটাই ত এভাবে তৈরি। পুরুষ বিষয়ী , নারী বিষয়, পুরুষ জ্ঞাতা , নারী জ্ঞেয় (“ স্ত্রিয়াশ্চরিত্রাঃ /দেবা ন জানন্তি কুতো মনুষ্যাঃ” এই অতি জনপ্রিয় কথনের মূলেও সে ধারণা) , পুরুষ কর্ষণকারী , নারী প্রকৃতির মত, বসুন্ধরার মত, মৃত্তিকার মত ভোগ্যা ও কর্ষণযোগ্যা । এই প্রাচীন দ্বৈততা ভেঙে , একজন মেয়ে নিজেকে স্রষ্টা, নিজেকে কৃষ্টির বাহিকা ভাবা মানেই ত ওই যুগযুগান্তের ভাবনাটার মূলে কুড়ুল মারা। অর্থাৎ এর ভেতরের ক্ষমতাতন্ত্রকে ভেঙে ফেলারই প্রচেষ্টা। তাই তা একটা বিপ্লব, একটা লড়াই। প্রথম দিন থেকে শেষ দিন পর্যন্ত, এর পর, সেই লড়াই জারি। কেননা, একটা কবিতা লিখে তা ছাপতে দেওয়া থেকে কবি-শিল্পী-সাহিত্যিক মহলে পাত পাওয়া, স্বীকৃতি, পুরস্কার, সবের গায়ে লেপ্টে থাকে , তিনি তা জানুন চাই নাই জানুন, লিঙ্গরাজনীতি। সোজা বাংলায় জেন্ডার পলিটিক্স।
নারীর কলম তুলে নেওয়াই যদি হয়ে থাকে প্রতিবাদ, তবে বাংলা সাহিত্যের আঙিনায় অন্নদাসুন্দরী দেবী বা জীবনানন্দ মাতা কুসুমকুমারী দেবীর মত গৃহবধূরাই প্রথম প্রতিবাদী নারী কবি। যদিও তাঁদের লেখায় পাব ঈশ্বর প্রীতি, প্রকৃতিপ্রেম, সৌন্দর্যের আরাধনা অথবা প্রেমের লীলার বিবরণ, পাব এমনকি স্বামীর প্রতি শ্বদ্ধার অর্ঘ্যও। তবু। এই অন্তঃপুরিকারা কীভাবে যে নিজেদের নিঃশেষে বিলিয়েছিলেন। তবু এদের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করব আমাদের বাংলা ভাষার কি সেই সৌভাগ্য হবে কোনদিন?
“আমার মা শ্রীযুক্তা কুসুমকুমারী দেবী … তা৬র কয়েকটি অপ্রকাশিত কবিতা ছাড়া অন্য কোন লেখা আমাদের কারো কাছে নেই। তখন কার দিনের সেই অস্বচ্ছল সংসারে একজন স্ত্রীলোকের পক্ষে শেষ পর্যন্ত সম্ভব হয়ে উঠল না আর… কবিতা লেখার চেয়ে কাজ ও সেবার সর্বাত্মকতার ভেতরে ডুব দিয়ে তিনি ভালই করেছেন হয়ত। “ এই কথা লেখেন আমাদের বাংলা আধুনিক কবিতার দিগ্দর্শক জীবনানন্দ। বামাবোধিনীর মত পত্রিকায় কবিতা পদ্য লিখতেন কুসুমকুমারী। তবু যে ধরণের প্রশ্রয় পেলে একজন মানুষ কবি হয়ে উঠতে পারে, সে অবসর নারীরা পাবেন কোথায়। অপূর্ণতা , অর্ধমনস্কতা, অতৃপ্তি, বঙ্কিম কথিত “আধখানা মালার নারকেল” হয়ে থাকার বেদনা, এই খন্ডিতের নিয়তি নিয়ে বাংলা কবিতার অন্তঃপুরিকারা আমাদের প্রথম প্রতিবাদিনী। তাঁদের প্রতি প্রণাম জানাই।
৩
