অব্যাহতি/ চার পর্বের গল্প/ পর্ব দুই

অব্যাহতি/ চার পর্বের গল্প/ পর্ব দুই

অব্যাহতি-২

সুপর্ণা ভট্টাচার্য 

                      দুই
‘তুমি কী আগে থেকেই সব বুঝতে পারো সার্থক’
‘সে কী কথা?আমি কি জ্যোতিষী?আমি কি ওই তারাদের দেশের লোক?’
‘এমনিই,মনে হলো’
‘এমনিই তো কিছু হয় না,সবই কার্য কারণের সঙ্গে জড়িত আছে,থাকবেও’
‘তোমার সেই ছবিটা মনে পড়ল,সেই যে একটা টিলার উপর ডুবন্ত সূর্যর আভা এসে পড়েছে। সেই আলোয় ছোটো একটা পাহাড়ী ফুল পড়ে আছে’
‘হুম। পাঁচ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছিল’
‘ভারি বেরসিক তো তুমি!’
সামনে গঙ্গার জল। গঙ্গার জলের ওপর ডান-বাঁ দুদিকেই উজ্জ্বল জাহাজ দাঁড়িয়ে। পিছনে অন্ধকার। জল পুলিশের লঞ্চ এপাশ-ওপাশ আলো ফেলতে ফেলতে এদিক ওদিক করছে।
‘সার্থক আমি কখনও জাহাজ দেখিনি,মানে জাহাজের ভিতরটা। আমাকে একবার দেখাবে ?’
‘চোখে সর্ষেফুল ছাড়া আর কিছু দ্যাখাতে পারিনা ‘
‘খালি ইয়ার্কি। বলোনা,দ্যাখাবে,প্লীজ?’
‘আমার এক ইঞ্জিনীয়ার বন্ধু আছে। জাহাজে কাজ করে। এখন কলকাতায় নেই। ফিরলে চেষ্টা করব’
‘আমার খুব জাহাজে করে বেড়াতে যেতে ইচ্ছা করে’
‘এ ইচ্ছা ভালো না। কষ্ট পাবে’
‘কী যে সব বলো!আমার জলে ভাসতে ভাসতে চলে যেতে ইচ্ছা করে এক দেশ থেকে অন্য দেশে’
‘তুমি বড়ো ছেলেমানুষ স্বাতী’
এসব কথা ভাবতে ভাবতে যাবে বলেই স্বাতী ট্রেনে যাচ্ছে।কীভাবে দিনের পর দিন,মাসের পর মাস একা থাকা একটা মেয়ে,জড়িয়ে পড়ছিল এক ছন্নছাড়া শিল্পীর সঙ্গে। যে মেয়েটা ছবি সম্পর্কে কিছু জানেনা,বোঝেনা ছবির ভাষা,রঙ তার কাছে শুধুই ঝলমলে অনুভব,একটি অক্ষরও পড়াশোনা নেই ছবি সম্বন্ধে। সেই মেয়েটা এক ছবির এক্সিবিশনে গিয়ে  রঙের গভীরে ঢুকে থাকা এক মানুষকে এমন করে গম্ভীর ভাবে নিয়ে নিল!স্বাগতা জোর করেছিল বলেই সেই এক্সিবিশনে যাওয়া। তিন শিল্পীর সমবেত প্রদর্শনী। এলোমেলো ঝাঁকড়া চুলের কঠোর মুখের ছেলেটাকে দেখে তার ছবি ভালো লেগেছিল,না তার আঁকা ছবি দেখে সে ছেলেকে ভালো লেগেছিল,তা সে জানেনা। তবে হঠাৎ করে যেন সবকিছুই বদলে গেল। দূর গগনের নক্ষত্রকে মায়াকাজল পরালো কে!
বেসরকারি হাসপাতালের ফ্লোর ম্যানেজার স্বাতী মৌলিক। বর্ধমানের বর্ধিষ্ণু পরিবারের জেদী একরোখা এক মেয়ে। নিজের যুক্তি,নিজের আবেগে চলে।
পায়ের ওপর পা তুলে বসে বসে আয়েশ করা ছেড়ে একা একা কলকাতায় থাকার পিছনে নিজের কাছে নিজের অনেক যুক্তি আছে।
