বাংলা ক্যালেন্ডারের পাতায় ফাগুন মাস উঁকি দিচ্ছে কি দেয়নি ,হতচ্ছাড়া কোকিলগুলো সক্কাল সক্কাল গলা সাধতে বসছে। এছাড়া যতদিন না বসন্ত নিয়ে এ যুগের কবি একটা নতুন ক্যাচি লাইন লিখছেন,ততদিন ধরে ,’বসন্ত এসে গ্যাছে’র বস্তাপচা আপডেট ফেসবুকের দেওয়ালে দেওয়ালে। আজকাল কালোকুচ্ছিত কাকগুলোরও মনে কি পুলক!তারা মহানন্দে বাসা বানানোয় মন দিচ্ছে।কাক বলে কি তাদের হৃদয়ে প্রেম নেই!তারাও কাকিনী খোঁজে,জোট বাঁধে,ঘর বানায়,ভালোবাসার সন্তান একসঙ্গে প্রতিপালন করে।
এই বসন্তে আমাদের সজনীর ফোনও কেন জানি না আজকাল একটু বেশিই সচল হয়েছে। তার কণ্ঠে পোসেনজিত আর অচনা(‘র’ কে সে অ বলে)ব্যানার্জীর লাভ সঙ,”মনে মনে আগুনে, এই ভরা ফাগুনে তুমি ছাড়া দিন কাটে না”… অকারণে পুলকে তার মুখের হাসি আরো প্রসারিত।
বাপ মা’র আদরের দেওয়া সজনী নামটি তার সার্থক। দুই মেয়ের ঘরে নাতিনাতনী আছে তার তবু সখি সখি ঢলো ঢলো ভাবটি এখনো যায় নি। ভাসা ভাসা ,হাসি হাসি চোখে কাজলের মোটা প্রলেপ। কানে বড় রিঙ মুমতাজের মত টিল্টেড নাকে নকল হীরের নাকছাবি। পায়ে রুনুঝুনু নুপূর। পুরুষ্টু ঠোঁটদুটিতে হাসি গান লেগেই থাকে। ভরন্ত শরীরে আজকাল শাড়ি ছেড়ে শালওয়ার কামিজ,পালাজো,লেগিংস, কুর্তি পরছে। নানা রঙের।নানা ডিজাইনের। কিনতে হয়না। ফেলাটবাড়ির বৌদিদের দান।
পাঁচছ’ঘর লোকের বাড়ি কাজ করে মন্দ উপার্জন করে না। ন’দে জেলায় দেশের বাড়িতে জমিজমা আছে। দেশে গেলে বস্তায় করে চাল,মুড়ি,ডাল নিয়ে আসে। সকাল সকাল মেয়েদের বিয়ে দিয়ে এক্কেবারে ঝাড়া হাত পা। তার বর পুরুষটি কেষ্টঠাকুরের মত দেখতে হলেও একপত্নীব্রতধারী। ললিতা,বিশাখা চন্দ্রাবলীদের সে চেনে না। পানদোষ নেই। বৌয়ের গায়ে কোনদিন হাত তোলেনি।যেমন কাজ পায় তেমন রোজগার করে। শীতে বৌয়ের জন্যে হুডি কিনে আনে। কাজ সেরে আগে বাড়ি ফিরে আসলে বৌয়ের জন্যে ভাত রেঁধে অপেক্ষা করে। দোষ একটাই ,একটু কঞ্জুষ। সে গেরামে পাকাবাড়ি বানাতে চায়। টাকা জমাতে চায়। সজনী তার সংসারে সীমাস্বর্গের ইন্দ্রাণী। সে কেন গেরামে গিয়ে শাশুড়ির অধীনে থাকবে? নিজের সংসারে সে টিভি,ফ্রীজ,গ্যাস সবই করে নিয়েছে। গ্রামে ফেরার কোনো বাসনা নেই তার। এসব নিয়েই মাঝেমধ্যে বাদ বিসম্বাদ তাদের। সজনী আমাকে সালিশি মানে। বলে “বৌদি,আমার তেমন খরচ তো নেই। জামা কাপড় তো তোমরাই দাও। তবে আমি একটু কিরিম পাউডার মাখতে ভালোবাসি। তা কিনলে বড্ড চোপা করে তোমার ভাই। বলতো, গায়ে গতরে ওজগার করে এটুকু কিনতে পারি না আমি?”
