ওঁদের যেমন দেখেছি -পর্ব ৫
অজন্তা সিনহা
এটা সেই সময়ের, যখন প্রায় পাঁচ বছর গানের সঙ্গে সম্পূর্ণ সম্পর্কহীন কাটানোর পর একটু একটু করে ফিরছি গানের কাছে। বলা যায় নিজের কাছেই ফিরছি। ঠিক এই সময়েই কোনও এক সূত্রে স্বাতীদির শরৎ বসু রোড-পদ্মপুকুরের বাড়িতে প্রথম যাই। স্বাতী বসু। রবীন্দ্রসংগীত চর্চার ক্ষেত্রে এক শ্রদ্ধেয় নাম। মনে আছে সে এক কাঠফাটা রোদ্দুরমাখা দিন। অফিসের কাজের ফাঁকে এক বন্ধুর সূত্রে গেছিলাম ওঁর বাড়িতে। প্রাচীন প্যাটার্নের দালান। সামনে বারান্দা। মোটা মোটা দেওয়াল। যার ফলে, ঘরের ভেতরটা সবসময় খুব ঠান্ডা থাকতো। স্বাতীদি প্রথম দর্শনেই আপন করে নিয়েছিলেন। তারপর যত দিন গেছে, তত ওঁর ভালোবাসার অমলধারায় সিক্ত হয়েছি। প্রসঙ্গত, এইসব অযাচিত প্রাপ্তির জন্যই আমার একা থাকার লড়াইটা কখনও কঠিনতর হয়ে উঠতে পারেনি।
স্বাতীদির বাড়িতে যাওয়ার উদ্দেশ্য ছিল ওঁদের গানের দল ‘ধৈবত’-এর সদস্য হওয়া। রবীন্দ্রসংগীত চর্চার ক্ষেত্রে ধৈবত সেইসময় বেশ সমীহ আদায় করে নিয়েছে। সদস্যরা প্রায় প্রত্যেকেই হয় দক্ষিণীর প্রাক্তনী বা সেখানে প্রশিক্ষণরত। বাকিরাও প্রথাগতভাবে সংগীতে সুশিক্ষিত। আমি আগে শ্রদ্ধেয় পূর্বা দাম বা প্রসাদ সেনের কাছে শিখলেও মাঝে বহুদিন চর্চার বাইরে। মনে পড়ছে, প্রথম দিন গানের প্রসঙ্গে সামান্য কথাবার্তার পরেই আমরা ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় চলে গিয়েছিলাম। আমার একা থাকার সিদ্ধান্ত, পরিবারের সমর্থন না পাওয়া, মেয়েকে তার বাবার কাছে রেখে আসার যন্ত্রনা–উজার করে দিয়েছিলাম নিজের একান্ত কথার ডালি।
স্বাতীদি কী নরম এক ভঙ্গিতে সব শুনেছিলেন! নির্জন দুপুর। শান্ত-সুন্দর পরিবেশ আকীর্ণ এক ছায়াঘেরা ঘর। তার মাঝখানে সদ্য পরিচিত দুটি মানুষ। একজন তার যন্ত্রণার কাব্য শোনাচ্ছে। অন্যজন শুনছে। সেই যে আমাদের হৃদয় এক তারে বাঁধা হলো, আর ছিঁড়লো না। স্বাতীদি চলে গেছেন অনেকদিন। যতদিন বেঁচে ছিলেন, যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হইনি আমরা। সাংবাদিকতা পেশায় ব্যস্ততা বাড়ায় ধৈবত ছেড়ে দিতে হলো। কিন্তু স্বাতীদি আমায় ছাড়েননি। নিয়মিত খবর নিতেন, যতদিন পর্যন্ত না নিজে খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন।
স্বাতীদি আর ধৈবতকে ঘিরে আমার স্মৃতির পুরোটাই বড় মধুর। প্রথম দিকে আমার যতটুকু দ্বিধা বা সংকোচ ছিল, সেটা স্বাতীদি তো বটেই, বাকিরাও আন্তরিক ব্যবহারে দূর করে দেয়। এর ফলে আমার গানে ফিরে আসার ব্যাপারটা ক্রমে সহজ ও স্বাভাবিক হয়। মনে পড়ছে, ওঁদের সঙ্গে বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছিলাম তখন। প্রচুর রিহার্সাল হতো ধৈবতের অনুষ্ঠানের। আক্ষরিক অর্থেই পারফেকশনিস্ট ছিল ধৈবত। বলা বাহুল্য, এটা আমার গানের ক্ষেত্রেও খুব ইতিবাচক একটা প্রভাব ফেললো।