তাদের বাড়ির আবহাওয়ায় কোনো মেয়ের হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট পড়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া বেশ চমকপ্রদ বটে। বংশানুক্রমিক ভাবে কাঁসার পিতলের ব্যবসা থেকে তার বাবা যেমন হঠাৎ করে একটি চালকল খুলে ফেলল,সেরকম চমকে দেওয়ার মতোই সিদ্ধান্ত। বাবা,জেঠুর মধ্যে এক প্রচ্ছন্ন অহঙ্কারী মালিক মালিক মনোভাব ছিল। সকলকে তুচ্ছ ভাবে কথা বলা দেখেই বড়ো হয়েছে সে। স্বাভাবিক ভাবেই মেনে নিয়েছিল। মা কে বেশ গিন্নি বান্নি সুখী সুখী মানুষ বলেই মনে হতো বরাবর। সংসারের তদারকি করা ছাড়া বিশেষ কিছুতে নেশা ছিল বলে মনে হয়নি কখনও। স্বাতীর তখন উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা চলছে। ইকনমিক্স পরীক্ষা দিয়ে এসে মাথা ধরেছিল খুব। ফ্রেশ হয়ে ছাদে গেল,পরদিন ছুটি। চাপটা কম। উঠে দ্যাখে,মা ছাদের জাফরি কাটা রেলিং এ হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে। আকাশ তখন সোনালী রঙে ছেয়ে গেছে। সে রঙের আভা মায়ের ওপর।
তার পায়ের শব্দে আস্তে করে মুখ ঘুরিয়ে তাকায় মা।
চোখ কেমন ভিজে ভিজে। মুখে বিষাদ।
‘কিছু হয়েছে ?’
‘না তো। কী আবার হবে?’
‘মুখটা দেখে কেমন একটা লাগল’
‘পরীক্কে কেমন হলো?’
‘ভালো’
‘এট্টা কথা তোকে বলে রাকি আজ মামণি। বড়ো ঘেন্না পিত্তি,রাগ নে থাকি একেনে’
স্বাতী চমকে উঠেছিল। এসব কী বলছে মা।
‘নেকাপড়া শিকলে আর এট্টু সাহস থাগলে এ সংসারে লাথি মেরে চলে যেতুম’
‘এসব কেন বলছ মা?’
‘গরীব হাগরে ঘরের মেয়ে আমি। নুন আনতে পান্তা ফুরাত আমাদের। আদপেটা খেতুম। মা টা দুদিনের জ্বরে মরে গেল আচমকা। বাপ কদিন থুম মেরে বসে থাগল। আমি ছোটো থেকেই রাঁদতে পারতুম। কিন্তু রাঁদবটা কী।মা মরে যাওয়ার শোকের থেকে ক্ষিদের জ্বালা বেশি। পাশের ঘরের দুগ্গা বৌদি  দেখেশুনে কদিন ভাত দে গেল। আস্তে আস্তে বাপ উটল। কাজে গেল। ভাগে চাষ করত। হটাৎ করে দেকি আমাদের অবস্তা পাল্টে যাচ্চে। বাপ চকচকে জামা পরচে,হাতে ঘড়ি। আমার জন্যি নতুন নতুন ধনেখালি চওড়া পাড়ের শাড়ি। মাছ হাতে করে বাড়ি ফেরে। গন্দতেল। সাবান। নকুল মামার দোকানের ছানাপোড়া। সবাই কেমন সমজে কতা বলে। আমি অবাক হই। ভালোও লাগে। মা মরে যাবার দুবচরের মাতায় বাপকে রাস্তার ধারে মরে পড়ে থাকতে দেকল সবাই। মাতাটা দুফাঁক করা। পুলিশ এলো। সে কী ভিড়। আমি এট্টুও কাঁদিনি। ভয়ে আমার হাত পা ঠাণ্ডা হয়েই থাকল। মাঝরাতে বিশুকাকারা বাপকে কাঁটাপুকুর থেকে নে এসে দাহ কলল। মুকে আগুন দিলুম আমি। রাত ফসসা হতে তোর বাপ এলো আমাদের বাড়িতে। ‘ মা থেমে থেকমে কেটে কেটে কথাগুলো বলতে লাগল,একটানা।