এইসবের পরেও বলি, এর পর গঙ্গা পদ্মা দিয়ে অনেক জল যেহেতু গড়িয়ে গেছে, সেইহেতু আমাদের চোখ পাততেই হবে, পরবর্তী নারীদের দিকে, যাঁরা অনেককিছুকে অস্বীকার করে, অনেক বেশি করে লড়েছিলেন। অপরাজিতা দেবী নামের আড়ালে ১২ বছর নিজেকে গোপন রাখার দরকার কেন পড়েছিল রাধারাণী দেবীর মত অসামান্যা সাহিত্যিকের? পরবর্তীতে স্বনামেও তিনি ধন্যা। আজকের নবনীতা দেবসেনের মা, রাধারানী রবীন্দ্র স্নেহ লাভ করেছিলেন, তাঁর কলম জন্ম দিয়েছে অনুকারী কবিদের। তবু তথাকথি অর্থে তিনি প্রতিবাদী ছিলেন না। অথচ নিবিড় ব্যক্তিগত , প্রেম ও মিলনের প্রতি সেযুগের রক্ষণশীলতার নিরিখে যথেষ্ট নির্ভীক ও অলজ্জভাবে আকাংক্ষা ময় কবি তিনি।
সেই অসামান্য কলম পেরিয়ে ১৯৪০ এর দশকে এসে দাঁড়ালেই দেখব, বাকি সব ক্ষেত্রের মত কবিতার ক্ষেত্রেও বাংলার মেয়েরা চাইছেন পুরুষের কাঁধে কাঁধ দিয়ে লড়তে। ইতিমধ্যে বিজ্ঞানচর্চায়, সমাজতাত্ত্বিক জ্ঞানের চর্চায়, বামপন্থী আন্দোলনে, সর্বক্ষেত্রেই মেয়েদের প্রবল উপস্থিতি নজরে পড়বে। বিশেষত ২০-৩০ এর দশক থেকে । সেসবের পাশেই , কবিতা আন্দোলনে পঞ্চাশের দশকে যে সব মেয়েরা নির্ভীক উচ্চারণে উঠে এলেন, তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্যা কবিতা সিংহ।
কবিতা সিংহ (১৯৩১- ১৯৯৮) একবার লিখেছিলেন মেয়েদের মাথার বাইরের দিকটা নিয়ে সকলের আগ্রহের কথা, বলেছিলেন মেয়েদের মাথার ভিতরের দিকটাকে নিয়ে কারুর মাথাব্যথা নেই। সেটা ৫০ দশক , আজ থেকে ষাট বছর আগের কথা । সেজন্যেই কথাটি আলাদা করে ভাবায়। এই সময়ে দাঁড়িয়ে, যেখানে বাবা মায়েরা , অন্তত বাঙালি বাবা মায়েরা , ছেলে হোক বা মেয়ে, অংকে ৮০-৯০ না পাওয়াকে অপরাধ ভাবেন, সেখানে কথাগুলির ধার সামান্য কমে এসেছে বলে মনে হয়? কিন্তু কবিতায় কবিতা সিং হের বিস্ফোরণ ক্ষমতা এখনো অম্লান।
কবিতায় প্রথম কবিতা সিং হই আমাদের জানান যে অশ্রু আর মূত্র একই উপাদানে গঠিত কিন্তু “বিভিন্ন পাইপে যায় চক্ষু আর শিশ্ন অভিমুখে”। ( ইচ্ছাময়ীর ইচ্ছা হলে)। নিজস্ব স্ত্রীলিঙ্গ নির্মাণের কথাটি কবিতা সিংহ অন্য অভিধায় বলেছিলেন, যখন তিনি বলেন :আমিই প্রথম/বুঝেছিলাম/দুঃখে সুখে/পুণ্যে পাপে/জীবন যাপন/ অসাধারণ… স্বর্গ নির্বাসিত প্রথম পাপ –জানা ইভের প্রসঙ্গ টেনে বলেন, ‘ভেঙেছিলাম/ হইনি তোমার/হাতের সুতোয়/নাচের পুতুল/ যেমন ছিল/অধম আদম/আমিই প্রথম বিদ্রোহিণী/ তোমার ধরায়/আমিই প্রথম।/…আমিই প্রথম/ ব্রাত্যনারী/স্বর্গচ্যুত/নির্বাসিত/জেনেছিলাম/স্বর্গেতর/স্বর্গেতর/ মানব জীবন/ জেনেছিলাম/আমিই প্রথম।