এই প্রেক্ষিতে স্বাতীদির ভূমিকাটা একটু আলাদাভাবে বলতে হয়। নিজে অত্যন্ত ভালো গাইতেন। সাংগীতিক দক্ষতার সঙ্গে একটা অসাধারণ গায়কী–প্রত্যেকটি গান ছবির মতো সুন্দর হয়ে উঠতো স্বাতীদির কণ্ঠে। বেশিরভাগ সময়ই স্ক্রিপ্টের সবচেয়ে কঠিন গানটা বরাদ্দ থাকতো স্বাতীদির জন্য। প্রতিটি রিহার্সালে মুগ্ধ হয়ে ওঁর গান শুনতাম। শুধু শোনা নয়, স্বাতীদির কাছে শিখেছিও প্রচুর। রিহার্সালের মধ্যেই ছোট ছোট জিনিস দেখিয়ে দিতেন। একটা শব্দ শুধু ডেলিভারির গুণেই কেমন অন্যরকম হয়ে যায়, অযাচিতভাবে স্বাতীদি শিখিয়ে দিতেন সেটা। আর ভালোবাসা, মায়া, মমতা–এসব তো স্বাতীদির হৃদয় উপচে পড়তো। শুধু আমি নই, চারপাশের সব মানুষই স্বাতীদির স্নেহ, প্রীতির ঝর্ণাধারায় স্নাত হয়েছেন।
অফিস থেকেই রিহার্সালে যেতাম। সে এক কঠিন সময়। নিজেকে কাজের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা করার তীব্র লড়াই। পায়ের তলার জমিটা যথেষ্ট নড়বড়ে। সংবাদপত্রে কাজ করার অভিজ্ঞতা একেবারেই নেই। বেতন এমন পাই না যে চাইলেই বাইরে থেকে কিছু কিনে খাব। তখন আমাদের অফিস ক্যান্টিনও ছিল না। খিদে পেত পাগলের মতো। চা খেতাম ঘন ঘন সেটা চাপা দেবার জন্য। শুধু ধৈবতের রিহার্সালের দিনটা অন্যরকম ছিল। স্বাতীদির বাড়িতে গেলেই সোজা আমাকে টেনে রান্নাঘরে নিয়ে যেতেন। সেখানে ভাত বেড়ে খেতে দিতেন যত্ন করে। কোনও বারণ শুনতেন না। অথচ, আমি কোনও দিনই এই নিয়ে কিছু বলিনি। স্বাতীদি আমার মুখ দেখেই বুঝে যেতেন।
আজ এই লেখা লিখতে লিখতে সেই ফর্সা, গোলগাল, সদা হাস্যময়ী মানুষটাকে দেখতে পাচ্ছি স্পষ্ট। তাঁতের শাড়ি, কপালে একটা বড় টিপ–এই ছিল স্বাতীদির সিগনেচার সাজ। অপূর্ব এক ব্যক্তিত্ব। খুব কোমল স্বরে কথা বলতেন। কিন্তু সবাইকে শুনতে হতো সেকথা। আমি তো একেবারে মনেপ্রাণে নতজানু থাকতাম। একটা প্রায় বাপে তাড়ানো, মায়ে খেদানো মানুষ, স্বামী-সন্তান ছেড়ে চলে এসেছে। আপনজনরা প্রায় ক্রিমিনাল হিসেবে দেগে দিয়েছে। সেই মানুষটার কী এত স্নেহ-মমতা প্রাপ্য ?
সংবেদনশীল স্বাতীদি আমাকে সেই বিশ্বাস ফিরিয়ে দিয়েছিলেন, যে বিশ্বাসের জমিতে দাঁড়িয়ে আবার স্বপ্ন দেখা যায়। মাথা উঁচু করে আকাশ ছোঁয়া যায়। যেদিন জানলাম, ওঁর দুরারোগ্য ব্যাধির কথা, ভিতরটা ছোট শিশুর মতো কেঁদে উঠেছিল। মনে হয়েছিল, স্বাতীদি কেন এই কষ্ট পাবেন ? এই জিজ্ঞাসা আজও রয়েছে অন্তরে, যার কোনও উত্তর নেই। স্বাতীদির কাছে যতখানি ঋণী, ততটা কোনও লেখায় অভিব্যক্ত করা অসম্ভব। মনে মনে, একটাই বলা, যদি আর একটা জন্ম পাই, তোমাকে এই অধমের জীবনে আবার চাইবো। তোমার মতো মানুষকে বড় দরকার স্বাতীদি।
★★ স্বাতীদির ছবিটি তাঁর সংগ্রহ থেকে দিয়ে আমাকে কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করেছেন ধৈবতের অন্যতম সদস্য ও প্রিয়বন্ধু সৌমেন্দ্র নাথ বসু।
অজন্তা সিনহা