অব্যাহতি/ চার পর্বের গল্প/ পর্ব তিন

অব্যাহতি/ চার পর্বের গল্প/ পর্ব তিন

অব্যাহতি

সুপর্ণা ভট্টাচার্য

তিন
পিছনে একটা লাল রক্ত রঙ পর্দা। সে পর্দার বাম দিকে উপরের কোণে কুসুম রঙ সূর্য।
কুয়াশা রঙ দিয়ে লেখা,’একদিন সূর্যের ভোর আসবে,আসবেই একদিন’।
পর্দার সামনে জনা পাঁচেক ছেলেমেয়ে। গান গাইছে। আবৃত্তি করছে। তাদের মুখোমুখি গোটা সত্তর মানুষ। গম্ভীর,অবিচল।সার্থক পর্দার প্রায় আড়ালে থেকে সিগারেটের শেষ অংশটা পায়ের জুতোয় পিষে বিড়বিড় করে বলে,’শালারা সবদিক দিয়ে সর্বহারা’
গালি দিয়েও সে যে কেন জড়িয়ে থাকে পরিত্রাণহীন!জড়াতেই থাকে। এক ছেলেমানুষি,এক পবিত্র অনুভব তাকে প্রাণপণ টেনে রাখে,এসবের সঙ্গে। ভেতরের এ সমস্ত অস্থিরতা তাকে ছবি আঁকিয়ে নেয়। খুব শান্ত,নিস্তরঙ্গ জীবন তাকে ছবি আঁকার তাগিদ দেয় না।এক একসময় সত্যিকারের ভয় পায় ,যদি  একদিন ক্লান্ত হয়ে দিঘীর মতো স্থির হয়ে যায় সে!এইজন্যই স্বাতীকে নিয়েও  ভয়ই পেতো সর্বক্ষণ। ভয় নিজেকে,ভয় তার ভিতরের সার্থককে। স্বাতী তাকে বদলে দিচ্ছিল,করে তুলছিল মায়া মমতার ভাণ্ড। একটা সুন্দর পুতুল খেলা খেলছে তারা,এমনটা মনে হতো সার্থকের । স্বাতী তাকে পৃথিবীর রূপ চেনাচ্ছিল। স্বাতী কাছে না থাকলে ছটফট করত। কাছে থাকলে স্বপ্নের ঘোর। এক আশ্চর্য নতুন স্বাদ। স্বাতীর গায়ের গন্ধে রঙের গন্ধ চাপা পড়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ হঠাৎ হিংস্র হয়ে উঠত স্বাতীর ওপর,আসলে নিজের ওপরই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠত। কিছুতেই সেটা বোঝাতে পারত না। না নিজেকে,না স্বাতীকে।
অনুষ্ঠান শেষ। দর্শকরা চলে যাচ্ছে। পারফর্মারদের মুখে কেমন একটা অদ্ভুত প্রশান্তি।
‘কত অল্পতেই সন্তুষ্টি তোদের’
‘এই সার্থক,আবার ফালতু বকছিস,আমরা তো তবু চেষ্টা করছি রে’
‘এসব চেষ্টা না করে এমন কিছু কাজ কর,যেটায় মানুষ সত্যিকারের উদ্বুদ্ধ হয়’
‘ফালতু বকিস না তো,উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টাই করছি আমরা। এই তোদের মতো হতাশা গ্রস্থ দের জন্যই এখনও কোন ঠাসা আমরা’
‘ভালো ভাই,আমি এতোসব বুঝিনা আসলে। সুন্দরবনের বেহুদা মাল আমি। তোদের মতো এতো ঝকঝকে বিপ্লবে বিশ্বাস করিনা। ওই টকটকে লাল রঙটা বুকের মধ্যে ঝরে সবসময়’
সার্থক হাঁটা লাগায়। মুখটা তেতো। পিছন থেকে টুকরো গালাগালির সঙ্গে ওর নাম ধরে চীৎকারটা তাড়া করে।
নন্দন চত্বরটা ছেড়ে আ্যকাডেমীর চত্বরের ভিড়ে এসে পড়ে। হরিদার চায়ের দোকানে দাঁড়ায়। চা খাবে। বাঁধানো উঁচু মঞ্চে,সিঁড়িতে জায়গা নেই একটুও। মেয়েরা বেশিরভাগ স্থূল,চড়া মেক আপ,হাতে সিগারেট। ওর মধ্যে গাঁজা ভর্তি। জানে সার্থক। চোখের নীচের কালি, মোটা থ্যাবড়ানো কাজলেও ঢাকা পড়েনি। কী সব ক্লান্ত মুখ!স্বাতীকে মনে পড়ে। শালা,মাথা থেকে তাড়াতে পারেনা মুখটা।
কাল বাড়ি যাবে। বন্যার জল সরে গেছে। বাবা,মা কী অবস্থায় আছে,বাড়ি কী অবস্থায় আছে একবার নিজের চোখে দেখে আসা উচিত।
আজ শুক্রবার। নেহেরু চিলড্রেনস মিউজিয়াম যেতে হবে। ক্লাস করায় সে। বাচ্চাদের সুকুমার,সপ্রতিভ মুখ খানিকক্ষণ সব ভুলিয়ে দেয়।
চা খেতে খেতেই দ্যাখে,অরণ্যরা এসে গেছে।
‘চলে কেন এলি’
‘ইচ্ছা’
‘সার্থক,সত্যিই তোর কোনো স্থিরতা নেই’
‘নেই তো নেই। তোদের সমস্যাটা কী?’
‘আমরা ভাবছি,তোর সঙ্গে তোদের গ্রামে যাব,কবে যাবি তুই?’