অথচ এই ইভের সত্তার ভেতরে বহিষ্কৃত ছিল না আদম, কারণ ‘আমিই প্রথম /নর্ম সুখের/ দেহের বোঁটায় /দুঃখ ছেনে/… তোমার পুতুল/ বানানো যায়/ জেনেছিলাম…’ এই কাহিনিতে বহিরাগত নয় প্রেম ও যৌনতা সুতরাং। কাহিনিটি এক্সক্লুসিভ নয়, ইনক্লুসিভ, আজকের ভাষায়। যা অনেক নারীবাদী আগে বা পরে স্বীকার করেননি। পুরুষ বিদ্বেষের সঙ্গে অভিন্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে নারীবাদ, পাঠকের চোখে।
কবিতা সিংহ তাঁর জীবনদর্শনে এক লপ্তে ঢুকিয়ে নেন পুরুষকে, লেখার ভেতরে পুরুষের কাছ থেকে যা চাহিদা তা-ও জানাতে ভোলেন না, অর্থাৎ এক ইউটোপিক বা আদর্শ পুরুষ ছবি রচনার প্রয়াসও তিনি নেন। তিনি নির্মাণ করেন এক “বিকল্প পুরুষ” । ‘স্বয়ংক্রিয়’ কবিতাটিতে তাঁর বলা, সেকেন্ড হ্যান্ড বাজার থেকে “দারুণ সস্তায়” কিনতে পারা যাবে এমন এক বিকল্প পুরুষ-এর কল্পবৈজ্ঞানিক মডেল। যা “বাতিল স্বয়ংক্রিয়” এবং যাতে “একশো চুম্বন পাবে এই লাল সুইচ জ্বালালে/ চারশত তোষামোদ, কবিতার উদ্ধৃতিসমেত/ আলিঙ্গন / যৌনক্রিয়া/মুগ্ধচোখে চেয়ে থাকা খয়েরি গোলাপি নীল এইসব বিবিধ বোতামে” পাওয়া যাবে “বারো ঘন্টা নাগাড়ে সমানে/ মাত্র এক লিটারের পবিত্র ডিজেল বিনিময়ে।
১৯৬৩ সালে লিখিত এই ‘স্বয়ংক্রিয়’ কবিতাটি ।
কখনও হয়তো, কবিতাটির হয়ে ওঠার একমাত্র কারণ, raison d’étre, পারে এই রাজনৈতিক প্রতিবাদটি। যেমন বোরখার ভিতরে নির্বাসিত পাকিস্তানি কবি ইশরাত আফরীন-এর কবিতা, পুরুষের সঙ্গে কথোপকথন। ঘরানায় লিখিত হলেও কিন্তু, স্পর্শ করে প্রাগৈতিহাসিক আন্তসম্পর্ককে।
একজন পুরুষের বড় হয়ে ওঠা ও একজন নারীর বড় হয়ে ওঠার মধ্যেকার বৈষম্যের যে যুগবাহিত ট্রাডিশন, নির্দেশ করে তার দিকে-
শেষ পরীক্ষায় প্রমাণিত হলো
তোমার অঢেল গুণপনা
তোমার মর্যাদা
তোমার মহান ব্যক্তিত্ব সত্ত্বেও
তুমি একটি খোকামাত্র,
যার কাছে ক্রন্দনরত মেয়েরা শুধু
আহত, ডানাছেঁড়া প্রজাপতির মতো …
তোমার সঙ্গে আমি কীভাবে ভাগ করে নেব
আমার জ্ঞান, আমার বোধ?
তোমাকে আমি কী করে সঙ্গে নেব
আমার জীবনের মানে খোঁজায়?