আমি সায় দিই,
‘তাই তো,তাই তো’।
পাঁচবাড়ি কাজ করে খেলেও সে নিজের চরিত্তির বিসর্জন দেয় নি। ফ্ল্যাটবাড়ির দাদারা,বুড়ো হাবড়া কাকুরা তার ভরন্ত শরীরে কুনজর দিলে সে ঠিক বুঝতে পেরে নিজেকে গুটিয়ে নেয়। কুপ্রস্তাব দিলে, সোজাসুজি মালকিনকে গিয়ে বলে,”বৌদি আমি তোমার বাড়ি কাজ করবনি কো,দাদা খারাপ কথা বলে। আজ আমাকে বলে জড়াতে নেগেছিল।” তারপর কাজ ছেড়ে দেয়। না তার সরল মিষ্টি স্বভাবে কোনো দোষ খুঁজে পাই নি আমি।
কিন্তু কি যে আজকাল মোহনবাঁশির মত ফোন ঘনঘন বেজে ওঠে তার! এত ফোন তো আগে আসত না। ফোনের ওপারের মানুষটিকে তো দেখতে পাই না। কিছুএকতরফা মধুর শব্দ কানে আসে। আড়িপাতা অন্যায় জেনেও কান খাড়া হয় আমার।
___’আমাকে ভালোবাসো না বলো?’
___’আমি তোমার সঙ্গে কথা বলব না, যাও।’
___’তোমাকে ঐ নীল গেঞ্জিটায় দারুণ নাগছিল সেদিন।’
___’এই শোনো না,তোমার জন্যে টিপিনে করে এট্টুস মাংস এনেছি। তুমি ঐ শিবতলার মোড়ের কাছে এসো দিকিনি”
___’তুমি আমার কথা আজকাল একটুও শোন না দুষ্টু।’
পঁচিশ বছরের পুরনো বরটির প্রতি এত প্রেম তো তার আগে দেখিনি। ব্যাপারটা কি? খতিয়ে দেখতেই হচ্ছে।
একদিন সাহস করে জেরা করতেই সলাজ হাসি।
___’কি গো সজনী ,কি চলছে আজকাল?’
সজনীর মুখ আনন্দে উদ্ভাসিত।
___’বর জানে ,এসব কথা?’
___’না জানে না।’
___’জানলে ,কি করবে?’
___’ম্যানেজ করে নেব।’
___’কতদিন চলবে এসব?’
___’যতদিন ভালো লাগে’
___’তারপর’?
___’অত ভাবি না বৌদি’
আমি আর কথা বাড়ালাম না। ভালোবাসার অধিকার সবার আছে। সে পরকীয়া হোক বা না হোক। সুপ্রীম কোর্টের ছাড়পত্র তো হালের কথা।
তবে সজনীর স্মার্টনেস দেখে চমৎকৃত হলাম। নিরক্ষর পাঁচবাড়ি কাজকরা মেয়েটি ভালোবাসার শক্তিতে হঠাৎই সাহসী হয়ে পরপুরুষ এবং বরপুরুষকে ব্যালেন্স করে দিব্যি চলতে শিখে গেছে। পঞ্চশরের শক্তি,ভালোবাসার মহিমা বুঝি এমনই…।
মনে হয়, জায়গাটা ছিল, ব্যারাকপুরের গান্ধী ঘাট। কুলুকুলু শব্দে বয়ে যাচ্ছে গঙ্গা। দুয়েকটা নৌকা পাল তুলে ভেসে চলেছে আপন মনে। ঝাউ, এরিকা পামের সারি ,কেয়ারী করা ঘাসফুলের বাগান। বর্ষাকাল, গাছে গাছে চিকন সতেজ সবুজ রং ধরেছে। কামিনী ফুলের গন্ধ, বাতাস মাতোয়ারা। সেদিন সকাল থেকেই ঝুপ ঝুপ করে বৃষ্টি। দিনটা বোধহয় রবিবার। রোজকার আপের বদলে উল্টোদিকের ট্রেনে গান্ধীঘাট।
