ওঁদের যেমন দেখেছি- পর্ব তিন

অজন্তা সিনহা
— আমি রানীদি বলছি অজন্তা।
— জানি তো। আপনার নাম্বার সেভ করা আছে আমার কাছে।
— তাতে আর কী ! ফোন তো করো না তুমি। ভুলেই গেছ দিদিকে।
— কী যে বলেন–
— ঠিকই বলি। আচ্ছা শোন, সংস্কৃতি শ্রেয়স্করের এবারের শো-তে কিন্তু আসতেই হবে তোমায়। শুধু কভারেজ করিয়ে দায় সারলে হবে না।
— নিশ্চয়ই দিদি। এবার অবশ্যই যাব।
— চুপ। তোমার কথা জানি আমি। ঠিক আগের দিন বলবে, আটকে গেছি দিদি। এবার কিন্তু এসব শুনবো না–
ফোন কেটে যায় অপরপ্রান্তে। এক মিনিটের বিরতি। হৃদয়ঙ্গম করার চেষ্টা করি, এক্ষুনি যে মানুষটা আমাকে এমন আন্তরিক অধিকারে বকলেন, আমি কী তার সেই ভালোবাসার যোগ্য ? এই ভাবনা ক্ষনিকের। তারপরই সব ভুলে, সেই মুহূর্তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে দায়িত্ব, তার পালনে ডুবে যাই। সাংবাদিকতার পাশাপাশি বিভাগীয়, বিশেষত পাতার দায়িত্বে যাঁরা থাকেন, তাঁদের এই কথা দিয়ে কথা না রাখাটা প্রায় রুটিনে পরিণত হয়। তাঁদের সব ধ্যান ও মনযোগ আবর্তিত হয় ওই পাতাকে কেন্দ্র করে।
রানীদি মানে রানী কর্ণা। কত্থক নৃত্যের কিংবদন্তি, আন্তর্জাতিক খ্যাত এই শিল্পীর এই নিয়ে বরাবর এক তীব্র অভিমান ছিল, যে, আমি ওঁর সাক্ষাৎকার নিই, লিখি, প্রকাশ করি। ওঁর প্রতিষ্ঠিত সংস্কৃতি শ্রেয়স্করের সব অনুষ্ঠানের সমালোচনা করাই প্রতিনিধি পাঠিয়ে। কিন্তু নিজে সেই অনুষ্ঠানে যাই না। যাই না নয়, আসলে যেতে পারি না। বলা ভালো পেরে উঠিনি। প্রবল ইচ্ছে থাকলেও পারিনি। এই আক্ষেপ, দুঃখ যাবার নয়। সেই সময় ব্যস্ততা তুঙ্গে। যত দিন যাচ্ছে সংবাদ মাধ্যমে বিনোদনের গুরুত্ব বাড়ছে। আমার পাতার বিষয় ছিল বিনোদন ও সংস্কৃতি। দু’ক্ষেত্রেই তখন শহর জুড়ে বিশাল কর্মকাণ্ড। এর পাশাপাশি মুম্বই-দিল্লী ও অন্যান্য বড় শহরে যাওয়ার পর্বও চলতো। রানীদির অভিমান জেনেও কিছু করার থাকতো না।
ওঁর সংস্পর্শে যাওয়া, অযাচিতভাবে অপরিসীম স্নেহ পাওয়া–সেইসব প্রসঙ্গে যাবার আগে সংক্ষেপে রানী কর্ণার পরিচয়। দেশভাগের আগে, অখন্ড ভারতের হায়দ্রাবাদের এক শিক্ষিত ও বর্ধিষ্ণু পরিবারে ১৯৩৯ সালে রানী কর্ণার জন্ম। ১৯৪২ সালে দিল্লী চলে আসে ওঁদের পরিবার। রানীর পড়াশোনা দিল্লীতেই। স্নাতক হন উদ্ভিদবিদ্যায়। তারপর থেকে অবশ্য তাঁর জীবনপথ পুরোপুরি আবর্তিত হয় নৃত্যকে কেন্দ্র করে। অতি শৈশবের সখের চর্চা কেমন করে যেন একদিন জীবনচর্চায় পরিণত হয়। একইসঙ্গে কত্থক, মনিপুরী, ওড়িশি ও ভরতনাট্যম প্রশিক্ষণ নেওয়া শুরু মাত্র চার বছর বয়সে। পরবর্তীকালে জয়পুর ঘরানার গুরু হীরালাল ও লক্ষৌ ঘরানার পন্ডিত বিরজু মহারাজের শিষ্য হিসেবে কত্থক নৃত্যে বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত হন রানী। কত্থক নৃত্যে নিজস্ব এক স্টাইলের প্রবর্তন করেন রানী, যা শাস্ত্রসম্মত। কিন্তু নিছক শাস্ত্রীয় নয়।