তুমি তো এখনও আমার চেয়ে বয়সে ছোট
তুমি তো চিরদিন আমার চেয়ে বয়সে ছোটই থেকে যাবে
কেননা আমি যে আমার পূর্বপুরুষদেরও মা।
১৯৯১ থেকে ১৯৯৫-এর ভিতরে লেখা আমেরিকান মেয়ে কবি আদ্রিয়েন রীশ-এর কবিতায় যে সন্ত্রাস খুঁজে পাই, তা আবার তাঁর দেশ-কাল-সমাজের অনুসারেই, ঢের বেশি গুপ্ত আর ভয়াবহ।
১৯৯১ থেকে ১৯৯৫-এর ভিতরে লেখা আমেরিকান কবি আদ্রিয়েন রীশ-এর কবিতায় সন্ত্রাস পাই, আবার দেশ-কাল-সমাজের অনুসারেই, বেশি গুপ্ত আর অন্তঃসঞ্চারী। বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ভারত বা চীনের মেয়েদের এশীয় নিরাপত্তাহীনতা তাঁর মধ্যে আমরা পাব না। তাঁর বাচনও আমাদের লাগবে পুরুষেরই বাচনের মতো। অথচ নারীর সমস্যা, নারীর প্রতিবাদ নিয়ে উচ্চকিত হলেও, আমরা তথ্য থেকে জানি রীশ আমেরিকার প্রথম সারির নারীবাদী কবি একজন। কবিতায় তিনি কী করেই বা এড়িয়ে থাকেন ব্যক্তিগত পরতে পরতে থাকা, অন্তঃসলিলা রাজনীতিকে!
রীশ-এর কবিতায় নিউজের উল্লেখ, রাজনীতি নিয়ে টুকরো মন্তব্য। যেমন—
আমি ব্যাঙের ছাতা তুলতে গেছিলাম ভয়াবহতার থেকে, না,তোমরা ঠকে যেও না
এটা কোনও রুশ কবিতা নয়, এটা এখানেই, এখানেই, অন্য কোনও জায়গা নয়
আমাদের দেশ, যা ক্রমশই নিজের সত্য আর ভয়াবহতার নিকটবর্তী হয়ে উঠছে
আর এর নিজস্ব পদ্ধতির – লোকজনকে হাপিস্ করে দেবার …
অথবা :
এই শহরের যেখানেই যাও, দেখবে দপদপ করছে স্ক্রিন
পর্নোগ্রাফিতে, সায়েন্সফিকশান থেকে উঠে আসা ভ্যামপায়ারে,
ভাড়া করা অত্যাচারিতেরা চাবুকের তলায় দুমড়ে যাচ্ছে
তবু আমাদের হাঁটতেই হয় … আর হাঁটতে হাঁটতেই
আমরা বৃষ্টিভেজা জঞ্জাল দেখি, ট্যাবলয়েডের নিষ্ঠুরতা দেখি
আমাদের নিজেদেরই পাড়ায় …
আমাদের আঁকড়ে ধরতে হয় আমাদেরই জীবন
যা অবিচ্ছেদ্য এই পচে ওঠা স্বপ্ন, ওই ধাতব উচ্ছ্বাস, ওই অবমাননাগুলির থেকে
যেখানে লাল ফুল বিপজ্জনকভাবে ঝলসে ওঠে
ছ-তলা বাড়ির বারান্দায় …
এই প্রাণবন্ত কবিতাটির দিকে তাকালে হয়তো খানিকটা বোঝা যাবে, যুদ্ধ আর দাঙ্গার আগুনে ছাড়াও আরও কতরকমভাবে আমরা জ্বলে উঠতে দেখি আমাদের জীবনকে। যে বীভৎসতাগুলি আপাতস্বাচ্ছন্দ্যের তলায় তলায় চাপা থাকে, তাদের দিকে তাকানোর এই চোখও কি রাজনৈতিক চোখ নয়? যা সন্ত্রাস খুঁজে নিচ্ছে, খুঁজে পাচ্ছে, “আমাদের নিজেদেরই পাড়ায়”? আমার মতো এক শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত, সমাজের নানা সুযোগপুষ্ট মেয়ে, যে-কবিতার সঙ্গে অনেক বেশি করে সংযুক্ত বোধ করতে পারে কেবল রাজনীতির প্রতি lip-service করার জন্য লেখা আরোপিত জনদরদী কবিতার চেয়ে। যার মধ্যে আছে “আমাদের জান্তব তীব্রতা— যা ভীষণরকম শহুরে”।