গান্ধীঘাট যাবো বললে রিক্সাওয়ালাদের মুখে বেশ একটা রসিক ফিচেল হাসি ফুটে উঠছে।ছোট ছোট রিক্সা।তুমি চাইলেও ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে বসতে পারবে না।আর বসতে মাথার দিব্বিই বা কে দিয়েছে।তাঁর পুরুষ্ট ঠ্যাং এর উপর নিজের ম্যানিকিওর করা হাতখানি রেখে চলেছি, গুণগুণিয়ে। আজ্ঞে মনে মনে। নয়তো রিক্সাওয়ালা আবার উল্টোদিকে ফিরে ফিরে, রিক্সা উল্টে যাতা কান্ড করবে না? মাঝেমাঝে আঙুল দিয়ে তাঁর থাইয়ে কিড়িমিড়ি আঁকছি। সে বুঝি শিরশিরিয়ে উঠলো। লোমশ ধাবড়া হাত দিয়ে আমার নরম মাখনের মত হাতখানাকে খপ করে চেপে ধরলো। উফ্! তাতেও কি আহ্লাদ গো! রিক্সাভাড়া আঠেরো টাকা। একটু বেশীই। সে নিচ্ছে নিক গে যাক। সবাই ঐ গদগদ মোমেন্টে জায়গামত পৌঁছতে পারলে বাঁচে! তা নয়তো দুটাকা খুচরোর জন্য রিক্সাওয়ালার পিছনে ছুটবে নাকি! টিকিট কাউন্টারে একটা বুড়ো বসে, ভামের মত জুলজুল করে চেয়ে আছে। টিকিট দিতে দিতে ঐ যেটুকু আন্দাজ করা যায় আরকি!
“কুড়ি নাকি পঞ্চাশ?
“তফাত কি?”সে প্রশ্ন করলো।
“কুড়ি হলে ঝোপে বসবেন।পঞ্চাশ হলে পাঁচিলের আড়ালে। খড় লাগলে বলবেন! এস্ট্রা একশ টাকা।”
জুলজুল চেয়ে চেয়েই চাটতে লাগল!
“কু… কুড়িই দিন।”
“অ” বিরস মুখে দুটো সাদা টিকিট ঠুঁসে দিলেন হাতে।
বুঝলেন, এগুলো ঝোপের ও অযোগ্য! আরে পীরিত করবে পয়সা ফেলবে না?
হাতে হাতে ধরে রডোডেনড্রনের পাশ দিয়ে যেতে যেতে বেশ একটা সুপার রোমান্টিক মুড! কালো মেঘের ছায়া পড়েছে গঙ্গার জলে।
দুপাশে সাজানো গোছানো ঝোপ।মাঝেমাঝে নোটগুলো নড়াচড়া করছে। আমিও উশখুশ কচ্ছি! আজ্ঞে নতুন নতুন যা হয় আরকি!
সামনেই একটা নধর ঝোপ দেখে ইয়ে একেবারে লকলক করে উঠলো। এই বুঝি বসি বসি !
যাঃ তারা ! দেখি ল্যাম্প পোষ্টের গায়ে একটা ক্যাঙগারু ছাপ সিমেন্টের বেদী তাতেই ঢিপ করে বসলাম। পাশেই একজোড়া দাদু দিদা ফোকলা দাঁতে ফরফর করে প্রেম কচ্ছে!
বসেই সে বললো, “ঐ দ্যাখো, কেমন নদী বয়ে যায়!
কেমন ঢেউ এর পরে ঢেউ!
কি ফাইন নৌকা! এসব নৌকায় দারুণ মাছ ধরে।
নৌকায় বেশ তেল কষা কষা করে ইলিশমাছ ভাত কাঁচা লঙ্কা দিয়ে খায়!”
ধ্যাত্তেরি নিকুচি করেচে ইলিশ মাছ আর কাঁচালঙ্কা!
“চলো ঝোপে ঢুকি!”
“এই নাঃ! আমার লজ্জা করে। ঐ দ্যাখো। ওমা! ও যে বিপ্লব! এ কাকে নিয়ে এসেছে বিপ্লব? এতো হারাধনদার বৌদি ! কি খলিফা ছেলে !
বৌদিকে গীতবিতান পড়ে পড়ে কি শোনাচ্ছে?”
“তুমি ঝোপে ঢুকবে নাকি আমি বাড়ি যাবো?”
যেন ঝোপে না ঝাঁপ দিলে এ জীবন বৃথা!