‘বাবা!’
‘হ্যাঁ। নম্বা চওড়া এট্টা মানুষ। আমার বাপের থেকে কয়েক বচরের ছোটো হবে। আমার তো ভয়ে ভাবনায় গলা শুকিয়ে কাট’
‘বাবা হঠাৎ গিয়েছিল কেন!’
‘টাকা দিতে গেচিল। বাপ নাকি ওনার কাচে কাজ করত বছর দেড়েক ধরে। ওনারই শত্তুররা মেরে দিয়েচে আমার বাপকে। তাই ওনার দায়িত্ব আমাকে ভরণপোষণ দেবার। আশেপাশের সবাই জড়ো হয়ে এলো। তোর বাপকে দেকলুম চেনে সবাই। বিশু কাকা জোয়ান। কালো কষ্টি পাতরের মতো চেহারা। বাবরি চুল। লাঠি খেলা পতিযোগিতায় নাম দিত। গম্ভীর হয়ে বলল,’এ মেয়েটাকে শ্যাল কুকুরে খাবে।  নইলে ওর বাপকে মেরেচে যারা, তারাই ছিঁড়ে খাবে একদিন। আপনি ওকে নে যান বাবু’
তোর বাপ খানিক চুপ করে থেকে বলল,’তুমি জানো কে খুন করেছে?’
‘না,তা জানিনি,কিন্তু বড়োসড়ো মাতব্বর গোচের কেউ হবে। পুলিশ তো চুপচাপ। স্বাতীর বাপটা কিসে জড়িয়েছিল,ভগমান জানে। কিন্তু অনেয্য তো কিচু করত। হটাৎ করে কেমন বদলে গেচিল’
তোর বাপ হটাৎ করে উটে পড়ে বললে,’ ঠিক আচে। নে যাচ্চি’
‘তুমি চলে এলে?’
‘এলুম। ঘর থিকে বিশাল পাসাদে। আমার থিকে এক কুড়ি বয়সে বড়ো এট্টা লোকের সঙ্গে।কাজের মাসীরা ছাড়া এট্টা মেয়ে মানুষ নেই গোট্টা বাড়িতে। দুটো পুরুষ মানুষ।তোর বাপ আর তোর জ্যাঠা। একমাস পর তোর জ্যাঠা এসে বললে,’তোমাকে ভাই বউ করব ঠিক করিচি। ‘
‘বিয়ে হয়ে গেল!’
‘হয়ে গেল। ‘
‘ জেঠু তো ভালোই করেছিল মা’
‘হুম।তা ভালোই করেচিল। অনাথ আমি ভেসেই যেতুম নইলে। সবে গতরে বড়ো হচ্চি। ‘
স্বাতী রেগে বলেছিল,’মা,তুমি ভাষাটা আর ঠিক করলে না। পারবে,তবু করোনা’
‘ওই এট্টা  জিনিস থাক নিজের ।আর সব তো নকল’
‘এমন করে কেন যে বলছ!’মায়ের গলার স্বরে কেমন কষ্ট হচ্ছিল সেদিন স্বাতীর।
‘ধীরে ধীরে জানতে পারলুম,আমার বাপকে ,তোর বাপ জ্যাঠারাই লোক দিয়ে মেরে দিয়েচিল’
‘মানে!’
‘ওই চালকলে অনেক দুনম্বরী কাজ কম্ম হয়। হুম,একনও হয়। আমার বাপ কী করে যে এসবে জড়িয়েছিল,তাতো আর জানিনা।লোভেই হয়ত। কিচু নিয়ে,হয়ত বা,বখরা নিয়েই গোলমাল হয়েচিল,,তাই,,,’