সুতপা ভট্টাচার্য মনে করিয়ে দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ থেকে শক্তি চট্টোপাধ্যায় পর্যন্ত জানিয়েছেন, মেয়েরা আদৌ কবিতা লিখতে পারে কিনা তা নিয়ে নিজেদের সংশয়ের কথা, আর নিজেই দিয়েছেন তাঁর উত্তর : “সত্যিই তো মেয়েরা কল্পনা করতে পারেই না। কবিতা লিখতে চায় যদি কোনো মেয়ে, তবে হয়তো তার বালিকা বয়সেই সে অনুভব করে নিজের কল্পনাশক্তির সীমা…। কিন্তু এমনটাই তো হবার কথা । কল্পনা যে করে সেই বিষয়ীকে নিজের মধ্যে চিনে নেওয়া মেয়েদের পক্ষে কি সহজ? যে ভাষা দিয়ে সে কল্পনা করবে, যে ছবি দিয়ে সে কল্পনা করবে , সেই ভাষা সেই ছবি পুরুষ –পেষিত সমাজের, তার সাহিত্যের। সে ভাষা সে ছবি মেয়েদের শেখায় পুরুষ নির্দেশিত এক ভুল ঐকাত্ম্য । সাহিত্যের পরম্পরা থেকে মেয়েরা সাধারণত সেই ভুল ঐকাত্ম্য গ্রহণ করে এবং প্রতিফলিত করে। নিজেকে বিষয়ী হিসেবে জানতে গেলে কোনো মেয়েকে ঘুরে দাঁড়াতে হয় সেই পরম্পরার বিপরীত মুখে। (সুতপা ভট্টাচার্য, ‘কবিতায় নারী, নারীর কবিতা’, মেয়েলি পাঠ, পৃ ৪৪)
অসম্ভব জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও, মেয়েলি কথা লেখার দোষে, আশাপূর্ণা দেবীকে শুনতে হয়েছিল তিনি ঘরেলু লেখক, ঘরোয়া গল্প লেখেন। মেয়েরাই লেখেন মেয়েরাই পড়েন এসব বাড়ির বউ ঝিদের গল্প। অথচ কী আশ্চর্য দক্ষতায় আশাপূর্ণা দেবী তছনছ করে ভেতর অব্দি খুলে দেখিয়ে দিয়েছেন, পুরুষতন্ত্রের কাঠামোকে। গল্পের শেষ মোচড়ে উল্টে দিয়েছেন পুরুষতন্ত্রের খেলাটাকে। আমরা ছোটবেলার পাঠাভ্যাসে শিখেছিলাম উল বোনার মতই আশাপূর্ণা দেবীর গল্প পড়াও দিবানিদ্রার বিকল্প গৃহবধূদের। এই ভুল শিক্ষা ভাঙতে প্রয়োজন হয়েছিল একজন নবনীতা দেবসেনের। তথ্যটি পাই তাঁরই এক লেখায় প্রথম, পাক্ষিক দেশ পত্রিকায় (বই সংখ্যা ২০০৯)। জ্ঞানপীঠ বাংলাভাষার মনোনয়ন কমিটির সদস্য হিসেবে নবনীতা দেবসেন আশাপূর্ণা দেবীর ‘প্রথম প্রতিশ্রুতি’ উপন্যাসের নাম প্রস্তাব করলে অপর দু’জন পুরুষ সদস্য আপত্তি তোলেন। মজার কথা, এই দুই সম্মানিত সদস্যের কেউই কিন্তু তখনও অব্দি ‘প্রথম প্রতিশ্রুতি’ বইটি পড়েননি। কেনই বা পড়বেন। মেয়েলি লেখা ত। যা হোক ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় নবনীতা দেবসেন অন্য সদস্যদের মত পাল্টাতে সমর্থ হন। আশাপূর্ণা দেবী ‘জ্ঞানপীঠ’ পুরষ্কারে ভূষিতা হন। নবনীতা দেবসেন লিখেছেন, ‘জ্ঞানপীঠের আলোকে এক ওজনদার মহৎ লেখিকাকে অবশেষে আবিষ্কার করলেন বাংলার উন্নাসিক বিদগ্ধ সমাজ।’ নবনীতা দেবসেন রুখে না দাঁড়ালে ‘নারীর সাহিত্য’ আজো ততটাই ব্রাত্য থেকে যেত।