অগত্যা দুই মক্কেল কাঁচুমাচু বোগেনভেলিয়ার ঝোপে। ফুরফুরে হাওয়া,ঝিরঝিরে বৃষ্টি! সামনে অমিতাভ বচ্চন নিজে শ্রীদেবী ইয়ে মানে ঐ আরকি, মনে মনে।
“পিঠটা একটু চুলকে দাও না, উঁহু, একটু বাঁদিকে, না,না একটু ওপরে, আর একটু নিচে। ঠিক ঠিক। একটু জোরে। আহ্!! অত জোরে নয়।”
পরপুরুষ গ্রীষ্মের আগুন গরমে
“তুমি আসবে বলেছিলে,তোমার জন্য আমপোড়া সরবত রেখেছি, বেলফুলে জল ছিটিয়ে রাখলাম। ভীষণ গরমে কতক্ষন তাজা থাকবে জানিনা, তবে অপেক্ষায় রইলাম।”
বরপুরুষ বর্ষার সন্ধেবেলায়
“এতো পুরো আবগারী ওয়েদার, পকোড়া,টকোড়া কিছু ভাজবে নাকি? এই ভেজফেজ নয়, একটু ঝালঝাল করে চিকেন কাবাব কর। ভেটকির ফিলে রাখা আছে না ফ্রিজে? ”
পরপুরুষ বর্ষার সন্ধেবেলায়
“তুমি এলে আজকে কোথা থেকে কবিতা পড়া শুরু করব বলতো, রবিঠাকুর নাকি বিদ্যাপতি। আমি নয় শুধু, তুমিও পড়বে কিন্তু। কিছু একটা এনে খেয়ে নেবো, ভেবোনা। শুধু বৃষ্টির শব্দ শুনবো আর কবিতা পড়বো।”
বরপুরুষ শীতের সকালে
“দেখো, আজকে বাজার থেকে কী এনেছি!!তুমি
ভালোবাসো, তাই শীতের কই, জব্বর করে একটা তেলকই বানাও। আর দিশি টমেটোর একটা চাটনী, খেজুর দিয়ে।আর এই ব্যাগটাতে কী আছে বলতো? পিটুনিয়ার চারা। জানি, তুমি কত খুশি হবে,কী ভাবো, তোমার মনের কথা জানিনা?অ্যাই টিভিটা চালাও একটু, ইন্ডিয়া কত করল দেখি ”
পরপুরুষ শীতের সকালে
“তুমি কাছে নেই, তাই সব সকালই আমার কাছে শীতের সকালের মত কুয়াসায় ঢাকা। আজকে আর আলাদা করে কী বলবো। শুধু বলতে পারি আমরা কাছাকাছি থাকলে, আজ কিন্তু সারাদিন গল্প করতাম,রোদ্দুরে পিঠ দিয়ে বসে বা লেপের আরামে।”
এ কথা মৈত্রেয়ী দাশগুপ্তের। রবীন্দ্রনাথের স্নেহধন্যা এই কন্যার প্রথম কবিতার বই “উদিতা” প্রকাশিত হয়েছিল মাত্র ষোল বছর বয়সে। আরও অনেক গুণের অধিকারী বিদুষী এই মেয়েটির দেখা হল মির্চা এলিয়াদের সাথে। ১৯২৮ সালে মৈত্রেয়ীর পিতা, কেমব্রিজের প্রাক্তনী, দার্শনিক সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তের কাছে গবেষণা করতে এসেছিলেন রোমানিয়ান যুবক মির্চা। বিদেশি গবেষকের বাসস্থান হল অধ্যাপক দাশগুপ্তের বাড়ি। পঞ্চশরে বিদ্ধ হলেন মৈত্রেয়ী-মির্চা। একে অপরের পাণ্ডিত্যে ঋদ্ধ হলেন, মুগ্ধ হলেন। সঙ্গোপনে লালিত এই সম্পর্ক যখন দিনের আলোয় এল, মৈত্রেয়ীর বাবা মেনে নিলেননা। মৈত্রেয়ীকে গৃহে অন্তরীণ করে রাখা হল আর মির্চা পেলেন গুরুগৃহ থেকে পত্রপাঠ বিদায়ের পরোয়ানা। ইংরেজি সন তখন ১৯৩০, মৈত্রেয়ী ষোল আর মির্চা তেইশ। পি. এইচ. ডি. সমাপনান্তে ১৯৩৩ সালে দেশে ফিরে কালি কলমে অপূর্ণ প্রেম কাহিনীকে রূপ দিলেন মির্চা , মাতৃভাষায় লিখলেন “লা ন্যুই বেঙ্গলি” যার অপর নাম “মৈত্রেয়ী”। রাতারাতি মৈত্রেয়ী হয়ে গেলেন রূপকথার নায়িকা।