‘তুমি বাবাকে কিছু বলোনি?আমিও তো কিছুই জানতে পারিনি এতোদিন। মামার বাড়ি বলে আমার কিছু নেই,এটাই জানতাম শুধু’
‘আমার বাপেরও তো কম অন্যায় ছিল নি। যা হোক,তা হোক করে  শাকপাতা খেয়েই না হয় বাঁচতুম। তবু তো বাঁচতুম। এমন করে মরে বেঁচে থাকতুম নি”
স্বাতী মায়ের হাতের ওপর হাত রেখেছিল । ছাদে তখন ঘন সন্ধ্যা। তার ভিতরে তুমুল ঝড়। বাবা,জ্যাঠামশায়ের মুখের দিকে তাকাবে কী করে!তাদের দুজনের চোখের মণি সে। সমস্তটা নিমেষে মিথ্যা হয়ে গেল।
‘নিজের পায়ে দাঁড়া মামনি। সেটা দেকব বলেই চুপ থাকি। কত কথা জমে আচে বুকটায়। ওই মানুষটা আমাকে ছুঁলেই কেমন বমি পেতো আমার। একনও পায়। সহ্যি করি। ওই দেখ,আকাশে ওইই তারাটার নাম স্বাতী। তোর নাম রেকেছিলুম ওই তারাটার নামে’
‘তুমি তারা দের চেনো মা?’
‘ওই ,কয়েকটা চিনি। আমাদের পাশে পরিমল দাদা মাষ্টার ছিল। দুগ্গা বৌদিকে তারা চেনাত। দুগ্গা বউদি আমাকে। পরিমল দাদার মতো কাউকে বিয়ে করিস মামণি’
পরিমল মাষ্টার কেমন ছিল জানেনা স্বাতী। শুধু জানে,সার্থক কখনোই পরিমল মাষ্টারের মতো নয়।
ট্রেন ছুটছে। উল্টোদিকে বসে বছর ছয়েকের এক বালক  মোবাইল ফোন দেখে যাচ্ছে একমনে।
স্বাতী ভাবে,মানুষের বৃত্ত একসঙ্গে ক্রমাগত বড়ো আর ছোটো হচ্ছে।
মা কে সঙ্গে আনতে পারল না চেষ্টা করেও।
দুই  প্রৌঢ়কে ছেড়ে আসার অসম্ভব ভাবনা ভাবতে পারল না মা।
ছেলেটিকে জিজ্ঞাসা করল,’তোমার নাম কি?’
মোবাইল থেকে চোখ তুলে ছেলেটি বলল,’রক্তিম’
সূর্য ডুবছে। আকাশ লালে লাল।
সার্থক একটিবার এলোনা,দেখা করতে।
স্বাতীর চোখ ভিজে ওঠে। জল আটকায় প্রাণপণে

Nila Banerjee

পুকুরঘাট

একদিন আমরা মাত্র কয়েকজন সদস্য নিয়ে পুকুরঘাট নামের একটি মেয়েদের ভার্চুয়াল দল খুলে ছিলুম। অচিরেই সে কয়েকটি সদস্যের দল কয়েক হাজার সদস্যের মেয়েদের দল হয় ওঠে। পুকুরঘাট দলের মত এত গুণী মেয়েদের সমাহার বাংলাদেশে খুব কম ভার্চুয়াল দলে আছে। কাজেই সেই দল সেখানেই আটকে থাকবে না বলা বাহুল্য। তাই পুকুরঘাট দলের অন্যতম উদ্যোগ হিসেবে প্রকাশিত হলো পুকুরঘাট পত্রিকা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

2 thoughts on “অব্যাহতি/ চার পর্বের গল্প/ পর্ব দুই

  1. অপূর্ব! ভীষণ মনকেমন করা। মায়ের চরিত্রটি যেন চোখের সামনে দেখতে পালাম!❤️

  2. দারুণ, আগ্রহ আরো বাড়লো। তিন নম্বরের জন্য অপেক্ষায় রইলাম 👍 💖

Others Episodes