অসংখ্য উদাহরণ আছে এমন, তবে উল্লেখ্যগুলিই বলি। সুচিত্রা ভট্টাচার্য একবার বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন এই বলে, যে, যে কোন সভাটভায়, কোন পুরুষের সঙ্গে দেখা হলেই তাঁরা বলেন, আপনি ত বিখ্যাত, আমার স্ত্রী আপনার খুব ফ্যান। মেয়েদের লেখা কেবল মেয়েরাই পড়বেন এই অলিখিত নিয়ম এক দিকে মানসিক বেড়ি পরায় মেয়ে লেখকদের, অন্যদিকে পুরুষের সঙ্গে একসংগে নাম উচ্চারিত না হবার সমস্যা ত থেকেই যায়। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কোন একটি লেখায়, বর্তমান কবিতার প্রবণতা আলোচনা করতে করতে , সারিবদ্ধভাবে পুরুষদের নাম করতে করতে এক সময়ে থেমে, তিনি বলেন, এই রে, মেয়েদের নাম না বললে আবার নবনীতা খুব রাগ করবে… এবং পরের অনুচ্ছেদে পর পর মেয়েদের নাম আসে। ইংরেজিতে একটা কথা আছে, they also ran…যে কোন ক্ষেত্রের মত লেখালেখিতেও পুরুষের একচেটিয়া আধিপত্যের ব্যাপারটা এই অসাড়ে অচেতনে আমাদের ভেতরে আত্মীকৃত, যে , মেয়েদের নামোল্লেখ করতে ভুলে যাওয়া যায় ও তারপর শুধরে নিয়ে সসম্মানে, “এঁরাও আছেন, এঁরাও লেখেন” বলা হয়। এতেই যেন আরো পরিস্ফুট হয়, মোটা দাগে দেগে যায় পুরুষতন্ত্রের সূক্ষ্ম, ও ততটা সূক্ষ্ম নয় এমন রাজনীতি।
এইসবের মধ্যে দিয়েই আজকে যে পরিমাণ মেয়েরা লিখে চলেছেন সেই সংখ্যাটা আশাপ্রদ। আমাদের ঠিক আগের প্রজন্মের চেয়ে প্রায় কয়েক গুণ বেশি। ৩৩% সংরক্ষণের প্রয়োজন কবিতা বা গদ্যের ক্ষেত্রে আছে কিনা তা নিয়ে হাসাহাসি করলেও, এই সংখ্যা বৃদ্ধির ঘটনাটা লক্ষ করার মতই। যে কোন পত্র পত্রিকায় চোখ বোলালে তা বোঝা যায়। আবার একইসঙ্গে , এও ঠিক যে মান্য পত্রিকাগুলির শারদ সংখ্যায় একটি জেন্ডার অডিট বা সোজা কথায় মেয়ে-শুমারি করলেই দেখা যাবে এখনো গল্প উপন্যাস কবিতায় সংখ্যালঘুই আছেন মেয়েরা। তাঁদের স্বর হয়ত আগের চেয়ে স্পষ্ট ও সংহত। আত্মসচেতন ও।
৩
কোথাও যেন বড় অসম্পূর্ণ মনে হয় মেয়েদের লেখার জীবন। সাফল্য এলে সঙ্গে সঙ্গে তার পিছে আসে সন্দেহ, ও কাকে ধরেছিল? কোন কোন সম্পাদকের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্কের জেরে লেখা ছেপেছে? কীভাবে পুরস্কার পেয়েছিল। নিখাদ গুণের জন্য স্বীকৃতি কখনোই পুরোপুরি বিশ্বাস করা হয়না মেয়েদের ক্ষেত্রে। স্বার্থোদ্ধার করতে নারীত্বের দাঁত নখ ব্যবহারের ইঙ্গিত প্রচ্ছন্ন হয়ে থাকে মানুষের কথায়, ঠারে ঠোরে।
অন্যদিকে, আজো রবীন্দ্রনাথের “খাতা” গল্পের উমার মত ভয়াবহ বেদনার না হলেও, অনেক মেয়ের, লেখা গোপন খাতাতেই থেকে যায়, বন্ধু দাদা বাবা জ্যাঠা স্বামী পার্টনার বা অন্য পুরুষ সদস্যদের কাছে হাস্যাস্পদ হবার ভয়ে। অন্তত বছর চল্লিশেক আগে আমার যে গোপন কবিতার খাতা ছিল তা আমি অন্তত জানি। আত্মপ্রকাশের জন্য কোন ফেসবুক টুইটার ছিল না তখন। সেলফ পাবলিশিং দূর অস্ত ছিল।