বিয়ের পর ভুবনেশ্বর, তারপর স্বামীর কর্মসূত্রে কলকাতায় আসেন রানী কর্ণা। ওড়িশায় থাকাকালীন ওড়িশি নৃত্যের কিংবদন্তি শিল্পী ও প্রশিক্ষক গুরু কেলুচরণ মহাপাত্রের সংস্পর্শে আসেন রানী এবং ১৯৬৬ থেকে ১৯৮৫ তাঁর কাছে ওড়িশি নৃত্যের প্রশিক্ষণ নেন। এছাড়াও রুক্মিণী দেবী আরুন্ডুলে, নরেন্দ্র কুমার, ললিত শাস্ত্রী প্রমুখের কাছে নৃত্য শিক্ষা করেন রানী। বিভিন্ন গুরুর কাছে নৃত্যের নানা ফর্ম ও ঘরানার প্রশিক্ষণ পাওয়ার ফলে রানীর সৃজনশীল ভাবনায় ব্যাপ্তি আসে। পরে মঞ্চে তাঁর কত্থকনির্ভর এক একটি নৃত্য-আলেখ্য নির্মাণ ও পরিবেশনায় সেই সমৃদ্ধি ও বৈচিত্র্য দারুণভাবে পরিলক্ষিত হয়। বহুমুখী ও বহুমাত্রিক ছিল রানীর সৃজনশীল প্রতিভা। ভাবনার দিক থেকেও অত্যন্ত গভীর ও মুক্তচিন্তার অধিকারী ছিলেন। পৌরানিক কাহিনিকে তিনি বিন্যস্ত করতেন সমসাময়িক সামাজিক প্রেক্ষিতে। সেই হিসেবেই নৃত্যের আঙ্গিক প্রয়োগ করে আলেখ্যগুলি প্রস্তুত হতো। প্রচুর পরীক্ষানিরীক্ষা করেছেন। কত্থক নৃত্যের ওপর গবেষণা করেছেন দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এস কে সক্সেনার অধীনে।
আমি যখন রানীদির সংস্পর্শে যাই, তখনই উনি একজন জীবন্ত কিংবদন্তি। এই তথ্য জানা ছিল বলে প্রথম যে দিন সাক্ষাৎকার নিতে রানীদির দক্ষিণ কলকাতার বাড়িতে যাই, খুব জড়োসড়ো হয়ে বসেছিলাম। শাস্ত্রীয় নৃত্য সম্পর্কে যতটুকু জ্ঞান ছিল, ওঁকে প্রশ্ন করার জন্য সেটা যথেষ্ট নয়–এমন এক হীনমন্যতা বোধেও আক্রান্ত ছিলাম। কিন্তু সে বোধহয় মিনিট দশেক সময়। এত দ্রুত রানীদি আমায় আপন করে নিলেন, কে বলবে সেদিনই পরিচয় আমাদের ! খুব অবাক হয়েছিলাম ওঁর বলা মিষ্টি বাংলাভাষা শুনে। মানুষটা কী ভীষণ খোলামনের ছিলেন, তা ক্রমে ক্রমে বুঝতে পারছিলাম। যে কোনও ভাষা বা সংস্কৃতির প্রতি ওঁর শ্রদ্ধা ও আগ্রহ ছিল বিস্ময়কর। এরফলে, ওড়িয়া ও বাংলা এই দুই রাজ্যেরই ভাষা আয়ত্তে ছিল ওঁর। ছিল সাংস্কৃতিক চেতনা।
রানীদির কাছে গেলে হাতে সময় নিয়ে যেতেই হতো। কত যে গল্প করতেন ! যে আলেখ্যগুলি নিয়ে কাজ চলছে, তার সাহিত্যের দিকটা নিয়ে আলোচনা করতে ভালোবাসতেন। এ আলোচনা পুঙ্খানুপুঙ্খ শুনতে ও শুনে মতামত দিতে হতো আমাকে। লজ্জায় মরে যেতাম। আমি অতি নগন্য এক সাংবাদিক। কিন্তু উনি সেসব ধার ধারতেন না। কলকাতার বাড়িতে একাই থাকতেন ওঁর ঘরকন্নার সহযোগী মেয়েটিকে নিয়ে। আর ছিল রানীদির ছাত্রছাত্রীরা। ওরা সন্তানবৎ ঘিরে থাকতো তাঁকে। পরে যখন নিজের ছেলে একমাত্র সন্তানকে হারালেন একেবারে অসময়ে, তখন আক্ষরিক অর্থেই ছাত্রছাত্রীরা রানীদির সহায় হলো। এ ঘটনা কবেকার, আমি সঠিক জানি না। কখনও প্রশ্ন করে ওঁর যন্ত্রনা বাড়াতে চাইনি। তবে, যখনই এ কথা উঠেছে, ওঁর অতি গাঢ় ও সংযমী বেদনার প্রকাশ স্তব্ধ বিস্ময়ে দেখেছি। এও দেখতাম আরও বেশি করে নৃত্যকে আঁকড়ে ধরছেন।