‘হঠাৎ?আমাদের গ্রামে?’
‘বন্যায় সব ভেসে গেছে শুনছি,পড়ছিও। শুভঙ্করদা বলছে,ত্রাণ নিয়ে যেতে। তুই সঙ্গে থাকলে সুবিধা’
‘এই শোন,তোদের এই ফালতু ত্রাণের প্রোগ্রামে নেই আমি’
‘আরে,ত্রাণ দিতে যেতেও তোর আপত্তি!’
‘হ্যাঁ,আপত্তি। আসল কাজটা কর। মেলে ঘা টা দে। লড়াইটা জোট বেঁধে কর। শুকনো চিঁড়ে,মুড়ি  আর পুরাতন জামা কাপড়ে শরীর আর পেট কোনো টাই ভরে না। শিকড়টা উপড়ে নতুন করে ভাব। প্রথম থেকে শুরু করার চেষ্টা কর। বল তোদের দাদাদের,ভিত কাঁচা থাকলে সব ধ্বসেই যায়’
‘সে জোটে তুই থাকবি তো?’
‘সবার আগে। ‘
সার্থক ডাস্টবিনে চায়ের মাটির ভাঁড়টা ছুঁড়ে ফেলে হাঁটা লাগায়। এবার আর অনন্যদের চীৎকার ভেসে আসে না।
বাচ্চাদের বন্যায় ভেসে যাওয়া নদী আঁকতে দিয়েছে সার্থক। ছোটো করে বলেছে,কেন নদী ভাসিয়ে দেয় জমি,ঘর বাড়ি,কেমন ছবি হয় সব ভেসে গেলে।
ছবি আঁকতে আঁকতে একটু হলেও মন থেকে জানুক শিশুরা।
কমলি। অবোধ চোখের সাদা বাছুর। সার্থকের গায়ের গন্ধ পেত দূর থেকে। সার্থক তখন বছর ছয়। গলা জড়িয়ে ধরত কমলির। মা বকাঝকা করত মাঝেমধ্যে।
গোয়াল ঘরের অদ্ভুত গন্ধ আছে। সার্থকের ঝিম ধরত।
উঠোনে রোদে বসে থাকত কমলি আর সার্থক। কমলির মা ঝুমলির দুধ খেত আগে কমলি,তারপর সার্থক। তারপর বেঁচে থাকা দুধ দু ঘরে বিক্রি করত মা। সেবার ভয়াবহ বৃষ্টি,বাঁধ ভাঙল রাতে। আগে থেকে সজাগ ছিল সকলে। বেঁচে গেল অনেকেই। ভেসেও গেল অনেকেই। ভেসে গেল কমলি। ভেসে গেল কমলির মা। ছোট সার্থক গলা ফাটিয়ে চীৎকার করে কেঁদেছিল একদিন। তারপর চুপ করে গিয়েছিল। গোয়ালঘর ফাঁকা সেই থেকেই। মা রান্নার জ্বালানীর কাঠকুটো রাখে। ছাগল বাঁধা থাকে। বন্যার আশঙ্কা থাকলেই ছাগল কোলে নিয়ে মা,বাবা চলে যায় ঘর ছেড়ে।
বাচ্চাদের খাতায় বন্যার ছবি। এক এক জনের এক এক রকম। আলাদা আলাদা রঙের। সার্থকের চোখে ভ্যান গখের সূর্যমুখী ফুলের ছবি ভাসে। হলুদ,উজ্জ্বল।
এইসব ছেলেমেয়ে সূর্যমুখী হোক।
টুং করে মেসেজ ঢোকার আওয়াজ হয়।
স্বাতী!
‘ভালো আছি’
নীরব হাসে সার্থক।
ছাত্র ছাত্রীদের দিকে তাকিয়ে বলে,’বাড়িতে গিয়ে সকলে ভোরের ছবি আঁকবে,কেমন?যেরকম ভোর তোমাদের মনের কল্পনায় আছে’
স্বাতীকে রিপ্লাই পাঠায়,’ভালো থাকবে,জানি’
অনন্যদের ফোন করে জানাবে,কাল সে পাথরপ্রতিমা যাচ্ছে। ওরা চাইলে যেতে পারে’
মায়ের জন্য শাড়ি এঁকে রেখেছে। শিউলি ফুল ভর্তি করে। বাবার জন্য গলা বন্ধ নীল রঙের উলি কটের গেঞ্জি। নতুন।
মায়ের,বাবার লজ্জা মাখানো হাসির ছবি দেখতে পায় সে।  মাষ্টারপিস। সে ছবি সার্থক কখনও আঁকতে পারবে না। চেষ্টা করেও।
Nila Banerjee

পুকুরঘাট

একদিন আমরা মাত্র কয়েকজন সদস্য নিয়ে পুকুরঘাট নামের একটি মেয়েদের ভার্চুয়াল দল খুলে ছিলুম। অচিরেই সে কয়েকটি সদস্যের দল কয়েক হাজার সদস্যের মেয়েদের দল হয় ওঠে। পুকুরঘাট দলের মত এত গুণী মেয়েদের সমাহার বাংলাদেশে খুব কম ভার্চুয়াল দলে আছে। কাজেই সেই দল সেখানেই আটকে থাকবে না বলা বাহুল্য। তাই পুকুরঘাট দলের অন্যতম উদ্যোগ হিসেবে প্রকাশিত হলো পুকুরঘাট পত্রিকা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

2 thoughts on “অব্যাহতি/ চার পর্বের গল্প/ পর্ব তিন

  1. শর্ট ফিল্ম হবার যোগ্য। আমার ক্যামেরা দক্ষতা থাকলে, অভিজ্ঞতা থাকলে ‘বই নয়, ছবি’ করতাম।💖

Others Episodes