মৈত্রেয়ী ততদিনে পারিবারিক চাপের কাছে নতি স্বীকার করে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন কুইনোলজিস্ট ডক্টর মনোমোহন সেনের সাথে। সংসার পেতেছেন হিমালয়ের কোলে মংপুতে। জীবন এগিয়ে যাচ্ছে তাঁদের মেয়ে মধুশ্রীকে নিয়ে। জানছেন জীবন সঙ্গী তথা আজীবনের বন্ধু হিসাবে একেবারেই মন্দ নন ডক্টর সেন। সেই বাসর রাত থেকে অতন্দ্র প্রহরীর মত আগলে রেখেছেন স্ত্রীকে। মৈত্রেয়ীর জীবনে অনেক অনেক বছর পেরিয়ে ১৯৭২ সালে আবার এল মির্চার অনুষঙ্গ। পড়লেন মির্চার লেখা সেই বিশ্ববিখ্যাত বইয়ের ফরাসি অনুবাদ। সময়ের সমুদ্র পেরিয়ে যে জীবন হারিয়ে গিয়েছিল তা আবার ফিরে এল মননে। ১৯৭৪ এ লিখলেন হৃদয় তোলপাড় করা গাথা – “ন হন্যতে ” – “লা ন্যুই বেঙ্গলি”র কাউন্টার পার্ট। পেলেন সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার(১৯৭৬)। আমরা পাঠকরা পেলাম এক কালজয়ী কথাসাহিত্য। মানুষের জীবন মন্থন করে যে লেখা যায় এমন অমর প্রেম গাথা – “ন হন্যতে ” না থাকলে জানা যেতনা। “ন হন্যতে” তে লিখলেন -“পর পুরুষের সনে বাঁধা পড়ে রবে নাম মৃত্যুর মিলনে।” মনে হয় জীবনে যে কোথাও নেই মরণের পর তার সাথেই নাম একত্রে উচ্চারিত হবে, এই চিন্তা তাঁকে কিছুটা হলেও পীড়া দিয়েছিল। তাইতো তিনি জীবন সায়াহ্নে কলম ধরলেন মির্চার লেখায় কোনও অসংগতি বা অতিরঞ্জন থাকলে তা শুদ্ধ করে দেবেন বলে। তিনি গল্পের রূপকে বলছেন মনোমোহন সেনের সহধর্মিণী হিসাবে তাঁর জীবন নষ্ট হয়নি, তবে মির্চা তাঁর স্বামী হলে তার জীবন অন্য রকম হত মাত্র।
বাস্তব জীবনে মৈত্রেয়ী-মির্চার আবার দেখা হয়েছিল শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৭৩ সালে। জীবন তখন পেরিয়ে গেছে তেতাল্লিশ বছর। মৈত্রেয়ী দেবী এই বিশ্ববিদ্যালয়ে রবীন্দ্রনাথের ওপর বক্তৃতা দেওয়ার আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন এবং মির্চা সেই শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়েরই অধ্যাপক ছিলেন। ততদিনে তিনি হয়েছেন বিদগ্ধ পণ্ডিত, ঐতিহাসিক, দার্শনিক, ধর্মতত্ত্ববিদ। বলার অপেক্ষা রাখেনা, মৈত্রেয়ী দেবীর সঙ্গে ছিলেন ডক্টর মনোমোহন সেন। মির্চার লেখায় মৈত্রেয়ীকে নিয়ে অনেক কল্পনার বর্ণনা আছে যা সর্বৈব মিথ্যা তাই মৈত্রেয়ী অনুরোধ করেছিলেন মির্চাকে যাতে তাঁর জীবদ্দশায় ইংরেজি ভাষায় অনুদিত না হয় ” লা ন্যুই বেঙ্গলি।” কথা রেখেছিলেন রোমানিয়ার ভদ্রলোকটি। ১৯৮৯ সালে মৈত্রেয়ী দেবীর মৃত্যুর পাঁচ বছর পর শিকাগো ইউনিভার্সিটি প্রেস ১৯৯৪ সালে দুটি উপন্যাসের অখণ্ড ইংরেজি সংস্করণ প্রকাশ করে। প্রসঙ্গত বলি মির্চা মারা যান ১৯৮৬ সালে। এই দুই উপন্যাস নিয়ে বহুল চর্চা হয়েছে, ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় রূপালি পর্দায় অভিনীত হয়েছে তাঁদের কথা। উপন্যাস দুটি একাধিক ভাষায় অনুদিত হয়েছে।
জীবনে প্রিয়তম মির্চার সাথে আর কখনও দেখা হবেনা এই সত্য মেনে নিতে কিশোরী মৈত্রেয়ীর প্রভূত বেদনা হয়েছিল। ১৯৩০ সালে এ নিয়ে বিপুল সমালোচনা হয়েছিল, কেচ্ছা রটেছিল। লেখিকার অন্যান্য বিবাহের সম্বন্ধও ভেঙে যায়। এই চরম শোকের সময় তিনি অতিক্রম করেছিলেন কবিগুরুর সান্নিধ্যে শান্তিনিকেতনে। পরবর্তীতে রবীন্দ্রনাথ তাদের মংপুর বাড়িতেও আতিথ্য গ্রহণ করেছিলেন। আজীবনের ক্ষততে প্রলেপ যুগিয়েছে রবীন্দ্র গান, রবীন্দ্র কবিতা। দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুত্রবধূ হেমলতা ঠাকুর মৈত্রেয়ী দেবীর “মংপুতে রবীন্দ্রনাথ ” বইটি পাঠান্তে তাঁর প্রতিক্রিয়া স্বরূপ একটি কবিতা লিখে দিয়েছিলেন যা কবিগুরু ও মৈত্রেয়ী দেবীর সম্পর্ককে এক অন্য মাত্রা দেয় –
“…মংপুতে রবীন্দ্রনাথ অমর সাহিত্য
বুদ্ধ-সুজাতা যেন খৃষ্ট-ম্যাগডলিন,
রবীন্দ্র-মৈত্রেয়ী নাম যুক্ত চিরদিন।”
একটি প্রশ্ন মনে জাগে, এত উদারচিত্ত বরপুরুষ না পেলে কী মৈত্রেয়ী দেবী পরপুরুষকে নিয়ে এমন নিবিড় উপন্যাস লিখতে পারতেন?
আরেকটা প্রশ্নও আছে। পুরুষ টা ধরুন ঘরের নয় (মানে বর নয়), আবার পরের ও নয়, তাহলেও কি পরপুরুষ? বড্ড ঝামেলার ব্যাপার। আচ্ছা বর বাদে সব পর। বুঝলাম। পরনারী, বারনারী? আচ্ছা সেসব থাক।
পরপুরুষের আকর্ষণে র বৃত্তান্ত নিয়ে কত কালজয়ী সাহিত্য! কত সিনেমা! ঘরে বাইরের বিমলা কে, কে ভুলতে পারে? বা নষ্টনীড় এর চারুলতা? চোখের বালি র বিনোদিনী? অপূর্ণ বিবাহিত জীবন বা অন্যতর সম্পর্কের তীব্র আকর্ষণ, নারী হৃদয়ের জটিল সমীকরনের অসাধারণ উন্মোচন এই চরিত্র গুলো তে। তবুও, পরকীয়া র শাস্তি ই যেন জুটেছে এদের কপালে, সমাজের রীতি অনুসরণ করে।
শেষ পর্যন্ত শেষের কবিতায় এসে একটা উত্তরণের দেখা পাই, যেখানে বিবাহের বাইরেও একটা মুক্ত সম্পর্ক লালন করার কথা বলা হয়েছে।
এসবও থাক।
আবুল বাশারের একটা লেখায় পেলাম এই লোককবিতা।
ঘর চিকন হয় লেপনে পুছনে
চাষা চিকন ধানে।
পরপুরুষে নারী চিকন হয়
নদী চিকন হয় বানে।
এইটাই শোনাব বলে এত ভণিতা।
পরপুরুষের প্রতি
(বা, বরপুরুষ কে, যে আরেকজনের পরপুরুষ, বড্ড গোলমেলে ব্যাপার, যাই বল না কেন)
