পাতা খসার খেলা
বুবুন চট্টোপাধ্যায়
ঘরে-বাইরে বলতে প্রথমেই বিমলার কথা মনে এল। বিমলার ছিল ঘরবন্দী জীবন। মেয়েদের অন্দরমহলে উঠোন চর্চায় তাঁর দিন যেত ।একজন মহিলা হয়ে জীবন থেকে এর বেশি তাঁর চাওয়ার ছিল না। চায়ওনি। তখনকার বড় ঘরের মেয়েদের স্বামীর যত্ন-আত্তি ছাড়া খুব বেশি কিছু চাওয়ারও ছিল না। দু’বেলা দুমুঠো ভাত-কাপড়ের ব্যবস্থা থাকলেই তারা খুশি। জীবনটাকে অযথা জটিল করেননি। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তো যে সে লেখক নন। শুধু বাড়ির বউ-ঝিয়ের গোল, গোল ভাত-কাপড়ের গল্প লেখার জন্য তিনি আসেননি। তাই “ঘরে -বাইরে “উপন্যাসে তিনি নিখিলাশ মানে বিমলার স্বামীকে উদাত্ত করে দিলেন। একালের আধুনিক, শিক্ষিত স্বামীর মতো তাঁর ভেতরেও স্ত্রী শুধু সহমর্মি নয় সহকর্মীও বটে এইরকম মার্ক্সবাদী বীজ বপন করে দিলেন। নিখিলেশের বন্ধু সন্দীপ এসে সেই ঘি তে কেমন আগুন ঢাললো সে তো সকলেরই জানা। সংসার,স্ত্রী নিখিলেশের মন,ভুবন একাকার হয়ে পুড়ে গেল।
আমার প্রশ্ন অন্য। রবীন্দ্রনাথ এতে কী প্রমাণ করতে চাইলেন? মেয়েদের আবার দেশোদ্ধারের কি দরকার? ঘর-সংসারই তো ভাল। শুধুমুধু পুরুষদের কর্মযজ্ঞে গিয়ে কপাল পোড়ানো? তাহলে তো এতো মহিয়সী নারীর এতো আত্মবলিদান মিথ্যা হয়ে যায়। মান্যতা পায় না। না। রবীন্দ্রনাথ বলতে চেয়েছেন এরকমও ঘটে। কিন্তু একটা -দুটো ঘটনার জন্য কি মেয়েদের ঘরে বসে থাকলে চলে? না কি সময় সেই দাবী গ্রাহ্য করে ? বিশেষ করে আজকের সময়। কোনো সময়ই দাবী করেনি। সেই অরণ্য যুগেও মেয়েরা শিকারে বেরিয়েছে। মাতৃতান্ত্রিক সমাজের হোতা হয়ে সমাজ চালিয়েছেন। সিংহাসনে বসে সফল রাজ্যপাট চালিয়েছেন লক্ষ্মী বাঈ। এইসব ইতিহাস গল্প হলেও সত্যি ।অল্প হলেও সত্যি। রবীন্দ্রনাথ সেই অর্থে নারীবাদী ছিলেন না। নারীকে এগিয়ে দিলেও সময়ের মান্যতা অনুযায়ী তাঁকে সংযমী রাখতেন। তাই এখানে বিমলার স্বামী সন্দীপ তাঁকে বুঝিয়েছে প্রথমত নিখিলেশ চান বলে দেশ মাতৃকা তাঁকে চায়। এছাড়া প্রাথমিক ভাবে আর অন্য কোনো অনুঘটক বিমলাকে দেশের জন্য উদ্বুদ্ধ করেনি। সেই পুরুষের চাওয়া। সমাজ গঠনের আদি কাল থেকে নরমে-গরমে এই খেলা চলছে। আজও চলছে। ইওরোপেও। সেই ভিক্টোরিয়ান যুগ থেকে। ভিক্টোরিয়ান যুগে ইওরোপেও ছিল আমাদের মতো একান্নবর্তী পরিবার। বৃহৎ পরিবার বেশিরভাগই মেয়েরাই সামলাতেন। পুরুষদের তো চালাকির অন্ত নেই। সংসার থেকেই ক্যাবিনেট আজও চালাকি করছে। তাই ছেলেরা