আর কে না জানে যে পিছু ফেরার জন্য আমরা মুখিয়ে আছি, তাই আজ আর রবীন্দ্রনাথের লেখার এই লাইন কটি অস্বাভাবিক কিছু মনে হয়না –
প্যারীমোহন এই সংবাদ অবগত হইয়া বিশেষ চিন্তিত হইল। পড়াশুনা আরম্ভ হইলেই নভেল-নাটকের আমদানি হইবে এবং গৃহধর্ম রক্ষা করা দায় হইয়া উঠিবে।
তা ছাড়া বিশেষ চিন্তা দ্বারা এ বিষয়ে সে একটি অতি সুক্ষ্ণতত্ত্ব নির্ণয় করিয়াছিল। সে বলিত, স্ত্রীশক্তি এবং পুংশক্তি উভয় শক্তির সম্মিলনে পবিত্র দাম্পত্যশক্তির উদ্ভব হয়; কিন্তু লেখাপড়া শিক্ষার দ্বারা যদি স্ত্রীশক্তি পরাভূত হইয়া একান্ত পুংশক্তির প্রাদুর্ভাব হয়, তবে পুংশক্তির সহিত পুংশক্তির প্রতিঘাতে এমন একটি প্রলয়শক্তির উৎপত্তি হয় যদ্দ্বারা দাম্পত্যশক্তি বিনাশশক্তির মধ্যে বিলীনসত্তা লাভ করে, সুতরাং রমণী বিধবা হয়। এ পর্যন্ত এ তত্ত্বের কেহ প্রতিবাদ করিতে পারে নাই।
প্যারীমোহন সন্ধ্যাকালে ঘরে আসিয়া উমাকে যথেষ্ট ভর্ৎসনা করিল এবং কিঞ্চিৎ উপহাসও করিল–বলিল, ‘শামলা ফরমাশ দিতে হইবে, গিন্নী কানে কলম গুঁজিয়া আপিসে যাইবেন।’
বিচিত্ররূপে হাসির খোরাক, ইয়ার্কি ও চোখ ঠারাঠারির বিষয় হয়েও যে মেয়ের সুবুদ্ধি হয়না, ভেতরের তাগিদে ওই উমার মত তারা লিখেই চলে লিখেই চলে, জীবন তাদের জন্য বাদামি লেফাফায় পত্র পাঠায়। কোন বিখ্যাত পুরুষ কবির সঙ্গে মেয়েটি রতিক্রিয়া করেছেন, তার কাল্পনিক বিবরণ ভুল বানানে ও বীভৎস ডিটেলিং এ পেশ হয় সে পত্রে। পড়ে, রবীন্দ্রনাথের উমার মতই বলতে ইচ্ছে করে, “তোদের দুটি পায়ে পড়ি ভাই–আমি আর করব না, আমি আর লিখব না।”
ধরে নেওয়া যাক, এই সব সত্ত্বেও কোন মেয়ে লিখতেই লাগলেন, লিখেই চললেন। প্রথমটা তাঁকে সুসভ্য সমাজ পিঠ চাপড়ায়, বলে বাহ তোমার কলমটা খুব পুরুষালি ত! কিন্তু দিনের পর দিন নিজের মেয়ে অভিজ্ঞতার ঝুলি ভর্তি হতে হতে একদিন তিনি লিখে ফেলেন মেয়েদের বাস্তবতাই। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই নারীবাদী বলে তাঁকে বর্জন করা হয়। অথবা খন্ডিত, বদ্ধ বাস্তবতার কথা লেখেন বলে ঠারে ঠোরে ইঙ্গিত করা হয়। কল্পনাশক্তির অভাবেই ত এসব হয় কিনা!
আসলে, মেয়েরাও কখনো কখনো বাধ্য হন একমাত্র নিজেদের এই ভয়াবহ বাস্তবতার কথাই লিখে যেতে । আর চারিপাশের উদারমনা সাহিত্যমনা পুরুষ বন্ধুরা চুক চুক করে বলেন, ধুস, তোমরা বড় এক পেশে, বড় বদ্ধ। উন্মুক্ত এই পৃথিবীতে ঘুরে দেখে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে এই মহান মানবসভ্যতাকে নিয়ে কিছুই লিখতে পারলে না। ক্লাসিক মাত্রেই জীবন দেখার গল্প। তোমরা কি জীবন দেখেছ?