বিকেলের আকাশ তখন ধীরে ধীরে ঢলে পড়ছে সন্ধ্যার গায়ে। নীল গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয়ে উঠছে। শেষ আলোর রেশ মেখে মসৃন গতিবেগে হুন্দাই এলান্ট্রা গাড়িটা এসে থামলো প্রিন্সেপ ঘাটের সামনে। গাড়ির পিছনের সিট থেকে নেমে দাঁড়ালো কথাকলি। মিসেস কথাকলি দত্ত। নেমেই চোখ রাখলেন আষার আকাশে, এই সময়টা তাঁর একেবারে নিজস্ব। আকাশ যেন এ সময়ে তাঁর একেবারে একান্ত হয়ে ওঠে। সারাদিনের ক্লান্তি সমস্যা কষ্ট সব সব কিছু ভাগ করে নেয় এই আকাশ। এই আধঘন্টা সময় তাঁর কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। অন্যমনস্ক ভাবে ভাবতে ভাবতে কথাকলি গিয়ে বসলেন গঙ্গার ধারের বাঁধানো বেদিতে। গঙ্গার ঠান্ডা হাওয়ায় তাঁর অবসন্নভাবটা আস্তে আস্তে কেটে যাচ্ছে। দলাপাকানো চিন্তার জট ধীরে ধীরে কেটে যাচ্ছে। সৌখিন রুপোর কেস থেকে ডানহিলের সিগারেটটি বের করে ধরালেন মধ্য চল্লিশের কথাকলি। তাঁর ম্যানিকিওর করা বাঁ হাতে ধরে থাকা রুপোর কেসটির দিকে তাকিয়ে রইলেন অপলকে। মনে পড়ে গেলো বেশ কিছু বছর আগের কথা!
তখন তিনি নতুন পা রেখেছেন কর্পোরেট ওয়ার্ল্ড-এ ;এ পৃথিবীটার হাল হকীকত তখন সম্পূর্ণ অচেনা!
অতীন। হ্যাঁ অতীন তাঁকে উপহার দিয়েছিলো এই কেসটি।
আজ ঘন নীল রঙের মটকা শাড়িতে ম্যাচিং মুক্তোর সেট এ কথাকলির পরিণত ব্যক্তিত্ব মার্জিত সাজগোজ সামঞ্জস্যপূর্ণ রূপ যেন ছড়িয়ে যাচ্ছিলো আরো অনেকটা। তাতে সঠিক সঙ্গত করছিলো তাঁর তীক্ষ্ণধার বুদ্ধি আর সুকণ্ঠ উপস্হাপন ; পার্কসার্কাস এর চেম্বার এ ডক্টর সামন্তর সাথে মিটিং সেরে এই সময় টুকু এখানে কাটিয়ে ফিরতে হবে উত্তম আশা ল্যাবরেটরি তে।
কথা বলার ফাঁকে ডক্টর সামন্তর মুগ্ধ দৃষ্টি চোখ এড়ায়নি কথাকলির। অসাধারণ সুন্দরী সে কোনকালই ছিলো না। কিন্তু ছিলো সুশ্রী, সুরূপা।
জীবনের প্রয়োজন তাঁকে শিখয়েছে অনেক কিছু,ধীরে ধীরে এই সৌন্দর্য্য তাঁকে অর্জন করতে হয়েছে, প্রতিযোগিতায় পেছনে ফেলতে হয়েছে অনেককে। তাঁর অনেক সুন্দরী স্কুল ফ্রেন্ডসরা যখন এই বয়সে পৌঁছে ধেবড়ে গেছে সেখানে কথাকলি নিজেকে তৈরী করেছে সবদিক থেকে। নিজেকে আকর্ষণীয়া করে তুলেছে পুরুষের চোখে এক ছেলে ও এক মেয়ের মা কথাকলি। তাঁর মনে পরে যায় খুব সখ করে বাবা নাম রেখেছিলো কথাকলি ;মিষ্টি দেখতে কথাকলি খুব ভালো নাচতো। শিখত শাস্ত্রীয় নৃত্য। বেশ চলছিল কিন্তু নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে হঠাৎ নেমে এলো বিপর্যয় বাবার অকাল মৃত্যুতে, সেবার কথাকলির উচ্চমাধ্যমিকের বছর। বাবা চলে গেলেন জানুয়ারি মাসে। আরো দুটি ভাই বোন ভাড়া বাড়ি মা সাধারণ গৃহবধূ। কথাকলি পড়লো অথই জলে। সে বছর কোন ভাবে পরীক্ষা শেষ করলো কথাকলি, মার্জিনাল সেকেন্ড ডিভিশন। আর পড়াশোনার দিকে ফিরে তাকানো হয়নি কথার। এরপর শুধুই জীবন যুদ্ধ, আর টিকে থাকা।