ভাবল সংসার দেখার এমন একটি বিনা বেতনের কাজ মেয়ারা সাধ করে যুগের পর যুগ করছে। মেয়েদের কিছু না হোক সামাজিক ভাবে একটু গ্লোরিফাই করা উচিত। সেই থেকে মেয়েদের ক্ষুরধার ব্রিটিশরা বললেন, “হোম গডেস। “ আমাদের দিশী পুরুষরা “ ঘরের লক্ষ্মী “ বলে সেই তকমা লুফে নিল। বোকা মেয়েরা গদগদ। চালাকরা গন্ধ শুঁকলেন। কিন্তু এটুকু বুঝলেন ঘরে বসে শুধু সংসারের দেখভাল করলে চলবে না। কারণ বেশিরভাগের ক্ষেত্রে শুধু পুরুষদের অর্জিত রোজগারে সংসার চালানো অসম্ভব হয়ে পড়ছে। বাজারের ক্রমাগত দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সঙ্গে সংসারের চাহিদা মিলছে না। বাজারী হাঙ্গরটার হাঁ সমানে বড়ো হচ্ছে। এখানে তো ছাড়। সেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়কাল থেকে মেয়েরাই এটা হাড়ে,হাড়ে বুঝেছেন। তখন ইওরোপের একটি নির্ধারিত বয়সের পর প্রয়োজনে রাষ্ট্রের জন্য যুদ্ধে যাওয়া অবশ্যকর্তব্য ছিল। সেই সময় বেশিরভাগ বাড়ি সক্ষম পুরুষহীন।। এদিকে সংসার বয়ে নিয়ে যেতে হবে। বাইরে বেরোতেই হবে। ব্যবসায়ীরা দেখলেন কর্মক্ষম মেয়েরা প্রচুর। যাদের কাজ দরকার। কাজের বিনিময়ে পারিশ্রমিক দরকার। তাদের কথা ভেবেই ইউরোপীয় সমাজে প্রথম সূঁচিশিল্প অথবা কসমেটিকস এর মতো অ-ভারী শিল্পের বাজার তৈরি হল। এখন মেয়েরা ওদেশে চাঁদেও যায়। ট্রাকও চালায়। মেয়েরা প্রমাণ করেছেন প্রয়োজনে পেশী শক্তির কাজে তারা পুরুষদের মতোই কর্মক্ষম এবং সাবলীল। সংখ্যাটা এখন প্রতিটি কাজেরর ক্ষেত্রেই প্রায় সমান।
এদেশেও প্রয়োজনেই মেয়েদের বাইরে পা রাখা। এখন সিনেমা -শিল্প -সংবাদ মাধ্যম-রকেট সায়েন্স-হাটে-বাহারে জবদস্ত প্রতিষ্ঠিত। “হোম গডেস” তকমায় জং ধরে গেছে। “ ঘরের লক্ষী “ গ্লোরিফিকেশন ছাড়াই তাবৎ বিশ্বে নারী বুঝতে পেরেছেন ঘরটাও আমার। বাইরেটাও আমার। ওদেশে তো এখন বহু পুরূষ গৃহে সন্তানের পেরেন্টিং করেন। স্ত্রী রোজগার করেন। তাদের গায়ে “হাউস হাজবেন্ড “ র তকমা ।সেটা এতোদিনে লজ্জার না গৌরবের অন্য প্রসঙ্গ। এদেশেও অনেক লুক্কায়িত “হাউস হাজবেন্ড” আছেন। এতদিনের সংস্কার, ইগো তাদের বলতে এখনো লজ্জা দেয় বোধহয়।
এতদিন ঘুমের আগে সন্তানের গালে চুমু খাওয়াটা শুধু আমার ছিল। আজ ফ্রাইডে নাইটও আমার। কারণ এটি প্রমাণিত পুরুষ আসলে দিনশেষে সঙ্গী চায়। তখন তার কেজো চালাকির বর্মগুলো খসে যায়। তখনই কী ঋতুতে পাতা খসার খেলা শুরু হয়? ঘরে -বাইরে। হয়তো।
বুবুন চট্টোপাধ্যায়