আর আমাদের সময়ের কবি সংযুক্তা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন,
‘কবিতা মানে আমার কাছে এই । নিজেকে রক্তাক্ত হতে দেখা ও একইসঙ্গে সেই রক্ত পান করা। নারী কবিতায় বস্তুত এ ছাড়া আর কিছু আছে কি? হ্যাঁ আছে প্রেম আছে বাৎসল্য, আরো আছে একসঙ্গে পায়ে পা মিলিয়ে হেঁটে যাওয়া । শেষ পরযন্ত বেঁচে থাকাও, বেঁচে থাকাই।
… একথা জেনেও যে, নারীকবিতা আজও একটি মার্জিনাল অবস্থানে রয়েছে। কত কী-ই যে লিখতে দেওয়া হয়নি মেয়েদের – সাফো বা অ্যাড্রিয়েন রিচ সত্ত্বেও নারী সমকামিতা কি জায়গা পেয়েছে তেমন করে কবিতায় ? কোথায় অন্তেবাসীর উচ্চারণ? কালো মেয়েদের ব্লুজ গানের সঙ্গে আমাদের ছাদপেটানো মেয়েদের গানকে কি তুল্যমূল্য করা হয়েছে? নারীর যৌনতা, পুরুষশরীরের প্রতি নারীর মুগ্ধতা কবিতায় কতটুকু? ‘
সংযুক্তা বন্দ্যোপাধ্যায়, আমার কবিতা ভাবনা, কবিতা প্রতিমাসে, জুন ২০০৭
সিলভিয়া প্লাথ বলেছিলেন তাঁর বড় সাধ যায় ট্রাকে চেপে ঘুরে ঘুরে বেড়াতে, কালো রাত্রির তারা দেখতে ট্রাকের খড়ের গাদায় শুয়ে। মেয়ে বলে পারলেন না। তাঁর বায়োলজি তাঁকে করতে দিল না এইসব অভিজ্ঞতা সঞ্চয়।
কাঠের বাক্সে বরফ দিয়ে প্যাকিং হওয়া মাছের বরফ দেখাই একমাত্র ভবিতব্য, আকাশ দেখা নয়। জেলখানার মানুষের চোখে , ছোট্ট জানালা দিয়ে আকাশের তারা দেখার আগে গরাদের কালো কালো দাগগুলোই ভাসে।
যশোধরা রায়চৌধুরী
কি যে ভালো সব লেখা পড়ছি। সমৃদ্ধ হচ্ছি।
অসাধারণ
খুব ভালো লাগল।
কবিতা সিংহ সম্পর্কে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের মন্তব্যটি মনে পড়লো।’ এতদিন ধরে কবিতা লিখছে অথচ এখনো…..
রাজনীতির ক্ষমতায়ন একচেটিয়া পুরুষের হাতে। দিন পাল্টাক এইরকম লেখার হাত ধরে।
নারীর ভাষা নারীর লেখা নারীর রাজনীতি—–মন স্পর্শ করা লেখা।They also ran—–
অপূর্ব। হৃদয়ের কথা।
অসম্ভব বলিষ্ঠ লেখা। দিন বদলের বার্তা দিচ্ছে কম্বুকণ্ঠে।
পুরো লেখাটা পড়তে পড়তে একটা ঘোরে চলে গেছিলাম। এক একটা মোড়কে একটা একটা ঢেকে রাখা দিক এক সাহসী উন্মোচনে ঝলসে উঠেছে। অনেককেই জানিনা, নামও শুনিনি অনেকের, তবু কোথায় যেন বড় একাত্ম হয়ে গেলাম। ঘামের গন্ধ শুধু পুরুষালি নয়, মেয়েলি ও হয় টের পেলাম বড় তীব্র ভাবে।
অনেক অনেক শুভেচ্ছা ও ধন্য বাদ জানাই এমন একটা ঝকঝকে লেখার জন্য
আনত এমন লেখার কাছে।
পড়লাম। জানলাম।