অনেক ঘাট ঘুরে শেষ পর্যন্ত এক দুঃসম্পর্কের দাদারা বদন্যতায় তাঁর চাকরি এই উত্তম আশা ল্যাবরেটরিতে।
প্রয়োজন জিনিসটা এমনি যে মানুষকে সহজেই শিখিয়ে দেয় অনেক কিছু, কথা খুব তাড়াতাড়ি এগোচ্ছিলো। সে বুঝেছিলো বইতে সে যা পড়েছে, মা বাবা তাঁকে যা শিখিয়েছে তার থেকে অনেক সত্যি এই জীবন। এর থেকে সে প্রতিদিন শিখেছে। আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয় নি।
ধীরে ধীরে ভাই বোনের এডুকেশন চাকরি মায়ের জন্য ফ্ল্যাট সব করেছে সে দায়িত্ব নিয়ে।
এরপর মনীশ এর সাথে ভালোবাসার বিয়ে। দুটি ছেলে মেয়ে। কথা প্রফেশনাল জগতে যত উন্নতি করতে থাকে, মনীশ যেন ততো গা ছেড়ে দিতে থাকে। রোজগারের জায়গাটা একেবারে খাম হয়ে যায় মনীশের। এখানেও নিজের কাঁধে তুলে নেয় সব দায়িত্ব। ছেলে মেয়েকে ভালো স্কুলে পড়ানো, নিজেদের জন্য পস এরিয়ায় দারুণ তিন কামরার এপার্টমেন্ট ; কিন্তু সংসারে আর সময় দিতে পারে না। এদিকে উত্তম – আশা ল্যাবরেটরির অ্যাডমিন হেড হয় কথা। সব সময় চলে যায় চাকরিতেই। এ নিয়ে মনীশ এর সাথে মনোমালিন্য স্থায়ী রূপ নেয়।
কথা জানে সে যেখানে পৌঁছেছে সেখান থেকে আর ফেরা সম্ভব নয়। কোনোভাবেই এই সুখ এই সংসার স্বচ্ছলতা তাঁকে বজায় রাখতে হবে।
সে দিনের কথা আজ খুব মনে পড়ছে তাঁর সেই প্রথম পা হড়কানোর দিন বা প্রথম সম্মতিদানের দিন। খুব সন্তর্পনে তাঁকে পাঠানো হয়েছিলো মাইথন এর রিসোর্টে। অতীনের সাথে সে খানেই আলাপ। দুটো দিন কাটানোর পরে অতীন তাঁকে উপহার দিয়েছিলো ওই রুপোর সিগারেট বক্স।
এ সব নিয়ে আর ভাবে না কথা, সব যেন সয়ে গেছে।
সাকসেসফুল তাঁকে হতেই হবে। ব্যাগের ভিতর থেকে মোবাইল বেজে ওঠে। কথা ধরে ফোনটা। এখুনি ফিরতে হবে তাঁকে ল্যাবরেটরিতে। জরুরি ফোন কল ; গাড়িতে গিয়ে বসে কথা, ধীরে ধীরে পিছনে পরে থাকে ঘাট গঙ্গা আবছা হয়ে আসে স্মৃতি। কথা ফেরে বর্তমানে।
একদিন আমরা মাত্র কয়েকজন সদস্য নিয়ে পুকুরঘাট নামের একটি মেয়েদের ভার্চুয়াল দল খুলে ছিলুম। অচিরেই সে কয়েকটি সদস্যের দল কয়েক হাজার সদস্যের মেয়েদের দল হয় ওঠে। পুকুরঘাট দলের মত এত গুণী মেয়েদের সমাহার বাংলাদেশে খুব কম ভার্চুয়াল দলে আছে। কাজেই সেই দল সেখানেই আটকে থাকবে না বলা বাহুল্য। তাই পুকুরঘাট দলের অন্যতম উদ্যোগ হিসেবে প্রকাশিত হলো পুকুরঘাট পত্রিকা।
সব লেখাগুলোই রসসিক্ত ও খুব সুন্দর