দেশের বিভিন্ন শহরে তো বটেই, রানী নৃত্য পরিবেশন করেছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। উচ্চ প্রশংসিত হয়েছেন সর্বত্র। শুধু পরিবেশন নয়, দেশবিদেশে অনুষ্ঠিত কর্মশালার দায়িত্বও অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে পালন করেছেন তিনি। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত নিজের প্রতিষ্ঠিত নৃত্য প্রশিক্ষণকেন্দ্র সংস্কৃতি শ্রেয়স্করের (ভারতীয় বিদ্যভাবনের একটি বিভাগ) প্রধান পদে ছিলেন রানী। ছিলেন ক্যালকাটা স্কুল অফ মিউজিকের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রথম ডিরেক্টর। অরবিন্দ ভবনের নৃত্য বিভাগ ‘অহনা’-রও প্রতিষ্ঠাতা তিনি। যুক্ত ছিলেন ১৯৮০-৮৭। পেয়েছেন বহু পুরস্কার। যার মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য সঙ্গীত নাটক একাডেমি ও পদ্মশ্রী পুরস্কার। পেয়েছেন উপ রাষ্ট্রপতি প্রদত্ত সোনার মেডেল, অর্ডার অফ দ্য কুইন অফ লাওস, সঙ্গীত বরিধি, বিজয়রত্ন ও অন্যান্য নানা পুরস্কার ও স্বীকৃতি। ২০১৩ সাল পর্যন্ত মঞ্চে নৃত্য পরিবেশন করেন, রানীর বয়স তখন ৭৪।
বয়স যে একটা সংখ্যা মাত্র, সেটা রানীদির দিকে তাকালেই বুঝতে পারতাম। ঋজু, সতেজ একটা মানুষ। আমি গেলেই বলতেন, “মোটা হয়ে যাচ্ছ অজন্তা। এক্সারসাইজ শুরু করো এখনই।” আমি ‘নিশ্চয়ই দিদি’ বলা মাত্রই–”আবার মিথ্যে কথা ? জানি তুমি এসব করবে না। মুখ গুঁজে লিখেই যাবে শুধু।” বলেই আমার পিঠে স্নেহের হাতটা রাখতেন। সুন্দর করে চা বানিয়ে খাওয়া ও খাওয়ানো ওঁর অন্যতম সখ ছিল। রানীদির বাড়িতেই আমি প্রথম লিকার চা খাই। সে যে কী অসাধারণ একটা ব্যাপার ! ঠিক কতক্ষণ ভিজলে চা নিখুঁত স্বাদের হবে, তাই নিয়েও বলতেন তিনি। চায়ের সঙ্গে বিস্কুট নয়, কুকিজ। নানা ধরনের কুকিজ থাকতো ওঁর স্টকে। সব বিষয়ে পারফেকশনিস্ট রানীদির বাড়িঘর থেকে নিজের সাজপোশাক–দেখার মতো ছিল। তেমনই ছিলেন ব্যক্তিত্বময়ী ও স্পষ্টবাদী। কলকাতা ছাড়ার পর আর সেভাবে যোগাযোগ ছিল না। ২০১৮-র ৭মে চলে যান রানীদি। আগাগোড়া আমার অনুভবে তিনি ছিলেন রানীর মতোই ঐশ্বর্যময়ী এক মানুষ, যাকে কোনোদিন ভুলবো না।
অজন্তা সিনহা
খুব ভালো লাগলো তোমার লেখা, এতো কিছু জানা ছিলো না সত্যি
খুব ভাল লাগছে এমন বিখ্যাত ব্যক্তিত্বদের সম্পর্কে জানতে। আগামীর অপেক্ষায়।